রঙ তুলির প্রেয়সী ১০.

0
2382

রঙ তুলির প্রেয়সী
১০.

আজ সকাল থেকেই কেমন আবহাওয়া মেঘলা মেঘলা। সবাই একসাথে বসে আছেন মুনতাহাদের ঘরে শুধু জাওয়াদ ছাড়া। হেলাল আহমেদ এর ইচ্ছে হলো এই মেঘলা আবহাওয়াতে পাকোড়া খেতে খেতে জাওয়াদের সাথে দাবা খেলবেন। তিনি রিয়াদকে বললেন, ‘জাওয়াদ কোথায় রে? ঘরে আছে? এক ম্যাচ হয়ে যেতো তবে। এই মুনতাহা যাও পাকোড়া বানাও। অনেকদিন হলো খাইনা।’

‘আছে দেখলাম। কী বই পড়ছে বসে বসে।’ রিয়াদ বললো। আদিয়া পাশ থেকে হেসে বললো, ‘কৌতুকের বই পড়তে দেখলাম।’

‘এতো সিরিয়াস হয়ে কেউ কৌতুকের বই পড়ে!’ তিথি অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো। তিথির কথার ধরণে হেসে দিলো সবাই। তিথি আবার বললো, ‘মামণি সত্যি, তোমার এই ছেলে কী? মানে, আদিয়া আর রিয়াদ ভাইয়াকে দেখো সব কথায় হাসে। কিন্তু উনার মুখে হাসি খুব রেয়ার! উনাকে পালার জন্য এনেছো নাকি?’

তিথির কথায় আবারও হাসলো সবাই। মুনতাহা বললেন, ‘হয়েছে যাই আমি পাকোড়া বানাই। আর কেউ কিছু খাবে?’

‘সিঙ্গাড়া খেতে ইচ্ছে হচ্ছে মা।’ বললো রিয়াদ। আদিয়াও রিয়াদের সাথে হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলালো। মুনতাহা উঠে গেলেন। হেলাল আহমেদ বললেন, ‘যা তো রিয়াদ। জাওয়াদকে বল দাবার বোর্ড নিয়ে চলে আসতে। এখানেই খেলবো।’

কেউ কিছু বলার আগেই তিথি বললো,’আরে আঙ্কেল! লুডু খেলি চলেন। অনেক তো দাবা খেলেছেন। এসব দাবা দুজন ছাড়া খেলা যায়না। চলুন চারজনে লুডু খেলি।’

‘সেটাও খারাপ না। দাঁড়াও তাহলে আমি লুডুটা ইনস্টোল করে নেই মোবাইলে।’ বলে নিজের মোবাইল খুঁজতে লাগলেন হেলাল আহমেদ। তিথি খিলখিল করে হেসে বললো, ‘কীসব যে করেন না আপনারা! আরে রিয়েল লুডুর কথা বলেছি। এটাতে মজা আছে নাকি?’

‘রিয়েল লুডু এখন পাবো কই? মনেহয় গত দু’বছরেও খেলিনি।’ আদিয়া বললো।

‘কেন আমি সেবার এসে না খেললাম?’

‘ঐতো, দু’বছর। আচ্ছা চল খুঁজে দেখি পাই কি না।’ বলে আদিয়া উঠে দাঁড়ালো। হেলাল আহমেদ বললেন, ‘জাওয়াদকে আসতে বলিস।’

‘আচ্ছা।’ বলে তিথিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল আদিয়া।
___________________

তিথি আদিয়াকে বলে নিজের রুমে খুঁজতে এলো টুনিকে নিয়ে। দু’একমিনিট খুঁজে সে টুনিকে বললো, ‘শোনো, তুমি এইখানে দেখো ভালো করে। আমি অন্য রুমে যাই।’

‘আর কই পাইবেন আফা? বড় ভাইজানের রুম আর ছোট ভাইজানের রুম ছাড়াতো এহানে আর কোনো রুম নাই।’

‘ঐ রুমগুলোতেই দেখবো।’

‘ছোট ভাইজানের রুমে হয়তো পারবেন। কিন্তু বড় ভাইজানের রুমে খুঁইজা হুদ্দাই সময় নষ্ট। উনি এইগুলান রাখেন নাকি। উনিতো চিস খেলায়।’

তিথি কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী খেলায়?’

টুনি বিজ্ঞের মতো হাত নাড়িয়ে বললো, ‘আরে আফা চিস চিস। মানে ইংরিজি কইলাম, দাবার।’

তিথি ফিক করে হেসে দিলো। চেস কে চিস বলছে টুনি। তিথি আর কথা না বাড়িয়ে বললো, ‘আচ্ছা না পেলে না পেলাম। খুঁজতে তো সমস্যা নেই। তুমি ভালো করে দেখো।’ বলে বেরিয়ে গেল তিথি।

জাওয়াদের রুমের সামনে এসে দেখলো তিথি যে জাওয়াদের রুমের দরজাটা খোলা। ভেতরে উকি দিলো, কেউ নেই। খানিকটা অবাক হলো তিথি। বিড়বিড় করে বললো, ‘গেল কই!’ বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে বারান্দার দিকে এগোলো। জাওয়াদ একটু বাইরে গিয়েছিলো। রুমে এসে দেখে তিথি বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে বাইরে। আস্তে আস্তে গিয়ে তিথির একেবারে পেছনে দাঁড়ায় জাওয়াদ। তারপর বলে, ‘কী ব্যাপার?’

হুট করে এভাবে পেছন থেকে কেউ কথা বলায় ভয় পেয়ে পেছন ফিরতে গিয়ে স্লিপ খেয়ে পড়ে যেতে নেয় তিথি। জাওয়াদ তিথির ডান হাত ধরে হ্যাচকা টান দেয়। তিথি উড়ে এসে পড়ে জাওয়াদের বুকে। আকস্মিক ঘটনায় স্তব্ধ তিথি কথা বলতেই ভুলে গেল। জাওয়াদ কড়া ভাবে তিথির চোখে চোখ রেখে বললো, ‘এতোটা কেয়ারলেস কেন? এক্ষুনি তো পড়ে ঠ্যাং ভেঙ্গে ফেলতে।’

তিথি কিছু বলতে চেয়েও পারছেনা। গলায় শব্দ আঁটকে যাচ্ছে। নিশ্বাসও আসছে আঁটকে আঁটকে। তিথি এমন এক ধ্যানে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে জাওয়াদের টনক নড়ে। তিথিকে ছেড়ে সরে দাঁড়ায় সে। তারপর বলে, ‘এখানে কী?’

তিথি কাঁপছে। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। এখনও ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারছেনা। মনে হচ্ছে যেন তার দুনিয়া ঘুরছে। সে আমতাআমতা করে কিছু বলতে যাবে তখনই টুনির গলা শুনলো, ‘আফা খালুজান ডাকতেছেন আপনেগো।’

জাওয়াদ মাথা ঘুরিয়ে বললো, ‘আমাকেও?’

টুনি নিচের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হ। খালাম্মা পাকোড়া বানাইছেন, খাইতে ডাকে।’

তিথি জাওয়াদকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। টুনিও চলে গেল। জাওয়াদ ব্যস্ত হয়ে এসে নিজের বিছানায় বসলো। তার বুক ধড়ফড় করছে। গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে এক নিশ্বাসে গিলে ফেললো। তারপর জোরে জোরে নিশ্বাস নিলো। ঢোঁক গিলে বিড়বিড় করলো, ‘ওরও… ঠোঁটের নিচে… তিল!’
__________________

আদিয়ার রুমেই পাওয়া গেল লুডু। হইহই করে লুডু খেলা হচ্ছে। আদিয়া আর তিথি এক টিম। রিয়াদ আর হেলাল আহমেদ এক টিম। যেহেতু চারজনেই খেলতে হয় সেহেতু জাওয়াদ চুপচাপ বসে বসে পাকোড়া খাচ্ছে আর খেলা দেখছে। খেলা দেখছে বললে ভুল হবে, সে তিথিকে দেখছে। এই প্রথম, মন দিয়ে দেখছে সে তিথিকে। যতোই দেখছে ততোই বুকের কাঁপন বেড়ে যাচ্ছে তার। বারবার একটা পরিচিত মুখ ভেসে উঠছে ওর চোখের সামনে। অস্থির লাগতে লাগলো জাওয়াদের। তিথির ঠোঁট, ঠোঁটের নিচের তিল, ঘন পাপড়ির চোখ… সবকিছু… সবকিছু আজ মন দিয়ে দেখছে জাওয়াদ। সবকিছু তাকে বারবার একটা মুখই মনে করিয়ে দিচ্ছে। চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করতে চাইলো জাওয়াদ। নাহ, পারছেনা। উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরলো। হাঁটতে হাঁটতে শুনলো পেছনে তিথি বলছে, ‘রিয়াদ ভাইয়া এসব ঠিকনা কিন্তু তুমি খালি ঠকাচ্ছো। এই টুনি তুমিই বলো আমার ছক্কা এসেছে না? আমি খেয়েছি রিয়াদ ভাইয়ার গুটিটা।’

অস্থির বুকে হাসলো জাওয়াদ। পেছন ফিরে তাকালো একবার, তারপর নিজের রুমে চলে গেল।
________________

গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে পৃথিবীর বুকে। সন্ধ্যা নামার আগেই পৃথিবী যেন অন্ধকার। নিজের বারান্দার দরজার সামনে বিষন্ন মনে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে জাওয়াদ। আজ ভালো লাগছেনা কিছু। পুরোনো স্মৃতিরা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বুকের ভেতর একটা চাপা কষ্ট বারবার উঁকি দিচ্ছে। মাথা ঝাড়া দিয়ে বা’দিকে তাকাতেই যেন একটা ধাক্কা খেলো জাওয়াদ। ধক করে উঠলো তার বুক। সে চট করে নিজেকে আড়াল করে নিলো। তারপর দেখতে লাগলো। হাঁটুর একটু উপর সমান খোলা চুল নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে তিথি। তারপর রেলিংএ পিঠ ঠেকিয়ে মাথাটা পেছনদিক দিয়ে হেলিয়ে দিলো। হাত দু’টি মেলে ধরলো দু’দিকে একটা পাখির মতো। মাথা হেলিয়ে দেয়ায় চুলগুলো পিঠ বেয়ে কেমন ঝুলে আছে রেলিংএর বাইরে। বাতাসে নড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে যেন একটা হার্টবিট মিস করলো জাওয়াদ। বুকের বা পাশে হাত চলে গেল আপনআপনি। অস্ফুট স্বরে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘ওহ মাই গড!’ জাওয়াদের চোখে পড়লো, তিথি পেছনদিকে হেলে থাকার কারণে তার টপস টা খানিক উপরে উঠে নাভি বেরিয়ে এসেছে। চোখ বন্ধ করে ফেললো জাওয়াদ, সাথেসাথে আরেকটা দৃশ্য ভেসে ওঠে তার চোখের সামনে। জাওয়াদ আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। ভেতরে চলে এলো। বিছানায় বসে হাসফাস করতে লাগলো। ধুপ করে চিত হয়ে শুয়ে পড়লো সে বিছানায়। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো চোখে দু’বছর আগের সেই মধুর সময়টা। শেষ বারের মতো নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে সে কাছে পেয়েছিলো। ছুঁতে পেরেছিলো, আদর করতে পেরেছিলো…

সেদিন জাওয়াদের বড় মামার ফ্যামিলি বেড়াতে এসেছিলো তাদের বাড়ি। পরদিনই জাওয়াদের ফ্লাইট ছিলো। বন্ধুদের সাথে তিন’মাসের ট্রিপ সিঙ্গাপুরএ। বড় মামার দুই মেয়ে, মাহি এবং ফাহি। মাহি জাওয়াদের সমবয়সী। ফাহি দু’বছরের ছোট। আর এই মাহির সাথে জাওয়াদ তার জীবনের সুন্দর মুহূর্ত গুলো কাটানোর স্বপ্ন দেখে। দুজনে মিলে টুনা টুনির সংসার পাতানোর স্বপ্ন দেখে। দুই পরিবারের ও সম্মতি আছে এই সম্পর্কে। কোনো বাধা না থাকায় দিন দুনিয়া ভুলে ভালোবাসায় মত্ত থাকতো দুজনে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইজেলে রঙ তুলিতে ছবি আঁকছিলো জাওয়াদ। এমন সময় মাহি এসে দাঁড়ায় দরজায়। মাহির উপস্থিতি টের পায় জাওয়াদ, কিন্তু ভাব ধরে যেন বুঝতে পারেনি। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে মাহি, ‘আসতে পারি?’

জাওয়াদ ছবি আঁকতে আঁকতেই বলে, ‘এসেই তো গেলি। আর আসবি কী?’

‘তাহলে চলে যাবো?’

এবার তাকায় মাহির দিকে জাওয়াদ। একটা লাল রঙের এক কালার সেলোয়ার-কামিজ পরেছে মাহি। কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো সিথি করে খুলে সামনে এনে রেখেছে। জাওয়াদ নিচের দিকে তাকিয়ে একবার হাসে। তারপর মাহির দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে, ‘তুই বড্ড জ্বালাচ্ছিস। অ্যালকোহল আমি নেইনা। তুই নিজেই আস্ত একটা অ্যালকোহল হয়ে ভর করছিস আমার ওপর।’

মাহি হেসে ফেলে। বলে, ‘হয়েছে হয়েছে। কী আঁকছিস?’

‘যা-ই আঁকি। দেখাবোনা।’

‘দেখাইওনা। তোর জন্য এনেছিলাম একটা জিনিস।’ বলে পেছনে রাখা দু’হাত সামনে আনে মাহি। জাওয়াদের প্রাণখোলা হাসিমুখের একটা ছবি। রঙ তুলিতে এঁকেছে মাহি। ছোটবেলায় দু’জনেই একসাথে ছবি আঁকা শিখেছে। মাহির আঁকা সেই ছবিটা এখনও ঝুলছে জাওয়াদের ঘরের দেয়ালে।
____________

চলবে…….
@ফারজানা আহমেদ
চাইলে সবাই গ্রুপে এড হতে পারেন। লিংক- https://www.facebook.com/groups/831432960641690/?ref=share
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে