শেষ পরিণতি পর্ব-০৭

0
985

#শেষ_পরিণতি পর্ব ৭
___________________
আবারও কল দিতে যাবো, তখন রাজনের নাম্বার থেকে কল আসলো। আমি রিসিভ করে বললাম,
-রাজন নীলিমার খবর জানতে পেরেছি।
-আমি রাজন না, আমি সাদেক।
রাজন এখন হসপিটালে আছে, আমার বাসা থেকে একটু দূরে একটা গাছের নিচে পাওয়া গেছে ওকে।
কেউ ওকে পিটিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখেছিলো, এমনকি বাইকটাও ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।
সাদেকের কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।
মাথার ভেতরে চক্কর দিয়ে উঠলো। এখন রাত ১০ টা বাজে, এই সময়ে এমন একটা সংবাদ শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
আমি রুমের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত বার বার পায়চারি করছি। কোনোকিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না। চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে।
৫ মিনিট পর পর সাদেককে কল দিচ্ছি।
কয়েকবার কল দিতেই ফোনের ব্যালেন্স ও শেষ হলে গেলো। কি করবো আমি বুঝতে পারছিলাম না।
মাথায় এই মুহূর্তে আমার রাজ্যের দুশ্চিন্তা।
কল দিয়ে নীলিমার এভাবে কথা বলা,
রাজনের উপর হামলা হওয়া, সবকিছুই এলোমেলো করে দিচ্ছে আমাকে।
রাতে আমার রুমে মা বাবা কেউ আসে না।
লুকিয়ে বের হলে হতেও পারি, কিন্তু এতো রাতে কাজটা করা মোটেও ঠিক হবে না।
এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে আমার।
ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদি।
আমি ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে অনেকক্ষণ ভিজলাম।
মন খুলে কাঁদলাম।
.
.
.
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আমি ফোন হাতে নিয়ে চাচা চাচির কাছে গেলাম।
নীলিমার জন্য সবাই অনেক দুশ্চিন্তা করছে।
আমার জানানো উচিৎ নীলিমা ভালো আছে।
নীলিমাদের বাসায় ঢুকে আমি সোজা চাচার কাছে চলে যাই।
চাচাকে নীলিমার ফোন করা বিষয়ে সবকিছু বলি।
এবং কল রেকর্ড থেকে নীলিমার বলা সবকথা শুনাই।
চাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাইনিং রুমের দিকে চলে যান।
চাচি যেভাবে বসে ছিলো সেভাবেই বসে থাকেন।
চাচিকে দেখে মনে হচ্ছে জীবন্ত পাথর।
অতি শোকে মানুষ পাথর হয়ে যায়।
নীলিমার উপর আমারও অভিমান জমেছে খুব।
যারা ছোট থেকে আদরে আদরে এতো বড় করলো, এখন বলছে তাদের কাউকে তার চাই না!
সামনে পেলে একটা থাপ্পড় দিতাম ওকে।
কিছুক্ষণ চাচিকে বুঝিয়ে আমি আমার রুমে চলে আসি।
বুকের মধ্যে যন্ত্রণা দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু সময়ের কাছে অসহায় আমি। এসময়ে চাইলেও রাজনকে দেখতে যাওয়া সম্ভব না।
অগত্যা বালিশে মাথা দিয়ে রাজনের কথা ভাবতে লাগলাম।
.
.
.
সকাল সকাল মা কে কোচিংয়ের জরুরি ক্লাসের কথা বলে বেরিয়ে গেলাম।
মা কে আজকাল অনেক মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে।
কি আর করার! সত্যি বললে মা কখনোই আমাকে বের হতে দিতো না।
প্রেমে পড়লে মানুষ মিথ্যাবাদী হয়ে যায়।
তখন কারণে অকারণে মিথ্যা বলতে শুরু করে পরিবারের সাথে।
যেমনটা আমি করছি।
.
.
আমি রাস্তায় কোথাও দেরি না করে রিকশা নিয়ে সরাসরি হসপিটালে চলে যাই।
রাজনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।
ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে জানতে পারলাম,
“রাজনকে মারাত্মকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে।
শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেটে গেছে। সবকিছু জেনে মনে হচ্ছে রাজনের উপর ৩-৪ জন মিলে হামলা করেছে। ”
সাদেকের থেকে জানতে পারি, রাজনের উপর এভাবে আক্রমণ করার মতো কোনো শত্রু নেই।
রাজনের শত্রুই নেই। থাকারও কথা নয়।
রাজন অমায়িক একজন মানুষ। তার সবখানে শুধু বন্ধু ছড়িয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এমন একটা মানুষের উপর প্রাণঘাতী আক্রমণ কে করতে পারে সেটা আমাকে খুঁজে বের করতে হবে।
তবে আপাতত আমার বড় কাজ হচ্ছে রাজনের মায়ের কাছে যাওয়া।
সাদেকের খালা ও সাদেক দু’জনই রাজনের কাছে আছেন।
আমি তাদের বলে হাসপাতাল থেকে বের হতে যাবো তখনই সেখানে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করেন রাজনের বাবা।
মুখে ছোট ছোট চাপদাড়ি, পড়নে স্যুট কোট, ফর্সা গায়ের রঙ নিয়ে, উচ্চতায় লম্বা এই ভদ্রলোকটি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তার মুখে বিষন্নতার ছাপ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ছেলের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনায় তিনি যথেষ্ট মর্মাহত।
আংকেলকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি আস্তে করে সালাম দিলাম। তিনি সালামের উত্তর না দিয়েই জিজ্ঞেস করলেন,
-কে তুমি? তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না।
আমি কিছু বলার আগেই খালা বললেন,
-ও রাজনের বন্ধু। রাজনকে দেখতে এসেছিলো।
আংকেল এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
-আমার ছেলের এই অবস্থা আর আমাকে এখন জানালেন আপনারা?
-রাতে অনেকবার কল করেছি কিন্তু আপনার ফোন বন্ধ ছিলো।
সাদেকের কথায় কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলোনা আংকেলের উপর।
তিনি ধীরে ধীরে গিয়ে রাজনের পাশে গিয়ে বসলেন।
দু’চোখের কোণায় চকচক করছে পানি।
আমি আর সেখানে সময় নষ্ট করলাম না।
হসপিটাল থেকে চলে গেলাম সাদেকের বাসায়।
.
.
.
.
আন্টির সাথে বসে অনেকক্ষণ সময় কাটালাম।
নুডলস রান্না করে খাওয়ালাম।
একসাথে খেলাধুলা করলাম।
এসবের মাঝে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে।
হঠাৎ সাদেকের বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো।
আমি এগিয়ে দরজা খুলে দিতেই খালা প্রবেশ করলেন ভেতরে।
-আপনার এখন রাজনের কাছে উচিৎ ছিলো খালা। এদিকটা তো আমিও সামলাতে পারতাম।
আমার কথার প্রতিত্তোরে খালা বলেন,
– রাজনের বাবা আর সৎমা আছে ওর কাছে।
আমাকে বললো তারা সবটা সামলাতে পারবে তাই চলে এলাম।
রাজন আমার কাছে নিজের সন্তানের মতো। কিন্তু তাই বলে তার জন্মদাতার কথার উপর কথা বলার অধিকার তো নেই।
ছেলেটার জীবনে অনেক কষ্ট জানো।
ওর মতো একটা ভালো ছেলের সাথে কেন যে বার বার এমন হয় বুঝি না।
খালার কথাগুলো আমাকে অনেক ইমোশনাল করে দিলো।
রাজনের প্রতি মায়া জন্ম নিচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে।
রাজনকে আমি হারাতে চাই না।
রাজন আমার ভালো থাকার চাবি। আর ওকে যে এতোটা যন্ত্রণা দিয়েছে তাকে আমার খুঁজে বের করতেই হবে।
মনে মনে কথাগুলো বলে, খালার থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
সাদেককে কল করে সেই জায়গাটার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিলাম, যেখানে রাজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।
অতঃপর সেখানে গিয়ে চারপাশ ভালোভাবে দেখতে লাগলাম। মনে হচ্ছে হয়তো কোনো ক্লু পেলে পেতেও পারি।
আমার আরও মনে হচ্ছে, রাজনের সাথে এমন হওয়ার পেছনে হাত আছে ফাহিমের।
এর প্রধান কারণ হলো, একটা মানুষের উপর প্রাণঘাতী আক্রমণ হলো,ওই অবস্থায় গ্রামের লোক রাজনকে পেলো কিন্তু পুলিশ এলোনা তদন্ত করতে! বিষয়টা কি সত্যিই অস্বাভাবিক লাগছে না।
তবে যাই হোক বা যে-ই হোক উপযুক্ত কোনো প্রমাণ নিয়ে হাজির হলে তারা অপরাধীকে গ্রেফতার করতে বাধ্য।
আমি মন দিয়ে চারপাশ খতিয়ে খতিয়ে দেখতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও কিছু পেলাম না ।
গাছটার বিপরীতে দোতালা একটা বাড়ি দেখতে পাচ্ছি।
আমি হেঁটে বাড়িটার গেটে সামনে এসে খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। বাড়িটার গেটের ভেতর পাশে,রাস্তার দিক করে একটা সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে।
কিন্তু একজনের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ অন্য কাউকে কেউ কেন দেখাবে?
কিছুক্ষণ এ বিষয়ে ভাবতেই,সিসি ফুটেজ পাওয়ার একটা চমৎকার বুদ্ধি মাথায় এলো।
বাসার দারোয়ান একজন যুবক। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এনে দেওয়ার সম্পর্কে ওর জ্ঞান থাকার কথা।
আমি আর না ভেবে দরোয়ানের কাছে গিয়ে হাতে ১০০০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিলাম।
তাকে কি করতে হবে সেটাও বললাম।
দারোয়ান শুরুতে আমতা আমতা করলেও পরে ফুটেজ এনে দিতে রাজি হলো।
.
.
১ ঘন্টা পর দারোয়ান হাসিমুখে ফিরে এলো।
আমি সিসি ফুটেজ প্লে করে শকুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
ফুটেজ দেখে তেমন কোনো লাভ হয়নি।
রাজনকে আক্রমণ করা প্রতিটি মানুষের মুখ কালো রুমালে বাঁধা ছিলো।
তবুও যতটুকু পেয়েছি তাই অনেক।
আমি দারোয়ানকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবারে সেই ঘটনাস্থলে যাই।
সৌভাগ্যবশত এবারে আমি বিশেষ একটা ক্লু পেয়ে যাই।
গাছের একটা চিকন শেকড়ের কাছে একটা লকেট চকচক করতে দেখলাম।
লকেটটা দেখে তার মালিককে চিনতে আমার একটুও সময় লাগলো না।
আমি সাদেককে কল করে কোনকিছু না ভেবেই থানায় চলে যাই।
থানায় গিয়ে ফাহিমের বন্ধুদের নামে এটেম্পট টু মার্ডার কেস করি।
লকেটটা আমি ভালোভাবে চিনি।
এটা ফাহিমের বন্ধু সোহেলের।
ও সমসময়ই এটা পরে থাকতো।
হয়তো ঝামেলার সময় ধস্তাধস্তির কারণে লকেটটা ছিড়ে পড়ে গেছে।
.
.
.
.
.
এরপর দশদিন কেটে যায় ।
রাজন এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। সাদেকের সাথে কথা বলল জানতে পেরেছি। কিন্তু পাহাড়সম ঝামেলার মধ্যে আছি আমি ও আমার পরিবার।
সেদিন ফাহিমের বন্ধুদের নামে কেস করার পরে, সবাইকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
কিন্তু বাবার ক্ষমতার দাপটে ফাহিম সবাইকে ২ ঘন্টার মধ্যেই ছাড়িয়ে নেয়।
এরপর থেকে লম্পটগুলো আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
কলেজে গেলো তাদের থেকে অনেক ধরনের হ্যারেসমেন্টের শিকার হতে হয় আমার।
রাস্তাঘাটে মানুষদের সামনে আমাকে বাজে মন্তব্য করা, প্রতিবাদ করলে রেপ করার হুমকি দেয়, এসবের মাঝে চলছিলো।
রীতিমতো মা বাবাকেও হুমকি দেওয়া শুরু করে তারা। সবকিছু মিলিয়ে আমি ডিপ্রেশনে চলে যাই
মা আমাকে কিছুদিনের জন্য কলেজে যেতে নিষেধ করেন।
সত্যি বলতে, ওদের এমন অসভ্যতা ও দাম্পট দেখে আমিও কিছুটা ভয় পেয়ে যাই।
তাই বাড়াবাড়ি না করে মা’র কথা শুনে বাসাতেই থাকি সারাক্ষণ। তবে রাজনের জন্য কষ্ট হচ্ছিল খুব।
ওর কথা ভেবে ভেবেই সময় কেটে যেত আমার।
সবসময় মনমরা হয়ে থাকতাম বাসায়।
.
.
আজ বিকালের কথা।
মা হন্তদন্ত হয়ে আমার রুমে ঢুকলেন।
-আলমারি থেকে ভালো একটা শাড়ি বের করে বললেন একটু পড়তো মা।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
-এমন অবেলায় শাড়ি পড়বো কেন?
আমার প্রশ্নের উত্তরে মা বললেন,
-তুই পড় আগে, সময় হলে সবটা জানতে পারবি।
কথাটা বলে রুম থেকে চলে গেলেন।
বাইরে অনেক মানুষের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
তার ভেতরের একটা পরিচিত কন্ঠ শুনে আমি কেঁপে উঠলাম।
রাজনের কন্ঠ আমার খুব চেনা। কিন্তু রাজন এখানে কি করছে?
মনে প্রশ্ন জেগে উঠলো।
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ডাইনিং রুমের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো আমার।
আমি দেখলাম, রাজন এবং রাজনের বাবা, সৎমা ও সাদেক বসে আছেন সোফায়।
হঠাৎ এভাবে স্ব-পরিবারে রাজনকে আমাদের বাসায় আসার কোনো কারণ পেলাম না।
আমি একধ্যানে তাকিয়ে আছি রাজনের দিকে।
সাদা শার্টে অনেক মানিয়েছে ওকে।
রাজনের দিকে তাকিয়ে থাকার এক পর্যায়ে রাজনেরও চোখ পড়ে আমার দিকে।
দু’জনের চোখাচোখি হতেই রাজন আমাকে চোখ মেরে দেয়।
আমি এমন অপ্রস্তুতকর পরিস্থিতির জন্য রেডি ছিলাম না। আমি বেশ লজ্জা পেয়ে দরজার কাছ থেকে সরে এলাম।
.
.
.
চলবে
– তুবা বিনতে রউফ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে