শেষ পর্বের শুরু পর্ব – ৮

0
666

গল্প: শেষ পর্বের শুরু (অষ্টম পর্ব)
__ ✍️ নীলিমা নওরীন মেঘলা

আজ দুপুরে হাশমত ব্যাপারির বাড়িতে দাওয়াত। উনি বারবার যেতে অনুরোধ করেছেন। আমিও কেন জানি সেই অনুরোধ ফেলতে পারিনি। যাবো বলে কথা দিয়েছি। তবে কী কারণে হঠাৎ আমায় দাওয়াত করলেন, সেই বিষয়টা ঠিক স্পষ্ট নয়।

মানুষটা বারবার তাড়া দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ আগেও কল করে বললেন, ‘সাব, আপনি কখন আইবেন? দুপুর তো গড়াইয়া গেল। আমি আপনার জইন্যে ওয়েট করতেছি। জলদি আইহেন।’

আমি শুধু ‘আসছি’ বলে ফোন রাখলাম।
.

হামিদ সাহেবের উপর ক্ষোভ জমে আছে। সকালে রাগ করে বের হওয়ার পর আর বাড়ি ফেরা হয়নি। মানুষটা বার কয়েক কল করেছেন, আমি রিসিভ করিনি। এবার অন্তত বোঝা উচিত উনি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছেন। এতকিছু সহ্য করা যায় না।
.

হাশমত ব্যাপারির বাড়ির পথে হাঁটছি এখন। যেহেতু দোকান লাগোয়া বাড়ি ওনার, তাই চিনতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না। এর আগে এক-দু’বার দোকানে গিয়ে বসা হয়েছে। বাড়ির ভেতরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি।

‘আচ্ছা, ব্যাপারিকে কি মিতুর কথা কিছু জিজ্ঞেস করা যায়? উনি কি কোনো সাহায্য করতে পারবেন?’ এসব বিভিন্ন কথা ভাবছি৷
মেয়েটার সাথে দেখা করাটা ভীষণ জরুরি। যতক্ষণ না দেখা হচ্ছে ততক্ষণ এই রহস্যের কোনো সুরাহা হবে বলে মনে হয় না।
.

হাশমত ব্যাপারি দেখা হতেই কুশল বিনিময় করার জন্য এগিয়ে এলেন। বোঝাই যাচ্ছে এতক্ষণ আমার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
বাড়ির ভেতর নিয়ে যেতে যেতে প্রশ্ন করলেন, ‘হামিদ সাব কই? উনি আইলেন না? আমি তো ওনারে লইয়াই আইতে কইছিলাম।’

আমি ‘না’ সূচক মাথা নাড়ালাম। বললাম, ‘ওনার জরুরি কাজ আছে। আসতে পারবেন না।’

আমার পাংশুবর্ণ মুখ দেখে কিছু বুঝলেন কিনা জানি না, তবে তৎক্ষনাৎ বলে উঠলেন, ‘ওনার কাইজ তো একটাই। ভূত হাজির করবার জইন্য হুজুর, কবিরাজ ধরা। ঠিক কইছি না?’
কথাটা বলেই শব্দ করে হাসলেন।

হাশমত ব্যাপারির কথা শুনে আমার অবাক হওয়া উচিত। তবে কেন জানি অবাক লাগছে না। কারণ লোকটাকে আজকাল বিশ্বাস হয় না। উনি আসলে হুটহাট এসব কথা বলে মানুষকে ভড়কে দিতে চান। সবাইকে নিজের আয়ত্তে নিতে চান। কোনো জ্যোতিষশাস্ত্রের কিছুই তিনি জানেন বলে মনে হয় না।
হয়তো হামিদ সাহেবকে সকালে আলখাল্লা পরা লোকটাকে নিয়ে বাড়ির পথে যেতে দেখেছেন। সেই ভিত্তিতেই কথাগুলো বলছেন। অথচ এখন জিজ্ঞেস করলে অকপটে মিথ্যা বলবেন। সবটাই নিজের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বলে চালিয়ে দেবেন।

আমার চুপ থাকা দেখে ব্যাপারি মৃদু ধাক্কা দিলেন। বললেন, ‘এত কী ভাবতাছেন সাব? আমি আছি তো। একদম চিন্তা কইরেন না। ইনভিস্টিগশনে আমি সাহায্য করমু আপনারে।’

আমি সৌজন্যতা দেখিয়ে মৃদু হাসার চেষ্টা করলাম। এখন মোটেও কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। মনটা এমনিতেই বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কে জানে হামিদ সাহেব বাড়িতে একা একা কী করছেন। ভালো লাগছে না কিছু। মানুষটার জন্য চিন্তা হচ্ছে। যদিও এই চিন্তা হওয়াটা পুরোপুরি অমূলক।
.

বেশ ভালোই খাবারের আয়োজন করেছেন। তবে প্রতিটা খাবার ব্যাপারি নিজেই পরিবেশন করলেন। কোনো মহিলা মানুষকে দেখলাম না।
অবশ্য কথায় কথায় জানা হয়েছে ওনার দুই মেয়ে ও এক ছেলে আছে, স্ত্রীও আছে। হয়তো রক্ষণশীল পরিবার। কোনো ছেলে মানুষের সামনে মেয়ে মানুষ আসার নিয়ম নেই।

‘আমি খাবার দিতেছি জইন্য কিছু মনে কইরেন না। অতিথি আমার, আমি খাওয়ামু। শুধু শুধু মাইয়া মানুষরে হয়রানি কইরা লাভ কী কন?’
কথাগুলো বলেই উনি দাঁত বের করে দ্বিতীয় দফা হাসলেন।

আমি ওনার সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে পারলাম না। কিছু না বলে চুপচাপ খাওয়াতে মন দিলাম। খেতে খেতে বললাম, ‘মিতু নামে কাউকে চেনেন?’

‘কী যে কন। চিনমু না ক্যান? সেদিনকার মাইয়া। হাফ প্যান্ট পইরা সারা গ্রাম দাপাইয়া বেড়াইতো। ইমলির লগে তো গলায় গলায় ভাব আছিল।’
বেশ রসিয়ে রসিয়েই বললেন।

কথাগুলো শুনে কেন জানি কৌতুহল হচ্ছে। আরও কিছু প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে। নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করলে আরও কিছু জানা যাবে।
অতশত না ভেবে বলে বসলাম, ‘মিতুর বাড়ির ঠিকানা দিতে পারবেন? একটু দরকার ছিল।’

‘দিতে তো পারিই, তয় একটা কথা…’
এতটুকু বলে একটু থামলেন। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘ওই মাইয়া কিন্তু সুবিধার না। আপনারে ফাঁসাইয়া দিবার পারে।’

আমি শেষ লোকমাটা মুখে তুলে নিতে নিতে বললাম, ‘ফাঁসিয়ে দেবে? কীভাবে ফাঁসাবে?’

‘মাইয়া মানুষের ফাঁসাইতে কত ফন্দি আছে সেইডা জানেন না? এর আগে তো এক পোলারে ফাঁসাইয়া পাঁচ লাখ টাকা হাতাইয়া ছাড়ছে।’

‘আমার অত টাকা নেই। কাজেই আমাকে ফাঁসাবে না৷ আপনি চিন্তা করবেন না। ঠিকানা তো বলুন। দেখা যাক কী হয়।’

উনি একপ্রকার বাধ্য হয়েই ঠিকানা দিলেন এবং হুঁশিয়ারি করে বললেন, ‘সাবধানে থাইকেন সাব। কোনো দরকার হইলে জানাইতে ভুইলেন না। আমি সবসময় রেডি আছি আপনের জইন্য।’

আমি মৃদু হেসে জবাব দিলাম, ‘আমি সাবধানে থাকবো। কোনো অসুবিধা হবে না। আর হ্যাঁ, রান্নাটা কিন্তু সত্যিই দারুণ হয়েছে। আমার পক্ষ থেকে আপনার স্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে দেবেন। আপনার বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করে ভালো লেগেছে।’

হাশমত ব্যাপারি হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আমি কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এখন মোটেও গালগল্প করার কোনো ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই নেই।

আগে নদীর পাড়ে কিছু সময় কাটিয়ে মন ফ্রেশ করতে হবে। তারপর মিতুর খোঁজে বের হতে হবে। অবশ্য ঠিকানা তো আছেই। সেই মোতাবেক গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করে নিলেই হবে। তবে কী পরিচয়ে যাবো, আর কীইবা বলবো সেটা একটা চিন্তার বিষয়। সে যা হবে পরে দেখা যাবে। আগে তো যাওয়া যাক।
.

নদীর পাড়ে বসে আছি প্রায় মিনিট বিশেক হলো। অদ্ভুতভাবে এখানে আসার পরই হামিদ সাহেবের সাথে দেখা। লোকটা একা একা মন খারাপ নিয়ে বসে ছিলেন পাড়ে। আমাকে দেখেই মুখ করুণ করে বললেন, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে। এবারের মতো কি ক্ষমা করা যায় না?’

আমি ওনার কথা শুনেও যেন না শোনার ভাণ করে বললাম, ‘আপনার বিশ্ববিখ্যাত সেই হুজুর সাহেব কোথায়? ওনাকে তো দেখছি না। বাড়িতে রেখে এসেছেন নাকি? ইমলিকে কে মেরেছে জানা গেছে নিশ্চয়? তাহলে তো আর কোনো সমস্যা থাকলো না। এবার আমার ছুটি?’

নিজের বলা কথাগুলো শুনে নিজেই যেন চমকে গেলাম। একটু কি বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেল? মানুষটা তো চুপ করে আছেন। কিছুই বলছেন না।
পরবর্তী মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম এতটা রূঢ় আচরণ করা একদম উচিত হয়নি আমার। মানুষ শোকের বশে কতকিছুই না করে। উনিও নাহয় একটু পাগলামি করে ফেলেছেন। বুঝিয়ে বললেই হতো। হঠাৎ করে ভীষণ অনুতপ্তবোধ হচ্ছে এবং একইসাথে মানুষটার জন্য মায়া হচ্ছে।
.

দুজন মানুষ চুপচাপ পাশাপাশি বসে আছি, কেউ কোনো কথা বলছি না। একটু পরপর পানিতে ঢিল ছুঁড়ে মারছি। মন ভালো করার জন্য উপায়টা বেশ কাজে দেয়।

আমিই আবার মুখ খুললাম। মানুষটাকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘ইমলির মৃত্যু রহস্য খুব তাড়াতাড়ি উদঘাটন হবে। দোষীরা শাস্তি পাবে। আপনি বাসায় গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে রেস্ট নিন। চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। আর এখন যদি আমার কথা না শোনেন, তবে সত্যি সত্যিই ব্যাগপত্র গুছিয়ে কিন্তু বাড়ির পথে হাঁটা দেবো। সেটা কি ভালো হবে?’

এতক্ষণে হামিদ সাহেবের নিরবতা ভাঙলো। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি খাবে না?’

‘আমি খেয়েছি। রাগ করে না খেয়ে থাকার অভ্যাস আমার নেই। জরুরি একটা কাজ আছে। একবারে রাতে ফিরবো। এখন যা বললাম সেটা করুন।’
কিছুটা জোর গলাতেই কথাগুলো বললাম।
তাহলে কি মানুষটার উপর আমি অধিকার দেখাচ্ছি? এত অধিকারবোধ জন্মালো কবে থেকে? অদ্ভুত!

হামিদ সাহেব কথার কোনো প্রতিবাদ না করে পাড় ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কোথায় যাবো, কী কাজ সেসব বিষয়ে কোনো কৌতুহল দেখালেন না। হয়তো বুঝে গেছেন জানতে চাইলেও কোনো উত্তর দেবো না আমি। শুধু শুধু কৌতুহল দেখিয়ে লাভ নেই।
.

হামিদ সাহেব চলে যাওয়ার পরেও কিছুক্ষণ পাড়েই থাকলাম। হেঁটে হেঁটে চারপাশটা দেখলাম। তারপর বেলা সাড়ে চারটা নাগাদ মিতুর খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে