লাভ ফাইট পর্ব-০১

0
1729

#লাভ_ফাইট
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট১

দিনে বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপ করেছিলাম।অথচ কপাল দেখো!রাতেই হারাম*জাদাটাকে আমার বিয়ে কর‍তে হচ্ছে।ব্রেকাপের থেকেও দ্বিগুণ কষ্ট হচ্ছে আমার।কে বলেছিলো?কে বলেছিলো ছাগলটাকে গিফট ফেরত দিতে।দিবি তো দিবিই!মাঝরাতে কেন গিফট ফেরত দিবি?মন চাচ্ছে এখনই ছাগলটাকে মে*রে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিই।
এলাকার মুরব্বিদের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি আমি।পাশে আমার সদ্য এক্স বয়ফ্রেন্ড ফালাক।চেহারা দেখে মনে হবে ভাজা মাছ উলটে খেতে পারে না।অথচ ফালাকই সব নষ্টের গোড়া।

” ছি ছি ছি! ইকবাল সাহেবের মেয়ে এমন করবে আমরা কল্পনাও করি নাই কখনো!শেষমেশ রাত দুপুরে ছেলে মানুষ নিয়ে ন’ষ্টামি?কি যুগ আসলো।”

গণি চাচার কথা শুনে ইচ্ছা করছে কুয়ার মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে ম*রে যাই।বেটা তুই আগে পুরো ঘটনাটা জেনে নে ভালো করে!তা না,চোখের সামনে যা দেখেছে তাই নিয়েই লাফাচ্ছে।চোখ যে সব সময় সঠিক জিনিস দেখে এর কোনো নিশ্চয়তা আছে?

” তাহলে সিদ্ধান্ত কি নিলেন ভাইজান?”

মিথিলার বাবা গণি চাচাকে বলেন।এলাকার গুন্যমান্য ব্যক্তি গণি চাচা।কোনো গন্ডগোল হলেই সে তা মিটিয়ে দেন।বয়স বেশি হওয়ায় জ্ঞান অভিজ্ঞতা বেশি।তাই সবাই উনাকে শ্রদ্ধা করে চলেন।কিন্তু এই মুহুর্তে লোকটাকে আমার পৃথিবীর সবচে বুদ্ধিহীন প্রাণী মনে হচ্ছে।আমাকে বা ফালাককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ধমক দিয়ে আর এক গাদা কথা শুনিয়ে চুপ করে রাখলেন।গণি চাচা চশমাটা হাতে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,,,

” দেখো!দিন কাল ভালো না বেশি।তরুণ প্রজন্মটা ন *ষ্টামিতে ভরে গেছে।দোয়েলও হয়তো আবেগের বশে তাই ই করতে যাচ্ছিলো।আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন।ভাগ্যিস আমরা দেখে ফেলেছি।বড় ধরণের ক্ষতি হওয়ার আগেই আমার মনে হয় ওদের দুজনের বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত।আপনার মতামত কি ইকবাল সাহেব?”

“আপনারা যা ভালো বুঝেন তাই ই করেন।”

ক্ষীণ কন্ঠে বলে বাবা।বুঝতে বাকী রইলো না বাবা আমার দ্বারা মনক্ষুণ্ম হয়েছেন।

” আপনারা যা ভালো বুঝেন মানে?পুরো ঘটনাটা আপনারা কেউ জানেন?একপলক দেখে মনগড়া কাহিনি করে বিয়ে দিয়ে আমার জীবনটা নষ্টের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন!”

” দোয়েল..!”

হুংকার দিয়ে ওঠে বাবা।আমি বেশ চমকে যাই।আকষ্মিকতায় ভয় পেয়ে বাইরের মানুষ জনের সামনেই কেঁদে দিই।বাবা আমার সাথে কখনো উঁচু গলায় কথা বলেনি।অথচ আজ এই ছা*গল ফালাকের পাকনামির জন্য বাবা আমায় বাইরের মানুষের সামনে ধমক দিলেন।

” রায়হান!”

” জ্বী চাচা!”

” এত রাতে তো কাজী টাজি পাবে না।এক কাজ করো।তুমি মসজিদের ইমামকে ডেকে নিয়ে আসো।”

গণি চাচার কথা শুনে রায়হান ভাইয়া বেরিয়ে যায়।রায়হান ভাইয়া আমাদের প্রতিবেশি মিথিলার বড় ভাই।অর্থাৎ মানিক আংকেলের বড় ছেলে।টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে বর্তমানে বেকার জীবন পার করছেন।অবসর কাটাতে মেয়েদের পেছনে ঘোরেন।মানুষের কাছে শুনেছি চৈতি আপুর সাথে উনার সম্পর্ক আছে।যদিও আমি নিশ্চিত নই তাতে।তার যদি রিলেশন থেকে থাকে তাহলে কেন সে আবার মেয়েদের পেছনে ঘুরবে? বিভিন্ন আকার ইঙ্গিতেও বুঝিয়ে দিয়েছেন আমাকেও তার ভালো লাগে।যদিও আমি বুঝেও না বুঝার ভান করেছি।এলাকার ছেলে ছোকরারাই মুলত তার আসল ক্যারেক্টর সম্পর্কে অবগত আছে।কিন্তু মুরব্বিদের কাছে তিনি নেহাৎই ধোয়া তুলসি পাতা।

এবার এই ঘটনার সূত্রপাতে আসা যাক।বেশ কয়েকদিন ধরেই ফালাকের সাথে আমার ঝামেলা হচ্ছিলো।ঝামেলাটা মুলত ছিলো ফালাকের আমাকে দেওয়া অবহেলা নিয়ে।অনেকের কাছেই এটা স্বাভাবিক বিষয় হতে পারে।তবে আমার কাছে এটি শুধুই অবহেলা।কোনো দামি গিফট চাইনি আমি ফালাকের কাছ থেকে।চেয়েছি শুধু একটু সময়।যা ও আমায় দিতে পারেনি।মন খারাপের সময় পাইনি ওকে আমি।যার কারণে ওর প্রতি আমার মনে তীব্র রাগ, ঘৃণা সৃষ্টি হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টানা এগুলো নিয়েই আমাদের ঝগড়া হয়।পরে বিকালের দিকে অবশেষে আমরা সম্পর্কের ইতি টানি। প্রথম প্রেম।অনেকটাই ইমোশন ছিলো সম্পর্কে।সাথে ওর প্রতিও ছিলো আমার তীব্র মায়া।যার কারণে ব্রেকাপের পর আমি অনেক আপসেট হয়ে পরি।কোনো কাজেই মন বসাতে পারছিলাম না।পড়াশোনায় তো না ই।এদিকে সামনে আমার এইচএসসি পরীক্ষা।রাত জেগে পড়া আমার বেশ পুরোনো দিনের অভ্যাস।কিন্তু সেদিন রাতে না আমি পেরেছি পড়তে আর না পেরেছি আমি ঘুমাতে।বইয়ের পাতা ভিজিয়েছি নোনা জলে।ঝগড়াঝাঁটি আমাদের রিলেশনে একটা কমন বিষয় ছিলো।পাঁচ বছরের সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও আমাদের আচরণ ছিলো সেইম এইজ কাপলদের মতো।ভালো কথা বলতে বলতেও ছোটখাটো ঝগড়া লেগে যেত।আর প্রতিবারই ঝগড়ার পর আমি কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলতাম।ঝগড়ার পর অভিমানের স্থায়িত্ব হতো সর্বোচ্চ দু-তিন ঘন্টা।তারপর সে ফোন দিয়ে সরি টরি বলে আমার অভিমান ভাঙাতো।এইবারও আশা রেখেছিলাম যে অক্ষর আমার অভিমান ভাঙিয়ে ঠিকই রিলেশনটা কন্টিনিউ করবে।কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে যাবার পরও যখন সে আমায় আর ফোন দেয় না। তখন বুঝতে পেরেছিলাম আমাদের একসঙ্গে পথ চলা এই পর্যন্তই ছিলো।রাত দেড়টার দিকে ফালাক আমায় ফোন দেয়।আমি কল রিসিভ করি।ভেবেছিলাম সরি বলে অভিমান ভাঙাবে।কিন্তু আমার ধারণা ভুল।ফালাক ফোন দিয়ে আমায় নিচে নামতে বলে।আমি এর কারণ জিজ্ঞাসা করি।জবাবে ও বলে,,,,,

” এত কারণ জিজ্ঞাসা করা লাগবে কেন তোর?নিচে আসতে বলছি নিচে আসবি।”

অগত্যা,ওর কথামতো নিচে যাই।ভেবেছিলাম সরি সারপ্রাইজ দেবে হয়তো।অনেকটা খুশী মনেই নিচে যাই।গিয়ে দেখি একটা বড় শপিং ব্যাগ নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে।আমি ভাবলাম কোনো কিছু এনেছে হয়তো আমার রাগ ভাঙাতে।কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এইবারও আমি ভুল হই।ব্যাগটা আমার হাতে দেয় ফালাক।আমি ব্যাগের ভেতর পাঞ্জাবী,টি-শার্ট,ঘড়ি,পার্ফিউম দেখতে পাই।

” এগুলা কী?”

” দেখতে পারছিস না?আলো লাগবে?”

” দেখতে পারছি বলেই তো জিজ্ঞেস করছি!পাঞ্জাবি,টি-শার্ট,জেন্স ঘড়ি,জেন্স পার্ফিউম দিয়ে আমি কি করবো?”

” যা মনে চায় তাই কর গিয়ে।রিলেশন চলাকালীন এগুলো আমায় দিয়েছিলি তুই।তোর কোনো স্মৃতি রাখতে চাই না।তাই এগুলো দিয়ে গেলাম।”

” ভাই তুই কি কখনো শুনেছিস ভিক্ষা ফিরিয়ে নিতে?অনেকে হয়তো নেয়।বাট আমি ডিফ্রেন্ট।আমার লেভেল অনেক ওপরে।ভিক্ষা ফিরিয়ে নেওয়ার মেয়ে না আমি।”

” কি বললি আমি ভিক্ষুক?”

” কবে কখন বললাম।আমি কি তোকে মিন করে কোনো কিছু বলেছি?”

” এখানে তো তুই আমি ছাড়া কেউ নেই।তার মানে আমায়ই তুই কথা গুলো বলেছিস।”

” যতটা বল*দ ভেবেছিলাম অতটাও বল*দ না তুই।”

” দেখ আমি তোর থেকে পাঁচ বছরের বড়।সম্মান দে আমায়।”

” সম্মান বয়স দেখে না!আচরণ দেখে আসে আমার।”

” দোয়েল..!”

” গলা নিচে!এখন আমি তোর কেউ না। So আমার সাথে জোর গলায় কথা বলার কোনো রাইট নাই তোর।আগে গার্লফ্রেন্ড ছিলাম তখন ধমকাতি তাই কিছু বলতাম না।”

” তোর সাথে ফালতু কথা বলার কোনো ইচ্ছা নাই আমার।ব্যাগটা নে।”

” নিলাম না।কি করবি তুই?”

লেগে যায় আবার ঝগড়া!আমাদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আশেপাশের মানুষজন উঠে যায়।আর তারপরে যা হয় তা সবারই জানা।

রায়হান ভাইয়া মসজিদের ইমাম সাহেবকে নিয়ে আসেন।আম্মু কাঁদছে।পায়েল চুপচাপ। মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকী হাসছে।ও আমাদের সম্পর্কের কথা জানতো।ব্রেকাপের কথা বলা হয় নি।বিয়ের কথা চলছে।সম্পর্কের পুর্ণতা পাবে এই ভেবেই ও হয়তো মুচকী হাসছে।

” কোয়েলের আব্বু,তুমি দোয়েলকে একটা সুযোগ দেও।ও এমন কাজ করার মেয়ে না।চিনি তো আমি মেয়েটাকে।”

আম্মু এমনিতে আমায় অত বেশি আদর করেন না।বড় মেয়ে ছোট মেয়েই তার চোখের মণি।ম্যাক্সিমাম সময়ই আম্মু আমায় ধমকের ওপরে রাখেন।আমি কিছু করতে গেলেই মা আমায় বাঁধা দিতেন।এই নিয়ে মায়ের প্রতি আমার শত অভিযোগ ছিলো।কিন্তু আজ আম্মুর মুখে এমন কথা শুনে আমার মায়ের প্রতি সমস্ত অভিযোগ মুহুর্তেই উধাও হয়ে গেলো।সত্যিই মা সন্তানের মন বোঝে।মিথিলার বাবা আমার কাছেই ছিলো।আম্মুর কথা শুনে মিথিলা বাবা বিড়বিড় করে বলে,,,

” মায়ের জন্যই মেয়েটা ন*ষ্ট পাইছে।ধরা খেলো মেয়ে তাও মা মেয়েকে সাপোর্ট করছে।মা ন*ষ্টা দেখেই তো মেয়ে আজ এমন!”

লোকটার কথা শুনে আমার মনে হলো লোকটাকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে দিই।নিজের ছেলে যে সারা শহরের মেয়েদের পেছনে ঘুরে বেড়ায় তার খবর রাখে সে?আসতে আমার আম্মু আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলতে!লোকটার আর কি দোষ দেবো!সমাজটাই তো এমন।সন্তানেরা বিপথে গেলে বা কোনো ভুল করলে সব দোষ মায়ের।আর সন্তান কোনো ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করলে তার ক্রেডিট পায় বাবা।

” তুমি কি ছেলেটাকে ভালোবাসো দোয়েল?”

বাবা আকষ্মিক প্রশ্নে আমি চমকে যাই।কোনো কথা বের হচ্ছে না আমার মুখ থেকে।কেমন যেন গলায় এসে আটকে যাচ্ছে কথা গুলো।

” দোয়েল, আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।”

” জ…জ…জ্বী আব্বু।”

মাথানিচু করে কাঁপা কন্ঠে উত্তর দিই আমি।আমার উত্তর শুনে ফালাক আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।আব্বু আবার আমায় জিজ্ঞেস করেন।

” তুমি কি ছেলেটার সাথে কোনো সম্পর্কে আছো?”

” ছিলাম।আজ আমাদের বিচ্ছেদ হয়েছে।”

” বিচ্ছদেই যখন হয়েছে।তখন তুমি এত রাতে ছেলেটার সাথে কি করছিলে?”

” দরকার ছিলো আব্বু।কিছু বলার ছিলো ওকে।যা ফোনে বলা সম্ভব না।তাই আর কি ডেকেছিলাম।”

বাবা কিছুক্ষণের জন্য নিরব হয়ে যায়।তারপর ফালাককে একই প্রশ্ন গুলো জিজ্ঞেস করেন,,,

” তুমি কি দোয়েলকে ভালোবাসো?”

” জ্বী আংকেল।”

” বিচ্ছেদের কারণ ?”

” সেটা আপনার মেয়ে বলতে পারবে ভালো।সে যেতে চেয়েছে আমি আটকাই নি।”

ফালাকের কথা শুনে আমার খুব রাগ হয়।আসলেই কী ওর বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি?যাক ভালোই হয়েছে।কারও বিরক্তির কারণ হয়ে থাকার ইচ্ছা আমার কখনো ছিলো না আর হবেও না।

” দোয়েল ওর সাথে যদি তোর বিয়ে না দিই।যোগাযোগ করতে না দেই তাহলে কি তোর কোনো সমস্যা হবে?”

” মানুষ বলে না?ভালোবাসার মানুষ,প্রিয় মানুষকে না পেলে মারা যাবে!কিন্তু আমি তা বলবো না।আমি হয়তো তাকে না পেলে মারা যাবো না।কিন্তু তাকে না পাওয়ার এক আফসোস আমার মধ্যে থেকে যাবে।যা সারাজীবন আমায় বয়ে যেতে হবে।তারপরও আব্বু।তুমি যা ভালো বুঝো তাই করো।নিশ্চয়ই তুমি আমার খারাপ চাইবে না।আর এটাও চাবে না যে আমি আফসোস,হারানোর কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকি।”

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে