শর্ত পর্ব-২১

0
438

#শর্ত
#লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:২১

টিপটিপ করে চোখ খুলে নিজেকে বেডে শোয়া অবস্থায় পেলো রাত।চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে পেলো শিশির আর চৈতী বেগমকে। দুজনই চিন্তিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।পাশেই কেয়া আর রিসাব।দরজার বাহির থেকে কোলাহলের শব্দ আসছে।অর্থাৎ বাহিরেও কিছু মানুষ রয়েছে। রাতের পাশেই একজন ডাক্তার।রাত অসুস্থ গলায় বললো,

-“আমি এখানে?”

শিশির মুখটা ঘুরিয়ে বললো,

-“হাসপাতালের বেডে আশা করেছিলে?”

রাত অবাক হয়ে তাকালো শিয়িরের দিকে।চৈতী বেগম ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টায় বললেন,

-“উফফ শিশির!ও অসুস্থ। এক্ষুণি তোর বকতে হবে?”

-“তো কি করব মা?ও নিজের খেয়াল রাখে আদৌ?ছুটোছুটি সারাদিন।খাওয়া-দাওয়ার ঠিক-ঠিকানা নাই। এখন যে বারংবার মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাচ্ছে।

চৈতী বেগম কিছু বলতে যাবেন তার আগেই রাতের পাশে বসা ডাক্তার মহিলাটি হেসে বলতে লাগলেন,

-“শিশির চৌধুরী, এটা তো আরো খুশির খবর।”

শিশিরের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো।অবাক হয়ে তার প্রশ্ন,

-“মানে?”

-“আরে এই মাথা ঘুরা তো সেই ঘুরা নয় শিশির চৌধুরী।মোট কথা হলো আপনি আবারো বাবা হতে চলেছেন।”

রাত অবাকের শীর্ষে।মুখে হাত তার।শিশির বেশ খুশি হলো।কিন্তু সেও অবাক কম হয়নি।রাতের পাশে বসতে বসতে বললো,

-“কিন্তু এটা কি করে সম্ভব ডক্টর?”

চৈতী বেগম খুশি হলেন বেশ।কিন্তু হঠাৎ শিশিরের কথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন। কেয়া তো বেশ খুশি। রাতের হাত ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলছে,

-“ভাইয়া তো প্রশ্ন রাখ তো!আমাদের বাসায় আবারো ছোট্ট একজন আসতে চলেছে ভাবী। আমার যে কত্ত আনন্দ হচ্ছে।”

রিসাব এসে রাতকে কনগ্রেস জানায়। তারপর কেয়ার কানে কানে বলতে লাগে,

-“এবার আমাদের পালা।”

-“সবে তো বিয়ে হলো মশাই।”

রিসাব হেসে ফেললো। এদিকে শিশির রাতের হাত ধরে বলতে লাগে,

-“ডক্টর?রাতের কোনো রিস্ক নেই তো?”

ডাক্তার হাসিমুখে বললেন,

-“একদমই না।কিসের রিস্ক।আল্লাহ চাইলে আর নিজের খেয়াল রাখলে সুস্থ একটা বাচ্চা হবে ইনশাআল্লাহ! ”

শিশির আর কোনো প্রশ্ন করলো না।তার আর কিচ্ছু জানবার নেই।তার রাত সুস্থ থাকলেই হয়।কিন্তু রাতের মনের প্রশ্ন তো সরেনি।রাত ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“কিন্তু আপু আমরা তো অন্যকিছু জানতাম।”

-“কি জানতে?”(অবাক হয়ে)

রাত চারিদিকে তাকিয়ে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতেই আস্তে আস্তে সবাই বেরিয়ে গেলো।শুধু শিশির গেলো না।শিশির যে রাতের স্বামী!রাত এবার বলতে লাগে,

-“আমার ভীষণ পেট ব্যাথা করত মাসের ওই সময়টায়।তাই জন্যে ডাক্তারের কাছে যাই।কিন্তু যেদিন আমার শিশিরের সাথে বিয়ে হবে ওইদিনের তিনদিন আগে আম্মু রিপোর্ট আনে কারণ আমি কলেজে ছিলাম।সেদিন জানতে পারি যে আমি কখনো মা হতে পারবো না।”

বলতে বলতে রাতের চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। ডাক্তার রাতকে জোর দিয়ে বললেন,

-“তেমন কিছুই না মিসেস চৌধুরী। হয়ত আপনার কনসিভ করতে সময় লাগবে এমন কিছু লেখা থাকতে পারে।কিন্তু মা হতে পারবেন না তেমন কিছুই না।”

রাত তো খুশিতে আত্মহারা।চোখের জল মুছতে মুছতে বললো,

-“সত্যি বলছেন!”

-“একদম!আর মিস্টার চৌধুরী? ”

শিশিরও চোখ মুছতে মুছতে বললো,

-“জ্বী?”

-“কালকে চেম্বারে আসবেন সময় করে।পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সব জানাবো।কিন্তু এটা সিউর থাকুন যে মা হতে পারবেন না এই কথাটা পুরোটাই ভুয়া।কারণ আমার তো ওনাকে সুস্থই লাগলো।”

-“জ্বী।আসুন এগিয়ে দি।”

বলতে বলতে শিশির ডাক্তারের সাথে বেরিয়ে যাচ্ছে।আর ডাক্তারও শিশিরকে বিভিন্ন উপদেশ দিচ্ছেন।রাত মনে মনে ভাবতে লাগলো,

-“তবে কি আম্মু আমায় ভুয়া রিপোর্ট দেখালো?কিন্তু কেন!!মা নিজের মেয়ের সাথে এমনটা কেন করবেন?”

ভাবতে ভাবতে রাত উঠতে নিলো। ঠিক তখনই সুপ হাতে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন চৈতী বেগম। রাতকে উঠতে দেখে বললেন,

-“শুয়ে থাক।উঠতে হবে না।”

-“আমার আম্মুর সাথে কথা বলতে হবে।”

-“তোর আম্মু শুয়ে পড়েছে রাত। ওনার বাতের ব্যাথা বেড়েছে। আর তোর যে এতকিছু হলো উনি টেরও পাননি। আমিই ডাকিনি। সারাদিন পর চোখটা লাগালেন।”

রাত আর উঠলো না।এই বিষয়ের জন্যে মা কে ঘুম থেকে তোলাটা ভালো দোখায় না।চৈতী বেগম রাতের দিকে সুপের বাটি এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-“তোর সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে।”

-“মানে!!”(অবাক হয়ে)

চৈতী বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।তারপর রাতের হাত ধরে বলতে লাগলেন,

-“তোর মা আমার কথায় তোকে মিথ্যা বলেছিল।”

বিস্ময়ে রাতের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।আস্তে আস্তে চৈতী বেগমের থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো।চৈতী বেগম রাতের পাশে বসে বলতে লাগলো,

-“হ্যা রাত।তোর বাবা-মাকে যখন বিয়ের প্রস্তাব দিই প্রথমে ওনারা রাজি হননি।কিন্তু শিশির আর সায়ানের কথা ভেবে রাজি হয়ে যান।তাছাড়া তোদের গ্রামের একটা বখাটে ছেলে নাকি তোর পিছু পড়েছিলো?তোর বাবা-মাকে অনেক ভয়ও দেখাচ্ছিল।তোকে বলেছে কিনা জানি না।তাই তোকে হারানোর ভয়ে তারা বিয়েতে রাজি হয়ে যান।তারপরও আমার মনে একটা খটকা থেকেই যায় যে রাত নিজে মা হলে যদি সায়ানকে ভুলে যায়?সেই ভয়ে আমি তোর মাকে মিথ্যা বলতে বলি।”

রাত মুখটা ঘুরিয়ে ফেললো। এতরাত কেঁদেছে একটা মিথ্যার জন্য!চৈতী বেগমকের একটা মিথ্যা রাতকে শত রাত্রি কান্না করিয়েছে।সে কথা রাত কি করে ভুলবে।সে নিম্ন স্বরে বললো,

-“তোমার থেকে এটা আশা করিনি মা।”

চৈতী বেগম এবার কেঁদেই ফেললেন। রাতের হাতটা আবারো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলতে লাগেন,

-“রাত তুই আমায় ভুল বুঝিস না। আমি সেই মুহূর্তে কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মিতালির এসবের জন্যে!আমি চেয়েছিলাম যেন সায়ান আর শিশির ভালো থাকে! ”

-“আর আমি?”(কান্নাজড়িত গলায়)

-“যেন তুইও ভালো থাকিস।”(গালে হাত দিয়ে)

-“না মা। তুমি আমার ভালোর কথা চিন্তা করলে এত বড় মিথ্যাটা বলতে না। আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি।”

-“আমাকে ক্ষমা করে দে রাত।আমি বুঝতে পারিনি তখন।আর আমি ভেবেছিলাম তুই হয়ত সায়ানের মধ্যেই নিজের সন্তানকে খুঁজে নিচ্ছিস।”

-“হ্যা নিয়েছি। আমি সায়ানের মধ্যেই নিজের সন্তানকে খুঁজে নিয়েছি।কিন্তু নিজে গর্ভে ৯ মাস রাখার পর জন্ম দেয়ার অধিকারটা অর্জন করতে পারিনি। সেই স্বাদ তো সব মা ই চায়। তুমি চাওনি?”

চৈতী বেগম মাথাটা নিচু করে ফেললেন।তার রাতকে বলা উচিত ছিলোরাত আবারো বলতে লাগে,

-“আমি মা হতে পারব,এটা জানার পরও আমি সায়ানকে মায়ের মতই ভালোবাসা দিতাম।যেদিন থেকে শিশিরের সাথে বিয়ে হয়েছে সেদিন থেকেই শিশিরকে স্বামী আর সায়ানকে নিজের সন্তান ভেবে এসেছি।পুরো সংসারটা সামলেছি।তারপরেও প্রতিদানে এটা পেলাম?”

-“আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে রে রাত। তোর কষ্টটা বুঝতে পারছি। পারলে ক্ষমা করে দিস।”

বলেই চৈতী বেগম দ্রুত পায়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। রাত কান্নায় ভেঙে পড়লো।নিজের মা-বাবা ও শ্বাশুড়ির এমন কাজে সে বেশ কষ্ট পেয়েছে।বেশকিছুক্ষণ পর রুমে ঢুকে শিশির।রাতকে এভাবে কাঁদতে দেখে শিশিরের তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।তাড়াহুড়া করে রাতের পাশে বসতে বসতে বললো,

-“কি হয়েছে রাত?কাঁদছো কেন বউ?”

-“শ..শিশির!”

বলেই রাত শিশিরের বুকে আছড়ে পড়লো।শিশির ভাবলো রাতের হয়ত এটা সুখের কান্না।মা হতে পারবে বলে।শিশির মুচকি হেসে বললো,

-“আর কেঁদো না রাত। এবার তো আমাদের সুখের সময়।”

রাত নিজেকে সামলে নিলো।নাক টেনে বললো,

-“আমি মা হতে পারব না। এই মিথ্যা কথাটা কে বলেছে জানো?”

রাত সব কথা শিশিরকে খুলে বললো।শিশির রাতের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

-“দেখ রাত! আমার মায়ের চিন্তা যেমন আমাকে আর সায়ানকে নিয়ে ঠিক তেমনই তোমার মা-বাবারও চিন্তা ছিলো তোমাকে নিয়ে।তাই ওনারাও না করতে পারেনি। আর মা ও #শর্ত দিয়ে দেয়।”

-“আমাদের পুরো বিয়েটাই আছে একটা #শর্ত এর উপর।”

-“না থাকলে কি আমাদের বিয়েটা হতো রাত?আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই তো করেন।”(মুচকি হেসে)

রাত এবার একটু শান্ত হলো।এতটাও রিয়াক্ট করা উচিত হয়নি।শিশির আবার বললো,

-“পিছনে যা হইছে সব বাদ। সবব বাদদ!একদম ভুলে যাও। ”

-“হুমম।”

-“সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমাদের একটা রাজকন্যার আগমন ঘটতে যাচ্ছে।”

রাত ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“রাজকন্যা কেন?রাজকুমারও তো হতে পারে!”

-“রাজকুমার তো আছেই।এবার একটা রাজকন্যার দরকার। একদম রাতের মত।”

বলেই সে রাতের গাল টেনে দিলো।রাত হেসে ফেললো।শিশির রাতের চোখ মুছে দিয়ে বললো,

-“নো কান্না।বাবা-মা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। বর্তমানই আসল। বর্তমানে আমরা সবাই সুখে আছি,আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালো আছি।এটাই অনেক।”(মুচকি হেসে)

রাত শিশিরের কাঁধে মাথা দিয়ে বললো,

-“হুমম।”

শিশির টি-টেবিলে থাকা সুপের বাটিটা দেখে বললো,

-“একি সুপটা খাওনি?নিশ্চয়ই মা এনেছিলো।”

-“হুমম।”

-“এখনো এসব করবে?ঠিকমত খাবে না?”

রাত ঠোঁট উল্টে ফেললো।শিশির রাতকে সুপটা খাওয়াচ্ছে যত্ন করে।রাত মনে মনে ভাবছে,

-“এমন বর আর কই পাব?শিশিরের মত মানুষ আসলেই অনেক কম সংখ্যক রয়েছে। ”

আচমকা রাত বলে উঠলো,

-“আমার ছেলে কই? কতক্ষণ ধরে দেখি না। খায়নি ও এখনো।”

শিশির রাতকে পানি খাওয়াতে খাওয়াতে বললো,

-“মা খাইয়ে দিয়েছে।ও রিসাব আর কেয়ার সাথে আছে।”

-“ওরা আমার অসুস্থতার জন্যে যেতে পারলো না।”

-“বিকালে যাবে।”

-“হু।”

ঠিক তখনই টুকটুক পায়ে ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো সায়ান।পিছনেই শিশিরের একটা কাজিন। সে রাতকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“ভাবী,দিয়ে গেলাম ওকে।”

রাত সায় দিলো। সায়ান কি সুন্দর দৌড়ে মায়ের কাছে চলে এলো। আস্তে আস্তে বিছানায় উঠে মায়ের পেটে উপর শুয়ে পড়লো।আর রাত মুচকি হেসে সায়ানের মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর বলছে,

-“বাবা,খেয়েছো তুমি?”

-“খেয়েছি।”

শিশির সায়ানকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“সায়ান,তুমি পেটে শুচ্ছো কেন আব্বু? এখানে তল তোমার ছোট্ট বনু আছে। সে কষ্ট পাবে না?”

সায়ান বেশ অবাক হলো।পেটের ভিতর যে তার ছেট্ট বনু থাকতে পারে এই কথাটা তার মাথায় ঢুকেনি বা কখনও মাথায় আসেওনি।সে তার বাবার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললো,

-“মিথ্যা বলছো কেন বাবাই।পেটের ভিতর কি বনু থাকে নাকি?”

রাত হাসছে।শিশির সায়ানকে কেলে নিতে নিতে বললো,

-“হ্যা আব্বু। এখানে তোমার ছোট্ট বনু আছে।সে আসবে,তুমি তার সাথে খেলবে।বোনকে দেখে রাখবে।”

-“কবে আসবে বাবাই। বলো না! বলো না।”

রাত এবার মুখ খুললো।হালকা হেসে বললো,

-“আসতে তো একটু সময় লাগবে।কিন্তু ততদিনে সায়ানকে ভালো হয়ে থাকতে হবে।গুড বয়ের মত। যেন বোনকে শিখাতে পারে।কোলে নিতে পারে।”

-“থাকব তো মাম।”

বলেই সায়ান তার বাবার কোল থেকে নেমে পড়লো।রাতের পেটে কান দিয়ে বললো,

-“বনু, তুমি শুনতে পারছো? তাড়াতাড়ি চলে আসো হুম? তোমাকে আমি চকলেট দিবো অনেকগুলা।”

রাত মুহূর্তটা অনুভব করছে। আর শিশির রাতকে ভরসা দিচ্ছে। মন্দ হতোনা যদি মুহূর্তটা এখানেই যেত।এত সুখ রাত কই রাখবে?

চলবে….

(ভুলক্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। একটা সুন্দর মন্তব্য উপহার দিয়েন☺️)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে