শেষ পরিণতি পর্ব-০৬

0
972

#শেষ_পরিণতি পর্ব ৬
_____________________
আন্টি খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। ১ গ্লাস ঠান্ডা পানি হবে?
– আচ্ছা তুমি ভেতরে এসে বসো আমি পানি আনছি। বলে আন্টি ভেতরে চলে গেলেন।
আমি ড্রয়িং রুম থেকে উঠে পা টিপে টিপে গিয়ে ভেতরের দিকে উঁকি দিলাম।
হঠাৎ করেই শক্ত কিছু একটার আঘাত এসে লাগলো আমার মাথার পেছনে। শুধু বুঝতে পারলাম একটা ফুলদানি দিয়ে আমাকে আঘাত করা হয়েছে৷ আমি ক্রমশ
জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি…
চোখ মেলে দেখি আমি একটা বিছানায় শুয়ে আছি।
কতক্ষণ পড়ে জ্ঞান ফিরেছে আমি জানিনা।
মাথার পেছনে এখনও ব্যথা।
ভালোভাবে তাকিয়ে দেখি আমার পাশে বসে আছেন, সাদেকের খালা।
আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে তিনি চেঁচিয়ে বললেন,
-সাদেক, রাজন, মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে এদিকে আয়।
কথাটা বলামাত্র রাজন ও সাদেক দৌড়ে আসলো আমার কাছে। সবার চেহারা বিমর্ষ।
সেখানে অপরাধবোধের ছাপ স্পষ্ট।
রাজনের খালা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-এখন কেমন লাগছে মা?
আমি “ভালো” বলে শোয়া থেকে উঠে বসতে গেলে রাজন আমাকে বসতে হেল্প করে।
আমি বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বলি,
আমাকে আঘাত করা হয়েছিলো কেন জানতে চাই?
আর কেই বা আমাকে আঘাত করেছে?
আমার প্রশ্নশুনে সবার মুখটা শুকিয়ে গেলো।
রাজন মাথাটা নিচু করে বললো,
-এমন একটা ঘটনার জন্য আমি খুব দুঃখিত।
ইচ্ছে করে তোমাকে আঘাত করে হয়নি তুবা।
-আমাকে ফুলদানি দিয়ে আঘাত করে অজ্ঞান করে দিয়ে তুমি বলছো আমাকে ইচ্ছে করে আঘাত করা হয়নি?
আপনিই এই কাজটা করেছেন তাই না রাজন ভাইয়া? আপনাকে না জানিয়ে এসেছি এ বাসায় এজন্য এতো রাগ? হয়ত এই বাসায় এমন কিছু আছে যা আমি জানলে আপনাদের বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে তাই আমাকে আঘাত করলেন?
যাতে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আর আপনারা সেই জিনিসটাকে সরিয়ে ফেলতে পারেন!
আপনার থেকে এটা আশা করিনি রাজন ভাইয়া। আপনাকে আমি বিশ্বাস করতাম খুব।
আমার কথা শেষ হতে না হতেই সাদেকের খালা বললেন,
– না না মা, তুমি যেমন ভাবছো তেমন মোটেও না। রাজন তোমাকে আঘাত করেনি। শুধু রাজন কেন, আমি বা সাদেক কেউই তোমাকে আঘাত করিনি।
-আপনারা যদি আঘাত নাই করেন, তাহলে কে আঘাত করেছে আমাকে? আপনারা ছাড়া আর কে ই বা আছে এ বাসায়?
প্রশ্নটা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেলো।
সবাইকে চুপ থাকতে দেখে আমি আবারও একই প্রশ্ন করলাম, বলুন আমাকে কে আঘাত করেছে?
তখন সাদেক আমতা আমতা করে বললো,
-আসলে আপনাকে যিনি আঘাত করেছেন তিনি রাজনের মা।
সাদেকের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
বিস্মিত কন্ঠে বললাম,
-রাজনের মা আমাকে আঘাত করতে যাবে কেন?
আমার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে সাদেকের খালা আমাকে খাট থেকে নামিয়ে, হাত ধরে হাঁটা শুরু করলেন। আমিও কিছু না বলে পিছু পিছু হাটছি।
তিনি আমাকে নিয়ে একটা রুমের জানালার পাশে দাঁড়ালেন। জানালে দিয়ে রুমের ভেতরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম খাটের কোণায়, ফ্লোরে বসে আছেন একজন মধ্যবয়সী মহিলা। আস্তে আস্তে কি কি যেন বিড়বিড় করছেন।
চুল গুলো উসকোখুসকো। পড়নের কাপড়েরও ঠিক নেই। তাকে দেখে আমি বললাম,
-কে ইনি?
-ইনিই হচ্ছে রাজনের মা। মানসিক ভাবে অসুস্থ সে।
মাঝে মাঝে খুব শান্ত, আবার মাঝে মাঝে খুব উগ্র আচরণ করে। বিশেষ করে অপরিচিত কাউকে দেখলে তার সমস্যাটা ভয়ংকর হয়ে ওঠে।
অপরজনকে আঘাত করার জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠে। যেমনটা তোমার সাথে হয়েছিলো।
-তাহলে সেদিন আমি যার চিৎকার শুনেছিলাম তিনি রাজনের মা ছিলেন?
সাদেকের খালা হ্যাসুচক মাথা নাড়ান।
আমি আবারও প্রশ্ন করি,
-কিন্তু এমন হওয়ার কারণ কি?
আমার প্রশ্নের উত্তরে পেছন থেকে রাজন বলে,
-আমার বাবা একজন সাইনটিস্ট।
মা মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়ার কিছুদিন আগে,মানে প্রায় বছর খানেক আগের কথা, এক প্রকারের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। ডাক্তারের চিকিৎসা নিয়েও কোনো ফলাফল পাওয়া যায় না। অতঃপর বাবা দিনরাত এক করে, অনেক পরিশ্রম কর, মা’র জন্য ভাইরাস বিরোধী একটা ভেকসিন তৈরি করে।
ভেকসিন তৈরির কাজ শেষে, বাবা আত্মবিশ্বাস নিয়ে কার্যকারিতা অন্যভাবে পরীক্ষা না করে আমাকে না জানিয়ে, মায়ের শরীরে পুষ করেন।
ভেকসিনে মা সুস্থ হয়ে যায় ২-১ দিনের মধ্যেই।
কিন্তু ফর্মুলা বেশি প্রয়োগ করায় ধীরে ধীরে মা’র ব্রেইন ইফেক্টেড হয়।
শুরু হয় তার উগ্র আচরণ। এমনকি আমাকে, বাবাকে, আশেপাশের সবকিছু ভুলে যান মাঝে মাঝে। রাত বেরাতে হঠাৎ হঠাৎ পাগলের মতো আচরণ করা শুরু করেন।
তখন থেকেই মা’র এই অবস্থা।
এখন তোমার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, আমি মা’কে এখানে কেন রেখেছি।
তার কারণ হলো, বাবা।
তিনি চান না মা’কে আমি এভাবে নিজেদের মাঝে রাখি। সে আবার বিয়ে করেছেন, সংসারে ঝামেলা কে টানবে বলো।
সে চায় মা’কে মানসিক হসপিটালে ভর্তি করা হোক। কিন্তু আমার দ্বারা এটা সম্ভব না।
তাই মাকে লুকিয়ে এখানে রেখেছি। এখানেই মা’র চিকিৎসা চলছে। সারাক্ষণ খালা মা’র খেয়াল রাখেন।
আমি সবার সামনে মা’কে আনতে চাই না কারণ, আমি চাই না কেউ আমার মা’কে পাগল বলুক।
বিশ্বাস করো তুবা আমার মা, পাগল না।
মাঝে মাঝে একটু বাচ্চাদের মতো করেন,মাঝে মাঝে একটু রাগারাগি করে, অপরিচিতদের দেখলে একটু আক্রমনাত্মক হয়ে উঠলেও আমি ঠিক সামলাতে পারি। তু ডাক্তার বলেছেন মা সুস্থ হয়ে যাবেন।
কথাগুলো বলছে আর রাজনের দুচোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে।
রাজনের জন্য আমার মায়া লাগছে খুব। ছেলেটা কতো কষ্ট নিয়েও বিন্দাস ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সত্যি মানুষের উপর দেখে কখনোই ভেতরটা বোঝা যায় না। হাজারও হাসির মাঝে চাপা পড়ে থাকে অপ্রকাশিত অনেক কষ্ট। মানুষ নিজের সাথে করে যায় প্রতিনিয়ত সুখী থাকার অভিনয়।
এভাবেই বাঁচতে হয়, এভাবেই জীবন চলছে, আগামীতেও চলবে।
.
.
.
দুপুর ১ টা বাজে।
এতক্ষণ আমি রাজনের মা’র সাথে সময় কাটিয়েছি। প্রথম প্রথম আমাকে দেখে একটু রিয়্যাক্ট করলেও পরবর্তীতে মিশে গেছে আমার সাথে।
এদিকে সময় হয়ে যাওয়ায়
একটা পেইন কিলার খেয়ে আমি রাজনের সাথে বের হই, নীলিনাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে।
.
.

দুজনে মিলে দূর থেকে ফাহিমকে অনুসরণ করে চলেছি টানা দুই ঘন্টা ।
কিন্তু তার মাঝে সন্দেহজনক কোনোকিছুই আমরা দেখতে পাইনি।
বিরক্ত হয়ে একটা গাছের শেকড়ে বসে পড়ি আমি। রাজন আমাকে বলে,
-আজ তিনদিন ধরে আমি ফাহিমকে অনুসরণ করছি, কিন্তু নীলিমা রিলেটেড কোনো তথ্যই আমি পাইনি, শুধু একটা বিষয় আমার খটকা লাগছে, সেটা হলো, ও একটা রেস্তোরা থেকে প্রতিদিন দু’জনের খাবার পার্সেল নেয়।
আমি যতদূর জানি, ও ফ্যামিলির সাথে থাকে।
এমনকি ওর বাবা একজন পুলিশ কমিশনার, বেশ বিত্তশালী লোক। বাসায় কাজের লোকেরও অভাব নেই। তাহলে ফাহিমের রেস্তোরাঁ থেকে প্রতিদিন খাবার নেওয়ার দরকার পড়ে কেন? আমি ওকে খাবার নেওয়ার সময় অনুসরণও করেছি কিন্তু কোনো না কোনো কারণে ফাহিমের গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি। আমার মনে হয়, আমাদের অন্য পথ অবলম্বন করতে হবে।
রাজনের কথায় আমি বেশ আশার আলো দেখতে পাই। আমি মনে হয় এমন একটা কথাই শুনতে পাচ্ছিলাম।
সারাদিন দু’জনের পেটে একটা দানাও পড়েনি।
ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। আমি রাজনের দিকে তাকিয়ে একটা মৃদু হাসি দিলাম।
রাজন বুঝে গেলো আমাদের কি করতে হবে।
আমরা দু’জন চলে গেলাম সেই রেস্তোরাঁয়। যেখান থেকে ফাহিম প্রতিদিন খাবার নেয়।
দু’জনে লাঞ্চ সেরে ফেললাম।
ওয়েটারকে ডেকে রাজন লুকিয়ে ওর হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলো।
তারপর ফোন থেকেl ফাহিমের ছবি বের করে ওয়েটারকে দেখিয়ে চাপাস্বরে বললো,
-এই ছেলেটাকে চিনিস?
ওয়েটার বললো,
-জ্বী স্যার। এই স্যার আমাদের রেগুলার কাস্টমার।
কিন্তু কেন স্যার?
-আমি হলাম পুলিশের লোক। এই ছেলেটার সম্পর্কে আমার বিস্তারিত জানা দরকার। কখন আসে, কার সাথে আসে, কোথায় যায়, সবকিছু আমাকে জানাবে। যদি জানাতে পারো আরও টাকা দেবো।
ওয়েটার রাজনের দিকে তাকিয়ে বলে,
-পুলিশ হয়ে ঘুষ দিচ্ছেন স্যার?
ছেলেটার কথায় আমি হেঁসে ফেলি, রাজন আমার দিকে একটু চোখ গরম করে তাকায়।
এমন প্রশ্নে রাজনও থতমত খেয়ে গেছে।
সে নিজের কন্ঠে গম্ভীরতা এনে বলে,
-যা বলছি তাই করো। আর এটা ঘুষ না, এটা তোমার বখশিশ।
ওয়েটার জ্বী স্যার বলে টাকাটা নিয়ে চলে যায়।
ছেলেটা যেতেই আমি অট্টহাসিতে হেঁসে উঠি।
হাসতে হাসতে হঠাৎ রাজনের দিকে চোখ চলে যায় আমার। রাজন পলকহীনভাবে, একধ্যানে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি একটু লজ্জা পেয়ে মাথানিচু করে ফেলি।
.
.
.
হোটেল থেকে বের হয়ে আমি আর রাজন একটু ঘোরাঘুরি করি। রাজনের সাথে সময় কাটাতে আমার খুব ভালো লাগছে। আমি বুঝতে পারছি রাজনের প্রতি আমার একটা সফট কর্ণার তৈরি হয়েছে। জন্ম নিয়েছে আলাদা এক মায়া, হয়ত এটাই ভালোবাসার মায়া।
বিকাল ৫ টার দিকে আমি বাসায় ফিরে আসি।
বাসায় ফিরে মা’র অনেক বকা খেতে হয়েছে।
বকা খাবোই বা না কেন!
একেতো অসুস্থ অবস্থায় না বলে বের হয়েছি, তার উপর আবার সারাদিন ফোন অফ ছিলো।
তাই বকা খাওয়া আমার উপর ফরজ হয়ে গেছিলো।
তবুও কলেজের কথা বলে মা’কে ম্যানেজ করে নিয়েছি।
.
.
.
.
আমি প্রেমে পড়েছি।
গভীর প্রেমে পড়েছি। এই ভালোবাসার উৎস হচ্ছে রাজন। আজ বাসায় ফিরেছি ধরে রাজনের কথা এক সেকেন্ডের জন্যও ভুলিনি। এইযে এখনো রাজনের শার্টটা হাতে নিয়ে বসে আছি,তবে আমি জানি, রাজন আমাকে ভালোবাসে না।
ও এখনো নীলিমাকে ভালোবাসে।
রাজনকে নিয়ে আমি কল্পনার জগত সাজাচ্ছিলাম।
আমার কল্পনায় ছেদ পড়ে একটা ফোন কলে।
অচেনা নাম্বার আমি সচরাচর রিসিভ করি না।
কিন্তু দুইবার কল দেওয়ায় কলটা রিসিভ করে সালাম দিলাম।
ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে একটা মেয়ের কন্ঠ।
কন্ঠ শুনে আমার চোখ থেকে পানি চলে আসে,আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলি,
-নীলিমা তুই! এতোদিন কই ছিলি বোন?
কেমন আছিস তুই। জানিস, আমি তোকে হন্যে হয়ে খুঁজেছি।
-আমি ভালো আছি। কিন্তু তুই মনে হয় চাস না আমি ভালো থাকি।
-এমন কথা কেন বলছিস নীলিমা?
-ঠিকই বলছি, তুই যদি আমার ভালো চাইতি, তাহলে আমি ভালো আছি শুনলেই খুশি হতি, আমাকে খুঁজতে গিয়ে আমার সমস্যা করতি না।
তোর ভালোর জন্য বলছি, আমার কথা তোরা ভুলে যা। আমার কাউকে দরকার নেই।
এই কথাগুলো মা বাবাকে বলে দিস।

কথাগুলো বলে নীলিমা ফোনটা কেটে দিলো।
আমাকে কিছু বলার সুযোগও দিলো না। কল কেটে দেওয়ার পরে আমি বেশ কয়েকবার কল দিলাম কিন্তু নাম্বারটা বন্ধ।
আবারও কল দিতে যাবো, তখন রাজনের নাম্বার থেকে কল আসলো। আমি রিসিভ করে বললাম,
-রাজন নীলিমার খবর জানতে পেরেছি।
-আমি রাজন না, আমি সাদেক।
রাজন এখন হসপিটালে আছে, আমার বাসা থেকে একটু দূরে একটা গাছের নিচে পাওয়া গেছে ওকে।
কেউ ওকে পিটিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখেছিলো, এমনকি বাইকটাও ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।
সাদেকের কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।
মাথার ভেতরে চক্কর দিয়ে উঠলো। এখন রাত ১০ টা বাজে, এই সময়ে এমন একটা সংবাদ শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
.
.
.
চলবে….
– তুবা বিনতে রউফ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে