রূপকথা পর্ব-০৯(অন্তিম পর্ব)

0
975

#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#অন্তিম_পর্ব

[১৯]
বাড়ির বিস্তৃত উঠান জুড়ে খেলা করে তৈরি হয়ে নিলো মাহতাব। পাঁচ বছর বয়স তার। খোরশেদ এর ছেলে। পা টিপে টিপে ফুফির রুমের সামনে দাঁড়ালো। পর্দার আড়ালে উঁকি দিয়ে দেখলো ফুফির তৈরি হওয়া কতদূর। আজ তাদের স্কুলে গার্ডিয়ান ডাকা হয়েছে। মাহতাবের গার্ডিয়ান হিসেবে রূপকথা আছে। তাই আর খোরশেদ বা তার স্ত্রী যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা।
কালো রঙের একটা সুতি শাড়ি পড়ে চোখে গাঢ় করে কাজল টানলো রূপকথা। মনের মতো করে নিজেকে গুছিয়ে নিলো। এখন আর কারো কথার ধার ধারেনা সে। নিজের মর্জি মতো চলে। এখন মানুষগুলো তার ব্যাপারে নাক গলাতে আসেনা। বহু আগেই সেই রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রূপকথা খপ করে মাহতাবের হাত ধরতেই খিলখিল করে হাসলো বাচ্চাটি। কোলে তুলে নিয়ে নাস্তা করতে গেলো।

পড়ার পাট চুকিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা পদে চাকরী হয়েছে রূপকথার। এতদূর পৌঁছানোর পথটা সহজ ছিলোনা। নানা প্রতিকূলতা, অর্থসংকট এর ভেতর দিয়ে এ পর্যায়ে এসেছে। এতে খোরশেদের অবদান সর্বোচ্চ। একটুকরো জমি ও বিক্রি করে দিয়েছে রূপকথার পড়ার খরচের জন্য। এখন তাকে কেউ কালো বলে কটূ’ক্তি করার মতো শক্তি বা সাহস কোনোটাই পায়না। শিক্ষক একজন সম্মানিত মানুষ। তাকে কিভাবে অসম্মান করা যায়?
আজ দেখতে আসবে রূপকথাকে। মা চাচ্ছেন এবার বিয়েটা করে ফেলুক রূপকথা। ছেলে তার সাথেই পড়াশোনা করেছে। সেই থেকেই ভালোলাগা। রূপকথা দ্বিতীয়বার গা ভাসিয়ে দেওয়ার মতো ভুল করেনি। রূপকথাকে উত্যক্ত করার মতো ভুল করেনি আফিফ। এতবছর যাবত পড়েছিলো মেয়েটার পেছনে। অবশেষে পরিবারকে রাজি করিয়ে নতুন জীবনে পা বাড়াতে চাইছে। আফিফ ভালো ছেলে। যদি দুই পরিবারের মধ্যেই সব ঠিকঠাক হয়ে যায় তাহলে আর না করবেনা রূপকথা। এবার বিয়েটা করা উচিত।

উপমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আশরাফুল সহ এলাকার কিছু ছেলেপেলের জন্য মেয়েটাকে টিকিয়ে রাখা যাচ্ছিলোনা। তাই উপমাকে বিয়ে দিয়েছে। তার দুটো ফুটফুটে মেয়ে বাবু আছে।

মামুন এখন বিদেশেই আছে। দুইবছর অন্তর অন্তর বাড়ি ফেরে। সুখের সংসার তার। তারও দুইটা বাচ্চা আছে।
সবাইকে শা’স্তি দেওয়া যায়না। কিছু মানুষের শাস্তি উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিতে হয়। ইহকাল হোক বা পরকাল, তার উপযুক্ত শা’স্তি সে পাবে।
সবারই একটা গতি হয়েছে। এবার নিজেকে নিয়ে ভাবার পালা।
নাস্তা করে মাহতাবকে সঙ্গে নিয়েই স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে রূপকথা।

গার্ডিয়ানদেরকে একটা কক্ষে ডাকা হলো। বাচ্চাদের শেখানো নিয়ে অনেক শিক্ষকই অনেক ধরনের আলোচনা করলেন, বক্তব্য দিলেন। এবার একজন শিক্ষক মাইক্রোফোন সামনে নিয়ে রূপকথাকে গার্ডিয়ানদের উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে বললেন।
মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে উজ্জ্বল চেহারায় তাকালো রূপকথা। সবাইকে সালাম ও শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করলো তার বক্তব্য।

-” আমরা চাই আমাদের সন্তানরা অন্যদের চেয়ে ভালো করুক। পড়াশোনায় মনোযোগী ভাব ধরে রাখুক। কিন্তু আমাদের চাওয়াটা কতটুকু কর্যকর হয়?
আমি এখানে আসার পর একজন গার্ডিয়ানকে দেখলাম বাচ্চাকে মা’রধর করছেন। বাচ্চা পছন্দের জামা পড়ে আসতে চেয়েছিলো। হয়তো ক’টূক্তির ভ’য়ে মা পড়তে দেয়নি। তাই স্কুলে এসেও কান্নাকাটি থামছেনা বাচ্চাটির। তাই মা শাসন করেছেন।”
কথাটি বলে স্মিত হাসলো রূপকথা। ফের মুখ খুললো,

-“সবার উদ্দেশ্যে বলছি আপনার সন্তানের দিকে মনযোগ দিন। তার মন পড়ার চেষ্টা করুন। সে কি চায় সেটা বুঝুন।
আমার দিকে তাকান, আমি ও একজন কালো মানুষ। সন্তানের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হচ্ছে মায়ের বুক। সর্বপ্রথম বাচ্চাটি মায়ের কাছ থেকে ভালোবাসা পায়। আপনি তো মা। তাহলে আপনার সন্তানদের মাঝে কেনো এত ভেদাভেদ? যখন আপনার একটি সন্তান ফর্সা হলো তাকে জন্মদিতে আপনার যতটুকু কষ্ট করতে হয়েছে। একটা কালো সন্তান জন্ম দিতেও তো আপনার ততটুকুই কষ্ট হয়েছে। দশমাস দশদিন পেটে ধরার বাইরে ও তাকে লালন করতে আপনার কষ্ট হয়েছে। তাহলে কেনো আপনারা দুটো সন্তানকে আলাদা করে দেখেন? যে সন্তানটা ফর্সা হলো সে কি আপনাকে আলাদা করে কিছু দিলো? যে কালো হলো সে কি আপনার কিছু খোয়ালো? কালো সন্তানটা যখন একটু সাজতে চায়, পছন্দের রং এর জামা পড়তে চায়, সুন্দরদের মাঝে ঘুরতে চায় সেখানে আপনারা বাঁধা দেন। কেনো বাঁধা দেন? ভ’য় হয়? যে আপনার সন্তানকে কেউ বা’জে বলুক, কুৎ’সিত বলুক। তখন আপনার কষ্ট হবে। তাই নিজেই আগে থেকে সন্তানকে তার পছন্দ থেকে সরিয়ে রাখছেন। আচ্ছা আপনি যে তাকে প্রতিনিয়ত আক্ষেপের জালে ফেলে কষ্ট দিয়ে কথা বলছেন তখন আপনার খারাপ লাগছেনা? কষ্ট হচ্ছে না?

আপনারা ভুল করছেন। আপনার ফর্সা সন্তানটিকে যেমন সবকিছুতে স্বাধীনতা দিচ্ছেন তখন কালোটিকে কেনো নয়? মনে রাখবেন যখন মানুষ দেখবে বাচ্চাটিকে পরিবার থেকেই নিচু করে রাখা হয়েছে তখন মানুষ আরও চেষ্টা করবে সে বাচ্চাটাকে ছোট করার। একবার ও ভেবে দেখেছেন বাবা মায়ের কটূ’ক্তিতে সন্তানের কতটা মানসিক যন্ত্রনা হয়? কালো সাদা দুটোই আল্লাহর সৃষ্টি। তাহলে আল্লাহর একটা সৃষ্টিকে সাদরে গ্রহণ করছেন। অপরটিকে কেনো হেলা করছেন?
আপনি একজন বাবা হয়ে এই সন্তানকে লালন করার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন না? আপনার কষ্ট হচ্ছে না? তাহলে কোন স্বার্থে নিজের সন্তানকে ছোট করছেন?
একটা বাচ্চা সর্বপ্রথম পরিবারের কাছ থেকে অবহেলিত হয়। যার ফলে সমাজও তাকে অবহেলা করে। আপনি যখন নিজের সন্তানকে গুরুত্ব দেবেন, কারো দুটো কটূ’ক্তির সঠিক জবাব দেবেন তখন দেখবেন সেই মানুষগুলোর মুখ একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সমাজ আর আপনার সন্তানকে তু’চ্ছ করছেনা। তাই নিজের সন্তানকে গুরুত্ব দিতে শিখুন। কথাগুলো আমি আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। যখন থেকে আমি পরিবারের সাপোর্ট পেলাম তখনই আমার দুনিয়া বদলে গেলো। মানুষের ক’টূক্তি গুলো প্রশংসায় রূপ নিলো।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নারী পুরুষের সমান অধিকারের আগে প্রয়োজন কালো সাদার বৈষম্য দূর করা। কালো সাদার সমান অধিকার দেওয়া। আপনি আপনার সন্তানকে গুরুত্ব দিন, তখন দেখবেন অন্যরাও গুরুত্ব দিচ্ছে। আপনার সন্তান অন্যায় করেছে নিজে শাসন করুন। নিজে শাসন না করে অন্যদের হাতে একবার ছেড়ে দিন, দেখবেন মানুষগুলো বারবার অনুমতি ছাড়া আপনার সন্তানকে শাসন করতে আসবে। সবার আগে পরিবার থেকে গুরুত্ব দিতে শিখুন। দেখবেন পুরো পৃথিবী গুরুত্ব দিতে শিখে যাবে। পড়ালেখার জন্য প্রয়োজন একটা পরিষ্কার, প্রফুল্ল, সুস্থ মস্তিষ্ক। যেখানে প্রতিনিয়ত অবহেলায় সন্তানকে বিষিয়ে তুলছেন, তাকে মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণায় পিষ্ট করছেন, সেখানে ভালো পড়াশোনা আশা করছেন কিভাবে? পরিবার আর সমাজের অবহেলায় অনেক ভালো শিক্ষার্থীরা ও ঝরে যাচ্ছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলে একটা প্রথা এখনো প্রচলিত আছে।
“মেয়ে মানুষের এত পড়ালেখায় কি হবে? মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোনোর আগেই বিদায় করো তাকে।”

মেয়ের শিক্ষা সুনিশ্চিত করুন। যদি মেয়েটি কালো হয় তাহলে সারাজীবন শশুর বাড়ীতে অব’হেলার শিকার হয়েই দিন পার করবে। সবাই একটাই ধারণা পোষণ করবে,” ডিভোর্সি মেয়েকে কে বিয়ে করবে?”। এই ভ’য়ে সে ও আর মুখ খুলে কিছু বলতে চাইবেনা। অত্যা’চার সহ্য করে যাবে। তার পরবর্তী প্রজন্ম ও একইভাবে কা’টবে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেলো কেউ পেছন থেকে আ’ঘা’ত করার সুযোগ পাবেনা। একজন শিক্ষিত মেয়ে সর্বক্ষেত্রে প্রতিবাদ করার সক্ষমতা রাখে। কিছু হয়ে গেলেও তার জীবন নিয়ে আর আপনাদের চিন্তা করতে হবেনা।

সমাজ বদলাতে হবেনা। আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। কালো-সাদা মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করা বন্ধ করুন। নারী শিক্ষায় অগ্রসর হোন। দেখবেন সমাজে আর বিশৃঙ্খলা থাকবেনা। একটা সুশৃঙ্খল সমাজ, একটা সুশৃঙ্খল জাতি উপহার পাবেন।”

রূপকথা খেয়াল করে দেখলো অনেকেই মাথানিচু করে আছেন। বিশেষ করে বাচ্চাটির মা। হয়তো অনুশোচনায় দ’গ্ধ হচ্ছে, হয়তো তাদের সঠিক বুঝ হয়েছে। এখানে মামুন ও উপস্থিত আছে। বিদেশ থেকে গত মাসে ফিরেছে। তার মেয়েটি ও এখানেই পড়াশোনা করে। সেই হিসেবেই এসেছে।

আজ আর ক্লাস হলোনা। সকল কার্যক্রম শেষ করে বাড়ি ফেরার পথেই মামুনের ডাকে পা জোড়া থেমে গেলো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই পিছু ফিরলো রূপকথা। মামুন গভীর দৃষ্টি ফেলে বলল,

-“নিজের জীবনে সুখী আছো?”

রূপকথা স্মিত হেসে বলল,
-“এতটাই সুখী যে, মাঝেমাঝে সুখকে প্রশ্ন করি ‘দুঃখ কি জিনিস গো’ ?”

-“ভালোই শুদ্ধ বলছো।”

শব্দ করে হাসলো রূপকথা।
-“আপনি বিদেশ গিয়ে শুদ্ধ ভাষা শিখেছেন, আর আমি আগ থেকেই শুদ্ধ বাংলা জানি। যেখানে যেমন খাপ খায়, সেখানে তেমন ভাষা ব্যবহার করি। তাছাড়া একজন শিক্ষিকার ভাষা কেমন হওয়া উচিত আপনিই ভালো বোঝেন। আসছি।”

মামুন একবার আফসোস করেই ফেললো,
-“ইশ কেনো মেয়েটাকে বিয়ে করলাম না?”

[২০]
বিকেলেই রূপকথাকে দেখতে এলো আফিফ এর পরিবার। চেয়েছিলেন ছেলের জন্য সুন্দরী একটা বউ ঘরে তুলবেন। কিন্তু ছেলের যেহেতু পছন্দ তাই আর দ্বিমত করলেননা। আফিফ বলল রূপকথা মনের দিক দিয়ে সেরা সুন্দরী।
দু’পরিবার থেকেই বিয়ের কথা পাকা হলো।

রূপকথা আর আফিফকে আলাদা কথা বলতে দেওয়া হলো। আফিফকে রূপকথা তার মন খারাপের সঙ্গিনী বকুল তলায় নিয়ে আসলো। গাছের মোটা, শক্ত শেকড়ে পাশাপাশি বসলো। এই জায়গায় কতশত স্মৃতি জমে আছে সেসব মনে পড়তেই তাচ্ছিল্য হাসলো রূপকথা।

আফিফ বলল,
-“বিয়েটা অবশেষে করছো তাহলে?”

রূপকথা মুখ খুললোনা। শুধু মলিন হাসলো।

আফিফ বিষাদ মাখা চোয়ালে তাকিয়ে বলল,
-“পরিবারের কথায় বিয়ে করছো? তবে থাক। আমি অপেক্ষা করে যাবো। তোমার যখন মনে হবে তখনই এসো।”

ভালো লাগলোনা রূপকথার। এরকম কতশত বাণী মামুন ও তাকে শুনিয়েছে। তবে আফিফের ব্যাপারটা আলাদা। কতবছর যাবত তার পেছনে পড়ে আছে। কয়েকবছর পুরোটা না চিনলেও অনেকটা চেনা হয়ে গিয়েছে তাকে।
রূপকথা আফিফকে স্বাভাবিক করতেই বলল,
-“বিয়েটা নিজ ইচ্ছেতে করছি।”

আফিফ চওড়া হাসি দিয়ে বলল,
-“একবার ভালোবেসে দেখো।”

রূপকথা বলল,
-“একান্তভাবে মন খুঁজে পেলে অবশ্যই ভালোবাসবো। জীবন তো আর থেমে থাকেনা। একজনের শূন্যস্থান পূরণের জন্য অপরজন চলে আসে। জীবন ফুরিয়ে যায়। মাঝে কিছু সুখ, কিছু দুঃখ উঁকি দিয়ে যায়। এর মাঝে ভালোবাসা হয়ে যায়।”

আফিফ খানিক বিরক্তির সুরে বলল,
-“এত কঠিন কেনো তুমি, মেয়ে?”

রূপকথা রহস্যময়ী হাসি দিলো। ফিসফিসানো গলায় বলল,
-“কারণ আমি নারী, আমি অনন্যাময়ী, আমি বিষাদিনী, আমিই রূপকথা।”

বিলের পাড় ঘেষে ছুটলো রূপকথা। তার বহুদিনের কল্পনাটি যেনো বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। কল্পলার জগতের মতো আজ তার পড়নে হলুদ শাড়ি। চোখ, ঠোঁট দুটোই রাঙানো। খোলা চুলের দোল খাওয়া দৃশ্য। মিষ্টি হাসিতে সত্যিই আজ তাকে রূপকথার রাজকন্যার মতো লাগছে।
আফিফ বসে থেকেই উপভোগ করতে লাগলো সেই মনমাতানো দৃশ্য।

#সমাপ্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে