রূপকথা পর্ব-০৫

0
523

#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৫

[৯]
মিষ্টি কিরণ ছড়িয়ে দেওয়ার নিমিত্তে প্রভাকর নিমজ্জিত। ক্ষণকাল সময় নিয়েই মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলে। মিইয়ে যায় তার তেজ। দক্ষিণাবহ হু হু করে তেজ বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কিশোরীদের উত্তেজনা। পশ্চিমাকাশে কৃষ্ণ আবর মেলা বসিয়েছে। ব্যাগ থেকে পলিথিন বের করে তাতে বই ঢুকিয়ে নিলো তিন কিশোরী। পলিথিন উপুড় করে গিট্টু দেওয়া অংশ ব্যাগের তলায় ফেললো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ইতিমধ্যে সূচনা হয়ে গিয়েছে। মেঘের গর্জনে ব্যাগ আঁকড়ে ধরলো। ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে ছন্দ পেলো। তালে তালে পা চললো। জুতা হাতে নিয়ে পিচ ঢালা নির্জন রাস্তায় দৌঁড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিলো রূপকথা, উপমা, তাহমিনা। সকাল থেকে আকাশের অবস্থা ভালো ছিলোনা। তাই বুদ্ধি করে পলিথিন নিয়ে এসেছে তিনজনে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে যখন হাঁপিয়ে গেলো? তখনই হাঁটুতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে গেলো রূপকথা। তার থেকে দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ালো উপমা, তাহমিনা। আকাশে মুখ করে বৃষ্টি স্বাদ আস্বাদন করছে রূপকথা। নেত্রপল্লব তিরতির করে কেঁপে উঠছে। গায়ের জামাটা বেশ আঁটসাঁট ভাবেই লেপ্টে আছে। বৃষ্টির পানি ধূয়ে দিচ্ছে সমস্ত শরীর, সমস্ত গ্লানি, বিষাদ। রূপকথা মনে মনে এক ইচ্ছে পোষণ করলো,
“ইশ! বৃষ্টির পানি যদি আমার শইলের রংটা ও ধূইয়া দিতো।”

পাশাপাশি চরণ ফেলে বাড়ি পৌঁছালো। পাকা রাস্তা থেকে নামলে খানিক কর্দমাক্ত মাটির রাস্তা রয়েছে। বৃষ্টির সময় জায়গাটার অবস্থা একেবারে করুণ হয়ে থাকে। টাকনুর উপর থেকে অনেকখানি পায়জামা উন্নমিত করে কাঁদায় পা ডুবিয়ে বাড়ির ফটকে এসে থামলো উপমা, রূপকথা। ঘরের ভেতর ডুকতেই দুঃসহ বিষাদে ছেয়ে গেলো মন। সুতীব্র বেদনা আঁকড়ে ধরলো। চিকচিক করে চক্ষু কোটরে জমে থাকা জলে পাপড়ি গুলো আদ্র হয়ে উঠলো রূপকথার। লম্বা হয়ে শুয়ে আছে খোরশেদ। পায়ে সাদা ব্যান্ডেজ প্যাঁচানো।
কাজ করতে গিয়ে চালের উপর থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে গিয়েছে। রূপকথার কোমল হাতখানি ছুঁয়ে দিলো ভাইয়ের ভগ্ন পা খানা। ঈষৎ ব্যথা পেয়ে মৃদু আর্তনাদ করলো খোরশেদ। ভ’য়ে আড়ষ্ট হয়ে সাথে সাথে হাত সরিয়ে তটস্থ হয়ে রইলো রূপকথা।
খোরশেদ বোনের করুণ চেহারা দেখে অল্প শব্দে হাসলো।

আলেয়া বেগমের চিন্তার শেষ যেনো হতে হতেও হয়না। রাত বাড়লে তার চিন্তাগুলো ধাপে ধাপে উন্নিত হয়। ছেলেটা পা ভে’ঙে বসে আছে। কেমন করে চলবে সংসার? কোনোরকম ওই ছেলের রোজগারেই দিনাতিপাত করেন। এখন সেই সম্বল টুকু অবশিষ্ট রইলোনা। সংসারের সমস্ত ভার, বোঝা ঘাড়ে নিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। না জানি কোনদিন একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে তেমন চিন্তা না থাকলেও রূপকথার চিন্তায় যেনো ম’রি ম’রি দশা। রা’গের চোটে চারটে খানি কথা শোনাতেও বাঁধেনা তার। তিনি নিজের মতো করে সন্তানের ভালো চান। কিন্তু একটি বার খতিয়ে দেখেননা “আমি যেভাবে চাইছি সেভাবে কি আমার সন্তান ভালো আছে?”
কোমরের ব্যথার জন্য বসা থেকে হঠাৎই দাঁড়িয়ে যেতে পারেননা আলেয়া বেগম। দাঁতে দাঁত কে’টে ব্যথা হজম করেন। ছেলে-মেয়েদের জানতে দেননা।
আলেয়া বেগমের শরীরখানা ঘুণে ধরা কাঠের মতো। উপরটা ভালো দেখা গেলেও ভেতরটা ভঙ্গুর। সেজো মেয়ে মমতার সাথে ফোনে কথা বলছিলেন তিনি।

-“জামাইর লগে কত মাইনষের ওঠাবসা। হেয় কি পারেনা তার শালিটারে নিয়া বিয়া দিতে?”

স্পিকার অন করা ছিলো। নয়তো আলেয়া বেগম কথা বুঝেননা। তার হাতে অল্পদামি একটা নোকিয়া বাটন ফোন আছে। মেয়েরা ফোন দিলে এটা দিয়েই কথা বলে। ওপাশ থেকে মমতার বিরস কন্ঠস্বর শোনা গেলো,
-“উনার লগের একটা ভালা পোলা আছিলো। বিয়ার লাইগা যখন মাইয়া খুঁজছে তহন আমি আপনেগো জামাইরে কইছিলাম রূপকথার কথা কইবার লাই। উনি কইলেন তারা সুন্দরী মাইয়া খোঁজে। রূপ কালা। ওর কথা কইতেও তো উনার শরম করে। মাইনষে কইবো নিজের কালা শালিটারে গইচ্ছা দিতাছে।”

রূপকথা শুনলো কথাগুলো। এ আর এমন কি? প্রতিদিনই অহরহ তাকে নিন্দে কথার জালে ডুবতে হচ্ছে। যদি সে হাঁস হতো তবে এই কথার জল গা ঝেড়ে ফেলে দিতে পারতো। আফসোস হচ্ছে রূপকথার। “ক্যান হাঁস হইলাম না?”

[১০]
আজকে আকাশ ভীষণ একা। তার বুকে চাঁদ নেই। তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য একটা তারকা ও আজ অবশিষ্ট নেই। রাতের আকাশ ভয়াবহ অন্ধকার ঠেকছে। জীবনটা ও তো অন্ধকার। মাঝেমাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো ক্ষণিকের দীপ্তি দেখতে পায়। নিমিষেই তা আবার হারিয়ে যায়, পূনরায় অন্ধকার তার জায়গায় বহাল হয়ে রয়। পড়তে বসে জানালার ফাঁকে চোখ রেখেই কথাগুলো ভাবছিলো রূপকথা। তাদের ঘরে এক অপ্রত্যাশিত মানবের আগমনে চমকে ওঠে রূপকথা। হাতুড়িপে’টার শব্দ, কম্পন টের পায় বক্ষ খাঁচায়। সহসা থেমে গেলো সে, আশ্চর্য হলো। মানুষটা এখানে কি করছে?

মামুন খোরশেদের পাশেই খাটে বসলো। দৃষ্টি তার চেয়ারে বসা রমনীর পানে। খোরশেদের কথায় নড়েচড়ে বসে মামুন। ফের তাকায় রূপকথার দিকে। তার কেনো জানেনা মনে হচ্ছে আল্লাহ কিছু মানুষকে কালো বানিয়ে ও সমস্ত রূপ ঢেলে দেয় তার চেহারায়। এক লোভনীয় মাধুর্য খুঁজে পাওয়া যায় সেই মানুষগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এমন মানুষের প্রেমে বারংবার ম’রা যায়। এমনি এমনি তো আর মেয়েটার নাম কোকিল পাখি দেয় নি সে। ভীষণ আন্তরিকতার সাথেই খোরশেদের ভালোমন্দ খোঁজ নিলো মামুন। পাশেই আলেয়া বেগম বিষন্ন বদনে বসা ছিলেন। মামুন বলল,
-“কোনো সাহায্য লাগলে বইলেন চাচি। আমরা তো আপনাগো পোলার মতো। যহনই দরকার হইবো ডাক দিবেন।”

ভরসা পেলেন আলেয়া বেগম। এরকম সাহস দিয়ে কথা বলার মতো লোকজন আজকাল পাওয়া যায় না। আলেয়া বেগম ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলেন।
-“বস বাবা, চা খাইয়া যাইবা।”

মামুন বাঁধা দিতেই সাবধানী গলায় শুধালো,
-“এহন এত কষ্ট করন লাগবোনা চাচি। মোড়ে দোকানে গ্যালেই চা খাওন যাইবো। আমনে বসেন।”

আলেয়া বেগম বাঁধা মানলেননা। মামুনকে জোরদার করে বসিয়ে উঠে গেলেন চা আনতে। রূপকথার দৃষ্টি বইয়ে, মন ডানপাশে বসে থাকা মানুষটির মাঝে। না চাইতেও আজ মন ব্যাঙের মতো লাফিয়ে মামুনের উপর পড়তে চাইছে। সে ও আজ বাঁধা দিলোনা। দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছেনা দুজনের, কিন্তু পাশাপাশি মন বিনিময় হচ্ছে।
মায়ের কাছ থেকে পরে জানতে পারলো মামুনই পা ভা’ঙার পর খোরশেদকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে।

[১১]
খোরশেদ পা ভে’ঙে ঘরে ঢুকেছে কয়েকদিন হলো। সংসার তো আর এমনি এমনি চলবেনা। তেল না থাকলে যেমন গাড়ি চলেনা, টাকা না থাকলেও সংসার চলেনা। মানুষ বলে টাকা ছাড়া ও সুখী হওয়া যায়। কথাটি ভুল। সুখী হওয়ার জন্য বেঁচে থাকা প্রয়োজন। আর বেঁচে থাকতে হলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার প্রয়োজন হয়না, তবে টাকার প্রয়োজন হয়। টাকার পেছনে দুনিয়া ছোটে। ঘরে বছরান্তে চাষ করা চাল আছে। চাল ছাড়া ও তো বাকি জিনিসের প্রয়োজন হয়। তেল, নুন ছাড়া রান্না হয়? টাকার প্রয়োজনে কয়েকজনের নকশিকাঁথা বানিয়ে দেওয়ার অর্ডার নিলো আলেয়া বেগম। কিছু নিজে করছেন। কিছু মেয়েদেরকে দিয়ে করাচ্ছেন। ঘরে সদাই-পাতি লাগবে। এখন বাজারে যাবে কে?
তখনই আলেয়া বেগম দেখা পেলেন মামুনের। তাদের বাড়ির সামনেই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আলেয়া বেগম গলার স্বর উঁচু করেই ডাকলেন,
-“বাবা, বাড়ির ভিতরে আসো। ওইহানে দাঁড়াইয়া কি করো?”

মামুন উঁকিঝুঁকি দিয়ে রূপকথাকে দেখার চেষ্টা করছিলো। আলেয়া বেগমের চোখে পড়ে যাবে সে, এটা ভাবতে পারেনি। কৃত্রিম হেসে ইতিউতি করেই বলল,
-“ভাবছিলাম খোরশেদের খবর জিগাইতে যামু কি যামুনা। এহন আমনেই ডাক দিলেন।”

আলেয়া বেগম হেসে বললেন,
-“আইবা, যাইবা এত ভাবনের কি আছে?”

মামুন বাড়ির ভেতর ঢুকে উঁকি দিয়ে দেখতে পেলো রূপকথা আর উপমা বসে বসে নকশিকাঁথায় নকশা করছে। সে আলেয়া বেগমকে জিজ্ঞেস করলো,
-“চাচির কিছু লাগবো?”

আলেয়া বেগম ভনিতা ছাড়াই বললেন,
-“হ বাবা। কিছু সদাই-পাতি লাগতো। বাজারে যাওনের মানুষ নাই।”

মামুন বলল,
-“আমি আছি ক্যান? আমনে আমারে নিজের পোলা মনে করেননা চাচি। যান বাজারের ব্যাগ লইয়া আসেন।”

আলেয়া বেগম উঠান ছেড়ে ঘরে গেলেন টাকা আর ব্যাগ আনতে। মামুন চট করে উঠে দাঁড়ালো। উপমাকে বলল,
-“উপমা আপু একটু পানি দিবা?”

কেউ পানি চাইলে না করতে নেই। তাই উপমা হাতের কাজ রেখে পানির জন্য গেলো। রূপকথার পাশে বসলো মামুন। মিইয়ে গেলো রূপকথা। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। নরম গাল জোড়া গরম হয়ে উঠলো। ফর্সা হলে দৃষ্টিগোচর হতো তার আরক্তিম নাক, গাল। মামুন ফিসফিস গলায় বলল,
-“আমারে একখান রুমাল বানাইয়া দিবা, কোকিল পাখি?”

রূপকথা গুটিয়ে নিলো নিজেকে। তার ভীষণ লজ্জা হচ্ছে। মানুষটা তার এত কাছে কেনো বসেছে? সে কি টের পায়না হৃদয়ের কম্পন?

আলেয়া বেগমের গলা শুনেই চট জলদি নিজ জায়গায় অবস্থান করলো মামুন। আলেয়া বেগমের হাত থেকে টাকা আর বাজারের ব্যাগ, ফর্দ হাতে ছুটলো বাজারে। এদিকে উপমা পানি নিয়ে এসে দেখে মামুন চলে যাচ্ছে। পানির গ্লাস হাত থেকে রাখতেই ঢকঢক করে গিলে নিলো রূপকথা। যেনো কতকাল ধরে সে তৃষ্ণার্ত।

স্কুল যাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো আশরাফুল। সে ও জমরদ বাড়ির ছেলে। বিনয়ের সাথে রূপকথাকে শুধালো,
-“বুবু একটু কথা কওনের সুযোগ দিবেন? উপমার লগে আমার জরুরি কথা আছে।”

চরম বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে আসলো রূপকথার। এই ছেলে নির্ঘাত তার চেয়ে তিন-চার বছরের বড় হবে। তাকে বুবু কেনো ডাকছে? তাও আবার উপমার সাথে কথা বলতে চায়। মতলব কি? জেদ ধরলো রূপকথা। কাঠকাঠ গলায় বলল,
-“কি কওনের আছে। আমার সামনেই কন। উপমা আমনের লগে একলা কথা কইবোনা।”

এতক্ষণ ভ’য় পাচ্ছিলো উপমা। সে যখন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে তখন ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কি কি বলে যা স্পষ্ট শোনার আগেই দৌঁড়ে পালায় সে। এ বাড়ির ছেলে মানুষ খুব খা’রাপ। বুবুর কথায় ভ’য় কাটলো তার।
আশরাফুল লাজলজ্জা হীন ভাবেই বলল,
-“বুবুর সামনে কইতে চাইছিলাম না। আপনে যহন চান তাইলে হুনেন।”
উপমার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলল,
-“আশিকরে আমি আদর কইরা বুঝাইয়া দিছি। হেয় এহন আর তোমারে চিডি দিবোনা। আইতে যাইতে সালাম দিবো ভাবী কইয়া। তুমি খালি একবার কইয়া দিবা কে তোমার লগে খারাপ ব্যবহার করে। আমি তার কইলজা ছিঁইড়া নিমু। আমার বউয়ের উপর বদ নজর আমি সহ্য করুম না।”

আশরাফুলের কথা শুনে রা’গে নাকের পাটা ফুলে উঠলো রূপকথার। উপমার হাত চেপে ধরে সামনে চললো। পেছন পেছন আশরাফুল হেসে হেলতে দুলতে আসছে। রূপকথা হাত জোড় করে বলল,
-“দয়া কইরা পেছন পেছন আইবেননা। লোকে আমগোরে খারাপ কইবো।”

#চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে