শর্ত পর্ব-০৭

0
429

#শর্ত
#লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:০৭

আজ শিশিরকে রিলিজ দেয়া হবে।অনেকদিনই তো কাটলো এই হাসপাতালের বেডে। শিশির এবার বাড়ি ফিরতে চায়।শিশিরের হাতের প্লাস্টার খোলা হচ্ছে আপাতত। রাত সায়ানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ডাক্তার শিশিরের হাতটা নাড়িয়ে দিয়ে বললো,

-“নাউ ফিল বেটার?”

শিশির চোখটা একবার বন্ধ করে ভ্রু কুঁচকালো।রাত ভয় নিয়ে তাকিয়ে আছে।শিশির চোখটা খুলে মুচকি হেসে বললো,

-“ঠিক আছে।বাট হাতটা নাড়াতে একটু কষ্ট হচ্ছে।”

ডাক্তার শিশিরের হাতটা সুন্দর করে শিশিরের কোলে রেখে বললেন,

-“কিছুদিন তো এমন হবেই।হাতটাকে রেস্টে রাখতে হবে।ভারী কাজ একদমই না। আর হাত নাড়াতে পারবেন। তবে কম। নাড়িয়ে নাড়িয়ে প্রেকটিস তো করতে হবে।”

-“জ্বী।”(মুচকি হেসে)

ডাক্তার এবার রাতকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-” ভাবী,শিশিরের সাথে কিন্তু পরিচয় আছে আগেরও। ঘরেরই মানুষ।”

রাত হেসে সায় দিয়ে বললো,

-“বাসায় আসবেন অবশ্যই ভাইয়া।”

-“হ্যা অবশ্যই ভাবী।এখন আপনার কাছে অনুরোধ হলো শিশিরের ভালো করে খেয়াল রাখবেন। ও কিন্তু একদমই বেখেয়ালে চলাফেরা করে। হাতটা আপাতত নাড়াবে কম।পা টা ঠিক হতে আরো ১৫-২০ দিনের মত লাগবে। সেদিকে একটু খেয়াল রাখবেন।বেশি যেন আবার না হাঁটতে চায়।আর কপালের ঘা তো শুকিয়েই গেছে।”

এভাবেই আরো বিভিন্ন কথা ডাক্তার রাতকে বলতে লাগলেন। রাত মনোযোগ সহকারে শুনে মাথা নাড়াচ্ছে।শিশির সেদিক পানে তাকিয়ে আছে। ইদানিং রাতের প্রতি বড্ড মায়া জন্মেছে তার।রাতের চোখগুলো বেশ মায়া লাগায় তাকে। রাতের কথা বলার স্টাইল, মজা করা সবকিছুতে কেমন অভ্যস্থ হচ্ছে শিশির।রাতের আচমকা কথা বলায় ধ্যান ভাঙে শিশিরের। রাত শিয়িরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলছে,

-“রেডি তো?”

-“কেন?”(অবাক হয়ে)

-“বাসায় যাওয়ার জন্য সাহেব।”

শিশিরকে খুব সাবধানে গাড়িতে তুলে দেয়া হয়।রাত সায়ানকে কোলে নিয়ে শিশিরের পাশে বসলো। সায়ান বাবাকে দূর থেকে দেখে হাসছে আর আদো আদো বুলি ছড়াচ্ছে।শিশির মুচকি হেসে সায়ানের কপালে চুমু খেয়ে বললো,

-” বাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট করে সবার আগে সায়ানকে কোলে নিবো। কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে। কতদিন ওকে কোলে নিই না।”

রাত মুচকি হেসে বললো,

-“আমি সাহায্য করব নে। ওকে কোলে নিতে।”

শিশির রাতের গাল টেনে দিয়ে বাহিরের দিকে তাকালো। গাড়ি চলছে। রাত সায়ানের সাথে বিভিন্ন মুখের ভঙ্গিমা করে সায়ানকে হাসাচ্ছে।শিশির সেদিকপানে তাকিয়ে রাতের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো।চমকে উঠলো রাত। শিশিরের দিকে তাকিয়ে বললো,

-” স্যাররর!”

শিশির চুপ করে আছে।বোঝানোর চেষ্টা করছে যে ও ঘুমাচ্ছে। রাত আবার ডাকলো,

-“ও স্যার।”

এবারো শিশির চুপ। রাত আর ডাকলো না। সায়ানকে নিয়ে মেতে উঠলো। এদিকে রাতের কাঁধে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে শায়িত হয়ে আছে।শিশির। বড্ড বেশি ভালো লাগছে তার। মন্দ হত না যদি সময়টা এখানেই থেমে যেত।

___

বাসায় আসতেই চৈতী বেগমের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো। ছেলে এতদিন পর বাড়িতে পা রাখলো। ওনার তো তোড়জোড় হবেই।শিশিরকে সুন্দর করে বেডে শুইয়ে দিতেই চৈতী বেগম রুমে ঢুকলেন। রাত তখন ঘুমন্ত সায়ানকে শিশিরের পাশে শোয়াচ্ছিল। চৈতী বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-“এখন কেমন লাগছে আব্বু?”

-“ভালো।”

-“যাক। তোর জন্যে ভালো কিছু রান্না করি।ডায়েট চার্ট দেখেই করব। চিন্তা করিস না।”

রাত হঠাৎ বলে উঠলো,

-“আন্টি আমি ওনার জন্যে পানির জগটা ভরে আনছি। আপনি এদিকেই থাকুন।”

চৈতী বেগম সম্মতি দিলেন। রাত চলে গেলো। চৈতী বেগম শিশিরের মাথার কাছে বসে বললেন,

-“এই ১ মাসে কি বুঝলি? ”

-“কিসের আম্মু?”

-“এইযে তোদের বিয়ের তো ১ মাস হতে চলল।”

-“ওহ হুম।”

-“রাত নিতান্তই ভালো একটা মেয়ে।”

-“আমি জানি সেটা মা।”

-“পারলে ওই পারবে সংসারটাকে আগলাতে।একটু ভেবে দেখিস।”

বলেই থামলেন চৈতী বেগম। শিশির মায়ের হাত ধরে বলতে লাগলো,

-“এক্সিডেন্ট করা গাড়িতে ঝুমকা আর চুড়ি পাইছিলা?”

চৈতী বেগম কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর মাথা নাড়িয়ে বললেন,

-“হ্যা হ্যা। ওগুলো তো আমার কাছেই।রাতকে দিতে হবে।”

শিশির যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সে তো ভেবেছিলো এগুলো হয়ত রাতই পেয়েছে। যাক! রাত পায়নি। শিশির তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো,

-” মা ওগুলো তোমার ওয়াড্রবে একটু লুকিয়ে রাখবে?”

-“লুকিয়ে কেন?”(ভ্রু কুচকে)

-“এমনি।তুমি রাখো তো। আর রাতকে ভুলেও বলো না।”

চৈতী বেগম হেসে বললেন,

-“সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছিস?”

-“সুস্থ হই।”(মুচকি হেসে)

-“বেশ!”

বলেই চৈতী বেগম নিজের রুমের দিকে চললেন। রাতও ফিরে এলো।চৈতী বেগমকে বের হতে দেখে বলে উঠলো,

-“আন্টি রান্নাটা কি আপনি করবেন?”

চৈতী বেগম রাতের গালে হাত রেখে বললো,

-“বিয়ের এতদিন পরেও আন্টি? ”

রাত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর মুচকি হেসে বললো,

-“যেদিন পুরোপুরি শিশির চৌধুরীর বউ হতে পারব,যেদিন উনি আমায় পূর্ণ স্বীকৃতি দিবেন সেদিন আর এই মিষ্টি করে আন্টি ডাকব না। সোহাগ করে আম্মু ডাকব।”

চৈতী বেগম হেসে উঠলেন। কথাগুলো কানে যায় শিশিরের।বিরবির করে বলে উঠে,

-“পিচ্চি মেয়ে এতকিছু বুঝে কিভাবে?”

চৈতী বেগম রাতের গাল টেনে দিয়ে চলে গেলেন। রাত এসে পানির জগটা শিশিরের বেডসাইড টেবিলে রাখলো। তারপর শিশিরের পাশে বসে ওর মাথায় হাত দিয়ে বললো,

-“জ্বর আছে নাকি দেখতে হবে।”

-“জ্বর নাই পিচ্চি।”

বলেই শিশির রাতের গাল টেনে দিলো। এবার রাত ফুঁসে উঠলো। দাঁড়িয়ে পায়চারী করতে করতে বললো,

-“আমার গালগুলো কি আটার রুটি পাইছেন হু? ”

-“কেন?”(চোখ বড় বড় করে)

-” যখন যে যেমন মন চায় শুধু গালই টানবেন হুহ!”

বলেই রাত আবারো ফুঁসতে লাগলো।শিশির হাসতে হাসতে বললো,

-“পিচ্চিদের গাল বেশি নরম হয়।”

-“এই আমি পিচ্চি না।কত কষ্ট করে ডাভ সাবান লাগিয়ে লাগিয়ে গালগুলোকে সফট করেছি।”

শিশির হাসছে রাতের কাহিনী দেখে। রাত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গাল দেখছে আর বলছে,

-“আহারে বেচারা গালগুলো লাল টকটকে হয়ে গেছে। ”

বলেই সে আবারো শিশিরের দিকে তেড়ে এসে বললো,

-“ফার্দার আমার গালে হাত দিবেন তো…”

বলতে বলতে শিশির আবার রাতের গাল টেনে দিলো। রাতের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।শিশির তখনো হাসছে। আর বলছে,

-“তোমার এই কুটুসকুটুস গালগুলো না ধরে থাকতেই পারব না আমি।”

রাত চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বিছানায় বসে পড়লো।শিশির রাতকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“আপনি কি আর কলেজ যাবেন না জনাবা?”

রাত শিশিরের দিকে এমনভাবে তাকালো যেন ও কিছু বুঝেই না।পৃথিবীর সব ওর অচেনা।শিশির রাতের এমন তাকানো দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

-“এভাবে তাকাচ্ছো যে? পড়াশোনা কি করবে না? সামনে এইচএসসির টেস্ট।”

রাত মুখ ভেংচি কেটে বললো,

-“হুহ। আমি এসব পড়াশোনার মধ্যে নাই।”

-” কি বললে তুমি?”

-” তো!আমার বিয়ে হয়ে গেছে স্যার।এখন আবার কিসের পড়াশোনা। ”

-“দেখো!একদম এসব বাজে কথা বলবা না। আমি কি বউকে অশিক্ষিত রাখব নাকি?”

-“এই আমি কি অশিক্ষিত নাকি?”

-“হ্যা। পুরো পড়াশোনা শেষ না করে চাকরী না করা অবধি আপনি অশিক্ষিত। ”

শিশির ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে কথাগুলো বললো।।রাত নাক ফুলিয়ে বললো,

-“এত পড়াশোনা করে কি হবে? আর সায়ান তো আমাকে ছাড়া থাকতেই পারবে না।”

শিশির ঠান্ডা গলায় বললো,

-“যতদিন আমি আছি ততদিন অন্তত কলেজের ক্লাসগুলো এটেন্ড করো।আমি সায়ানকে দেখে রাখতে পারব।”

-” এহ একদম না। নিজেই অসুস্থ। আপনাকে কে দেখে রাখবে হুম?”

-“মা আছে তো।”

-“হয়েছে পরেরটা পরে দেখা যাবে।”

বলেই রাত উঠে দাঁড়ালো।শিশির রাতকে উদ্দেশ্য করে রাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

-“তুমি না গেলে কিন্তু আমি তোমায় ঠেলে পাঠাব। চিনো না আমায়!”

-“উফ যাবোনে। নিন এবার রেডি হোন।গোসলের জন্যে। ”

-“মানেহ।”(অবাক হয়ে)

-“আরে গোসল করবেন না নাকি?”

-“আমি করব।বাট তুমি কেন কাপড় নিয়ে ঢুকছো।”

রাত বিরক্ত হয়ে বললো,

-“অসহ্যকর লোক তো।চলুন। আমি না গেলে পড়ে টড়ে আরেক কাহিনী করবেন।”

-“একদম না।”

বলেই শিশির দাঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। রাত শিশিরকে এক পাশ থেকে ধরে বললো,

-“আমিই গোসল করাব। চলুন।”

শিশির ইতস্ততভাবে বললো,

-“ধূর।আমি করতে পারব তো।”

-“আপনি মেয়েদের মত সরম পাইয়েন না তো।”

বলেই রাত শিশিরকে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। শিশির আর কি বলবে?তার তো কিছু বলারই নাই।রাত যা শুরু করলো!

______

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মিতালি।হাতে কফির কাপ।দৃষ্টি বাহিরে।কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় মত্ত সে।হঠাৎই পিছন থেকে কেউ বলে উঠলো,

-“কি ভাবছো মিতালি?”

মিতালি পিছনে না ফিরেই গম্ভীর গলায় বললো,

-“রাত কিভাবে আমার সংসার ভাঙলো সেটা।”

নুশান মিতালির সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো,

-” মানে?”

মিতালি চাপা রাগ নিয়ে বললো,

-“মানে বুঝতে পারছো না তুমি? রাত আমার সংসার ভেঙেছে।”

-“এনাফ মিতালি। কিসের তোমার সংসার। তোমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। তুমি এখন আমার ওয়াইফ। আর আমাদের মধ্যে কেউ নাই।”

মিতালি নুশানকে ধাক্কা দিয়ে বললো,

-” না না না। শিশির শুধু মাত্র আমার। শুধু আমার।”

নুশান এবার রেগেই গেল। তেতে উঠে বললো,

-“এই কি হয়েছে তোর!১৩ দিনের বাচ্চাটা রেখে আমার কাছে আসার সময় তোর এসব মনে ছিল না তাই না?”

-“এসেছি তো। আমি এখন ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি আবার ফিরে যেতে চাই।কিন্তু রাতের জন্যে!! ”

বলতে দেরী নুশানের চড় মারতে দেরী হলো না। নুশান মিতালিকে চড় দিয়ে বললো,

-“সবটা এত সহজ না বুঝছিস!আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। আর কিসের ভুল বুঝতে পেরেছিস তুই? নাকি শরীরের খি*দে মিটে গেছে! ”

মিতালি গালে হাত দিয়ে বললো,

-“শিশির আমাকে কখনো মারেনি নুশান।কিন্তু তুমি!”

নুশান আরেকটা চড় মেরে বললো,

-“শিশির এখন পরপুরুষ। ওর নাম মুখে আনতে লজ্জা করে না?”

-” না করে না। আমি ফিরবো আবার ওর কাছে। আর ও রাতের জন্যে এমন করছে।নয়ত আমি যত ভুলই করি না কেন শিশির ঠিকই আমাকে মেনে নিবে।”

বলেই মিতালি খিলখিল করে হাসতে লাগলো। নুশান ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর মিতালিকে জোর করে বুকে নিয়ে বললো,

-“পাগলামি করো না মিতালি। কি সমস্যা কি তোমার!তুমি চলে এসেছো।এখন ওদেরকে ওদের মত থাকতে দাও।”

মিতালি নুশানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন বললো,

-“কখনো না। শিশির এত সহজে আমাকে ভুলে গেল? ওকে আমি কিছুতেই সুখে থাকতে দিবো না।”(শয়তানী হেসে)

চলবে….

(ভুলক্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। একটা সুন্দর মন্তব্য উপহার দিয়েন☺️💌)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে