শেষ পরিণতি পর্ব-১১

0
850

শেষ_পরিণতি
_______________
#সিজন ২ #পর্ব ২
____________________
আমার মাথাটা নীলিমার কোলের ভেতরে রাখা।
আমি অস্ফুট স্বরে নীলিমাকে বললাম,
-প্লিজ নীলিমা যে করেই হোক আমাকে বাঁচা।
আমার বাচ্চাটার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
আমি ওর মুখে “মা ” ডাক শুনতে চাই।
কথাগুলো বলে দু’হাত দিয়ে পেট চেপে ধরি।
এভাবেই ধীরে ধীরে শত কষ্ট ও যন্ত্রণা নিয়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
.
.
.
.
চোখ মেলে দেখি আমি হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি।
হাতে স্যালাইন ধরানো আছে।
ওয়ালে টানানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সময় তখন রাত ১১ টা।
আমার শ্বাশুড়ি তখন সোফায় বসে ঝিমুচ্ছে। আমি একটু নড়েচড়ে উঠে বসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত পেট ব্যথার কারণে আমি ব্যর্থ হলাম।
মাথার ভেতরেও ঝিনঝিন করছে। আমার নড়াচড়ার শব্দ শুনে মা দৌড়ে এলেন।
আমাকে ধরে পুনরায় আগের মতো করে শুইয়ে দিয়ে বললেন,
-না মা। একদম না। ডাক্তার তোমাকে বেডরেস্টে থাকতে বলেছেন। এখনতো একদমই নড়াচড়া করা যাবে না।
আমি মার হাত ধরে বললাম,
-মা একটা সত্যি কথা বলবেন?
মা মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক জবাব দেওয়ায় আমি বললাম,
-মা! আমার বেবি বেঁচে আছে তো? আমি পারবো তো ওর মুখে মা ডাক শুনতে?
আমার কথা শুনে মার দুচোখ বেয়ে অনবরত পানি পরতে শুরু করলো।
মাকে এভাবে কাঁদতে দেখে আমার বুকটা ধুপ করে কেঁপে উঠলো।
মনে হলো পুরো পৃথিবী নিঃশেষ হয়ে গেছে।
এ ক’দিনে আমি আমার বেবিকে নিয়ে কতশত স্বপ্ন দেখেছি, কল্পনায় ভিন্ন জগৎ সাজিয়েছি, সব যে এভাবে এক নিমিষে গুড়িয়ে যাবে বুঝতে পারিনি।
আমার বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠি।
আমার কান্নার শব্দ শুনে ডাক্তার এবং নার্সরাও ছুটে আসেন।
আমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে ডাক্তার সাহেব ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলেন,
-প্লিজ ম্যাম এভাবে চিৎকার করে কাঁদবেন না। এতে আপনার এবং আপনার বেবির ক্ষতি হতে পরে।
ডাক্তারের মুখে “আপনার বেবি! ” কথাটা শুনে আমি থমকে যাই।
পেটে ব্যথা অগ্রাহ্য করে আমি ধপাস করে উঠে বসে ডাক্তারের হাত ধরে বলি,
-আমার বেবি মানে! তারমানে আমার বেবি বেঁচে আছে ডাক্তার!
আমার কথার প্রতিত্তোরে ডাক্তার বলেন,
-জ্বী ম্যাম আপনার বেবি বেঁচে আছে। কিন্তু!
-কিন্তু কি ডাক্তার?
-পরে গিয়ে যেই আঘাতটা লেগেছে সেটা বেবির হেডসাইডে লেগেছে। আপনার অনেক রক্তক্ষরণও হয়েছে। যার ফলে বেবির কন্ডিশন ততোটা ভালো না। যদিও এই কন্ডিশন থেকে সার্ভাইব করে বেবি সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে কিন্তু এই আঘাতের ইফেক্ট বেবির উপরে কিভাবে পড়েছে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।
এমতাবস্থায় আমি একজন ডাক্তার হিসেবে আপনাকে উপদেশ দেবো,
আপনার এবরশন করে ফেলাই ভালো হবে।
যদিও জানি এটা আপনার জন্য মোটেও সহজ না। কিন্তু পরবর্তীতে আপনার সামান্য অসাবধানতায় বড় কোনো ক্ষতি হতে পারে।
যেটা আপনার এবং আপনার বেবির জন্য খুব বিপদজনক।
এমনকি কোনো সমস্যা ছাড়া যদি আপনার ডেলিভারিও হয়, সেক্ষেত্রে বেবি প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা ৯৫ ভাগ।
তাই আমার উপদেশ, আপনি এবরশন করে ফেলুন। কিছুদিন পরে সুস্থ হয়ে না হয় আবার বেবি নিয়ে প্ল্যানিং করবেন!
ডাক্তারের কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।
মাতৃত্বের অনুভূতি কতোটা প্রখর হতে পারে, সেটা আমি বুঝতে শুরু করেছি সেদিন থেকে,যেদিন প্রথম ডাক্তারের মুখে শুনেছিলাম আমি মা হতে চলেছি।
সন্তানের প্রতি মায়ের যেই ভালোবাসা,সেটা হলো নিঃস্বার্থ ও অন্ধ ভালোবাসা।
সন্তানের মুখ দেখার আগেই, তার অস্তিত্ব অনুভবের আগেই এই নির্ভেজাল ভালোবাসা জন্ম নেয়। এই ভালোবাসার অনুভূতি এখন আমার শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে গেছে।
আমি কি করে নিজের স্বার্থের জন্য এই অনুভূতি দূরে সরিয়ে দিই!
না এটা কোনোভাবেই সম্ভব না।
আমি উত্তেজিত কন্ঠ ডাক্তারকে বললাম,
-আমি এবরশন করতে রাজি নই ডাক্তার।
সব কষ্ট সহ্য করতে রাজি আছি, কিন্তু নিজের অনাগত সন্তানের পৃথিবীর আলো দেখার আগেই তার জীবনের আলো নিভে যেতে দিতে রাজি নই।
ডাক্তার এবং আমার শ্বাশুড়ি মা আমাকে বোঝাতে চাইলে তাদের থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম,
-আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল।
আশা করি এই ব্যাপারে আর কোনো কথা বাড়াবাড়ি হবে না।
আমার কথা শুনে ডাক্তার একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-ওকে ম্যাম যেমন আপনার ইচ্ছে।
আপনাকে ৪৮ ঘন্টা আমাদের অবজারবেশনে থাকতে হবে। তারপর চেক-আপ করে আপনাকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হবে।
“কাল দুপুর পর্যন্ত পেসেন্টকে তরল খাবার ব্যতীত কিছু খাওয়াবেন না।”
মাকে কথাটা বলে ডাক্তার সাহেব চলে গেলেন।
ডাক্তার বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরে, কেবিনে দ্রুত পায়ে প্রবেশ করলো রাজন।
রাজনকে দেখে আমার ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠলো।
মনে পরে গেলো অচেনা নাম্বার থেকে হোয়াটসঅ্যাপে আসা সেই ভিডিওর কথা।
রাজন ধীরপায়ে এগিয়ে আমার পাশে বসলো।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-এখন কেমন লাগছে তোমার?
আমি রাজনের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলি।
আমার ইচ্ছে করছিলো ওর এই হাতটা ভেঙে ওর অন্য হাতে ধরিয়ে দেই।
ওর মুখে থু থু দিয়ে প্রশ্ন করি,
তোমার সাহস হয় কিভাবে সেই হাত দিয়ে আমাকে স্পর্শ করতে যে হাত দিয়ে তুমি অন্য মেয়েকে স্পর্শ করেছো।
ভিডিওতে স্পষ্ট দেখেছি কোনো মেয়ের সাথে ওর শারীরিক সম্পর্কের মুহূর্ত। দেখেছি পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে কাউকে সাদরে বুকে আমন্ত্রণ করতে।
এসব আমি কোনোভাবেও এড়িয়ে যেতে পারি না।
তবে এই মুহুর্তে আমি চাইছি না এসব কথা রাজন বা অন্য কেউ জানুক।
আমার অনেককিছু জানার আছে।
ভিডিওতে রাজনকে স্পষ্টভাবে দেখলেও মেয়েটার চেহারা বোঝা যায়নি। ভিডিওতে মেয়েটাকে এডিট করে ব্লার করে দেওয়া হয়েছে।
এমনকি ভয়েস মিউট ভিডিও পাঠানো হয়েছে আমাকে।

এমতাবস্থায় আমার কি করা উচিৎ আমি জানি না। তবে যে করেই হোক আমার জানতেই হবে,
“মেয়েটা কে?
রাজনের গর্ভবতী স্ত্রী আছে জেনেও কেন সম্পর্কে জড়ালো?
তাদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও আমাকে পাঠানোর উদ্দেশ্য কি?
কি চায় সে?”
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা আমার খুবই জরুরি।

তাই শত ঘৃণা চাপা দিয়ে আমি চুপ করে রইলাম।
.
.
.
পরদিন দুপুর।
আমার জন্য স্যুপ বানিয়ে নিয়ে মা ও বাবা এসেছেন। আমার খবর শুনে বাবার অনেক প্রেসার উঠে গেছিলো। বাবাকে সামলে উঠে আসতে আসতে একটু দেরি হলো তাদের।
মাকে দেখে আমার কষ্টগুলো নাড়া দিয়ে উঠলো।
মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলাম।
মা আমাকে অনেকভাবে বুঝিয়ে স্যুপটা খাইয়ে দিলো।
এদিকে সারারাত আমার পাশে জেগে বসে থাকায় আমার শ্বাশুড়ি মায়েরও অবস্থা কাহিল।
আমি আর মা অনেক বুঝিয়ে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম।
যদিও তিনি যেতে একদমই রাজি হচ্ছিলেন না কিন্তু আমার জিদের কাছে তার হার মানতে হলো।
তবে যাওয়ার আগে বলে গেলেন,
“রাতে কিন্তু আমি আবার আসবো।”
মনে মনে ভাবলাম
এমন একজন শ্বাশুড়ি পাওয়া প্রতিটি মেয়ের স্বপ্ন হয়ে থাকে৷
আমি সত্যি অনেক ভাগ্যবতী। এমন একজনকে শ্বাশুড়ি হিসেবে পেয়ে।
.
.
.
বাড়ির ভেতর ঢুকে মাজেদা বেগম বেশ অবাক হন।
বাড়ির গেট টা খোলা।
এমনকি কেয়ারটেকারকেও দেখা যাচ্ছে না কোথাও।
তিনি আরও বেশি অবাক হন গ্যারেজে রাজনের গাড়ি দেখে।
কিছুক্ষণ আগেও রাজন কল করে জিজ্ঞেস করেছিল হসপিটালের সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা! কোনোকিছুর প্রয়োজন আছে কি না।
তারপর বললো ওর নাকি জরুরি মিটিং আছে সেই কাজে ব্যাস্ত থাকবে রাত পর্যন্ত।
সেটা হলে, গ্যারেজে গাড়ি থাকার কারণটা তিনি বুঝলেন না।
তিনি মনে প্রশ্ন নিয়েই সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
দরজা ভেতর থেকে লক করা।
মাজেদা বেগম ধারণা করলেম রাজন হয়ত ভেতরেই আছে।
ব্যাগ থেকে ডুপ্লিকেট চাবি বের করে দরজা খুলে তিনি ভেতরে প্রবেশ করলেন।
ভেতরে ঢুকতেই তার কানে কিছু সাউন্ড ভেসে আসলো।
সাউন্ডটা তুবার রুম থেকে আসছে।
তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন রুমের দিকে।
রুমের দরজা মেশানো ছিলো।
মাজেদা বেগম দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই পাথরের মতো জমে গেলেন।
তার মনে হচ্ছে পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে।
ওখানে এক মিনিটও দাঁড়িয়ে না থেকে তিনি দ্রুত রুমের বাইরে এসে দাঁড়ালেন।
রাগে থরথরিয়ে কাঁপছেন তিনি।
তার মনে হচ্ছে এমন দৃশ্য দেখার আগে হয়ত অন্ধ হওয়াই ভালো ছিলো।
কোনো মা’ই নিজ চোখে তার সন্তানকে শারীরিক সম্পর্কে মিলিত অবস্থায় দেখতে চাইবেন না।
কিন্তু না চাইতেও মাজেদা বেগমের সামনে এমন কিছু পড়লো।
তাও আবার নীলিমার সাথে!
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার।
.
.
.
.
.
.
চলবে..
Tuba Binte Rauf

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে