রঙিন খামে বিষাদের চিঠি পর্ব-১৬+১৭

0
461

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ১৬
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৩৫,
রোজার সাথে তাদের বাসায় ঢুকলো আয়াত এবং রিয়ানা। ঢুকতেই দুজনই অবাক হয়ে যায়। সবাই একদম নতুন জামাকাপড় পরে তৈরি হয়ে সোফায় বসে আছে। ইয়াসিন সাহেব, ফাতেহা খানম, জুবায়ের, রায়াদ চারজনই উপস্থিত। জুবায়েরকে দেখে ভ্রুকুটি করে তাকালো রিয়ানা। এই লোক তো রায়াদ সাহেবের বন্ধু। তবুও সব-টা সময় এই বাসাতেই পরে থাকে। অদ্ভুদ লাগলো রিয়ানার কাছে। আয়াত ফাতেহা খানমের দিকে অগ্রসর হয়ে বললো,

“আন্টি, সবাই একদম এত সাজগোজ করে রেডি! ব্যাপার কি? কোথাও যাচ্ছেন আপনারা?”

ফাতেহা খানম বললেন,

“না মা, আমরা কোথাও যাচ্ছি না। তোমার আংকেল এমনিই আমাদের নিয়ে ডিনার করতে নিয়ে যাবে বলে মনঃস্থির করলো। এজন্য ডাক দেওয়া তোমাদের।”

“এটা তো রোজা বললো না। তাহলে আমরাও একটু সেজেগুজে বেরুতে পারতাম৷”

আয়াত মুখ ফুলিয়ে কথাটা বললো। ফাতেহা খানম হাসলেন আয়াতের প্রতিক্রিয়া দেখে। উঠে এসে আয়াতের গালে হাত রেখে বললেন,

“আমার ৩টা মেয়ে-ই মাশা আল্লাহ পরি। তাহলে আলাদা করে সাজগোজের কি প্রয়োজন!”

আয়াত বললো,

“আচ্ছা বাদ সেসব। কিন্তু আচমকা কি উদ্দেশ্যে এই ডিনারে যাওয়া? একটু কারণ তো বলুন আন্ট!”

“কিছু না মা। এমনিই অনেকদিন পরিবারকে সময় দেওয়া হয়না। এজন্য ভাবলাম আজ ফ্রি আছি। একটু একসাথে সময় কাটাই।”

ইয়াসিন সাহেব বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে আয়াতের দিকে তাকিয়ে কথাটুকু বললেন৷ রিয়ানা দরজার কর্ণারে চুপচাপ দাড়িয়ে সবার কথাবার্তা শুনছিলো। ইয়াসিন সাহেবের কথা কর্ণগোচর হতেই সে আনমনে একটু হাসলো। এক বন্ধু মেয়ে সময় চাইলেই দোষ দিয়ে এড়িয়ে যায়। আরেকজন নিজ ইচ্ছেয় সময় দিতে চায়। আকাশ পাতাল তফাৎ। রিয়ানার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠা হাসি আর কেউ খেয়াল না করলেও জুবায়ের, রায়াদ দুজনই খেয়াল করলো। রিয়ানাকে কোনো ঝগড়া ছাড়াই আজ থ্রিপিস পরে আসতে দেখে একটু শকড হয়েছে দুজনই। এজন্য না চাইতেও তাকে খেয়াল করছিলো দুজনে। জুবায়ের রায়াদের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,

“ঘাড়ত্যাড়া মানুষের হঠাৎ করে সোজা হওয়া! হজম হয় কেন?”

রায়াদের কানে জুবায়েরের কথা-টা যেতেই সে কটমটিয়ে তাকালো জুবায়েরের দিকে। জুবায়ের বোকা চাহনীতে হাসার চেষ্টা করলো। বললো,

“এত রাগিস কেন কথায় কথায়?”

“কারণ তুই ভালো কথা কম, ফাল’তু কথা-ই বেশি বলিস। ইচ্ছে তো করে গলা টি’পে ধরি।”

জুবায়ের গলা-টা এগিয়ে দিয়ে বললো,

“নে ধর। তোর জন্য আমার জান সবসময় কুরবান করতে রাজী আছি।”

রায়াদ ফাজলামির মাঝেও জুবায়ের কথা শুনে আলতো হাসলো। ভাগ্যিস ফ্রেন্ডশিপ এক্সেপ্ট করেছিলো! নয়তো এই পাগল-টাকে কোথায় পেত! জীবনে আর কিছু না হোক জুবায়েরের মতো একজন মানুষকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে আফসোস নেই রায়াদের। জুবায়ের রায়াদের হাসির প্রতিত্তোরে নিজেও হাসলো। ইয়াসিন সাহেব সবাইকে তাড়া দিলেন বেরুনোর জন্য। সবাই নিচে নেমে আসলো। ইয়াসিন সাহেব নিজেই ড্রাইভ করবেন। এজন্য গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করলেন। জুবায়ের এবং রায়াদ জুবায়েরের বাইকে যাবে। এজন্য দুজন আগেই বাইক নিয়ে চলে যায়। লোকেশন জানা-ই আছে। ইয়াসিন সাহেব গাড়ি বের করতেই পেছনে রোজা, আয়াত এবং রিয়ানা বসলো। ফাতেহা খানম এবং ইয়াসিন সাহেব সামনে বসলেন। সবার বসা হয়ে যেতেই গাড়ি স্টার্ট করলেন ইয়াসিন সাহেব। রিয়ানা জানালার ধারে বসেছে। আয়াত মাঝখানে, রোজা অন্যপাশে। আয়াত বোনের কাঁধে মাথা এলিয়ে বসলো। দুজনেই এক আবহাওয়ায় ছোট থেকে বড় হওয়ায় বাংলাদেশের আবহাওয়ায় নিজেদের মানিয়ে নিতে একটু সমস্যা-ই হয়ে যায় তাদের জন্য। ঠান্ডা পরিবেশে বড় হয়ে এদেশের গরম আবহাওয়ায় মাথা ধরে যায় দুজনের-ই। এরমাঝে বাসার সব কাজ একা হাতে সামলানো! আয়াতের মাথা ব্যথা ধরে বসেছে। এ কারণে রিয়ানার কাঁধে মাথা রেখে বসা তার। রিয়ানা এক পলক বোনকে দেখে আয়াতের মাথার চুলে হাত চালিয়ে দিলো। আলতো হাতে টেনে দিয়ে কপালে ম্যাসাজ করে দিতে থাকে। সে জানে তার বোন কখন এমন নেতিয়ে পরে। আয়াতের খুব বেশি খারাপ না লাগলে সে এমন নিস্তেজ হয়ে যায় না। রোজা দুবোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। কেমন একটা আফসোস হচ্ছে তার। ইশশ তার-ও যদি এমন বোন থাকতো! তাহলে তার বন্ডিং টাও আয়াত এবং রিয়ানার মতো হতো। আফসোস তার বোন নেই। আছে রাগী, গম্ভীর, বদমেজাজি একটা ভাই। রোজা রায়াদের কথা ভেবে গাল ফুলিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।

৩৬,
রায়াদ এবং জুবায়ের আগেই রেস্টুরেন্টের সামনে এসে পার্কিং লটে বাইক পার্ক করে দুজনেই বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে বাকিদের জন্য অপেক্ষা করছে। গুলশান-২ এর সিক্স সিজন হোটেলের স্কাই পুল রেস্তোরায় এসেছে তারা৷ ফোনের স্কিনে সময় দেখলো। আট-টা বাজতে চলেছে৷ ১১টার মাঝে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যায়। বাবা-মায়ের আসতে এত লেইট কেন হচ্ছে! বুঝতে পারছেনা রায়াদ। জ্যামে পরেছে হয়তো। এই ভেবে রাস্তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো দুজনে। জুবায়ের ফোনে মনোযোগ দিয়ে ফেসবুক স্ক্রল করছে। রায়াদ জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে মেজাজ হারিয়ে বললো,

“জলজ্যান্ত একটা মানুষ পাশে দাড়িয়ে। তার সাথে কথা না বলে তোর ফোন ঘাটাঘাটি করতে হচ্ছে?”

“জলজ্যান্ত মানুষ আমার বেশি কথা সহ্য করতে পারেনা।”

জুবায়ের মেয়েদের মতো ঠোঁট বাকিয়ে কথা-টা বললো। রায়াদ দুম করে।জুবায়েরের পিঠে কিল বসিয়ে দেয়। থমথমে গলায় বলে,

“মেয়েদের মতো ফেইস রিয়েকশন দিবিনা। রাগ উঠে।”

“ওটা তোর নাকের ডগাতেই থাকে।”

“বাদ দে। আগে বল ঐ মেয়ের বাবা! আয়াতের মতো মেয়ে জুটেছিলো! ভেঙে দিয়েছিস! এসব কথার মানে কি? এ ক’দিন না আমার সাথে তেমন কথা বলছিস। না আমার সাথে যোগাযোগ করছিস। সে-ই যে বাসা থেকে গেলি; আজ আম্মু ফোন না দিলে আসতিও না।”

“তুই বাসায় ডেকেছিলি; সেদিন গিয়েছিলাম তোদের বাসায়। তোর আংকেল মানে আয়াত এবং রিয়ানার বাবা। উনাকে দেখে কিছু-টা ভয় পাই। উনার নজর এড়িয়ে চলে যেতে ধরে বাইক সহ আমি পরে যাই পাকা রাস্তায়। ভয় আর ব্যথা আবার সেদিন বৃষ্টি! সব মিলিয়ে জ্বর এসে পরে। দূর থেকে দেখলাম আংকেল আংকেল ডাকছিস। গেইজ করি উনি তবে আয়াতের বাবা। পরে রোজার কাছে কল দিয়েও বিস্তারিত জেনে নিই। এজন্য তখন চলে গেলেও পরে আসতে ভয়-ই লাগছিলো।”

“কিন্তু আংকেল তোর কি করলো?”

জুবায়েরের কথা শুনে অবাক হয় রায়াদ, এরপর প্রশ্ন-টা করে। জুবায়ের হাসলো, হাসিমুখে বললো,

“পরিচয় ভুলে যাচ্ছিস আমার! জুবায়ের চৌধুরী রায়াদ। দাদার একমাত্র নাতী, বাবার একমাত্র ছেলে। চৌধুরী বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারি। সে বাড়ি ছেড়ে টইটই করে বেড়াচ্ছে! তাকে তো ঘরে বাধা দরকার এবার! অথচ ঐ ঘর-টা আমার জন্য জাহান্নাম বানিয়ে দিয়েছে স্বয়ং তারা-ই।”

“কিন্তু এরসাথে তোর আয়াতের, তার বাবার কি সম্পর্ক?”

“জবের জন্য ঢাকা ছেড়ে গেলেও এরমাঝে বাবার কল পাই আমি। বাড়িতে যেতে বলে ইমার্জেন্সি। যাওয়ার পর দেখলাম বিয়ের কথা তুলেছে তারা। পাত্রী-কে দেখে উনারা সব পছন্দ করেই রেখেছিলো। শুধু আমি যাওয়ার পর আমায় দেখে কথা পাকাপোক্ত করতে আয়াতের বাবা আমাদের গ্রামে আসেন। কিন্তু আমাদের বাড়ি অব্দি পৌঁছানোর আগেই আমি তাদের মুখোমুখি হই। মুখে মাস্ক, মাথায় ক্যাপ, চোখে সানগ্লাস, শার্ট, জিন্স পরে নিজেকে আড়াল করে সুন্দর মতো উনাদের বলি, ছেলে সম্পর্কে তাদের যা জানানো হয়েছে সব মিথ্যা। তার পড়াশোনা নেই, জব নেই। বাবার টাকায় চলে। বাড়ির মানুষ ভালো না। মেয়েকে আঁটকে রাখবে। বাবা-ছেলের মিলেনা বলে ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। ছেলের সম্পর্কে তার বাবা মিথ্যা জানিয়ে বিয়ে করাতে চাচ্ছে।আয়াতের বড় আংকেল আমার বাবার বিজনেস পাটনার। এজন্য উনাকে দেখেই চিনেছিলাম।১৪-১৫বছর বয়সে উনাকে দেখেছিলাম। এরপর বাড়ি ছাড়া আর এত বছর পর দেখা। আমি তো বড় হয়ে গেছি এজন্য হয়তো ঠিকঠাক চিনতে পারেননি আমায়। কিন্তু আমি চিনেছিলাম। উনি আমার কথা বিশ্বাস করতে চাচ্ছিলেন না। বললাম, আমি ছেলের বেস্টফ্রেন্ড। আমি কি করে তার সম্পর্কে মিথ্যা বলি! আর একটা মেয়ের জীবনও বা কি করে নষ্ট হতে দিই! এলাকার আমার সাথের আরও ২-৪জন ছেলেপুলে-কে দিয়ে আমার সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলাই। ওনারা যেখানে নেমেছিলেন! সেখান থেকেই বিদায়। মাঝখানে শুধু দু-ভাই ওখানেই ঝগড়া শুরু করেছিলেন। আয়াতের বাবা বারবার বলছিলেন, তার শিক্ষিত নম্র ভদ্র মেয়ের জন্য এমন ছেলে কি করে সিলেক্ট করলেন উনি! তখন বুঝতে পারি বাবার বিজনেস পাটনারের ভাই উনি। উনার সাথেও বাবার তুমুল ঝগড়া হয় এসব কথা নিয়ে। এজন্য ফিরতে দেরি হয়। আর আমিও কেটে পরি ঝগড়া দেখে। এখন আয়াতের বাবা আমায় দেখে চিনে ফেলবেন নিশ্চিত! এই ভয় হচ্ছে। বলেছিলাম এক রকম। এখন অন্য রকম দেখলে তো বিপ’দ। বাবার মুখে শুনেছিলাম আমার ছবিও উনাকে দেখানো হয়েছে। কিন্তু আয়াতের ছবি আমি দেখিনি, আর হয়তো সে-ও আমার ছবি আগে দেখেনি। যার ফলে দুজন দুজনকে চিনিনি, কিন্তু আংকেল কে তো চিনি। উনি আমায় দেখলে ব্যান্ড বাজিয়ে দিবেন তো। এজন্য মুখোমুখি হতে ভয় লাগছে।”

৩৭,
রায়াদ সব শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ়। মাঝখানে এত কাহিনী হয়ে গেছে! রায়াদ হাত কপালে উঠে যায় সরাসরি। জুবায়ের বুকে হাত বেঁধে দাড়িয়ে আছে। তখনই ইয়াসিন সাহেব সবাইকে নিয়ে পৌছে যান। গাড়ি পার্ক করে সবাই নামার পর রায়াদ বলে,

“এসব এখন বাদ থাকুক। পরে ভাবা যাবে।”

“হুম।”

জুবায়ের মাথা হেলিয়ে সম্মতি দেয়। দুজনে এগিয়ে যায় রিয়ানা-দের দিকে। রায়াদ তার বাবার দিকে তাকিয়ে জিগাসা করে,

“এত লেইট হলো?”

“একে তো জ্যাম। এরমাঝে তিন জনই রাস্তায় ফুচকা দেখে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছিলো। রেস্টুরেন্টের খাবারের থেকে ফুচকা ওদের বেশি প্রিয়। তা খাইয়ে নিয়ে আসতে দেরি হলো।”

রায়াদ ইয়াসিন সাহেবের উত্তর শুনে তিনজনের দিকেই বিরক্তিমাখা চাহনীতে তাকায়। কি আছে এই ফুচকার মাঝে! কে জানে। দেখলেই একেক-টা মেয়ে পাগল হয়ে যায় অদ্ভুত। রায়াদ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“চলো তবে ভেতরে যাওয়া যাক?”

রায়াদের কথার সাথে তাল মিলিয়ে সবাই হোটেলের ভেতরের দিকে পা বাড়ায়৷ রিয়ানার এই প্লাজু পরে হাঁটতে কি যে বিরক্ত লাগছে! ইচ্ছে তো করছে তার জিন্স পরতে। কিন্তু সাথে নেই। নয়তো পাল্টে নিতো। সাদা এবং হালকা সবুজ রঙের কম্বিনেশনের জামা এবং সাদা সালোয়ার ওরনা পরেছে রিয়ানা। রায়াদ আড়চোখে আরও একবার রিয়ানাকে দেখে নিলো। মেয়ে-টার এমন ড্রেস পরে থাকতে কি হয়! পোশাকেই নারীর সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। শরীর দেখিয়ে তো শুধু নির্লজ্জ ছাড়া কিছুই মনে হয়না রায়াদের। অথচ লজ্জা নারীর ভূষণ। রায়াদ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। লিফটের সামনে এসে সবাই লিফটের ভেতরে ঢুকে পরে। ১৪তলায় এসে লিফট থামে। ওরা বেরিয়ে এসে সিড়ি বেয়ে ১৫তলায় উঠে। সেখানেই স্কাই পুল রেস্তোরাঁ। যার ডান সাইডে মাঝারি সাইজের-ই বলা চলে এমন পুল। এবং বাম সাইডে বসার ব্যবস্থা করা। বুফে সিস্টেম রেস্তোরাঁ এটা। পুলের পশ্চিম পাশে হাঁটাচলার একটু ফাঁকা স্পেস আছে। সবাই ঘুরেফিরে রেস্তোরাঁ-টা দেখতে থাকে। রিয়ানা সোজা গিয়ে রেলিং ঘেষে দাড়িয়ে পরে। দৃষ্টি, রাতের লাল-নীল লাইটের আলো, রাস্তায় সোডিয়ামের আলোয় ঝকমক করা ব্যস্ত এক টুকরো ঢাকা শহরের বুকে। সবার জীবন-ই ব্যস্ততায় বয়ে যাচ্ছে স্রোতের মতো। শুধু রিয়ানা-ই কি সে-ই এক ব্যক্তিতে আঁটকে আছে! ভেবে পেলোনা রিয়ানা। ছাড়লো দীর্ঘশ্বাস। তার ভাবনার মাঝেই রোজা ডাক দিয়ে বললো,

“আপু এসো, সবাই খাওয়া শুরু করেছে।”

রিয়ানা পা বাড়ালো সেদিকে।

চলবে?

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ১৭
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৩৮,
পরপর কেটে গেলো আরও দুসপ্তাহর মতো সময়। রিয়ানার দেশে আসার একমাস পূর্ণ হয়ে কেটে গেলো বেশ কিছুদিন। সময় কত দ্রুত বয়ে যায়। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন দেশে আসলো। অথচ কত তাড়াতাড়ি একমাসেরও অধিক সময় কেটে গেলো। দিন কে দিন তার নিজের অনুভূতি গুলো কেমন মৃত হওয়ার পথে। কিছুতেই আর আগ্রহ নেই। যে যেমন বলছে, শুনে যাচ্ছে। পছন্দ হলে কথা রাখছে, নতুবা কষ্ট দিচ্ছে সবাইকে। ব্যস এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছে। সকালে উঠে নাস্তা করা, বোনের সাথে খানিকক্ষণ আড্ডা দিয়ে রুমে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে নিজের ফ্রেন্ড’সদের সাথে গ্রুপচ্যাটে আড্ডা দেয়। এরপর টুকটাক নিজের মতো সময় কাটায়। সময়-টা যায় হয় বারান্দায় বসে উদায় হয়ে বসে থেকে। নয়তো আকাশে শূণ্য দৃষ্টি মেলে। অথবা কখনও বিকেল-টা কাটে রোজার সাথে। দুবোনে রোজার সাথে বাইরে গিয়ে বাসার আশেপাশে কোনো একটা ফুচকা স্টলে বসে ফুচকা খেয়ে। আবার কখনও কোনো একটা ক্যাফে-তে বা রেস্টুরেন্টে গিয়ে জম্পেশ খাওয়া দাওয়া করে। রাতটুকু তো ঘুমেই কেটে যায়। রিয়ানার একটা ভালো গুণ, যত যন্ত্রণা-ই হোক! ঘুম-টা ছেড়ে যায় না। বিছানায় গা এলিয়ে দিলে ঘুমিয়ে পরে সে। ব্যস এভাবেই দিন চলে যায়। সময়-টা মন্দ না! ভালো-ই কাটছে তার। কিন্তু এখানে এভাবে থাকতে আর ইচ্ছে করছেনা রিয়ানার। মন তো বলছে জার্মানি চলে যেতে। সেখানে গেলে মন খারাপের রেশ হলেই সে নিজের মনমতো ঘুরে বেড়াতো। আর এখানে একপ্রকার বন্দী জীবন। বেরুতে পারবেনা এমন না, কিন্তু রাস্তাঘাট চেনা! এটাই বড় বিষয় হয়ে দাড়িয়ে। ফোনের জিপিএসের সাহায্যে চলতে পারলেও চেনাশোনা আর অচেনা! বিস্তর তফাৎ। হানিফ সাহেব আজও গ্রাম থেকে ফিরেননি। ফিরে আসা-টা জরুরী। এরপর বাবাকে বলে জার্মানির টিকেট কেটে নিয়ে চলে যাবে সে। আয়াত আর হানিফ সাহেব গেলে যাক! না গেলে না যাক। তার কিছু যায় আসেনা৷ সামনে উইন্টার সেমিস্টার আসছে। সে ইউনিভার্সিটিতে এডমিট হয়ে যাবে এবার। সহজ ভাষায় গিউনেজিউম ধাপ শেষ হওয়ার উপর যা শেখানো হয় তার ব্যসিসে ৬মাস একটা প্রজেক্ট হয় কলেজে। সেটা শেষ করেই আপাতত ব্রেকে ছিলো রিয়ানা। আর সেই সুযোগেই তার বাবা দেশে আনলো। এবার গিয়ে ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়ার প্রসেস শুরু করবে সে। উইন্টার সিজনে শুরু করলে দেখা যাবে পছন্দের সাবজেক্ট বা পছন্দের ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেতে পেতে সামার সিজন না এসে বসে! মানুষের মন বোঝা নাকি বড্ড বেশি-ই কঠিন! আর মানুষের শরীরের থেকে মনের অসুখ-ও নাকি বেশি! এজন্য তো রিয়ানার ইচ্ছে মনোবিজ্ঞানী হওয়ার। আর পড়াশোনা করতেও চায় এই বিভাগেই। এখন উপরওয়ালা জানেন তার ইচ্ছে পূরণ হবে কিনা! রিয়ানার হাতের ফোন-টা বেজে উঠায় সব ভাবনা-চিন্তার জগতে বিপত্তি ঘটলো। চকিতে ফোনের দিকে তাকালো। ফোনের স্কিনে জ্বলজ্বল করছে সাজ্জাদের নাম। অদ্ভুত! এই লোক-টা এতদিনে এতমাস পর কল দিলো? কি কারণে? বুঝে আসছেনা রিয়ানার। কথা বলে মায়া বাড়াতে চাইলো না সে। কল-টা কেটে দিলো৷ তৎক্ষনাৎ একমিনিটের মাথায় মেসেজ আসলো। রিয়ানা মেসেজ-টা ওপেন করতেই দেখতে পেলো, ‘চাচার অসুখ গুরুতর। আয়াতের কাছে কল দিলাম ধরলো না। বাধ্য হয়ে আপনার কাছে কল দিলাম। সবাই উনাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ায় খবর-টা আমার উপর-ই পৌঁছানোর দায়িত্ব ছিলো। যদি সম্ভব হয় আয়াতের সঙ্গে গ্রামে আসবেন। অথবা তাকে আসতে বলবেন।’

রিয়ানা মেসেজ-টা পড়ে হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে। বাবা অসুস্থ! কি করে কি হলো? ডিটেইলস জানতে মুহুর্তে কলব্যাক করলো সাজ্জাদের নাম্বারে। কিন্তু এবার তার কৃত কর্মের উল্টো প্রতিক্রিয়া আসলো। ওপাশ থেকে কল-টা কেটে দেওয়া হলো। রিয়ানা এই দুঃসংবাদের মাঝেও চোখের কোণে অশ্রু জমিয়ে হেঁসে ফেললো। আনমনে বিরবির করে বললো,

“অভিমান আজও জমিয়ে রেখেছেন! ফিরিয়ে দেওয়ার দিন আপনি করে বলেছিলেন! আজও বললেন। অথচ আমি যেদিন আপনার তরে এসেছিলাম! চাইলেই পারতেন আপন করে নিতে। কিন্তু আমার জেদের পর আপনার জেদ! দুজনের অনুভূতিকে মনের কবরে দাফন করিয়ে ছাড়লো। তবে এই অভিমান কিসের তরে সাজ্জাদ ভাই!”

রিয়ানা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চোখের কোণে অশ্রু মুছে আয়াতের রুমের দিকে পা বাড়ালো। উদ্দেশ্য বোনকে বাবার বিষয়-টা অবগত করে সাজ্জাদের কাছে কল করতে বলা। আয়াতের কল অন্তত সে কাটবেনা।

৩৮,
রাতের প্রায় ১টা। রায়াদের মনে বিক্ষিপ্ত অনুভূতির ছড়াছড়ি। একটা কথা বেশ ভাবিয়ে ছাড়ছে তাকে। আজ দুসপ্তাহ যাবত একটা কথা তাকে বেশ করে পিছু নিয়েছে। উঠতে-বসতে, খেতে-শুতে একটা কথা ভীষণ করে ভাবাচ্ছে তাকে। হাতের ফোন-টা নিয়ে সময় খেয়াল না করেই জুবায়েরের কাছে কল লাগালো রায়াদ। একবার, দুবার, তিনবার কল হয়ে কেটে যাওয়ার পর ৪র্থ বারে গিয়ে জুবায়ের কল রিসিভ করলো। রায়াদ কিছু বলবে! তার আগেই জুবায়ের বিস্মিত কণ্ঠে শুধায়,

“এতরাতে এভাবে কল কে দেয় হারামি? ঘুমের বারো’টা বাজাতে শিখলি কবে থেকে? দ্যা গ্রেট রায়াদ শাহনেওয়াজ তো টাইম সম্পর্কে বেশ স্ট্রিক্ট। টাইমলি ঘুমায়। অথচ আজ জেগে থেকে নিজেও ঘুমায়নি! অন্যের ঘুমেরও বারো’,টা বাজিয়ে দিলো! কাহিনী কি?”

“আচ্ছা জুবায়ের, ভালোবাসা একটা মানুষকে বদলাতে পারে তাইনা?”

জুবায়ের আরেক দফা অবাক হলো। কানের কাছ থেকে ফোন নামিয়ে উপুর হয়ে শুয়েছিলো সে। সোজা হয়ে শুয়ে ফোনের স্কিনে নাম্বার-টা ঠিক করে দেখে নিলো। না, রায়াদেরই নাম্বার। কিন্তু কথাবার্তা এরকম অন্যজনের মনে হচ্ছে কেন তার কাছে? গলার স্বরও একই তো লাগলো। সে ফের কানে ফোন ঠেকিয়ে প্রশ্ন করলো,

“মদ-টদ খেয়েছিস নাকি? তোর গলায় ভালোবাসার কথা? নাকি আমি-ই ড্রিংক করে বসেছি! ভুলভাল শুনছি।”

“চুপ করবি তুই? আমি যা জিগাসা করলাম উত্তর দে।”

রায়াদ জুবায়েরের অভিব্যক্তি শুনে মেজাজ হারিয়ে ক্ষিপ্ত স্বরেই কথা-টা বললো। জুবায়ের আরাম করে বুকের উপর বালিশ নিয়ে ড্রীম লাইটের আলোয় সিলিং ফ্যানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

“ভালোবাসা অবশ্যই মানুষকে বদলায়। ভালোবাসা নিজেও রঙ বদলায়। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। নিজের রঙ বদল করে ভালোবাসা মানুষকেও বদলে দিতে বা বদলে যেতে বাধ্য করে। একটা চঞ্চল মানুষ দেখা যায় ভালোবেসে নিশ্চুপ হয়ে যায়। আর একটা নিশ্চুপ মানুষ! ভালোবাসা অভাবের জীবনে ভালোবাসা পেয়ে হারালে! সেই যন্ত্রণা লুকাতে নিজের শান্ত স্বভাবকে লুকোতে চঞ্চল হয়ে যায়। অথবা আরও শান্ত হয়ে যায়। ভালোবাসা! সে বড্ড ভয়ংকর সুন্দর বিষয়।”

কথাগুলো বলতে গিয়ে জুবায়েরের গলা ধরে এলো। কণ্ঠ খানিক-টা খাঁদে নেমে এলো তার। রায়াদ বিচলিত হলো। জুবায়েরের শান্ত কণ্ঠ তাকে চিন্তিত করে তুললো। জুবায়ের কি তার থেকে কিছু লুকোচ্ছে! এই কথাগুলোর মাঝে রায়াদ কেমন জানি জুবায়েরের জীবনের কিছু একটা ঘটনা! যেটা সে অবগত নয় বা জুবায়ের বলেনি! এমন কিছু লুকিয়ে আছে। সে তো এক উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছে। অথচ জুবায়েরের কণ্ঠ এত শান্ত হয়ে এলো! অথচ সে তো বড্ড ছটফটে ছেলে। রায়াদ উদ্বিগ্ন হয়ে জুবায়েরের উদ্দেশ্যে বলে,

“তুই কি আমার থেকে কিছু লুকোচ্ছিস জুবায়ের? তোর গলার স্বর কেন জানি আমায় জানান দিচ্ছে! কথাগুলোয় তোর জীবনের কিছু ঘটনা লুকিয়ে আছে?”

রায়াদের প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় জুবায়ের। লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে । মনে মনে ভাবে, ‘তোর মতো বন্ধু পাওয়া সৌভাগ্য রায়াদ শাহনেওয়াজ। গলার স্বর শুনেই বুঝে ফেলিস মনের অবস্থা। অথচ কিছু মানুষকে বুক চিরে মনের অবস্থা দেখালেও মন বুঝবেনা। তারা ভীষণ কষ্টদায়ক মানুষ। ওরা তোর সামনে না আসুক। তোর যা রাগ! আমার কষ্টের কারণ জেনে মে”রে না বসিস। ওরা ভয়ানক মানুষ। আমার নিজেরই ভয় লাগে। এজন্য এতটা দূরে আমি। ওদের ছায়া-ও আর আমার জীবনে জড়ানো নতুন মানুষগুলোর উপর না পরুক।’ এদিকে জুবায়েরকে চুপ থাকতে রায়াদ ফের প্রশ্ন করলো,

“চুপ করে আছিস যে?”

“আরে না! কি সব বলিস? তুই হঠাৎ ভালোবাসা বিষয়ের জানতে উঠেপরে লাগলি? কারণ কি বল শুনি?”

জুবায়ের কথা কাটাতে জবাব-টা দেয়। রায়াদ দম ফেলে। চোখ বন্ধ করে বলে বসে,

“সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে ফেরার পর তুই তো বাসায় গেলি। আমরা সব বাসায় এসে বাসায় ঢোকার পথে রিয়ানা আমার থেকে এক হাত দূরত্বে পাশাপাশি-ই হাঁটছিলো। আয়াত রোজার সাথে গল্প করছিলো, বাবা আর মা তো নিজেদের মতো ব্যস্ত ছিলেন। রিয়ানা একমাত্র বেখেয়ালে সবার পিছনে হাঁটছিলো। চিন্তিত দেখাচ্ছিলো তাকে। হাঁটার ধরণ বেসামাল। যদি পরে যায়! এই ভয়ে পাশাপাশি-ই হাঁটছিলাম। তখনই আমার ভাবনা-কে সত্যি করে উনি পরতে ধরেছিলেন সিড়ি বেয়ে উঠার সময়। ধরে ফেলি। প্রশ্ন করি, ‘এই বয়সে এত কিসের টেনশন! এত চিন্তিত হয়ে হাঁটার দরকার কি? লাইফ-টাকে রঙিন ভাবে সাজানো উচিত। জবাবে সে নিজেকে সামলে বলেছিলো, ‘রঙিন খামে সবসময় রঙিন চিঠি-ই থাকেনা৷ ভালোবাসা নামক বিষ-টাও বিষাদ হয়ে রয়। হোক সেটা জীবন সঙ্গী জনিত ভালোবাসা বা পরিবারের মানুষের ভালোবাসা।’ আমি তো ভালোবাসা জিনিস-টাকে নিয়ে এতটা ভাবিনি। গত কয়েকদিন যাবত ভেবে যাচ্ছি। কিন্তু সঠিক ব্যখ্যা বুঝতে পারছি না। ভালোবাসা তবে এমনও হয়! যে রঙিন এক জীবনে বিষাদে ছেয়ে দেয়?”

জুবায়ের সব শুনে স্মিত হাসলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

“ঐ যে বললাম, ভালোবাসা ভয়ংকর সুন্দর। ভালোবাসা সব পারে সব। মানুষকে কাঠের পুতুল থেকে রঙিন ফানুষ! দু’টোয় বানাতে পারে।”

চলবে?

ভুলত্রুটি মার্জনীয়,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে