শেষ পরিণতি পর্ব-১০

0
946

#শেষ_পরিণতি
সিজন ২
পর্ব ১
লেখিকা
– Tuba Binte Rauf

গর্ভাবস্থায় নিজের স্বামীকে ঘরে আশ্রয় দেয়া কাজিনের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখাটা কতটা কষ্টদায়ক হতে পারে??

তখন সকাল আট টা বাজে।
বাসার সবাই ঘুমিয়ে আছে।
নীলিমা শোয়া থেকে উঠে কিচেনে চলে যায়।
নীলিমা হলো আমার বান্ধবী এবং কাজিন। বেশ বড় একটা বিপদের মুখে পরে নিজের বাসায় আশ্রয় হারিয়েছে ও।
আমি ওকে ভালোবেসে আমার ঘরে এনে উঠিয়েছি। আমি গর্ভবতী হওয়ায় সকালে উঠে নিলীমা আমার এবং আমার হাজবেন্ড রাজনের জন্য নাস্তা বানায়। সে
চুলায় চা বসিয়ে দিয়ে ফল কাটতে থাকে।
হঠাৎ নিলীমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কেউ।
আচমকা নীলিমা কেঁপে উঠে।
“কে?” বলে পেছনে তাকায়।
পেছনে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নীলিমা বলে,
“ওহ রাজন তুমি! আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম”।
রাজন কিছু না বলে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিলীমাকে।
নীলিমার ঠোঁটের কোণে ভেসে ওঠে একটা বাকা হাসি।
এই সবকিছুই থেকে যায় সবার চক্ষু আড়ালে।
নীলিমা দিব্যি সবার সামনে নিজেকে খুব ভালো মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করছে।
নীলিমাকে এভাবে বাসার সব কাজ করতে দেখলে যে কারো মন গলে যাবে। কিন্তু নীলিমাকে কেনো যেন রাজনের মা “মাজেদা বেগম” একদমই সহ্য করতে পারেন না।
তার বার বার শুধু মনে হয়, এ সবকিছু নীলিমার নাটক।
এমনকি আমাকেও এ ব্যাপারে অবগত করতে চেয়েছেন তিনি, কিন্তু বোনের প্রতি তীব্র ভালোবাসায় অন্ধ ছিলাম।
তাই বার বার আমার সামনে শ্বাশুড়ি আম্মা তার মনের ধারণাগুলো চাইলেও তুলে ধরতে পারেন নি।
আমি আমার শ্বাশুড়ির কাছে নিজ সন্তারের থেকে কোনো অংশে কম না। যখন তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন আমি সবসময় তার সাথে থেকেছি।ভালবাসা ও যত্নে সারিয়ে তুলেছি তাকে তিলে তিলে।
মাজেদা বেগম সুস্থ হওয়ার পরে তার স্বামীও ফিরে এসেছিলেন।
কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি তাকে ক্ষমা করেন নি৷ তিনি
আমার এবং রাজনের সাথেই নিজের জীবনকে সাজিয়ে তুলেছেন নতুনরূপে।
আমার এবং আমার শ্বাশুড়ির সম্পর্ক, রক্তের সম্পর্কেও হার মানায়। আমাকে সবসময় চোখে চোখে রাখেন তিনি।
অন্যদিকে নীলিমাকে তিনি দু’চোখে সহ্য করতে পারেন না।
.
.
.
সকাল সকাল নীলিমার ডাকে ঘুম ভাঙলো আমার।
আমাকে জাগিয়ে হাতে এক গ্লাস ফলের জুস ধরিয়ে দিয়ে পাশে বসল নীলিমা।
ব্যাপারটায় আমি একটু বিরক্ত হলাম।
বিরক্তিকন্ঠ নিয়েই বললাম,
-সকাল ৭ টা বাজে মাত্র নীলিমা।
এতো সকালে তোকে জুস আনতে বলেছে কে?
আর বাসায় তো কতো লোক আছে আমার দেখাশোনা করার, তুই এতোকিছু কেন করতে যাস বলতো!
আমার কথার উত্তরে নীলিমা বলে,
-বোনের খেয়াল বোন রাখবে না তো আর কে রাখবে বল!
তবে আজ একটু তাড়াতাড়িই তোকে জাগিয়ে তুলেছি। তার জন্য সরি।
কি করবো বল, একটা বিশেষ দরকার ছিল।
-সরি বলতে হবে না। কি দরকার সেটা বল তাড়াতাড়ি।
নীলিমা একটু আমতা আমতা করে বললো,
-বোনের শ্বশুর বাড়িতে আর কতদিন বসে বসে খাওয়া যায় বল। লোকে এটা ভালোভাবে দেখে না। তাছাড়া তোর শ্বাশুড়িও আমাকে পছন্দ করে না। সারাক্ষণ কেমন যেন করে, তাই আমি অনলাইনে কয়েক জায়গায় চাকরির জন্য এপ্লাই করেছিলাম। আজ ইন্টারভিউয়ের জন্য এক জায়গা থেকে ডেকেছে আমাকে।
সকাল ৮ টা ৩০ এ ইন্টারভিউ।
কিন্তু আমার কাছে ইন্টারভিউ দেওয়ার মতো তেমন ভালো কোনো ড্রেস নেই, তাই বলছিলাম তোর থেকে যদি একটা ড্রেস দিতি, ভালো হতো আমার….

নীলিমার কথা শুনে ইচ্ছে করলো ধমক দিয়ে বলি “বোনের বাসা তো নিজেরই বাসা, জবের কি প্রয়োজন? ” কিন্তু পরমুহূর্তে আবার থেমে যাই।
নীলিমার যে ড্রেসের প্রয়োজন এটা মাথাতেই ছিলো না আমার। হতে পারে এমন আরও অনেক জিনিস ওর প্রয়োজন কিন্তু আমাকে জানায়নি!
এক্ষেত্রে নীলিমার জব করাটাই বেটার। অন্যের উপর ডিপেন্ড করে থাকতে হবে না ওকে।
প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব ইচ্ছা ও স্বাধীনতার প্রয়োজন।
আমি কিছু না বলে একটু হেসে দিয়ে বললাম,
– এটা আবার বলতে হয় আমাকে!
ওই ড্রয়ারে দেখ চাবি আছে আলমারি থেকে যা খুশি নিয়ে নে।
আমি কিছুদিন আগে কয়েকটা নতুন ড্রেস কিনেছিলাম, কিন্তু কন্সিভ করার পরে সেগুলো আর পরা হয়নি, সেভাবেই পরে আছে।
তুই সবগুলো নিয়ে তোর আলমারিতে রাখ।
নীলিমা খুশি হয়ে চাবি নিয়ে আলমারি থেকে ড্রেস গুলো বের করে নিলো।
রুম থেকে বের হওয়ার সময় আমি ডাক দিয়ে বললাম,
-বের হওয়ার আগে একটু দেখা করে যাস।
নীলিমা ঠিক আছে বলে চলে গেলো।
.
.
.
ব্রেকফাস্ট সেরে রাজন অফিসের জন্য রেডি হতে থাকলো।
তখনই কাশি দিয়ে রুমে প্রবেশ করলো নীলিমা।
আমার কালো শাড়িটা পরেছে ও।
কালো শাড়িতে নীলিমাকে দেখে আমার মুখটা চুপসে গেলো। নীলিমা পরেছে এজন্য নয়, বরং শাড়িটা নীলিমাকে পরতে দেখে রাজন কিভাবে রিয়াক্ট করবে এটা ভেবে।
এই শাড়ি রাজন আমাকে গিফট করেছিলো কিছুদিন আগে।
একবারও পরা হয়নি। রাজনের গিফট করা কোনো কিছু আমি অন্য কাউকে দিই এটা রাজনের একদমই পছন্দ না।
নীলিমা আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
-কেমন লাগছে আমাকে?
প্রশ্নের উত্তরে আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই রাজন বলে উঠলো,
-বাহ এ শাড়িতেতো তোমাকে মানিয়েছে খুব।
রাজনের কথা শুনে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
নীলিমাকে আলমারি থেকে কিছু টাকা দিয়ে বললাম,
-প্রয়োজনীয় যা লাগে কিনে নিস।
নীলিমা মুচকি হাসি দিলো।
আমি বললাম,
-ইন্টারভিউতে কেউ শাড়ি চুড়ি পরে এভাবে সাজুগুজু করে যায়?
ইন্টারভিউতে যাবি ফরমাল ড্রেসে।
আমার কথা শুনে নীলিমার মুখটা কালো হয়ে গেলো।
ভেতরে ভেতরে নিজের উপর রাগ হলো খুব।
শুধু শুধু মেয়েটার মন খারাপ করে দিলাম।
পরমুহূর্তে আমি হেঁসে দিয়ে বললাম,
-তবে সুন্দর লাগছে খুব।
ভালোভাবে ইন্টারভিউ দিবি। বেস্ট অফ লাক।
আমি ড্রাইভারকে বলছি তোকে পৌঁছে দিয়ে…
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই নীলিমা বললো,
-গাড়ি লাগবে না। আমি রিকশা করে চলে যাবো।
নীলিমা আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই একটা হাগ দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো।তার
কিছুক্ষণ পরে অফিসের জন্য বের হয়ে গেলো রাজনও।
রাজন বের হয়ে যাওয়ার পর আমি হাঁটতে হাঁটতে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম।
আমার রুম সংলগ্ন বেলকনি থেকে মেইন রাস্তার বেশ অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়।
আমি গ্রিল ধরে রাস্তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।
কিন্তু একটা বিষয়ে খুব অবাক হলাম।
আমাদের বাসা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে নীলিমা।
সামনে থেকে অনেক রিকশাই যাচ্ছে কিন্তু ও একটাতেও উঠছে না।
কিছুক্ষণ পরে রাজনের গাড়ি গিয়ে নীলিমার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই নীলিমা গাড়িতে উঠে বসলো।
মনে একটা খটকা লাগলো আমার।
নীলিমা রাজনের সাথে যাবে এটা তো আমাকে বললেই পারতো!
পরমুহূর্তে আবার ভাবলাম, হয়ত পরে ডিসিশন চেঞ্জ করেছে। রাজন হয়ত বলেছে যাওয়ার সময় ওকে নামিয়ে দিয়ে যাবে।
বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে আমি রুমে চলে আসলাম।
.
.
.
এরপর কেটে গেলো কয়েকটি দিন।
বিকালের দিকে আমাকে ডেকে নিয়ে মা ডাইনিং রুমে এলেন।
সোফায় বসিয়ে অয়েল মাসাজ করে দিচ্ছেন মাথায়।
মা মাঝেই মাঝেই আমার মাথায় তেল দিয়ে দেয়। মার হাতে এক প্রকারের জাদু আছে।
মাথায় হাত দিলেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে হয়। আরামে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো।
ঠিক তখনই আমি কেঁপে উঠি মোবাইলে একটা মেসেজের শব্দ শুনে।
ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি অচেনা নাম্বার থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটা ভিডিও এসেছে।
আমি ফোন হাতে নিয়ে ভিডিওটা প্লে করতেই আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
মা যেন দেখতে না পায় সেজন্য তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়ে আমি টি টেবিলের উপর আছড়ে পরি।
প্রচন্ড ব্যথা পাই পেটে।
মুখ থেকে রক্ত বের হয়ে আসে।
হাত থেকে ফোনটা ছিটকে সোফার নিচে চলে যায়।
মা চিৎকার করতে করতে আমাকে জড়িয়ে টেনে তোলে।
মার চিৎকার শুনে নীলিমা, বাড়ির কেয়ারটেকার রহিম আংকেল সবাই এগিয়ে আসে।
অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে পেটে।
মনে হচ্ছে যন্ত্রণায় বোধ হয় মরেই যাবো।
কিন্তু তার থেকে বেশি চিন্তা হচ্ছে আমার বেবির জন্য।
ব্যথায় কাতরাচ্ছি আমি, কিন্তু মনে মনে একটাই প্রার্থনা, আল্লাহ যেন আমার বেবির কোনো ক্ষতি না হয়।
রহিম আংকেল এম্বুলেন্স ডাকলেন।
মা চিল্লিয়ে কান্না করছে।
আমার মাথাটা নীলিমার কোলের ভেতরে।
আমি অস্ফুট স্বরে নীলিমাকে বললাম,
-প্লিজ নীলিমা যে করেই হোক আমাকে বাঁচা।
আমার বাচ্চাটার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
আমি ওর মুখে “মা ” ডাক শুনতে চাই।
কথাগুলো বলে দু’হাত দিয়ে পেট চেপে ধরি।
এভাবেই ধীরে ধীরে শত কষ্ট ও যন্ত্রণা নিয়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
.
.
.
.
চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে