সর্দি কন্যা পর্ব – ০৫

0
750

#সর্দি কন্যা
#রোকসানা রাহমান
#পর্ব (৫)

উষ্মা বালতি নিয়ে আমার কাছে ছুটে এলো। খাটের কাছে রেখে বলল,
” এখন করুন। ”

আমার বালতি দেখেই বমি ভাব কেটে গেল। উষ্মার আশপাশে ব্যাঙের খোঁজ চালিয়ে বললাম,
” এটা তোমার রুম? ”

সে উত্তর দেওয়ার বদলে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” জানতেন না? ”
” না। ”
” দেখেও বুঝেননি? ”

আমি চুপ হয়ে গেলাম। বোকা চোখে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। সে আমার পাশে বসল নিঃসংকোচে। বলল,
” কোথায় থাকছেন একবার দেখে নিবেন না? আপনি এত বোকা? আন্টি তো বলেছিল, আপনি খুব বুদ্ধিমান। আপনি আবারও আন্টিকে মিথ্যে প্রমাণ করলেন। ”

এই প্রথম উষ্মার কথায় রাগ হওয়ার বদলে লজ্জা পেলাম। লুকিয়ে পুরো রুমে চোখ বুলালাম। মধ্য আকারের রুমটিতে একজনের খাট, তার পাশেই কাঠের পড়ার টেবিল। বই-খাতা বেশ গুছানো। টেবিলের উল্টোদিকে ছোট্ট আলনা। ভাঁজে ভাঁজে মেয়েদের কাপড় গুছানো।
” আমি খুব গুছানো, তাই না? ”

আমার চোখের দৃষ্টি উষ্মার মুখে ফিরে আসল। সে উৎসুকে চেয়ে আছে। আমি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললাম,
” না। ”

উষ্মার চোখের চাহনি বদলে গেল। মুখের ভাব বদলে গেল। বসা থেকে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিতেই আমি বললাম,
” আমি আবারও আম্মুকে মিথ্যে প্রমাণ করেছি, এটাই বলবে তো? ”

উষ্মা অবাক হলো। বিস্ময় খেলে গেল চোখের তারায়। আমি বিছানা থেকে নামতে নামতে বললাম,
” আম্মু হয়তো মিথ্যেকেই সত্যি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। ”
” মানে? ”

আমি উত্তরে সামান্য হাসলাম। উষ্মার ভাঁজ করে রাখা কাপড় থেকে একটা জামা হাতে নিয়ে বললাম,
” এটা তো খুব সুন্দর। এক পিসই নাকি? ”
” না। থ্রি-পিস। ”
” অন্য দুটো কোথায়? ”
” ওখানেই আছে। ”

আমি আলনার দিকে একটুখানি চেয়ে থেকে বললাম,
” দেখতে পাচ্ছি না। তুমি খুঁজে দেও তো। ”

উষ্মা আমার কাছে এগিয়ে এলো। যেখান থেকে জামাটা নিয়েছিলাম সেখানে অন্য অংশগুলো খুঁজছে, পাচ্ছে না। ঐ সারি রেখে, উপরে, নিচে এমনকি পেছনেও খোঁজা বাকি রাখল না। একসময় বিরক্ত হয়ে বলল,
” পাচ্ছি না। মনে হয়, আম্মুদের রুমে। ”
” না। এ রুমেই। ”

উষ্মা রেগে গেল। মুখ শক্ত করে বলল,
” আমার থেকে আপনি বেশি জানেন? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে দেখান। ”

আমি সোজা হেঁটে গেলাম টেবিলের কাছে। সাজিয়ে রাখা বইয়ের পেছনে হাত দিতেই ওড়না পেয়ে গেলাম। উষ্মার মুখের সামনে ধরে বললাম,
” অন্য অংশটা মনে হয় খাটের নিচে। ”

উষ্মার মুখ হাঁ হয়ে গেল। যেন আমি অসম্ভব কিছু করে ফেলেছি। আমি হাসলাম। ভীষণ তৃপ্তিমাখা হাসি। যেন কত বছর পর এমন আনন্দ পেয়েছি। উষ্মা লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেলল। আমি বললাম,
” যতটা অগোছাল হলে একটা মেয়ে তার জামা-কাপড়ের খোঁজ রাখতে পারে না, তুমি ঠিক ততটাই অগোছাল। ”

উষ্মার নতমাথা আরও ঝুঁকে গেল। আমি মায়া ভুলে বললাম,
” তুমি শুধু অগোছালই না, কাণ্ডজ্ঞানহীন। নাহলে এভাবে ভেজা কাপড়ে মেঝে ডুবাতে না। বিছানাটাও ভিজিয়ে ফেলেছ। মাঝরাতে ব্যাঙের সাথে লাফাচ্ছ। সর্দি লাগিয়ে বৃষ্টিতে নেচে-গেয়ে বেড়াচ্ছ। জ্বরে পুড়ে মরবে নাকি? ”

উষ্মা মাথা নিচু অবস্থায় বলল,
” বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর আসে না। শুধু সর্দি হয়। ”
” সর্দিও একটা রোগ। শরীরের ভোগান্তি। আর তুমি তো শুধু নিজেকে না আমাকেও…”

আমি কথাটা শেষ করলাম না৷ মুখ কুঁচকে ফেললাম। উষ্মার থেকে দূরে সরে বললাম,
” মানছি, আম্মু চাচ্ছে আমি তোমাকে বিয়ে করি। কিন্তু তুমি তো চাও না, তাহলে এসবের মানে কী, উষ্মা? কেন বারবার আমার পছন্দ সাজার চেষ্টা করছ? শুধুই কি আম্মুকে খুশি করতে নাকি অন্য কিছু? ”

উষ্মা উত্তর দিল না। নীরব দাঁড়িয়ে রইল। আমি অপেক্ষা করেও যখন উত্তর পেলাম না। তখন বললাম,
” আম্মু যেহেতু এখনও বিয়ের কথাটি তুলতে পারেনি আর পারবেও না। আমি সেই সুযোগ দেব না। ভোরের আলো ফুটতেই আমি বেরিয়ে পড়ব। যদিও কাউকে বলার ইচ্ছে ছিল না। তবুও তোমাকে বললাম, যাতে আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা না হয়। আম্মুর ঘুম ভাঙলে তুমি বলে দিও। ”

উষ্মা হ্যাঁ-না কিছু বলল না। আগের মতোই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তার কম্পিত শরীরটাতে চোখ রেখে বললাম,
” যাও, কাপড় পাল্টে নেও। ”

উষ্মা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। আমি দরজায় খিল টেনে বিছানায় এগোলাম। বালিশে মাথা রাখার আগে জানালাটা বন্ধ করতে প্রস্তুত হলাম। পাল্লাদুটো এক করতে সেই লাফানোর শব্দ, গানের গলা, গানের মাঝে খিলখিল হাসির শব্দ। আমা পাল্লা ছেড়ে বাঁশঝাড়ে দৃষ্টি রাখলাম। বিশ্ব মাপের বিস্ময় নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম,
” তুমি আবার ভিজছ? ”

উষ্মা দূর থেকেই দ্বিগুন স্বরে চিৎকার করে বলল,
” আমার বৃষ্টি ভালো লাগে, রাতের বৃষ্টি আরও বেশি। ভিজলে মনে হয়, আমি উষ্মা নই, অন্য কেউ। অন্য ভুবনের বাসিন্দা। ”

__________
আমার সে রাত কাটল একদমই নির্ঘুমে। চোখ বুঝে শুধু অন্য ভুবনের বাসিন্দার গান শুনলাম, লাফানোর ঝুপঝাপ শব্দ শুনলাম, ক্ষণে ক্ষণে বাতাস কাঁপানো হাসি শুনলাম।

ভোরের আলো ফুটল। পাখির কিচিরমিচির শব্দে চোখ মেললাম। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাসি মুখে দরজা খুলেই উষ্মার দর্শন পেলাম। কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের শাড়ি এখনও শরীরে জড়ানো। ভেজা নাকি শুকনো বুঝা যাচ্ছে না। কিন্তু টুপটুপ করে পানি পড়ছে না। আমি এড়িয়ে যেতে চেয়েও পারলাম না। প্রশ্ন করলাম,
” সারারাত ভিজেছ? ”

উষ্মা মাথা উপরনিচ করে হ্যাঁ বুঝাল। আমি আবার বললাম,
” ঘুমাওনি? ”

তার বোধহয় এ প্রশ্নটা পছন্দ হলো না। নত মাথা সোজা করে বলল,
” আমি পানি ছুঁলেই সর্দি হয়। তাই আম্মু বৃষ্টিতে ভিজতে দেয় না, পুকুরে নামতে দেয় না। ”
” আচ্ছা৷ ”
” ছোটবেলা একবার খেলতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম, তাই আম্মু দূরে কোথাও একা যেতে দেয় না। ”
” আচ্ছা। ”
” আমাদের এখানে ষোল-সতেরো বয়সী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়, আমার বয়স একুশ। ”
” আচ্ছা। ”
” আমি প্রথমবারের মতো যেদিন পাত্রপক্ষের সামনে বসেছিলাম সেদিন আপনার আম্মু হুট করেই চলে আসে। একঝাঁক মেহমানের সামনে আমার মাকে খুব বকে। এত অল্প বয়সে বিয়ে দিতে মানা করে। পরবর্তীতে জানায়, আমাকে তার খুব পছন্দ। আঠারো হলেই আপনার বউ করে নিয়ে যাবে। ”
” আচ্ছা। ”
” কিন্তু আঠারো, উনিশ পার হয়ে যখন বিশে পড়লাম তখন পাড়া-প্রতিবেশিরা নানান কথা বলে বেড়ায়। আমার মা খুব চিন্তায় পড়ে যায়। তখন আন্টি সান্ত্বনা দেয়, খুব শীঘ্রই আপনাকে নিয়ে আসবে। ”
” আচ্ছা। ”
” কিন্তু আমার এই মুহূর্তে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই, তাই আপনার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। ”
” আমারও নেই। ”

উষ্মা আমার দিকে তাকাল। করুণ চাহনি! আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। দরজা ছেড়ে বাইরে বের হয়ে আসলাম। উঠোনের দিকে চলতে চলতে বললাম,
” আমি মোবাইল রেখে যাচ্ছি, আম্মুর কাছে দিয়ে দিও। ”

আমি উঠোনের মাঝপথেও আসতে পারলাম না। তার আগেই একজোড়া কোমল হাত আমার পা জড়িয়ে ধরল। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল,
” আপনি যাবেন না। প্লিজ, যাবেন না। ”

আমি বিপদে পড়ে গেলাম। উষ্মার হাত সরাতে চাইলাম। নিজেকে উদ্ধার করার প্রচেষ্টা চালাতে চালাতে বললাম,
” আরে, কী করছ? পা ছাড়। কেউ দেখবে। সবাই জেগে যাবে। ”
” যাক। দেখুক। তবুও যেতে দেব না। ”
” কী আশ্চর্য! যেতে দেবে না কেন? এখানে থেকে কী করব? তুমি চাচ্ছোটা কী? ”
” আমি চাই বিয়েটা হোক। ”

আমি উষ্মার হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে ফেললাম। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উগ্র গলায় বললাম,
” তুমি তো বিয়ে করতে চাও না, আমিও চাই না। তাহলে বিয়েটা কেন হবে? কেন? ”
” আমার জন্য। ”

আমি হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লাম। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে উষ্মাকে দূরে সরিয়ে বললাম,
” তুমি কি পাগল? কথার কোনো ঠিক নেই। একেক সময় একেকটা বলছ। মাথায় সমস্যা আছে নাকি? তোমার তো চিকিৎসার প্রয়োজন। ”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে