শেষ পর্বের শুরু পর্ব – ৩

0
612

গল্প: শেষ পর্বের শুরু (তৃতীয় পর্ব)
__ ✍️ নীলিমা নওরীন মেঘলা

‘আপনার কী মন খারাপ?’
পাশে থেকে মেয়েলি কণ্ঠের কেউ একজন কথাটা বলে উঠলো।

আমি আগের নিয়মেই চোখ বন্ধ করে মেয়েটাকে চেনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নাহ, আমার চেনাজানা কেউ মনে হলো না। চোখ খুললেই নিশ্চিত হওয়া যায় মানুষটা কে; তবে আমার চোখ খুলতে মোটেও ইচ্ছে করছে না। সাসপেন্স ক্রিয়েট করতে ভালো লাগছে।

‘হামিদ সাহেব নিশ্চয়ই আমার চোখ বন্ধের সুযোগ নিয়ে আবার উঠে পায়চারি শুরু করেছেন। মানুষটা পারেনও বটে!’
কথাগুলো আনমনে ভাবতেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।

মেয়েটা কিছু সময়ের ব্যবধানে আবার যান্ত্রিক সুরে জিজ্ঞেস করলো, ‘উত্তর দিচ্ছেন না যে? কী ভাবছেন এত?’

আমি কোনো ভূমিকা না করে সরাসরি জবাব দিলাম, ‘চোখ বন্ধ করে আপনাকে চেনার চেষ্টা করছি, তবে ঠিক চিনতে পারছি না। অবশ্য যাকে বন্ধ চোখে চেনা যায় না, তাকে খুব একটা পরিচিত কেউ বলা যায় না। আর অপরিচিত মানুষ নিয়ে আমার তেমন কোনো ইন্টারেস্ট নেই।’

আমার কথা শুনে মেয়েটা এবার শব্দ করে হাসলো। আমি আগের নিয়মেই চোখ মুদে সিটে হেলান দিয়ে বসে রইলাম।

‘আপনি ভীষণ মজার মানুষ। দারুণ কথা বলেন। তবে আমি অপরিচিত সেটা যেমন ঠিক, তেমনই অপরিচিত মানুষ সম্পর্কে আপনার কোনো ইন্টারেস্ট নেই এটা ভুল। বলা যায়, হাতির সাইজের মিথ্যা কথা।’

‘ঠিক বুঝলাম না। মিথ্যে কথা কীভাবে হলো?’

‘মিথ্যে নয়তো কী? আপনি যে এখন হামিদ সাহেবের সাথে ওনার বাড়ি যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন? ওনার মেয়ের মৃত্যু রহস্য উদঘাটন করতেই তো? ওরা কি আপনার অপরিচিত নয়? ইন্টারেস্ট না থাকলে রাজি হলেন কেন?’

মেয়েটার কথা শুনে আমি রীতিমতো অবাক হলাম। মেয়েটা এতকিছু জানলো কীভাবে? এটা তো আমি আর হামিদ সাহেবের বাইরে তৃতীয় কারো জানার কথা নয়। তাছাড়া আমি প্রফেশনাল গোয়েন্দাও নই যে সবাই আপনা-আপনি জেনে যাবে। নেহাৎ পরপর কিছু ঘটনার কারণে ইমলিকে নিয়ে কিছুটা কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে। হামিদ সাহেবের অনুরোধও ফেলতে পারিনি।

‘আবার ভাবতে বসে গেলেন তো? আমি সবকিছু কীভাবে জানলাম, সেসবই ভাবছেন?’

পুনরায় কথাটা কানে যেতেই সম্বিৎ ফিরে পেলাম। মেয়েটা কি মাইন্ড রিডিং জানে নাকি? কিছু বলার আগেই সবকিছু বুঝে যাচ্ছে। কেন জানি হুট করেই মেয়েটাকে ভীষণ পরিচিত কেউ মনে হচ্ছে। হাসিটা বড্ড চেনা। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছি না।
এই এক সমস্যা, কাজের সময় ঠিকঠাক কিছুই মনে পড়ে না।

আমার চিন্তায় ছেদ ফেলে মেয়েটা আবার বলে উঠলো, ‘আমি কিন্তু আপনাকে সাহায্য করতেই চাই।’

আমি অতশত না ভেবে বললাম, ‘কী রকম সাহায্য?’

‘কী রকম সাহায্য সেটা পরে বলছি। কিন্তু তার আগে বলুন, আপনার কী মনে হয় এটা আত্মহত্যা নাকি খুন?’

‘এখনও সঠিকভাবে কিছু বলতে পারছি না। তবে যে মেয়ে সাঁতারে এত পারদর্শী, সে কীভাবে পানিতে ডুবে মরতে পারে?’

‘ঠিক তাই।’

‘এবার বলুন কীভাবে সাহায্য করবেন আমায়?’

‘আর দুই দিন পরই অমাবস্যা। সেদিন কোনো না কোনো ক্লু নিশ্চয়ই পেয়ে যাবেন।’

মেয়েটার মুখে অমাবস্যার কথা শুনেই মনে পড়ে গেল মাস কয়েক আগের ঘটনা।
হামিদ সাহেবের সাথে পরিচয় পর্বটা তখন এতটা গাঢ় ছিল না। আমাকে অনুসরণ করেই নাকি তিনি মেসে উঠেছিলেন। তারপর প্ল্যানচেট আরও কতকিছু। প্ল্যানচেটের অভিজ্ঞতা তখনই প্রথম হয়েছিল আমার, যদিও ভালো কোনো অভিজ্ঞতা নয়।

‘প্ল্যানচেটের মাধ্যমে নাকি মৃত ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। যতসব গাঁজাখুরি গল্প…’ কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমি ঠিক তেমনই ভাবতাম।
কিন্তু সেদিনের পর থেকে জীবনে অনেক কিছুই বদলে গেল। হুটহাট মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া, ইমলির সাথে কথোপকথন, ওর ছবি উধাও হয়ে যাওয়া… সবটা আমার কাছে রহস্যের মতো মনে হতো। পরে জানতে পেরেছিলাম, যেহেতু প্ল্যানচেট করার সময় মাধ্যম হিসেবে আমাকে ব্যবহার করা হয়েছিল, তাই নাকি সেদিন ইমলি আমার শরীরে প্রবেশ করে। যতদিন পর্যন্ত আমি ওর মৃত্যু রহস্য উদঘাটন করতে না পারবো, ততদিন ওর মুক্তি হবে না।
গত অমাবস্যায় বলেছিল, ‘ছবির ফ্রেমের মধ্যে নাকি চিঠি লুকোনো আছে। অমাবস্যার রাতে খুললেই পেয়ে যাবো। সেখানে সবকিছু লেখা আছে।’
কিন্তু অদ্ভুতভাবে অমাবস্যার ঠিক আগের দিনই ছবিটা উধাও হয়ে যায়। পরে হাজার খুঁজেও আর পাওয়া যায়নি।
তাই এবার হামিদ সাহেব যখন ওনার সাথে আসার কথা বললেন, আমি কথাটা ফেলতে পারিনি। নিশ্চয়ই ওইখানে গেলে কিছু না কিছু জানা যাবে।

আমি বেশ উদ্বগ নিয়ে মেয়েটাকে এবার প্রশ্ন করলাম, ‘ক্লু? কেমন ক্লু?’

আর কোনো জবাব এলো না।

যখনই চোখ খুলতে যাবো তখনই কারো তীব্র ধাক্কায় আমার ঘোর ভাঙলো। হামিদ সাহেব পাশে থেকে বলে উঠলেন, ‘কখন থেকে কী বিড়বিড় করছো? এত করে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছো না? ভীমরতিতে ধরেছে নাকি? আমরা পৌছে গেছি। জলদি নেমে পড়ো।’
কথাগুলো শেষ করে হামিদ সাহেব তাড়া দিতে দিতে ব্যাগপত্র সমেত নেমে পড়লেন। আমি শূন্য দৃষ্টিতে আশেপাশে কয়েকবার তাকালাম। কিন্তু মেয়েটাকে দেখলাম না।
মেয়েটা হুট করে কোথায় উধাও হয়ে গেল? নাকি পুরোটাই আমার মনের ভুল ছিল? কিন্তু একই ভুল কয়বার হয়?
আচ্ছা, মেয়েটা কোনোভাবে ইমলি নয়তো? হাসিটা তো পরিচিত মনে হচ্ছিলো।

হামিদ সাহেব ফের তাড়া দিলেন নামার জন্য। আমিও আর ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। নেমে পড়লাম বাস থেকে।
হামিদ সাহেবের পাশে গিয়ে বললাম, ‘আর কতদূর?’

‘বেশি দূরে না, কাছেই। এখন অটোতে উঠলে পনেরো মিনিটের মধ্যে পৌছে যাবো।’

আমি ‘আচ্ছা’ বলে মাথা নাড়ালাম।

প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টার জার্নির ফলে শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো দেড়-দুই ঘন্টার পথ হবে। কিন্তু রাজশাহী থেকে মাগুরা এতদূর সেটা জানা ছিল না। অবশ্য গুগল করে জেনে নেওয়া যেতো। কিন্তু কথায় আছে না ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’। আমার অবস্থাও কিছুটা সেই রকম।

হামিদ সাহেব গাড়ি ঠিক করে উঠে পড়লেন। আমিও ওনাকে অনুসরণ করে ব্যাগপত্র নিয়ে চড়ে বসলাম পাশের সিটে।
বাসের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে কিছুটা স্বস্তি লাগছে। চারপাশে ফুরফুরে হাওয়া বইছে।

আমি একটা নদী দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কী নদী?’

প্রায় সাথেসাথে অটোওয়ালা জবাব দিলেন, ‘নবগঙ্গা।’

‘বাহ! দারুণ নাম তো। আচ্ছা, এর নাম নবগঙ্গা কেন?’

অটোওয়ালা হাসলেন। হলুদ দাঁতগুলো বের করে বললেন, ‘সেটা তো কইতে পারি না।’

হামিদ সাহেব এবার মুখ খুললেন। নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলেন, ‘মূলত এটা মাথাভাঙ্গার শাখা নদী। মাথাভাঙ্গা থেকে গঙ্গা নবরূপ লাভ করেছে জন্য এর নাম নবগঙ্গা।’

‘ইন্টারেস্টিং।’

‘হু।’

কেউই আর কোনো কথা বললো না। দুম করে পরিবেশটা যেন শান্ত হয়ে গেল। হামিদ সাহেবের মন খারাপের কারণটা ঠিক ধরতে পারলাম না৷ বাসের মধ্যের ঘটনা কি এখনো ভুলতে পারছেন না? নাকি নদীর কথা বলাতে মন খারাপ হয়ে গেল?
সেটাও হতে পারে। কারণ ইমলি তো নদীতে ডুবে মরেছিল।
‘আচ্ছা, এটাই কি সেই নদী?’
প্রশ্নটা করতে গিয়েও থমকে গেলাম। নাহ, এখন জিজ্ঞেস করা যাবে না। আগে ওনার বাড়ি যাই, ধীরেসুস্থে পরে সবটা জেনে নেওয়া যাবে।
.
বাড়ি পৌছাতে পৌছাতে প্রায় দুইটা বেজে গেল। হামিদ সাহেব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রান্নাবান্নার কাজে। যেহেতু বাড়িতে আর দ্বিতীয় কোনো মানুষ নেই, তাই ওনাকেই সবটা একা হাতে করতে হচ্ছে।

আমি ফ্রেশ হয়ে বাড়ির চারপাশটা ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগলাম। ছিমছাম একটা আধাপাকা বাড়ি। দীর্ঘদিন কেউ বসবাস না করার ফলে ঘরগুলোতে একটা ভ্যাপসা ভাব বিরাজ করছে। এক সারিতে তিনটা ঘর। মাঝখানে মস্তবড় উঠান। উঠানের আনাচে-কানাচে বিভিন্ন রকম গাছে ঠাসা। একপাশে কলঘর আর রান্নাঘর।

আমি দক্ষিণের সবচেয়ে কোণার ঘরটায় বসে একটা কালো মোলাটের ডায়েরি খুলে বসে আছি। এখানের সমস্ত ঘটনা লেখার জন্যই মূলত ডায়েরিটা সাথে রাখা।
প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে লিখলাম ‘ইমলি’। তার নিচে পয়েন্ট আকারে লিখলাম-
১. বয়স: পনেরো(বেঁচে থাকলে এখন কুঁড়ি হতো।)
২. সাঁতারে পারদর্শী।
৩. ছিমছাম গড়নের মিষ্টি চেহারা। ব্রাকেটে লিখলাম (অসম্ভব সুন্দর হাসি।)
৪. মৃত্যু: পানিতে ডুবে।

তারপর কিছুটা জায়গা ফাঁকা রেখে পরবর্তী ঘটনাগুলো লেখার চেষ্টা করলাম-
১. বাস কাউন্টারে হামিদ সাহেবের সাথে পরিচয়। আমাকে অনুসরণ করে ওনার মেসে ওঠা।
২. প্ল্যানচেট।
৩. প্ল্যানচেটের রাতে ইমলির সাথে কথপোকথন। ছবি উধাও হয়ে যাওয়া।
৪. বাসের মধ্যে কথোপকথন। ব্রাকেটে আবার লিখে রাখলাম(অমাবস্যার রাতের ক্লু) দেওয়ার বিষয়টা।

তারপর ডায়েরিটা বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে যখনই চোখ বুজতে যাবো, এমন সময় পাশের ঘর থেকে হামিদ সাহেব হাঁক ছাড়লেন। নিশ্চয়ই রান্না হয়ে গেছে এতক্ষণে। পাশের দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঘন্টার কাঁটা চারটা ছুঁইছুঁই।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে