শেষ পরিণতি পর্ব-০৪

0
1066

#শেষ_পরিণতি পর্ব ৪
____________________
কলেজের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আমি বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। কলেজের মাঠে একটা বেঞ্চিতে, বন্ধুদের সাথে বসে আছে ফাহিম!
আমার এতক্ষণ ধারণা ছিলো, নীলিমা হয়ত ফাহিমের সাথে পালিয়েছে, কিন্তু না!
যদি তাই হতো তাহলে ফাহিমের এখন কলেজে থাকার কথা নয়। নীলিমা তাহলে গেলো কোথায়?
কোনো বিপদে পড়েনি তো?
দুশ্চিন্তায় কাঁপতে শুরু করেছি আমি।
কলেজে না ঢুকে, ফাহিমের একটা ছবি তুলে আমি বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
পথিমধ্যে কোথাও আর থামিনি। খুব দ্রুত বাসায় পৌঁছে গেলাম।
আমি বাসায় গিয়ে আগে চাচার কাছে গেলাম।
চাচা তখন জানালার পাশে বসে ছিলেন।
চাচার সামনে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে বললাম,
-চাচা নীলিমা ফাহিমের সাথে পালায়নি।
চাচা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-ফাহিমের সাথে পালায়নি এটা তুই কিভাবে বলছিস?
-আজ কলেজে গিয়ে ফাহিমকে দেখেছি। প্রতিদিনের মতোই সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছে। যদি ও নীলিমাকে নিয়ে পালাতো তাহলে আজ ওর কলেজে থাকার কথা না।
আমি ওর ছবি তুলে নিয়ে এসেছি।
আমি ফোনটা এগিয়ে দিলাম চাচার দিকে।
ছবিটা দেখে চাচার কপাল থেকে দরদর করে ঘাম ছুটছে।
হঠাৎ করে চাচা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলেন। হাত থেকে ফোনটা পরে গেলো ফ্লোরে।
আমি চাচার এই অবস্থা দেখে অনেকটা ঘাবড়ে গেলাম।
চাচিকে কয়েকবার ডাক দিয়ে চাচার হাত পায়ের তালু ঘষতে লাগলাম।
প্রেসার উঠেছে চাচার। সবাই অনেক ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।
হৈচৈ শুনে মা বাবাও চলে এলেন।
আমাকে দেখে অবাক হয়ে মা বললেন,
-তুই না কলেজে গিয়েছিলি!
তাহলে এখানে করিস।
আমি কিছু বললাম না।
চাচা একটু স্বাভাবিক হলে চাচি ও আমাকে ডেকে আড়ালে নিয়ে গেলেন।
-তোদের মধ্যে কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল?
চাচিকে আমি সব খুলে বললাম।
আমার কথা শুনে চাচি কাঁদতে শুরু করলো।
“আমার মেয়েটার কোনো বিপদ হয়েছে কি না কে জানে। আল্লাহ তুমি আমার মেয়েটাকে রক্ষা করো” কতগুলো বলছে আর চিৎকার করে কাঁদছে চাচি।
আমার চোখ থেকেও অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। নীলিমা এমনিতে যতো অহংকারীই হোক না কেন। সে আমার বোন ও ভালো বান্ধবী ছিলো।
আমার সাথে ও কখনোই খারাপ ব্যাবহার করেনি।
বরং একসাথে আনন্দ ও খুনসুটিতে কেটেছে আমাদের শৈশব।
যে করেই হোক নীলিমার খবর আমার জানতেই হবে।
কেমন আছে, কোথায় আছে, কিভাবে আছে, সবকিছু না জানা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।
আমি বাসা থেকে বের হয়ে আবার কলেজের দিকে হাঁটছি।
ফাহিমের সাথে আমার কথা বলতে হবে।
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ফাহিমের সাথে কথা বললে অনেক কিছু জানতে পারবো।
আমি যতদূর জানি, ফাহিম আর নীলিমার সম্পর্কটা বন্ধুত্বের ছিলো না।
ওরা একে অপরকে ভালোবাসতো। যদি তাই হয় আর নীলিমা যদি ফাহিমের সাথে না পালিয়ে অন্য কারও সাথে যায়,তাহলে ফাহিমের এতোটা স্বাভাবিক থাকার কথা না।
আবার যদি ফাহিমের সাথেও পালায় তাহলে তার এখন কলেজে উপস্থিত থাকার কথা না।
কি হচ্ছে, কি ঘটেছে বুঝে ওঠা মুশকিল।
.
.
আমি কলেজে চলে এলাম কিন্তু ফাহিমকে পেলাম না। সবার কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম ফাহিম নাকি আজ ক্লাস না করেই চলে গেছে।
মন খারাপ করে আমি কলেজ থেকে বের হয়ে কলেজের ক্যান্টিনে বসে আছি।
নীলিমার খোঁজ কিভাবে পাবো বুঝে আসছে না।
উদাস হয়ে বসে আছি ঠিক তখনই উদাসীনতা ভেদ করলো একটা ফোন কলে।
ফোন বের করে দেখলাম মা কল করেছে।
রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মা’র কন্ঠ ভেসে এলো,
– না বলে কোথায় চলে গেলি হুট করে?
জানিস না বাড়ির কি অবস্থা! তাড়াতাড়ি বাড়িতে আয়। তোর চাচা থানায় যাচ্ছে মিসিং কেস করতে, তোর চাচিও কেঁদে কেঁদে অস্থির।
আমি আসছি বলে ফোনটা কেটে দিলাম।
ফাহিমের উপর আমার কড়া নজর রাখতে হবে।
মনে মনে ঠিক করে নিলাম, কাল থেকে ফাহিমকে আমি ফলো করবো। তবে একা ব্যাপারটা অনেক রিস্ক হয়ে যায়, ভালো হতো যদি সঙ্গে কাউকে পাওয়া যেতো।
কিন্তু এমন কে আছে, যে আমাকে এই বিষয়ে সাহায্য করতে পারে!
একটু ভাবতেই মাথায় একটা নাম এলো,
“রাজন”
সে নীলিমাকে এখনো খুব ভালোবাসে, সবকিছু শুনে মনে হয় না সে আমাকে হেল্প না করে থাকতে পারবে। কিন্তু রাজনকে আমি পাবো কোথায়?
তার ফোন নাম্বারও নেই আমার কাছে।
তবে হ্যা, রাজনের এক বন্ধুর বাসা আমাদের বাসার পাশেই। নাম সাদেক হবে হয়ত।ওর কাছে রাজনের খোঁজ পাওয়া যাবে৷
নীলিমাকে প্রথম যেদিন রাজন প্রপোজ করেছিলো, তখন তাকে দেখেছিলাম।
আমি আর কিছু না ভেবে ওর বাসার দিকে রওনা দিলাম।
.
.
.
আমি সাদেকের বাসায় গিয়ে কয়েকবার কলিংবেল প্রেস করতেই দরজা খুলে দিলেন একজন মধ্যবয়সী মহিলা। সাদেকের মা হবে হয়তো।
আমি তাকে সালাম দিয়ে সাদেকের কথা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমাকে বসতে বলে, ভেতরে চলে গেলেন।
ডাইনিং রুমে বসে অপেক্ষা করছি সাদেকের।
হঠাৎ আমি চমকে উঠলাম একটা ভয়ংকর চিৎকারে। কোনো মেয়ের কন্ঠ হবে।
আবারও চমকে উঠলাম বাসার ভেতরে কারো আছড়ে পরার শব্দে।
হয়ত এপাশে আসতে চাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই কেউ জোর জবরদস্তি করে ভেতরে নিয়ে গেছে, ধস্তাধস্তির শব্দে সেটা স্পষ্ট।
আমার খুব ভয় লাগলো।
আমি সাদেকের জন্য অপেক্ষা না করেই, কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।
তাড়াহুড়ো করে বের হয়েছি।
বের হওয়ার সময় একটা চলন্ত বাইকের সাথে ধাক্কা লাগে আমার। হুমড়ি খেয়ে পরে যাই।
প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছি পায়ে।
পিচের রাস্তায় পরে গিয়ে কনুই অনেকখানি কেটে গেছে। পিঠের কাছ থেকে জামাও ছিড়ে গেছে কিছুটা। ব্যাথায় চিৎাকার করে কান্নাও করতে পারছি না। চোখ থেকে পানি পড়ছে অনবরত । রাস্তাটা একটু নিরিবিলি।
মানুষজনের চলাচল মেইন রাস্তার তুলনায় খুবই কম।
নয়ত এতক্ষণে লোকজন জমা হয়ে হুলুস্থুল কান্ড বাধিয়ে দিতো।
আমি কনুই চেপে ধরে ওঠার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পায়ে মারাত্মক ব্যথা পাওয়ার উঠতে পারল না।
বাইক থেকে নেমে ছেলেটা তার গেঞ্জির উপরে পরিহিত শার্টটা খুলে আমাকে দিলো।
ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলাম -রাজন।
রাজনকে দেখে সব ব্যথা উবে গেলো।
একদম পারফেক্ট সময়ে রাজনের দেখা মিলেছে আমার।
আমি খুশি হয়ে বললাম,
-রাজন ভাইয়া আপনি!
আমি এতক্ষণ আপনাকেই খুঁজছিলাম।
আপনাকে আমার খুবই দরকার।
রাজন আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
-প্রয়োজন পরে আগে তোমার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
হাত থেকে রক্ত পরছে অনেক, আর এতো অমনোযোগী হয়ে হাঁটছিলে কেন?
হর্ণ দিয়েছি সেটাও তুমি শোনোনি।
আমি সত্যিই বাইকের হর্ণের শব্দ শুনতে পাইনি।
সাদেকের বাসার ওই ঘটনা টা মনে এতোটা ভয়ের সৃষ্টি করেছিলো যে আশেপাশের সবকিছু থেকে অজ্ঞাত হয়ে গিয়েছিলাম।
রাজনের শার্টটা আমি ভালোভাবে জড়িয়ে নিলাম।
একটা রিকশা দাঁড় করিয়ে রাজন আমাকে টেনে তুললো রিকশায়।
পা অনেক ফুলে গেছে। পায়ে ভার দেওয়া অসম্ভব।
মনে মনে অনেক ভয় হচ্ছে।
এই অবস্থায় বাসায় গেলে মা আমাকে আস্ত রাখবে না।
কিভাবে কি হলো, কোথায় গিয়েছিলাম হাজারটা প্রশ্নের সাথে বকা ফ্রী।
কিছুক্ষণ বকাঝকার পরে শুরু হবে কান্না।
.
.
.
কনুইতে তিনটা সেলাই লেগেছে আমার।
সেলাই শেষে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন ডাক্তার।
কপালে ও পিঠে হালকা আঘাত পেয়েছি, সেখানেও ক্লিন করে দিয়েছে।
পায়ের জন্য দুইটা ইনজেকশন দিতে হয়েছে, আর কিছু ঔষধ লিখে দিয়েছেন।
এক মুহূর্তে কিভাবে কি হয়ে গেলো বুঝলাম না।
এই সময়ে যদি আমার বাসায় বসে থাকতে হয় তাহলে সেটা মোটেও ঠিক কাজ হবে না।

হসপিটালের কাজ শেষে রাজন আমাকে রিকশায় উঠিয়ে দিলো। এরমাঝে অনেকবার তাকে নীলিমার কথাগুলো বলতে চেয়েছি কিন্তু রাজন শোনেনি। অবশ্য রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে তার নাম্বার আমাকে দিয়ে দিয়েছে, বলেছে বাসায় গিয়ে রেস্ট নেওয়ার পরে কল দিতে।
আমিও আর আপত্তি করিনি।
রিকশা ছুটে চলেছে বাসার দিকে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখি মা ১০ বার কল করেছে।
এভাবে কি করে বাসায় যাবো বুঝতে পারছি না।
ভয়ে একদম চুপসে গেলাম আমি।
.
.
.
চলবে..
লেখিকা- তুবা বিনতে রউফ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে