রঙ তুলির প্রেয়সী ১৫.

0
2363

রঙ তুলির প্রেয়সী
১৫.

বাড়ির উঠোনে এসে গাড়ি আঁটকালো রিয়াদ। অনেক বড় উঠোন। একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে গাড়িটা পার্ক করলো রিয়াদ। এইখানে আলাদা কোনো পার্কিং নেই। হেলাল আহমেদরা আগেই চলে এসেছেন দেখা যাচ্ছে। সবাই গাড়ি থেকে নেমে গেল জাওয়াদ ছাড়া। আদিয়া তিথিকে নিয়ে এগিয়ে গেল। ঘরের সাথে লাগোয়া বড় বড় তিনটা সিঁড়ি। ভেতরে যাওয়ার দরজা দুইটা। তিথি যেতে যেতে আদিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ‘দুইটা দরজা কেনরে?’

‘এইযে প্রথমটা হচ্ছে বড় মামার ঘরের। আর তার পরেরটা ছোট মামার।’

‘আলাদা থাকেন নাকি সবাই?’

‘আরে না। চুলা এক। কিন্তু ঘর আলাদা আরকি। এই দুইটা হচ্ছে দুইজনের ঘরের ফটিক।’

‘ফটিক?’ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে তিথি।

‘আহ, মানে ড্রয়িং রুম।’

‘ও। কিন্তু আমরা ঢুকবো কোন ঘরে প্রথমে?’

আদিয়া হেসে বললো, ‘যেকোনো একটা দিয়ে ঢুকলেই হবে। শুধু এই দুইটা ঘরই এমন আলাদা। ঢোকার পরে ভেতরে যাওয়ার আরেকটা দরজা আছে।’ বলতে বলতে বড় মামার ঘরের দিকে গেল আদিয়া তিথিকে নিয়ে।
_______________
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
‘জাওয়াদ, কী হলো? নামছিস না কেন ভাই?’ রিয়াদ গাড়ির দরজা খুলে জাওয়াদের হাতে ধরে টান দিলো।

‘কেমন একটা আড়ষ্টতা কাজ করছে। ভালো লাগছেনা। ইচ্ছে হচ্ছে ফিরে যাই।’ উদাস গলায় বললো জাওয়াদ। বুকের ভেতরটা কেমন করছে তার।

‘বুঝতে পারছি। অনেকদিন পর তো। নেমে আয়।’ জাওয়াদকে টেনে নামালো রিয়াদ। তারপর বললো, ‘চল। নরমাল বিহেভ কর।’

‘ত-তুই চাবি দে। আমি যাই। তোরা থাক।’ অস্থির হয়ে বললো জাওয়াদ।

রিয়াদ বিরক্তির সাথে ‘চ’ কারান্ত শব্দ করলো। তারপর বললো, ‘মাহির স্মৃতি থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাইছিস? অথচ নিজের ঘরেই একগাদা স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকিস সারাদিন। লিসেন ব্রো, তিথির কথা মাথায় রাখ।’

‘রিয়াদ। ঐ মেয়েটা এসেছে এখানে। আমার মাথায় রক্ত উঠে যায় ওরে দেখলে। গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে করে।’

‘ইগনোর কর। আর নরমাল বিহেভ কর। তুই এমন করলে সবাই বুঝে যাবে।’

‘হুম।’ বলে বড় একটা নিশ্বাস নিলো জাওয়াদ। তারপর পা বাড়ালো ঘরের দিকে।
______________

তিথি জড়সড় হয়ে বসে আছে। এতোজন অচেনা মানুষের মাঝে সে কোনোদিন থাকেনি। এই মুহূর্তে তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। সবাই একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। মিনমিন করে উত্তর দিচ্ছে সে। তবে বোঝাই যাচ্ছে আসলেই সবাই খুব মিশুক। হেলাল আহমেদ আর মুনতাহাকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। অন্য কোনো ঘরে আছেন হয়তো। আদিয়াদের দুই মামীই খুব ভালো। খুব আদুরে গলায় কথা বলেছেন তিথির সাথে। মামারাও আদর করে কথা বলেছেন। যেন কতোদিনের চেনা! কিন্তু তিথিই সহজ হতে পারছেনা। কারণটা সে বুঝতে পারছেনা, সে তো খুব সহজেই সবার সাথে মিশে যায়। তাহলে? হুট করে কী হলো? হুট করে এতোজন অচেনা মানুষের সামনে এসে হয়তো মানিয়ে নিতে সময় লাগছে। এমনসময় তিথি দেখলো একজন বৃদ্ধা এসে ঢুকলেন রুমে। সাথে দুটো সুন্দরী মেয়ে। এদের মধ্যে একটা মেয়েকে খুব চেনা চেনা লাগলো তিথির। যেন কোথাও দেখেছে দেখেছে।

‘নানু!’ বলে একটা চিৎকার দিয়ে উঠে গিয়ে বৃদ্ধা মহিলাকে জড়িয়ে ধরলো আদিয়া। তিথি বুঝতে পারলো, ইনি ওদের নানু।

‘ভালো আছিস?’ হাসতে হাসতে আদিয়ার মাথায় হাত বুলালেন চাঁনতারা বেগম।

‘হ্যাঁ। তুমি?’

‘ভালো।’ বলে তিথির দিকে তাকালেন চাঁনতারা বেগম। তিথি উঠে দাঁড়িয়ে হেসে সালাম দিলো। চাঁনতারা বেগম এগিয়ে গিয়ে ওর সামনে দাঁড়ালেন। তারপর তিথির গালে, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ভালো আছিস বোন?’

তিথির প্রাণটা যেন জুড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছিলো একদম যেন নিজের মায়ের মা’র সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে। এতো আপন আপন মনে হচ্ছিলো! তিথি হেসে চাঁনতারা বেগমকে জড়িয়ে ধরলো। চাঁনতারা বেগম তিথির মাথায় হাত বুলালেন। তিথি জড়িয়ে ধরেই বললো, ‘আমি ভালো আছি নানু। আপনি কেমন আছেন?’

‘ভালো আছি। দেখি দেখি ছেড়ে সামনে দাঁড়া তো তোকে দেখি।’ বলে তিথিকে ছেড়ে সামনে দাঁড় করালেন। তারপর কণ্ঠে মুগ্ধতা ছড়িয়ে বললেন, ‘বাহ! কী সুন্দর হয়েছিস৷ একদম তোর মায়ের মতো। না, সুমেলির থেকেও সুন্দরী হয়েছিস। পুতুলের মতো!’

তিথি লজ্জা পেলো। নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফাহি নীরবতা ভেঙ্গে আস্তে করে আদিয়াকে বললো, ‘সত্যিই খুব সুন্দরী। ফুপির বান্ধবীর মেয়ে তাইনা? তোদের ওখানে থাকে?’

‘হ্যাঁ। খুব ভালো গো ও।’ বললো আদিয়া।

এতোক্ষণ থেকে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে নুহা। কোনো কথা বলছেনা কারো সাথে। শুধু আদিয়ার সাথে একটু কুশল বিনিময় করেছিলো। পরক্ষণেই তিথির দিকে চোখ পড়তেই হুট করে মনটা বিষিয়ে উঠলো যেন। চোখের সামনে একটা পরিচিত মুখ মনের অজান্তেই ভেসে উঠলো। সুন্দরী মেয়েরা সবসময় তার থেকে সুন্দরী মেয়েকে হিংসে করে। নুহার বেলায়ও তাই হলো। তিথি জাওয়াদের পাশাপাশি থাকে দিনরাত, এই কারণটাই নুহার মন বিষিয়ে যাওয়ার মূলে। অন্য মেয়েকে সে জাওয়াদের পাশাপাশি সহ্য করতে পারেনা। তারওপর এরকম একটা সুন্দরী… যতোবারই সে তিথির দিকে তাকাচ্ছে, ততোবারই মস্তিষ্কের ভেতর যেন বিষ ছলকে উঠতে লাগলো। সে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে ফুটিয়ে আদিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘কীভাবে বুঝলি ভালো? এরকম অনাথ মেয়েরা কেমন থাকে সবারই জানা। ফুপি যে কীভাবে এরকম জোয়ান একটা মেয়েকে এনে রাখলো! জোয়ান দুটো ছেলে বাড়িতে। এসব মেয়ে ঝোপ বুঝে কোপ মারে।’

বিরক্তি নিয়ে তাকালো ফাহি আর আদিয়া। আদিয়া বললো, ‘নুহাপু, সবসময় নেগেটিভ ভেবো না। তিথি আসলেই ভালো।’ বলে তিথির দিকে এগিয়ে গেল আদিয়া। নুহা আর ফাহিও গেল। আদিয়া গিয়েই তিথিকে পরিচয় করিয়ে দিলো ফাহি আর নুহার সাথে, ‘এই তিথি। এই হচ্ছে ফাহি আপু। বড় ভাইয়ার ঘরে একটা ছবি দেখলিনা? উনার বোন। আমাদের বড় মামার মেয়ে। আর ইনি নুহা আপু। আমাদের খালাতো বোন।’

তিথি দুজনকেই সালাম দিলো। এবার বুঝতে পারলো কেন ফাহিকে তার চেনা চেনা লাগলো। ঐ ছবির মেয়েটার মতো লাগে দেখতে। নুহা আদিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঐ দুটো কই? জাওয়াদ রিয়াদ?’

কেউ কিছু বলার আগেই রিয়াদ আর জাওয়াদ এসে ঢুকলো। আদিয়া জিজ্ঞেস করলো, ‘ছিলে কোথায় তোমরা?’

রিয়াদ বললো, ‘উঠোনে গোবর ছিলো। জাওয়াদের পা গেড়ে গেছিলো। পুকুরে ছিলাম। এই নুহা, কোনো কাজ তো জীবনে করিসনা। আসার পরে গোবরগুলো পরিষ্কার করতে পারলিনা?’

নুহা রেগে গিয়ে বললো, ‘তোরে আমি লাথি দেবো।’

‘হ্যাঁ এটিই শুধু পারিস।’ বলে আড়চোখে একবার ফাহিকে দেখে নিলো রিয়াদ। কেমন একটা জড়তা এসে ভর করতে লাগলো তার মাঝে। ফাহিও লজ্জায় কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। কদিন থেকে রিয়াদের সাথে তার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। নুহার কাছে শুনেছে রিয়াদ নাকি তাকে পছন্দ করে। এটা মনে হতেই লজ্জায় লাল হয়ে যেতে লাগলো ফাহি। সে কাজের বাহানায় বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। নুহার নজর পড়লো জাওয়াদের দিকে। আগের থেকে আরো বেশি হ্যান্ডসাম হয়েছে। আগের মতোই জাওয়াদকে দেখলে বুক ধুকপুক করে নুহার। কিন্তু আশ্চর্য! জাওয়াদ একটা বারের জন্যও তাকাচ্ছেনা নুহার দিকে। যেন সে নুহার উপস্থিতি টেরই পায়নি। নুহার ভেতরটা কেঁদে উঠলো।

‘নানু আমার লক্ষ্মী নানু। কেমন আছো?’ চাঁনতারা বেগমকে জড়িয়ে ধরলো জাওয়াদ। তখনই উনার পেছনে দাঁড়ানো তিথির দিকে চোখ পড়লো তার। হেসে দিলো জাওয়াদ তিথির দিকে তাকিয়ে। তিথিও নিচের দিকে তাকিয়ে হাসলো। এই জিনিসটা চোখ এড়ালোনা নুহার। তার বুকের ভেতরটা কেমন অজানা আশংকায় কেঁপে উঠলো। চাঁনতারা বেগম জাওয়াদকে ছেড়ে আলতো করে ওর গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো, ‘বুড়িটাকে এতোদিনে মনে পড়েছে?’

‘সবসময়ই পড়ে।’ জাওয়াদ উত্তর দিলো তিথির দিকে তাকিয়েই।

‘বুড়িটা তো আমাকে ভুলেই গেল।’ পাশে এসে দাঁড়িয়ে গোমড়া মুখে বললো রিয়াদ।

চাঁনতারা বেগম হেসে বললেন, ‘হয়েছে আর ঢং করা লাগবেনা। কী যে শান্তি লাগছে! এতোদিন পরে আমার ভাইদের দেখে।’ বলে দু’হাতে জাওয়াদ আর রিয়াদের মাথায় হাত বুলালেন উনি। তারপর আবার বললেন, ‘যা তোরা গোসল টোসল করার হলে করে নে। এতো দূর থেকে এসেছিস।’

রিয়াদ বললো, ‘হ্যাঁ, তার আগে মামা মামীদের সাথে দেখা করা লাগবে। আর মা বাবা কই, আদিয়া?’

‘বাবা শুয়ে রেস্ট নিচ্ছেন। আর মা মনেহয় পুকুরে গোসল করছেন।’

নুহা বললো, ‘জাওয়াদ তোরা গোসল করবি? পুকুরেই করতে হবে। আজকে মটরে কী যেন হয়েছে এখানে। পানি নেই। বিকেলের দিকে মিস্ত্রি আসবে।’ বলে জাওয়াদের দিকে তাকালো উত্তরের আশায়। কিন্তু জাওয়াদ ওর দিকে ফিরে পর্যন্ত তাকালো না। রিয়াদ বললো, ‘ভালোই হবে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পানি আছে। আরাম লাগবে।’

জাওয়াদের এই অবহেলা সহ্য হচ্ছেনা নুহার। সে জাওয়াদের দৃষ্টি অনুসরণ করছে। জাওয়াদের দৃষ্টি বারবার একটা জায়গায়ই গিয়ে ঠেকছে। যা দেখে নুহার ভেতরটা বারংবার বিষিয়ে উঠছে। ভেতরের সেই পুরোনো সত্ত্বাটা জেগে উঠছে। সে নিঃশব্দে প্রস্থান করলো। নুহা যেতেই চাঁনতারা বেগমও বেরিয়ে গেলেন। আদিয়া তিথির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই সাঁতার জানিস?’

তিথি ডানে বামে মাথা নাড়লো। আদিয়া বললো, ‘তাহলে তোর গোসল করতে হবেনা। হাত পা ধুয়ে নিবি। তারপর পানি এলে বাথরুমে গোসল করবি।’

‘আচ্ছা।’

‘দিন অনেক লম্বা হয়ে গেছে দেখি। সবেমাত্র সাড়ে বারোটা বাজলো। তিথি আয় তোকে বাড়ি ঘুরে দেখাই।’

‘একটু বোস। আমার কারে বসলে বমি পায়। অনেক কষ্টে বমি আঁটকে এসেছি। শেষের দিকে তো জানালা লাগিয়ে রেখেছিলি।’

‘ও! এজন্যেই এখনও কিছু খাসনাই তুই। আরে, আগে বলবিনা? খারাপ লাগছে? শুবি?’

‘না না, ঠিক আছি এখন।’ বলে একবার আড়চোখে জাওয়াদের দিকে তাকায় তিথি। দেখে এদিকেই তাকিয়ে আছে সে। আশ্চর্য! ছেলেটা এভাবে কেন দেখছে তাকে? আজ সারাদিন থেকে যতোবারই ওর দিকে চোখ পড়েছে ততোবারই দেখেছে তিথি, জাওয়াদ তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চাহনি অদ্ভুত! কেমন বুক কাঁপে তিথির।

জাওয়াদ তাকিয়ে আছে তিথির দিকে। এ কেমন নেশায় বুদ হলো সে? বারবার যেনো তিথি তাকে টানছে। পায়ের ওপর পা তুলে নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে এক দৃষ্টিতে দেখছে তিথিকে জাওয়াদ। রিয়াদ এতোক্ষণ মোবাইলে কিছু একটা দেখছিলো। শেষ করে মোবাইল পকেটে রেখে জাওয়াদকে তাড়া দিলো, ‘জাওয়াদ, চল চল। গরম লাগছে অনেক।’

‘হুম।’ বলে উঠলো জাওয়াদ। ওরা চলে যেতেই তিথি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। এতোক্ষণে অস্বস্তি যেন চেপে রেখেছিলো তাকে।
__________

চলবে………
@ফারজানা আহমেদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে