শেষ পরিণতি পর্ব-০৩

0
1166

#শেষ_পরিণতি
পর্ব ৩

কি হয়েছে মা ডাকছো কেন?
এই একটা দিনই তো সকালে ঘুমানোর সুযোগ হয়।
-বাড়িতে মস্ত বড় ঝামেলা বেঁধে গেছে, আর তুই আছিস ঘুম নিয়ে।
তাড়াতাড়ি ওঠ।
মায়ের কথা শুনে নিমিষেই ঘুম চলে গেল।বাহির থেকে অনেক শোরগোলও কানে এলো।
আমি শোয়া থেকে উঠে বললাম,
-ঝামেলা হয়েছে মানে?
কিসের ঝামেলা! আর বাইরে এতো হৈচৈ কেন?
-আরে নীলিমা ভোরবেলা বাসা থেকে পালিয়ে গেছে। তোর কাকার আলমারি থেকে টাকা ও অনেক গয়নাও নিয়ে গেছে। বাইরে আয়, তোর বাবা ও কাকা তোর সাথে কিছু কথা বলতে চায়।
মা’র কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম।
নীলিমা পালিয়ে গেছে মানে!
আমি ঠিক শুনছি নাকি বুঝতে কোনো ভুল হয়েছে
তাড়াতাড়ি উঠে আমি ওয়াশরুমে গিয়ে কোনোরকম ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে চলে যাই।
সেখানে নীলিমার মা বাবা, বড় বোন ছোট ভাই,ফুপু, দাদাভাই আমার বাবা সবাই বসে আছেন।
সবার মুখটা ভার হয়ে আছে। তাদের সামনে বসতে আমার খুব ভয় করছিলো। নীলিমার বাবা, মানে আমার চাচাকে আমি খুব ভয় পাই। সরকারি স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন তিনি। স্কুলের সবাই তাকে খুব ভয় পেতো। প্রচন্ড রাগী এবং গম্ভীর স্বভাবের মানুষ । যদিও এখন অবসর নিয়েছেন কিন্তু তার পারসোনালিটি এখনও সেই আগের মতোই আছে।
আমার সাথে চাচার খুব কম কথা হতো। চাচা সবার সাথেই কম কথা বলেন। চাচা যখনই কথা বলতো, শুধু পড়াশোনার ব্যাপারে কথা বলতো। সেই চাচার আজকের এমন রাগান্বিত চেহারা দেখে ঘাবড়ানোটাই স্বাভাবিক।
আমার মনে হচ্ছিল হয়ত বড় কোনো অপরাধ করে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছি।
সবার নজর তখন আমার দিকে। কেমন যেন নীলিমা পালিয়েছে নীলিমা না, পালায়নি। পালিয়েছি আমি।
রীতিমতো আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করে।
তবুও নিজেকে শান্ত রেখে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
ডাইনিং রুমে তখনও নিরবতা বিরাজ করছে।
নিরবতা ভেঙে চাচা বললেন,
-সামনের চেয়ারটাতে বস।
আমি চেয়ারটা টেনে বসলাম।
কপাল থেকে দরদর করে ঘাম ছুটছে।
চাচা গম্ভীর গলায় বললেন,
– কিছু প্রশ্ন করবো ঠিক ঠিক জবাব দিবি।
মিথ্যা বলার চেষ্টা করবি না, আমি মিথ্যা একদম পছন্দ করি না।
আমি অস্ফুট স্বরে বলি,
-জ্বী আচ্ছা।
-নীলিমা কোনো ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলো তুই সেটা জানতি?
-আমাকে ও এই সম্পর্কে কিছুই বলতো না।
-একসাথে চলাফেরা করতি, অথচ এই ব্যাপারে কিছুই যে জানতি না সেটা তো না।
যা যা জানা আছে তোর, সবকিছু খুলে বল আমাদের।
আমি একটু ঢোক গিলে সাহস জুগিয়ে বলতে শুরু করলাম,
-নীলিমা আমাকে সত্যিই এই বিষয়ে কিছু বলতো না।
তবে কলেজে বেশ কিছুদিন ধরে পুলিশ কমিশনারের ছেলে, ফাহিমের সাথে ওকে বেশ ঘনিষ্ঠ হতে দেখেছি। কিন্তু বিষয়টা ও আমার থেকে আড়াল করতে চাইতো, এমনকি আমি জিজ্ঞেস ও করেছি কয়েকবার, নীলিমা এড়িয়ে গেছে। ও আমাকে এই ব্যাপার থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছে বুঝতে পেরে আমি আর মাথা ঘামাইনি।
আপনারা সবাই হয়ত ভাবছেন আমি ওকে পালাতে সাহায্য করেছি, কিন্তু না। আমিও আপনাদের মতো মাত্রই জানলাম।

আমার কথা সবাই কতোটা বিশ্বাস করলো আমি জানিনা। সবাই আবারও চুপচাপ হয়ে আছে।
হঠাৎ সবার মাঝ থেকে ফুপু বলে উঠলেন,
-কাউকে না জানালেও নীলিমার ভাইয়ের কাছে তো জানাতে পারতি।
এমন একটা বিষয় এভাবে এড়িয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হয়েছে তোর?
-ফুপু, ওদের মধ্যে সম্পর্কটা কি আমি সেটাও জানতাম না। হতেও পারতো ওদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের ছিলো।
ফুপু আর কিছু বললেন না। আবার পাশ থেকে নীলিমার মা বলে উঠলেন,
-ছেলেটার স্বভাব চরিত্র কেমন?
ফাহিমকে ব্যাক্তিগতভাবে আমার একদমই পছন্দ না। কিন্তু নিজের অভিমত লুকিয়ে বললাম,
-“ভালোই”
এবার পাশ থেকে প্রশ্ন করলো আমার মা,
-ছেলেটা কি করে?
ওপাশ থেকে নীলিমার বোন প্রশ্ন করলো,
-ছেলেটা কি করে?
চারপাশের হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমার মাথা গুলিয়ে গেলো।
তখনই চাচা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
-থামো সবাই। তুবা তুই রুমে যা।
তবে শোন, নীলিমা যদি তোকে কল দেয়, আমাকে জানাবি।
আমি হ্যাসূচক মাথা নেড়ে, রুমে চলে এলাম।
.
.
.
খুব তাড়াতাড়ি ঘটনাটা পুরো এলাকায় ছড়িয়ে গেলো।
দলে দলে মানুষ আসা শুরু করলো বাসায়। এক একজনের এক এক ধরনের মন্তব্য।
চাচার প্রেসার বেড়ে গেছে অনেক।
আমি আমার রুমের জানালার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে আছি।
মা আমাকে একটা বাটিতে নুডলস দিয়ে গেলো।
যাওয়ার সময় চোখ বড় বড় করে রাগান্বিত কন্ঠে আমাকে বললেন,
-এতো আদর ভালোবাসা দিয়ে লাভ কি?
সেই তো আমাদের মুখে চুনকালি মাখিয়ে পরের ছেলের সাথে ভেগে যাবি।
মা, বাবার সম্মান কিছু না। পরের ছেলেই সব।
পুলিশ কমিশনারের ছেলের সাথে পালাইছে।
এখনও তো থানা পুলিশে দৌড়িয়েও কোনো লাভ নেই। একা একা কথাগুলো বলতে বলতে মা চলে গেলেন।
আমি হতবাক হয়ে গেলাম মা’র কথায়।
দোষ করেছে একজন, আর সবার কথা শুনতে হচ্ছে আমার! এ কেমন বিচার!

এসবের মাঝেই কেটে গেলো ছুটির দিন।
পরদিন কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমি।
যেতে যেতে মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেল।
পথটা আজ অনেক দীর্ঘ মনে হচ্ছে। যখন নীলিমা ছিলো তখন কথায় কথায় মুহূর্তেই কলেজে চলে যেতাম। নিজেকে খুব একা লাগছে।
মনে মনে নীলিমার উপর অনেক অভিমান করলাম।
ও কেন করলো এমন?
ফাহিমের কথা বাসায় একবার জানাতে তো পারতো।
কাউকে না হোক অন্তত আমাকে তো বলতে পারতো।
কোথায় আছে, কেমন আছে, কে জানে!
চোখের কোণা থেকে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
নীলিমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
আচমকা আমার সব চিন্তায় ছেদ পড়লো একটা বাইকের শব্দে।
পেছন ফিরে দেখি রাজন দাঁড়িয়ে আছে।
রাজনকে দেখে আজ আগের মতো আনন্দ হলো না।
তাকে দেখে চোখের পানি মুছে,জোর করে একটু মুচকি হাসলাম।
-নীলিমার ব্যাপার নিয়ে মন খারাপ?
রাজনের প্রশ্ন শুনে একটুও অবাক হলাম না আমি।
নীলিমার পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা পুরো এলাকার মানুষ জানে। সেখানে রাজনের জানাটা কোনো ব্যাপারই না।
চাপা কন্ঠে উত্তর দিলাম,
-না, তেমন কিছু না।
রাজন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-আমার কিন্তু খুব মন খারাপ।
কাল সারারাত আমি কেঁদেছি। চিৎকার করে কেঁদেছি। যে আমাকে অপমান ছাড়া কিছুই দেয়নি, তার জন্য কেন এতো কেঁদেছি জানি না।
হয়ত এটাই ভালোবাসা।
ভালোবাসার মানুষ অন্য কারও অধিকার হয়ে গেছে এটা মেনে নেওয়া সহজ কথা নয়।
তবুও চেষ্টায় আছি। সবচেয়ে বড় সত্যি কি জানো?
সবচেয়ে বড় সত্যি হলো “বাস্তব ”
চাইলেও এটাকে অস্বীকার করা যায় না। আমার যদি ক্ষমতা থাকতো, আমি নীলিমাকে সবচেয়ে কুৎসিত করে দিয়ে নিজের মন কোটরে পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখতাম।
কিন্তু সেটা অসম্ভব।
কথাগুলো বলার সময় রাজনের চোখ ভিজে গেলো।
আমি জানতাম, ছেলেরা তেমন কাঁদে না। তারা নিশ্চুপভাবে কষ্টকে বরণ করে নেয়।
কিন্তু রাজনের বেলায় একদম তার বিপরীত।
তার তো কথা বলার আগেই চোখ ভরে ওঠে পানিতে। তবুও ভালো, নিজের মাঝে কষ্ট চেপে রেখে কি লাভ!
ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে রাজনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,
-আপনিও তো নীলিমার রূপ দেখেই প্রেমে পড়েছিলেন তাই না?
আমার কথার প্রতিত্তোরে রাজন বললো,
-হ্যা। আমি নীলিমার রূপ দেখে প্রেমে পড়েছিলাম, কিন্তু পরবর্তীতে সেটা শুধু রূপের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো না।
আমি কিছু না বলে কলেজের পথে পা বাড়াই।
রাজন বাইক নিয়ে আবারও আমার পাশে এসে থামে।
-আমার খুব খারাপ লাগছে, যদি কিছু মনে না করো আমার সাথে এক কাপ চা খাবে?
আসলে মনের কথাগুলো বলার মতো একজন মানুষ পাচ্ছিলাম না।
আমি খেয়াল করলাম রাজন আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে। কালকেও সে আমাকে আপনি আপনি করে কথা বলেছে। হয়ত ও বন্ধুত্ব করতে চাচ্ছে।
কেন যেন ভালো লাগলো খুব।
তবুও ভালো লাগাকে ইগনোর করে বললাম,
-সিচুয়েশনটা এখন চা খাওয়ার মতো নেই।
নীলিমার ঘটনা নিয়ে এলাকার মানুষ নানান কথা বলছে, এখন আপনার সাথে আমাকে দেখতে আরও গুজব রটাবে।
পরিবেশটা ঠিক হোক, অন্য একদিন খাবো।
রাজন আমার কথায় সম্মতি দিয়ে চলে গেলো।
আমিও কলেজে চলে এলাম।
কলেজের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আমি বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। কলেজের মাঠে একটা বেঞ্চিতে, বন্ধুদের সাথে বসে আছে ফাহিম!
আমার এতক্ষণ ধারণা ছিলো, নীলিমা হয়ত ফাহিমের সাথে পালিয়েছে, কিন্তু না!
যদি তাই হতো তাহলে ফাহিমের এখন কলেজে থাকার কথা নয়।
তবে নীলিমা তাহলে গেলো কোথায়?
কোনো বিপদে পড়েনি তো?
দুশ্চিন্তায় কাঁপতে শুরু করেছি আমি।
কলেজে না ঢুকে, ফাহিমের একটা ছবি তুলে আমি বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
.
.
.
চলবে
– তুবা বিনতে রউফ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে