সর্দি কন্যা পর্ব – ১০ (অন্তিম পর্ব)

0
1883

#সর্দি কন্যা
#রোকসানা রাহমান
#অন্তিম পর্ব

রাতে আমার ঘুম হলো না। অস্থির চিত্তে এপাশ-ওপাশ করে অর্ধেক রাত কাটিয়ে দিলাম। বাকি সময়টা আর বিছানায় শুয়ে থাকার ধৈর্য, ইচ্ছে, রুচি কোনোটাই হলো না। ফোন হাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সারাদিন বৃষ্টি ঝরিয়ে আকাশ এখন মেঘমুক্ত। চাঁদ উঠেছে, তারাও। তাদের আলোয় রাতের অন্ধকার গাঢ় থেকে ঝাপসায় পরিণত হয়েছে। সে ঝাপসা অন্ধকারে মন উদাস হতেই কলিংবেলের শব্দ শুনলাম। আমি চমকে উচ্চারণ করলাম, ‘ উষ্মা! ‘

আমি চাইলাম না তবুও পা দুটো বারান্দা ত্যাগ করল। রুমের দরজা মেলে বসার রুমের দিকে এগিয়ে গেল। পা দুটো অবাধ্য হতে দেরি করে ফেলেছে। বসার রুমে উষ্মা নেই। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ হচ্ছে। আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম। মাকে বললাম,
” ঘুমাওনি? ”

মা ভাতের প্লেটের উপর আরেকটি প্লেট উল্টে রাখলেন। পানি ভর্তি গ্লাস তুলে বললেন,
” না, উষ্মার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ”

আমি নিশ্চিত হলাম এই ভেবে যে, উষ্মা সত্যিই এসেছে, আমার ভ্রম নয়। মা ব্যস্ত চালে চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ঘাড় বাঁকিয়ে বললেন,
” তুই এখনো জেগে আছিস! কোনো সমস্যা? ”

আমি মাথা দুপাশে মৃদু নেড়ে বললাম,
” তেমন কিছু না। ঘুম আসছে না। ”
” মাথা যন্ত্রণা নাকি? চা করে দেব? ”
” তুমি যাও, আমি বানিয়ে নেব। ”
” পারবি তো? ”
” হ্যাঁ, পারব। ”

মা চলে গেলে আমি চুলায় আগুন ধরালাম। চায়ের জন্য পানি দিলাম। চা-পাতির খোঁজ করলে মা বললেন,
” দাঁড়া আমি দিচ্ছি। ”

আমি খানিকটা চমকালাম। মা গরম পানিতে চা-পাতি দিতে দিতে বললেন,
” এত করে সাধলাম মেয়েটা খেলই না। বলে কী না পেট ভরা! ”

মা প্লেট থেকে ভাত আর তরকারি আলাদা করছিলেন। আমি ছোট্ট করে বললাম,
” ওহ! ”

মা আমার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
” এখানে খাবি নাকি রুমে যাবি? ”
” রুমে যাব। ”
” তাহলে যা, আমি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ব। ”

আমি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বসার রুমে আসলাম। নিজের রুমের দিকে পা বাড়িয়ে থেমে গেলাম। মায়ের কথা মনে পড়ল। বলেছিলেন, উষ্মা কয়েক ঘণ্টা থেকে চলে যাবে। যদি সত্যিই চলে যায়? সকালে দেখা না হয়? সরি বলার জন্য হলেও একবার দেখা করা জরুরি। আমি উষ্মার রুমের দিকে এগুলাম। ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি কে জানে! দ্বিধা মনে তার দরজার সামনে দাঁড়াতেই দেখলাম উষ্মা পড়ছে। আমি কিছু না ভেবেই রুমের ভেতর ঢুকে গেলাম। বললাম,
” জার্নি করে এসে এখনও পড়ছ? এত রাত জাগলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। একটু ঘুমিয়ে নেও। ”

উষ্মা এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যেন ভূত দেখেছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
” কারও রুমে ঢুকলে অনুমতি নিতে হয়, আপনি জানেন না? আপনার দেখি মিনিমাম ভদ্রতাটুকু নেই। ”

আমি লজ্জা পেলাম, বিব্রত হলাম। কী বলব খুঁজে পেলাম না। ইতস্ততায় দৃষ্টি নামিয়ে নিলে সে বলল,
” বাইরে যান। ”

আমি চোখ তুলে তাকালে সে বলল,
” অনুমতি নিয়ে তারপর ঢুকবেন৷ কিছু শিক্ষা হাতে-কলমে নিতে হয়। ”

আমি কথা বাড়ালাম না। তার অপমান গায়ে মাখলাম না। ধীর পায়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইলাম,
” আসতে পারি? ”

উষ্মা উত্তর দিল না। দরজার কাছে হেঁটে এলো। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” না, এখন আমি ঘুমাব। ”

কথাটা বলেই শব্দ করে দরজা আটকে দিল। সেই শব্দে আমার অন্তর কেঁপে উঠল। নীরব মন ফিসফিসে বলল, ‘ বদলে যাচ্ছে, সব বদলে যাচ্ছে! ‘ আমার মনের ফিসফিসানিকে পাত্তা দিলাম না। হয়তো এই পাত্তা না দেওয়াটাই আমার ভুল হয়ে গেল!

ভোরের দিকে ঘুমানোর ফলে ঘুম ভাঙল অনেক বেলা করে। আধো ঘুমে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দশটা পার হয়েছে। আমি তড়িৎগতিতে বিছানা ছাড়লাম, হাত-মুখ ধুয়ে সতেজ হলাম। শার্ট-প্যান্ট পরে সাহেব সেজে খাবার টেবিলে বসে অনুযোগ রাখলাম,
” আমাকে ডাক দিলে না কেন, আম্মু? অফিসের জন্য দেরি হয়ে গেছে। বসের কড়া নজরে পড়তে হবে। ”

আম্মুর মধ্যে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না। নাস্তা দিতে দিতে ধীরেসুস্থে বললেন,
” উষ্মাকে এগিয়ে দিয়ে ফিরে আসতে দেরি হয়ো গেছে। তুই তো সবসময় নিজেই উঠিস, তাই ডেকে দেওয়ার কথা মাথায় আসেনি। ”

আমি থম মেরে থেকে বললাম,
” ও চলে গেছে? ”
” হ্যাঁ। ”

____________
উষ্মার প্রথমবার চলে যাওয়ায় টানা দুই বছর অনুতাপে পুড়েছিলাম। দ্বিতীয়বার চলে যাওয়ায় কেমন একটা ব্যথার সূচনা ঘটল যেন! সন্ধ্যা হলেই সে ব্যথা তীব্র হয়। বৃষ্টি হলেই হাহাকার করে উঠে বক্ষ জমিন! মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে ছলছল দুটো চোখ মন বিষিয়ে দেয়। মস্তিষ্কে জট পাকিয়ে দেয়। চিন্তা-ভাবনা এলোমেলো করে দেয়।

অফিস থেকে ফিরে মায়ের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করার মতো অভ্যাসটাও তৈরি হলো কয়েক মাসের মধ্যে। সে অভ্যাস বছরে গড়ালেও মনে হলো কী যেন বলা হয়নি! কী যেন শোনা হয়নি!

তেমনই এক রাতে গল্প শেষ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সেসময় মা এসে বললেন,
” দরজা খোলা রাখিস। তোর বাবা আজ এ রুমে ঘুমাবে। ”

আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম,
” বাবা এ রুমে ঘুমাবে? কেন? ”
” নাজুরা আসবে তো। যদি জায়গা না হয়? শুনেছি উষ্মাকে এয়ারপোর্টে এগিয়ে দেওয়ার জন্য নাজুর দেবরও আসবে। ”

আমি চোখ কপালে তুলে বললাম,
” এয়ারপোর্ট! উষ্মা এয়ারপোর্টে গিয়ে কী করবে? ”
” প্লেনে চড়বে। ”

আমার ভ্রূ কুঁচকে আসলে মা আমার কাছে এগিয়ে আসলেন। দুঃখী মুখ করে বললেন,
” যে মেয়েটিকে অযোগ্য বলে ছুঁড়ে ফেলেছিলি সেই মেয়ে আজ তোর চেয়ে পদে বড়, সম্মানে এমনকি যোগ্যতায়। কী হারিয়েছিস বুঝতে পারছিস? ”

আমি বিস্মিত বদনে মাথা দুপাশে নাড়লাম। মা সগর্বে বললেন,
” উষ্মা দূতাবাসে পদায়নের জন্য সিলেক্ট হয়েছে। সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেবে। ”

আমার বিস্ময় সপ্তম আকাশ ছুঁয়ে ফেলল। উষ্মা তাহলে সত্যি সত্যি পররাষ্ট্র ক্যাডার হয়ে গেল! কীভাবে সম্ভব? এত অলৌকিক!

____________
উষ্মারা আসল রাত দুটো পার করে। আমি একবার নাজু আন্টির সাথে দেখা করে এলাম। কুশল বিনিময়ের সময় আড়চোখে অন্য কাউকে খুঁজছিলাম, পাইনি। এরমধ্যে বাবা ঘুমাতে আসলেন আমার রুমে। আলো নিভিয়ে আমিও তার পাশে শুয়ে পড়লাম। তিনি চোখ বন্ধ করে বললেন,
” অন্ধকারে কী দেখিস, অরু? ”

আমি রাগ করতে গিয়েও করতে পারলাম না। শান্ত স্বরে বললাম,
” কিছু না। ”
” তাহলে তাকিয়ে আছিস কেন? ঘুমা। ”

আমি বাবার কথা শুনলাম। চোখ বন্ধ করে একপাশ হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, আসল না। সজাগ কানে বাবার ভারী নিশ্বাসের শব্দ টেনে নিচ্ছে। আমি অধৈর্য হয়ে উঠে বসলাম। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আকাশ মেঘলা। মেঘ গর্জন তুলছে হঠাৎ হঠাৎ। সে গর্জনে আমার বুকের হাঁসফাঁস আরও বেড়ে গেল। কী নিয়ে এত উতলা আমার?

অনেক্ষণ হাঁটাহাঁটির ফলে পানির তৃষ্ণা পেল। পানি খেতে বারান্দায় গিয়ে দেখি উষ্মা বসে আছে। মুহূর্তেই তৃষ্ণা বেড়ে গেল। বুকের পাটাতন মরুভূমির মতো উত্তপ্ত ও খাঁ খাঁ করছে যেন!

” কেমন আছ, উষ্মা? ”

উষ্মা চমকে তাকাল। বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। অল্পক্ষণ চুপ থেকে ছোট্ট করে বলল,
” ভালো। ”

তারপরেই চলে যাওয়ার জন্য হাঁটা ধরলে আমি চটপটে বললাম,
” সেদিনলর জন্য সরি। ”

উষ্মা থামল। জিজ্ঞেস করল,
” কোন দিনের জন্য? ”
” তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম যেদিন। ”
” আমি কি আপনার কাছে থাকতে চেয়েছিলাম? চাইনি তো? তাহলে ফেরালেন কী করে? ”

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবারও বলল,
” সরি তো আমার বলা উচিত। আপনি চাননি তবুও আপনার অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি। অপমানিত করেছি, আন্টিকে কষ্ট দিয়েছি। ”
” এভাবে বলছ কেন? ”

উষ্মা বোধ হয় কথা বাড়াতে চাইল না। বলল,
” যদি সম্ভব হয়, আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। ”

সে কথা শেষ করে দিলেও আমি পারলাম না। প্রশ্ন করে বসলাম,
” তুমি সত্যি দেশ ছাড়ছ? ”

উষ্মা উত্তর দিল না। নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি আবারও বললাম,
” ওখানে ব্যাঙ আছে তো? ওরা কি তোমার পোষ্য হবে? ”

উষ্মা এবারও নীরব থাকল। আমি মৃদু গলায় বললাম,
” উষ্মা বৃষ্টি হচ্ছে, ভিজবে না? ”

উষ্মা নীরবতা ভেঙে বলল,
” না। আমি শুধু আমার গাঁয়ের বৃষ্টিতে ভিজি। ”
” ওখানেও বুঝি তোমার গ্রাম আছে? ”

উষ্মা উত্তর না দিয়ে চলে গেল। আমি বেশ কিছুক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে নিজের রুমে ফিরে এলাম। বিছানায় না গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালাম। বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দিলাম আলতো করে। শরীর শিরশির করে উঠল। কাঁপুনিতে চোখ বন্ধ করে নিতে কারও উপস্থিতি টের পেলাম। পাশে চেয়ে দেখি উষ্মা। বৃষ্টিতে মুখ ভিজিয়ে বলল,
” আপনি বৃষ্টি পছন্দ করেন না অথচ আপনার রুমেই বারান্দা! ”

আমি হেসে ফেললাম। সে হাসি বোধ হয় উষ্মার পছন্দ হলো না। কপাল কুঁচকে বলল,
” হাসছেন কেন? ”

আমি উত্তর দিলাম না। তার ভেজা মুখটিতে চেয়ে রইলাম অপলক। চোখের নিচের গাঢ় কালো ছাপ ও লাবন্যহীন গালই বলে দিচ্ছে তার নির্ঘুম রাতের সংখ্যা, অক্লান্ত শ্রমের কথা।

উষ্মা নিষ্প্রভ চাহনি সরিয়ে নিল। বিষণ্ণ গলায় বলল,
” আপনার রূঢ় ব্যবহারে আমি কষ্ট পায়নি, অবিশ্বাস করেছেন তাই কষ্ট পেয়েছি। ”

আঙুল থেকে আংটি খুলে আমাকে দিয়ে বলল,
” শুধুমাত্র কথা রাখতেই আমি রাত-দিন এক করে পড়েছি। ”

একটু চুপ থেকে আবার বলল,
” আপনার সাথে আমার আর কখনও দেখা না হোক। ভালো থাকবেন। ”

_____________
পরেরদিন উষ্মার সাথে এয়ারপোর্টে আমিও গেলাম। সে ইমিগ্রেশনের জন্য ভেতরে ঢুকতে নিলে আমি পিছু ডাকলাম,
” উষ্মা? ”

উষ্মা থামল। আমি ধীরে হেঁটে গেলাম তার কাছে। একটা হাত চেপে বললাম,
” তুমি বলেছিলে, এখনই বিয়ে না করতে। আমি কথা রেখেছি। এবার বলো, কখন বিয়ে করতে হবে। আমি তখনই বিয়ে করব। ”

উষ্মা সহজ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হাত সরিয়ে নিল। আমার পেছনে তাকিয়ে আরও একবার সবার থেকে বিদায় নিতে নিতে বলল,
” আমি সারা বছরের রোগী। দেখুন এখনও সর্দি লেগে….”

কথাটা শেষ না হতেই তার হাঁচি এলো। এক হাতে নাক চেপে কাঁধ ব্যাগে হাতালে আমি পকেট থেকে রুমাল বের করে দিয়ে বললাম,
” উহু, তুমি সারাবছরের রোগী নও। আমার মন আকাশের মেঘরাজ্যের সর্দিকন্যা! ”

উষ্মা রুমাল গ্রহণ করল না। নিজের টিস্যু প্যাকেট থেকে টিস্যু বের করে ব্যবহার করে বলল,
” আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ভালো থাকবেন। ”

আমি অবাক হয়ে দেখলাম উষ্মা ভেতরে চলে গেল। আমাকে প্রত্যাখ্যান করে হারিয়ে যাওয়ার পর আমার সেই অজানা ব্যথাটার নাম দিলাম, হৃদয়-বিয়োগ!

বাবার ডাকে যখন ফিরতি পথে বাড়ালাম তখন টুং করে একটা শব্দ হলো। মেসেজ এসেছে। আমি ফোন বের করে মেসেজটা খুলল। তাতে লেখা,

‘ আমি আপনার পছন্দ হয়ে দেখিয়েছি। এবার আপনার পালা। ভাবুন তো, আমার কেমন ছেলে পছন্দ? সময় অনেক কিন্তু সুযোগ একটাই। শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে। ‘

সমাপ্তি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে