শেষ বিকেলের রোদ পর্ব-০৪

0
956

শেষ বিকেলের রোদ-৪র্থ পর্ব
©শাহরিয়ার

— নাস্তা শেষে সোহানকে সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম বাসা থেকে। একই রিক্সায় দু’জন পাশাপাশি বসেছি, আমার খোলা চুল গুলো বার বার উড়ে যেয়ে সোহানের মুখ স্পর্শ করে চলেছে। সোহান কিছু বলছে না মাঝে মাঝে হাত দিয়ে গাল থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিচ্ছে।

— সোহান এই তোর চুল বেঁধে আসতে পারিস না?

— চুল বাঁধবো কেন? এতো সুন্দর চুল বাতাসে উড়বে কারো মুখে যাবে এটাইতো নিয়ম।

— সোহান মানুষের মুখে যাবে এটা নিয়ম?

— হ্যাঁ কেন তুমি মুভিতে দেখো না, গল্পের বইয়ের ভিতর পড়নি কখনো?

— সোহান না তোর মত মুভিও দেখি না আর গল্পের বইও পড়ি না।

— গুনগুন করে কেমন আনরোমান্টিক পোলারে।

— সোহান কিছু বললি?

— দাত গুলো বের করে কি নাতো।

— সোহান সেই ভালো তুই কথা না বলে চুপ করে থাকলেই শান্তি বজায় থাকবে।

— মানে কি? এই আমি কি অশান্তি করি নাকি? তুমি এমন করে বলতে পারলে?

— সোহান এই দেখো নাকে কান্না শুরু হয়ে গেছে, আরে থাম থাম মানুষ দেখলে কি মনে করবে?

— মানুষ কি মনে করবে?

— সোহান ওরে আমার পিচ্চিটারে কিছুই বুঝে না। মানুষ এসে আমাকে গনধোলাই দিবে বুঝলি, এখন একদম চুপ করে বসে থাক।

— চুপ করে বসে আছি এমন সময় সোহান বলে উঠলো আচ্ছা ফুলটুসি তোর বান্ধবিকে কি গিফট করবি তা ঠিক করেছিস?

— নাতো মার্কেটে যেয়ে যা পছন্দ হবে তাই গিফট করবো।

— সোহান ওদের বিয়েটা কি পারিবারিক ভাবে হচ্ছে নাকি প্রেমের বিয়ে?

— বিয়েতো হচ্ছে পারিবারিক ভাবেই, তবে ওরা একে অপরকে আগে থেকেই ভালোবাসতো।

— সোহান ও আচ্ছা তাহলে ভালোই।

— হুম ভালোইতো, দু’জন কথা বলতে বলতে রিক্সা চলে আসলো শপিং সেন্টারের সামনে। দু’জনে রিক্সা থেকে নেমে ঢুকে পড়লাম শপিং সেন্টারের ভিতরে। অনেকটা সময় ঘুরাঘুরি করে দু’জনে মিলে গিফট পছন্দ করে কিনলাম।

— সোহান আচ্ছা ফুলটুসি বিয়ে বাড়িতে তুই কি পরে যাবি?

— আমি আবার কি পরে যাবো, বাসায় নতুন নতুন কত জামা আছে সেগুলো থেকে যেকোন একটা পরে যাবো।

— সোহান তুই যে মাথা মোটা আমি আগে থেকেই জানি বুঝলি ফুলটুসি। বান্ধবির বিয়েতে কেউ জামা পরে যায়? না মানে রেগুলার যেসব জামা পরিস আর কি সেগুলো পরে নাকি।

— তাহলে কি পরে যাবো?

— সোহান কি পরে যাবি মানে? শাড়ি পরে যাবি, সুন্দর করে সেঁজেগুজে শাড়ি পড়ে তারপর যাবি।

— তুমি সত্যিই পাগল হয়েছো, আমার এ জীবনে আমি কোন দিনও শাড়ি পরিনি। আর আমার কোন শাড়িও নেই।

— সোহান পরিস নি পরবি।

— কিন্তু আমার যে কোন শাড়ি নেই। আর আমাকে শাড়ি পরলে মোটেও ভালো দেখাবে না তা আমি বুঝতে পারি।

— সোহান তোকে কে বললো যে শাড়ি পরলে তোকে ভালো দেখাবে না? সব মেয়েকেই শাড়িতে খুব সুন্দর দেখায়।

— তার মানে তুমি রাস্তায় যে সকল মেয়েরা শাড়ি পরে হাঁটে তাদের দিকে চেয়ে থাকো?

— সোহান উফ তুই সব কিছু এক লাইন বেশী বুঝিস তবে কাজের জিনিসই বুঝিস না।

— কি আমি বুঝি কোনটা বুঝিনা আমি বলো?

— সোহান এই যে বিয়ে বাড়িতে কি সাঁজে যেতে হবে সেটাই বুঝিস না, বলেই হাত ধরে টান দিয়ে একটা শাড়ির দোকানের ভিতর ঢুকলো দু’জন।

— সোহান নিজে পছন্দ করে একটা আকাশি রঙের শাড়ি পছন্দ করে কিনে দিলো। সেই সাথে ম্যাচিং করে কাঁচের চুড়ি, আর একটা টিপের পাতা কিনে দিলো। শপিং করতে করতে দুপুর হয়ে গেলো। দু’জন শপিং শেষ করে বের হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো সেখানে যেয়ে দু’জনে লাঞ্চ শেষ করে রিক্সায় উঠতেই বৃষ্টি শুরু হলো।

— বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেলাম টপটপ করে পানি পরছে।

— সোহান কোথাও দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলেই মনে হয় ভালো হতো।

— কেন আমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগছে না?

— সোহান বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগবে না কেন? কিন্তু জ্বর আসলে তখন এর সাজা বুঝতে পারবি।

— কি বুঝবো না বুঝবো তা জানি না, তবে এতোটুকু বুঝি যখন তোমার সাথে আমি থাকবো না তখন তুমি বুঝবে। কি ছিলাম তোমার আমি।

— সোহান এই থাকবি না মানে কোথায় যাবি?

— কোথাও যাচ্ছি না, তবে মেয়ে মানুষ যেহেতু সারা জীবনতো আর বাবার বাড়ি থাকবো না।

— সোহান তা ঠিক বলেছিস।

— দু’জনের মাঝে আর কোন কথা হলো না, চুপচাপ দু’জন চলে আসলাম বাড়িতে। নিজের রুমে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বার বার নিজেকে দেখছি। সত্যিই আমি অনেক বড় হয়ে গিয়েছি।

— সন্ধ্যার পর ছাঁদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি বৃষ্টির শেষে ঠাণ্ডা বাতাসে পুরো শরীর হিম শীতল হয়ে যাচ্ছে, এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে যাচ্ছে মনের ভিতর। হঠাৎ করেই পেছন থেকে কারো স্পর্শে কেঁপে উঠলাম পেছনে ফিরে দেখি সোহান।

— তুমি কিছু বলবে?

— সোহান হ্যাঁ আজতো তুই আমাকে চা বানিয়ে খাওয়ালি না।

— ওহ সরি, বৃষ্টি হচ্ছিলো তাই আর রুম থেকে বের হয়নি। তুমি দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি।

— সোহাস পেছন থেকে হাত টেনে ধরে না থাক এখন যেতে হবে না। একটু পর ডিনার করবো।

— দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি আমার মনে হচ্ছে আমি সোহানকে ভালোবেসে ফেলেছি, কবে কিভাবে ভালোবেসে ফেলেছি এই মানুষটাকে তা আমার জানা নেই, হয়তো ফুলটুসি নামটাই সে আমায় ভালোবেসে দিয়েছে, এতোটা কাছাকাছি থেকেও আমি তাকে বলতে পারছি না ভালোবাসি। জানি না কোন দিনও বলতে পারবো কিনা, ও কি কখনো আমার অভিমানের ভাষা বুঝে না।

— সোহান ফুলটুসি কি ভাবছিস?

— কই কিছু নাতো,

— সোহান উহু তুইতো কিছু ভাবতাছিস আমি নিশ্চিৎ

— তুমি যদি বুঝতে আমি কি ভাবছি তাহলেতো ভালোই হতো [মনে মনে] এতো নিশ্চিৎ হলে কি করে?

— সোহান বকবক করা ফুলটুসি যেহেতু নীরব সেহেতু কিছু ভাবছে এটা ধরেই নেয়া যায়।

— নিচে চলো সবাই ডিনারে চলে আসছে এতো সময়ে নিশ্চই।

— সোহান হ্যাঁ চল।

— রাতের খাবার শেষ করে নিজের রুমে চলে আসলাম। টেবিলে চোখ রাখতেই দেখতে পেলাম নতুন দু’টো বই, বই খুলতেই বেরিয়ে আসলো চিরকুট।

“বেশী বেশী বই পড়বি আর রোমান্টিক হবি, এগুলো পড়া শেষ হলেই আমাকে বলবি আমি আবার নতুন বই কিনে দিবো ফুলটুসি”

— এই ছোট ছোট সারপ্রাইজ আমার সব চাওয়া গুলো তুমি বুঝ শুধু বুঝনা সোহান আমি তোমাকে ভালোবাসি তুমি এমন কেন? ভাবতে ভাবতে বই খুলে পড়তে শুরু করলাম।

— সকালে নাস্তার টেবিলে বড় চাচা বললো মা কখন যাবি তোরা বিয়ে বাড়িতে?

— রাস্তা কিছুটা দূরের আমরা বিকেলেই বেরিয়ে পড়বো।

— বড় চাচা আচ্ছা দেখে শুনে সাবধানে যাস।

— টুকটাক কথা বলতে বলতে নাস্তার পর্ব শেষে সকলে যার যার মত চলে গেলো।

— দুপুরের খাওয়া শেষ করেই আমি নিজের রুমে চলে আসলাম। ব্যাগ খুলে শাড়িটা হাতে নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে অনেকটা সময় বিছানায় শুয়ে রইলাম। তারপর দীর্ঘ সময় শাড়ি পরার চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়ে মাকে ডাক দিলাম। মা আমার অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে শেষ।

— এতো হেসো নাতো আমি কি কখনো শাড়ি পরছি নাকি?

— মা শোন প্রথম প্রথম শাড়ি পরতে গেলে এমন সমস্যা হবেই, কিন্তু শাড়ি পরা খুবই সহজ, এই দেখ এভাবে পরবি। বলে শাড়ি পরাতে শুরু করলো। কিছু সময়ের ভিতরেই শাড়ি পরা শেষ।হয়ে গেলো। আমি মাকে বললাম এবার তুমি বাহিরে যাও। মা চলে যেতেই আমি কাঁচের চুড়ি আর কালো একটা টিপ পরে নিলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হচ্ছি। আজ সত্যিই আমাকে অসাধারণ লাগছে। এই মুহুর্ত এই সুন্দর্য সবার আগে সোহানকে না দেখিয়ে যে আর থাকা যায় না, তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নিয়ে সোহানকে ফোন দিয়ে রুমে আসতে বললাম।

— সোহান দরজার সামনে এসে কিরে ফুলটুসি হলো তোর?

— ভিতরে ঢুকো,

— সোহান না তোর রুমে ঢুকবো না।

— চুরি করে যেহেতু ঢুকতে পারো, এখন আমি বলছি ঢুকতে পারবে।

— সোহান আস্তে করে দরজা ঠেলে ঘরের ভিতর ঢুকে অন্য দিকে তাকিয়ে বল কি বলবি?

— আমার দিকে তাকিয়ে দেখতো কেমন লাগছে?

— সোহান উহু তাকাবো না।

— তাকাও বলছি,

— সোহান অপলক তাকিয়ে রইলো মুখ থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছে না

— কিছুতো বলো,

— সোহান তোকে পরীর মত লাগছে, বলেই হাতটা কপালে লাগিয়ে টিপটা উঠিয়ে আবার লাগিয়ে দিয়ে এখন ঠিক আছে। এতো সময় এটা মাঝে ছিলো না।

— থ্যাংকিউ,

— সোহান আমিতো ভাবতাছি, বিয়ে বাড়িতে পাত্রীকে না দেখে সবাই তোকে দেখতে থাকবে।

— উফ তুমিও না কি সব বলো, চলো বের হবো দেরী হয়ে যাচ্ছে।

— সোহান হ্যাঁ চল।

— মা আর বড় চাচীর কাছে বিদায় নিয়ে দু’জনে বেরিয়ে পড়লাম।

— পাশাপাশি সিএনজিতে বসে আছি দু’জন সোহান অপলক আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমি দেখেও না দেখার মত করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছি। আমি চাই ও আমাকে দেখুক অনুভব করুক ভালোবাসুক আমাকে। সোহান বুঝবে আমাকে ভালোবাসে এখনো যে ভালোবাসি কথাটা শুনিনি সে কথাটা আমি শুনতে চাই ওর মুখ থেকে।

— হঠাৎ গালে হাতের স্পর্শে আমি কেঁপে উঠলাম।
বাস্তবতায় ফিরে এসে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলাম সোহান আমার খুব কাছে বসে আছে।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে