সম্পর্ক পর্ব-০৪

0
813

#সম্পর্ক
#Tasfiya Nur
#পর্বঃ৪

কাচপুর ব্রিজে দাড়িয়ে রাতের প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত মহুয়া রাত প্রায় এগারোটা বেজে আসছে কিন্তু ঢাকার মতো ব্যস্ত শহরে এই রাত কিছুনা। পাশে দাড়িয়ে আছে রাহাত আর তিথিয়া গাড়ির ভিতর ঘুমে বিভোর।রাহাত পাশে দাড়িয়ে মহুয়ার উদাসীনতা দেখে যাচ্ছে ডিনার সেরে আটটার মাঝে মোহমানরা চলে গেলে মহুয়াকে বাসায় রেখে আসতে বলেন রাহাতের মা কিন্তু মহুয়া গাড়িতে বসে তাকে এখানে আনতে বলে এরপর থেকে চুপচাপ এক ধারে যে দাড়িয়ে আছে কোনো হেলদোল নেই বাতাসে শাড়ির আচল মাঝেমধ্যে উড়ে উঠছে চুলগুলো খোপা করা ছিলো মহুয়ার রেসপন্স নেই দেখে রাহাত খোপা খুলে দেয় তাতেও মহুয়া একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার যেই সেই হয়ে গেছে। রিতুশাকে সবার সামনে আনতে বলার পর থেকে মহুয়াকে এমন চুপচাপ দেখছে রাহাত বারকয়েক প্রশ্নও করেছিল উত্তরে নিরবতা ছাড়া কিছুই পায়নি রাহাত।রাহাতের মা রীতিমত মহুয়ার এহেন কর্মে আজ বিরক্ত হয়েছিলেন।
কি হয়েছে মহুয়া আর কত চুপ থাকবে বলোতো আমি কিন্তু এবার ধৈর্য হাড়া হয়ে যাচ্ছি, তখনও রিতুশাকে নিয়ে গেলেনা তিথিয়াকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে মাকে নিয়ে গিয়ে তার সাথে রিতুশাকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে তিথিয়াকে নিয়ে ঐ যে আমার রুমে লক করে বসে ছিলে মাথা ব্যাথার কথা বলে যে গেলেই না মেহমানদের সামনে মা এত ডাকলো তোমায় তবুও আংটিবদলের সময় গেলে না খাবার টেবিলেও আসলে না এক্সাক্টলি কি হয়েছে একটু বলবে আমায়।আমার আর ধৈর্যের পরিক্ষা নিও না আমার রাগ উঠে যাচ্ছে।
মহুয়াকে নিজের দিকে করে দুই বাহুতে হাত রেখে চেপে ধরে কথাগুলো একনাগারে বলে থামলো রাহাত।মহুয়া বাহুতে চেপে ধরার কারণে ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো জলভরা চোখে তাকালো রাহাতের দিকে।নহুয়ার তাকানোতে রাহাতের বুকের ভিতর এক অজানা লুকানো ব্যথা অনুভব হচ্ছে। রাহাতও মহুয়ার দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে বাহু থেকে নিজের হাত জোড়া ছাড়িয়ে নিলো।
আমার জীবনের কিছু অব্যক্ত কথা শুনবে রাহাত?
শীতল কণ্ঠে রাহাতকে প্রশ্ন করে মহুয়া।মহুয়ার এত শান্ত থাকা রাহাতকে যেন ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে কোনোরকম তুতলিয়ে বলে উঠলো,
বলো মহুয়া আমি সব শুনতে রাজি আছি তবু তোমার নিরবতা মানতে রাজি নই আমি।
মহুয়া রাহাতের উত্তর পেয়ে মুচকি হেসে ব্রিজের উপর হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে লাগলো,
গল্পটা তখনকার যখন আমি সদ্য ষোলো বছরে পা দেওয়া একজন ষোড়শী কন্যা।ছিমছাম পাতলা গড়নের হলুদ ফর্সার এই আমিকে বাবা মা পাড়া প্রতিবেশী সবাই খুব আদর করতো আমাদের বংশে কন্যাসন্তান কম ছিলো আল্লাহ যখন খুব বেশি খুশি হন তখন কন্যা সন্তান দেন এই কথা সবাই মানতো গ্রামের তাই কন্যা হলেও আমাদের গ্রামের মানুষ অবহেলা করতোনা। আমি মহুয়া ইসলাম মৌমিতা বাবা মোহাম্মদ মহিদুল ইসলাম বাবার নামের সাথে বড় খালা নাম দিয়েছিলো আমার মা বলতো সবসময়। গ্রামের কৃষক বাবার অতিসাধারণ একজন সন্তান ছিলাম মা শান্তনা বেগম ছিলেন গৃহিণী নিজেদের যা আবাদ ফসলের জমি ছিলো আলহামদুলিল্লাহ জীবন হাসিখুশি ভাবে চলে যেত অতি স্বাচ্ছন্দ্যে দিন না গেলেও খারাপ যায়নি কখনো আমরা দুই ভাইবোন ভাইটা বড় নাম রিহাদ ইসলাম ভাইয়া আমাদের জেলা শহরে হোস্টেলে থেকে কলেজে পড়তো আমি গ্রামের সাধারণ একটা হাইস্কুলে পড়তাম। বাবা মা ভাই পড়াশুনা নিয়ে সময়টা ভালো যাচ্ছিলো বিপত্তি বেধে যায় তখন যখন,
কথাটুকু বলে থামে মহুয়া,রাহাত আগ্রহ নিয়ে শুনছিলো মহুয়ার গল্প এর আগে মহুয়া কখনো নিজের ব্যাপারে রাহাতকে বলেনি এড়িয়ে গেছে আজ যখন নিজের ব্যাপারে বলছিলো তার মাঝে থেমে যাওয়ায় রাহাত আরও আগ্রহ সহিত জিগাসা করে তারপর কি মহুয়া?
মহুয়া একনজর রাহাতকে দেখে আবারও বলতে শুরু করে,
বিপত্তি যখন বাধে তখন আমি দশমে শ্রেণীতে পা দেই আমাদের গ্রামটা ছিলো সাদাকালো যুগের মতো কোন আধুনিকতার ছোয়া ছিলো না। আমাদের গ্রামটা জমিদার দ্বারা শাসিত ছিলো তার উন্নতির উছিলায় গ্রামের বাচ্চাদের জন্য প্রাইমারি আর হাইস্কুল করে দিয়েছিলেন অনেক আগেই কিন্তু উচ্চশিক্ষার জন্য হলেও গ্রাম ছেড়ে শহরে যেতে হতো আধুনিকতার ছোয়া কেবল লাগতে শুরু করেছিলো গ্রামে কারেন্ট আসা মেয়েদের বাড়ন্ত বয়সে সুবিধা জন্য কিশোরী পাঠাগার বাকিসব উন্নতির ধারাও শুরু হয়েছিলো কিন্তু মানুষের ধ্যান ধারণা ছিলো সেকেলে যুগের। জমিদারের তিন ছেলে ছিলো একজন বিবাহিত আর বাকি দুজন তারা শহরে থেকে পড়াশুনা করতো জমিদার সাহেব নিজেও আমাদের জেলা শহরে নিজস্ব কোম্পানি ওপেন করেন বিভিন্ন মেডিসিন আর খাবার জিনিসের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রজেক্টের। জমিদার সাহেব আর বড় ছেলে সব সামলাতেন এসব নিয়ে গ্রামে অনেক চর্চা হতো কখনও কান দিতাম না নিজের মতো এক কান দিয়ে শুনতাম অন্য কান দিয়ে বের করে দিতাম। স্কুলের বান্ধবীরা আরও বেশি লাফাতো এসব নিয়ে,আমি ইগনোর করে চলতাম অন্যের ব্যাপার নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন করতে হবে এটাই ভাবতাম আমি। দুনিয়াতে যদি আমাকে বলা হয় কি সবথেকে ভালো পারো আমি নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারবো ইগনোর করা এটা খুব ভালো পারি কারণ যারা অগ্রগতির পথে নিন্দুক হয়ে দাড়ায় তাদের ইগনোর করতে পারলে লাইফে মুভ ওন করা সম্ভব বলে আমি মনে করতাম আমার লক্ষ্য ছিলো বড় মাপের সঙ্গীতশিল্পী হওয়া কারণ আমার গানের গলা মোটামুটি ভালো ছিলো নিয়মিত প্রাক্টিসও করতাম ভাইয়ার হেল্পে ভাইয়া সব ব্যবস্থা করে দিয়ে চলে গিয়েছিলো হোস্টেলে।নিয়মিত ক্লাস আর গানের ধারণা নিয়ে জীবন ভালোয় যাচ্ছিল আমার বাবা মা গ্রামের বাকি দশটা পরিবারের মতোয় সাধারণ হলেও পড়াশুনা নিয়ে পিছপা হতেন না। দশম শ্রেণীতে নতুন তখন পুরোনো ব্যাচের বিদায় অনুষ্টান ছিলো কিছুদিন পর সেটা নিয়ে স্কুলে ক্লাস ওফ রেখে অনেক আলোচনা হতো কিভাবে কি করা যায় আমরা যেহেতু নিউ ব্যাচ সেহেতু দায়িত্ব আমাদের উপর বেশি দেওয়া হয়েছিলো আমরাও চাদা তুলে সব আয়োজন শুরু করি তাদের কি গিফট করা যায় এজন্য বাকিটা স্কুল থেকেই সব দিয়েছিলো।ক্লাসে ফাস্ট গার্ল হওয়ার দরুণ মেয়েরা প্রায় সকলে একটু মিলে থাকতো আমার সাথে সেই সুবাদে কয়েকজনকে নাচ আমি গান অনেকে কবিতা আবৃত্তি এটা সেটা নানান কিছুর আয়োজন করি যেন তাদের বিদায় দিতে সবাই যতটা বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হবে তা যেন কেটে যায় আমাদের আয়োজনে এজন্য সামান্য কিছু আয়োজন করি কারণ যত হোক তাদের স্কুলটার সাথে দশটা বছরের স্মৃতি সবার সাথে সবার ভাইবোনের মিষ্টি সম্পর্ক সব কি এক নিমিষেই ভুলা যেত। যতই হোক জীবনটা সম্পর্কের মারপ্যাচে আটকে থাকায় কিছু সম্পর্কে যন্ত্রণা কিছু সম্পর্কে সুখ সবটাই নির্ভর করে সম্পর্কের প্রতি বিশ্বাস আর যত্ন নেওয়াটা নিয়ে। দেখতে দেখতে বিদায় অনুষ্টানের দিনটাও চলে আসে। সেইবার প্রায় অনেক বড় পরিসরে বিদায় হচ্ছে বলে প্রধান অতিথি হিসেবে জমিদার সাহেবকে
নিমন্ত্রিত করা হয়।বিদায় অনুষ্ঠানের দিন তিনি এসেও ছিলেন সাথে তার শহরপড়ুয়া দুই ছেলে কলেজ অফ থাকায় নাকি বেড়াতে এসেছে তাই সাথে এনেছিলো।বিদায় অনুষ্ঠানে আমাদের সিনিয়রা সেদিন আনন্দ করতে স্কুল ড্রেস বাদ রেখে সব ছেলেরা এক ড্রেস আর মেয়েরা এক ড্রেস বানায় আর আমরা যারা নাচ গান কবিতা আবৃতি করবো তারা এক ড্রেস বানাই। কিন্তু সেদিন দুর্ভাগ্য বশত বাবা কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ে যার দরুণ কিছুটা লেট হয়ে যায় আমার স্কুল পৌছাতে শাড়ি পড়তে হয়েছিলো জীবনে প্রথম তাই মা পড়িয়ে দেয় সামলাতে কিছুটা সমস্যা হয়ে যায় শাড়ি সাথে মা হালকা সাজগোজ করিয়ে দেয় চুলগুলো খোপা করে আমার শখ ছিলো ফুল বাগানের সেখান থেকে গোলাপ এনে গুজে দেয় মা কপালে চুমু দিয়ে বলেছিলো ভালোভাবে সব সম্পন্ন করে বাসায় আসিস ।স্কুলে গিয়ে শাড়ি সামলিয়ে ভিতরে ঢুকতে গিয়ে মাথায় বারি খাই একজনের সাথে না তাকিয়ে সরি বলতে বলতে শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে চলে যাই যদি তাকাতাম দেখতে পেতাম একজোড়া চোখ অবাক হয়ে আমায় দেখছে। সব কাজ করছিলাম সিনিয়রদের জন্য গিফট বক্স গুলো গুছিয়ে নিয়ে আমরা প্রতিজনকে একজন একজন করে তুলে দেই সবার শেষে নাচ হয় আমার গান গাওয়ার পালা আসে সবাই গান শুনে করতালিও দেয়। করতালিতে মুখরিত হয়েছিলো সেদিন স্কুলের প্রতিটা কোণা। কবিতা আবৃতির পালা চলছিলো তখন একজোড়া চোখ মুগ্ধ হয়ে হয়তো আমাকে দেখছিলো কিন্তু আমি খেয়াল করিনি সেদিন।ব্যাপারটা তখন বুঝতে পারি যখন সে আমায় এসে বলে,আমার শাড়ির আচলের সেপ্টিপিন টা খুলে যায় তাই আমি নিজের আসন ছেড়ে একজন বান্ধবীকেও বলেছিলাম কিন্তু সে নিজের আসন ছেড়ে উঠতে নারাজ তাই অগত্যা নিজে একা উঠে নিজেদের ক্লাসরুমে যাই ঠিক করতে পিছু পিছু আরও একজন যে আসছিলো আমি বুঝতে পারিনি।
একনাগারে কথাগুলো বলে একটু থামে মহুয়া রাহাত এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো সব কথা।হঠাৎ মহুয়া থেমে যাওয়ায় মহুয়াকে জিগাসা করে,
কি হলো থামলে কেন মহুয়া কে এসেছিলো সেদিন বলো।
একটু পানি দিবে রাহাত বড্ড তেষ্টা পাচ্ছে। জড়ানো গলায় বলে মহুয়া।
রাহাত মহুয়ার আকুলতা বুঝতে পেরে সাইড করে রাখা গাড়ির দিকে যায় গাড়ি খুলে বুঝতে পারে শরৎ এর সময়টায় হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা কিন্তু এই জনসমাগম পূর্ণ শহরে তা বুঝা যায়না এই নির্জনতায় তা ধরা দিচ্ছে, নিজের শরীর থেকে টিশার্ট এর উপর পড়া জ্যাকেট টা খুলে তিথিয়ার শরীরে দিয়ে দেয় মেয়েটা আরামে ঘুমোচ্ছে কিন্তু শীতে একটু কেঁপে কেঁপে উঠছিলো।সবশেষে গাড়ির সামনে ডেস্কে রাখা পানির বোতলটা নিয়ে এগিয়ে যায় মহুয়ার দিকে।মহুয়ার সামনে গিয়ে বোতলটা এগিয়ে দেয় মহুয়া নিঃশব্দে বোতলটা নিয়ে পানি খায় কয়েক ঢোক তারপর আবার সেই বেখেয়ালি হয়ে তাকায় আকাশের দিকে বাতাসে চুলগুলো উড়ছে এবার হালকা শীত শীত লাগছে মধ্য রাত প্রায় হয়ে এসেছে এবার বাসায় ফেরা উচিত বলে মনে হলো মহুয়ার ফুফুকে কল করে বলে দিয়েছিলো রাহাতদের বাসায় থাকবে তাই উনি চিন্তা করবেন না।তাই রাহাতের দিকে তাকিয়ে বললো এবার বাসায় যাওয়া উচিত রাহাত।
রাহাত অসহায় চোখে তাকায় মহুয়ার দিকে তারপর থমথমে গলায় জিগাসা করে বললে না তো মানুষটা কে ছিলো?
মানুষটা তোমার বোনের হবু ভাসুর হয় সম্পর্কে আমার প্রাক্তন স্বামী মিঃ সাগর চৌধুরী।গাড়িতে এসো বাসায় যাবো।
কথাটা বলে মহুয়া হনহনিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে।
মহুয়ার উত্তরে থমকে দাড়িয়ে যায় রাহাত তার যেন হাতপা চলছেনা মনে হচ্ছে মনের উপর পাথর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে কয়েক টন পাথর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। শরীরটা এলিয়ে শুতে পারলে ভালো লাগতো মনটা ভারী হওয়ার সাথে যেন শরীরটাও ভারী লাগছে কোনোরকম পা টেনে নিয়ে যায় গাড়িতে ড্রাইভিং সীটে বসে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলে আমি বাকি কথা শুনতে চাই মহুয়া।
রাহাতের কথায় মহুয়া সীটে গা এলিয়ে দিয়ে বলে শুনবে বোর লাগবে আমার বাকি সময়ের জীবনটা ভালো ছিলোনা।
আমি তবুও শুনবো মহুয়া তুমি বলো।জোড়গলায় বলে রাহাত।
আচ্ছা ঠিক আছে শুনো তবে

চলবে?
(আসসালামু আলাইকুম, ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে