রঙিন খামে বিষাদের চিঠি পর্ব-১৪+১৫

0
474

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ১৪
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৩০,
রায়াদের কথার জবাবে জুবায়ের বললো,

“বাদ দে আপাতত। পরে ফ্রি হয়ে বলবো। এখন এদের দুবোনকে থামানো উচিত বলে মনে হচ্ছে।”

রায়াদ মাথা হেঁলিয়ে সম্মতি জানালো জুবায়েরের কথায়। আয়াত বোনকে বোঝাতে বোঝাতে একপ্রকার হাঁপিয়ে উঠলো। তবু রিয়ানার জেদ সে ড্রেস পাল্টাবে না। জুবায়ের আর রায়াদ দুজনই তাকিয়ে তাকিয়ে ওদের দেখছে। রোজা এবার দু’বোনের মাঝ বরাবর দাড়িয়ে বললো,

“প্লিজ থামো তোমরা। আয়াত আপু রিয়ানা আপু যেটায় কমফোর্ট। তাকে সেটাই পরে থাকতে দাও। এটা নিয়ে আর তোমরা তর্কাতর্কি করো না। বার্থডে গার্ল সে। তার মর্জিকে আজ অন্তত আমরা সম্মান জানাই?”

“হ্যাঁ আয়াত মা, রিয়ুকে ওর মতো ছেড়ে দাও। চলো কেক কাটো সব।”

ফাতেহা খানম রোজার কথার সাথে সায় মেলালেন। আয়াতের ভেতরে ভেতরে টেনশনের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে যে কেন এত তৎপর! এটা যদি বলতে পারতো! আয়াত ছটফটিয়ে দ্রুতপদে ছাঁদের এক কিনারায় গিয়ে দাড়ালো। রায়াদ এক পলক আয়াতের এত তৎপরতা দেখে হনহনিয়ে রিয়ানার সামনে এসে দাড়ালো। রিয়ানার হাত ধরে টানতে টানতে ছাঁদ থেকে প্রস্থান করলো। আচমকা রায়াদের এহেন কান্ডে সবাই হতবাক। বিমূর্ত রূপে দাড়িয়ে দুজনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। আয়াত দ্রুত পদে নিজের গাউন উঁচিয়ে হাঁটা ধরলে জুবায়ের চট করে এসে আয়াতের সামনে দাড়ায়। আয়াত বিস্মিত হয়ে তাকাতেই জুবায়ের বললো,

“আপনি এখন ওদের মাঝে না গেলেই ভালো হয় আয়াত ম্যাম৷ রায়াদ ঠিক-ই রিয়ানা ম্যামকে শুধরে নিয়ে ফিরবে। আপনি বরং যা সব অগোছালো আছে! গুছিয়ে নিন। এটাই ভালো হবে।”

আয়াত দমে গেলো। মনে পরে গেলো রিয়ানা রায়াদের কথা একটু হলেও শোনে। সে ফাতেহা খানমের সামনে হাটুমুড়ে বসে কোলে মাথা এলিয়ে দিলো। চিন্তা, ভয় সব বাবাকে নিয়ে। রায়াদ যদি একবার রিয়ানার এসব বাড়াবাড়ির কথা মুখ ফুটে বলে দেয়! তারপর হয়তো তার বাবা রিয়ানার সব স্বাধীনতা বন্ধ করে দিবে। যেটা রিয়ানা কখনও মানতেও পারবেনা। কষ্ট পাবে। আয়াত একটুও চায় না মেয়ে-টা কষ্ট পাক। বড় বোন হয়ে কি করে ছোট বোনকে কষ্ট পেতে দেখবে সে! যেখানে কষ্ট থেকে আগলানোর চেষ্টা করে যায় আয়াত। ফুঁপিয়ে কান্না করে দিলো আয়াত। ফাতেহা খানম টের পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। রিয়ানা দিনদিন সাহসিকতার সব মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এটা উনারও মনঃপুত হচ্ছে না। রোজাকে চোখের ইশারায় নিচে যাওয়ার কথা বোঝালেন ফাতেহা খানম। রায়াদের রাগ সম্পর্কে উনার ধারণা আছে। রিয়ানা কথা না শুনলে গায়ে তুলতেও বাঁধবে না রায়াদের। এই ভয়ে-ই রোজা-কে নিচে যেতে ইশারা করলেন। রোজা মায়ের ইশারা বুঝে নিচতলায় যেতে পা বাড়ায়। জুবায়ের ছাঁদের রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাড়ালো। দৃষ্টি ফুঁপিয়ে কান্নারত আয়াতের দিকে। মনে মনে ভাবলো, ‘এক বোন যেমন ধানিলঙ্কা, আরেকজন লবণ। লবণ যেমন পানি পেলে গলে যায়। এ মেয়ে একটু কষ্ট পেতেই গলে যায় লবণের মতো। রিয়ানার মতো একটু কঠোর হলে হয়তো রিয়ানা বিপথে যেতো না।’

৩১,
এদিকে রিয়ানার রুমে এনে রিয়ানার হাত ছাড়লো রায়াদ। এতক্ষণ রিয়ানা একটুও চেষ্টা করেনি নিজেকে রায়াদের হাত থেকে ছাড়ানোর। রায়াদ ঠিক কি করে! এটায় জানার ইচ্ছে ছিলো তার৷ রায়াদ হাত ছাড়তেই সে খাটের উপর ধপ করে বসে পরলো। রায়াদ তীক্ষ্ণ চাহনীতে তাকালো রিয়ানার দিকে। এরপর বিছানায় ছড়িয়ে রাখা আয়াতের রেখে যাওয়া ওফ হোয়াইট গাউন-টার দিকে তাকিয়ে বললো,

“টাইম ১০মিনিট। পাল্টে ড্রইং রুমে আসবেন। অপেক্ষা করছি আমি।”

রিয়ানা গায়ে মাখালোনা রায়াদের কথা। হাতের ফোন-টায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সাজ্জাদের আইডিতে ঢুকে স্ক্রল করতে লাগলো। যেখানে এই মানুষ সুযোগ পেয়ে তাকে বদলাতে পারেনি। সেখানে সুযোগ না দেওয়া লোক-টা তাকে পাল্টাতে চাচ্ছে! বেশ ইন্টারেস্টিং। রায়াদ রিয়ানার গা ছাড়া ভাব দেখে রাগ সামলে হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো। জোড়ে নিঃশ্বাস নিয়ে ফের রিয়ানার হাত ধরে দাড় করিয়ে দিলো। ফোন কেড়ে নিয়ে বিছানায় ছুড়ে মেরে রিয়ানার চোখে চোখ মিলিয়ে বললো,

“আমি কিছু বলেছি আপনাকে!”

রিয়ানা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো রায়াদের চোখ হতে। তাচ্ছিল্যের সহিত হেসে বললো,

“আমি আপনার কথা কেন শুনবো?”

“আপনি বড্ড বেশি ঘাড়ত্যাড়া এটা জানা ছিলো না। শুধু জানতাম আপনার ঘাড়ের রগ ত্যাড়া।”

“আর কিছু?”

রিয়ানা রায়াদের দিকে আবার তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে। রায়াদ হতবিহ্বল হয়ে তাকায় রিয়ানার দিকে। তার রাগের সামনে যেখানে কেউ টিকতে পারেনা! সেখানে এই মেয়ের কিছু যায় আসে-ই না! এত ছন্নছাড়া মেয়ে হয় আদৌও? রায়াদ রিয়ানার মতোই ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

” আর কিছু নয়। চুপচাপ ড্রেস পাল্টান। আমি এসব পেট বের করা, হাত পুরো বের করে রাখা ড্রেস মোটেও পছন্দ করিনা।”

“হু আর ইউ? আমি আপনার পছন্দ অপছন্দের দাম কেন দিবো? এমনি অনেক শুনে নিয়েছি আপনার কথা। আমার অন্য কারোর কথা শুনে চলার অভ্যাস নেই।”

রায়াদ রিয়ানা হালকা ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিলো। হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে বললো,

“আপনি ড্রেস পাল্টাবেন না?”

“না। ”

রিয়ানার সোজাসাপটা জবাব৷ রায়াদ আলতো হাসলো। রিয়ানা খেয়াল করলো তার হাসি। কিন্তু হাসার মতো কোনো কারণ দেখল না যে রায়াদ হাসছে। সে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রায়াদ তাকে বিস্মিত করে বলে উঠলো,

“আপনি ৫মিনিটে ড্রেস পাল্টাবেন। নয়তো আমি আপনার ড্রেস পাল্টাতে বাধ্য হবো। আর অবিবাহিত হয়ে আপনি নিশ্চয় চাইবেন না কোনো পর পুরুষ আপনাকে ছুঁয়ে দেখুক!”

“ওহহ! সিরিয়াসলি? আপনি ড্রেস পাল্টে দিবেন? ওকে ট্রাই করা যাক। নিন আসুন, পাল্টে দিন ড্রেস।”

রিয়ানা কাঁধ থেকে বিজের দোপাট্টা ফেলে রায়াদকে কথাটা বললো। রায়াদের কথায় যেন তার কিছু-ই যায় আসেনা। রায়াদ থমকালো।। একটা মেয়ে এতটা বেহায়া কি করে হতে পারে! নিজের ইজ্জতের দাম টুকুও দেয়না? সে বিরক্ত হয়ে রিয়ানার দিকে তাকাতেই রিয়ানা বললো,

“ঘাবড়ে গেলেন? আমি জানি আপনি পারবেন না। আমার মাঝে লজ্জার একবিন্দু পরিমাণ কিছু নেই। থাকলে নিশ্চয় আমার স্লিম পেট, নাভীর আশপাশ বের করে ড্রেস-টা পরতাম না। সী! এদিকে তাকান। হালকা পাতলা ক্লিভেজও দেখা যায়। তাহলে বুঝে নিন আমার লজ্জা ঠিক কোন সীমানায় ঝুলছে। সে আসতে চায় আমার মাঝে, বাট আমি-ই বাঁধা দিই। যেখানে সুযোগ পেয়েও কেউ আমায় বদলাতে পারেনি। সেখানে আপনি আমার কিছু নন, নাথিং। আপনার কথায় আমি নিজের ড্রেস একটুও পাল্টাবো না। কত শত নারী আছে, যারা আমার থেকেও বাজে ড্রেস পরে বেড়ায়। সেখানে যথেষ্ট শালীন আমার ড্রেস।”

“জাস্ট শাট আপ মিস রিয়ানা হোসাইন। আর একটা কথা বললে ঠাটিয়ে চড় মারবো আপনাকে। কি ভাবেন নিজেকে? ঐ বাজে ড্রেস পরা নারীদের একজন? আপনি কারোর ঘরের সম্মান, একজন বাবার রাজকন্যা। আপনার ড্রেস, আপনার আচরণ একটা পরিবারের শিক্ষা বহন করে। দয়া করে হানিফ আংকেলের মতো সম্মানীয় ব্যক্তির সম্মান আপনার এই বাজে ব্যবহার দিয়ে প্রকাশ করবেন না।”

৩২,
রায়াদ চেঁচিয়ে-ই কথাটা বললো। রিয়ানা হাসলো, একটু শব্দ করে-ই হাসলো। রায়াদ বিস্ময়ে বিমূঢ়। এই মেয়ের কি কোনো কথা-ই সিরিয়াসলি নেওয়ার স্বভাব নেই! সে খিটখিটে মেজাজে প্রশ্ন করলো,

“হাসবার মতো কি বলেছি?”

“আমি কোনো বাবার রাজকন্যা নই। কারোর জীবন সম্পর্কে না জেনে কোনো মন্তব্য করবেন না৷ বের হোন রুম থেকে। আমি ড্রেস পাল্টে আসছি। তর্ক করার এনার্জি পাচ্ছি না। কেক কেটে ঘুমাবো আমি। আমার বোনকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছেনা আর। ”

“যা কষ্ট দেওয়ার দিয়েই ফেলেছেন। আর কি কষ্ট দিবেন?”

“আমি আমার বোনের মতো এতটা ভালো নই। সে আমার কষ্ট তাজা করেছে। আমিয়ো একটু ফেরত দিলাম। পুরোটা নয়। আমার মতো কষ্ট সহন শক্তি আমার বোনের নেই। এজন্য অল্প-ই দিয়েছি। নাউ লীভ। আমি ড্রেস পাল্টে নিবো।”

রায়াদ রিয়ানার কথা শুনে অবাক চোখে রিয়ানাকে একটু দেখলো। এরপর রুম ছাড়লো। ড্রইং রুমে এসে রোজাকে দেখে জিগাসা করলো,

“তুই এখানে? দাড়িয়ে আছিস কেনো?”

“আম্মু পাঠালো তোদের ডাকতে। তোদের চিল্লাপাল্লা শুনে সাহস হয়নি ডাকার।”

রোজা কাঁপা গলায় জবাব দিলো। রায়াদ ফোঁস করে দম ছাড়লো। বাজখাই গলায় বললো,

“মেয়ে-টাই এমন। না চিল্লালে কথা শোনেনা। চল ছাঁদে চল। উনি আসবে একটু পরই।”

“তুমি যাও। আমি আসছি আপুর সাথে।”

রায়াদ মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে বাসা ছাড়তে পা বাড়ালো। রোজা হাফ ছেড়ে বাঁচল।। ভাইয়ের রাগকে বড্ড ভয় পায় সে। রায়াদ যেতেই রিয়ানা বের হলো রুম থেকে। রিয়ানাকে দেখে রোজার চোখ কপালে উঠলো। ওফ হোয়াইট গাউনে রিয়ানার সৌন্দর্য যেন নজর কাড়ার মতো। মেয়ে-টা এমনি সুন্দর। কেন যে নিজের স্বভাবের জন্য সৌন্দর্যকে চাপা দেয় জানা নেই রোজার। সে রিয়ানার সামনে গিয়ে জড়িয়ে ধরে খুশিতে গদগদ হয়ে বেশ জোড়েই বললো,

“রিয়ু আপু, তোমায় দারুণ লাগছে। ইশশশ, এত্ত কিউট তুমি।”

রোজার কণ্ঠ কানে পরতেই রায়াদ দরজার কাছে দাড়িয়ে একবার পিছন ফিরে তাকালো। রিয়ানাকে আপাদমস্তক এক নজর দেখে নিলো। রিয়ানার চোখে চোখ করতেই বেরিয়ে গেলো রায়াদ। রিয়ানা নিজেকে রোজার থেকে ছাড়িয়ে বললো,

“চলো যাওয়া যাক?”

“হুম চলো।”

রোজা খুশিমনে রিয়ানার হাত ধরে ছাঁদের দিকে পা বাড়ায়। ছাঁদে আসতেই আয়াত বোনকে দেখে খুশি হয়। কান্নার মাঝেও হেঁসে দিয়ে বোনের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে। আলতো স্বরে বলে,

“একটা নতুন জীবনের শুভ সূচনা হোক আমার বোনের। তার জীবনের সকল শোক তাপ কষ্টের গ্লানি মুছে সুন্দর একটা জীবন শুরু হোক। তোকে হাসিখুশি দেখতেই আমার ভালো লাগে বোন। প্লিজ একটু ভালো থাকতে শিখ এবার। আমি আর তোকে এভাবে দেখতে পারিনা। কষ্ট হয় আমার।”

রিয়ানা মুচকি হাসলো। বোনের পিঠে হাত দিয়ে হালকা চাপড় দিয়ে বললো,

“শীত এসে শরৎ এর সৌন্দর্য ছিনিয়ে নিয়ে যায় আপু। সে এসে চলে গিয়ে আমার সৌন্দর্যও ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। সে বিহীন আমি মলিন-ই সুন্দর।”

চলবে?

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ১৫
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৩৩,
হাইওয়ের ওয়াক ওয়ে-র ধারঘেষে ডেইজি ফুলের সমারোহ। শীত নেমেই পরেছে প্রায়। কিছুদিন পর এদের দেখা পাওয়া যাবেনা। সেই বসন্তের অপেক্ষা। রিয়ানা উবু হয়ে দু’হাত মুঠো ভর্তি ফুল তুলে নিলো। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ সামনে নিয়ে ডায়েরী বের করলো। ডায়েরীর পাতায় ফুলগুলো রেখে আবারও ডায়েরী ব্যাগের ভেতর রাখলো। হাঁটতে হাঁটতে সেন্টারের কাছাকাছি এসে একটা কফির বারে ঢুকে পরলো। এক মগ কফি অর্ডার করে দুহাতে মাথা চেপে ধরলো। আজ বড্ড মাথা ব্যথা করছে তার। ইচ্ছে হচ্ছে বাসায় গিয়ে আরাম মতো একটু ঘুমাতে। কিন্তু বাসায় যেতে একটুও মন টানছেনা তার। সাজ্জাদের মুখোমুখি হতে তার একটুও ভালো লাগেনা। ছেলে-টা পাগলের ন্যায় তার মন জয় করার চেষ্টা করছে। অথচ তার একটুও আগ্রহ আসেনা সাজ্জাদের প্রতি। ছেলে-টাকে কষ্ট দিতেও কেমন একটা খারাপ লাগা কাজ করে রিয়ানার। মনে হয় একটু মন নরম করে সাজ্জাদের কথায় নিজেকে একটু বদলাতে। কিন্তু নিজ সত্তা! তাকে কি জবাব দেবে রিয়ানা! একটা মানুষের জন্য নিজের ব্যক্তিত্ব-ই বিসর্জন দিবে? যাকে সে ভালো-ই বাসে না। ভালোবাসলে না হয় অন্য কথা ছিলো। কিন্তু সাজ্জাদের প্রতি তার ভালোবাসার মতো কোনো অনুভূতি-ই অনুভব হয়না। সাজ্জাদ আশেপাশে থাকলে-ই উল্টে বিরক্তি লাগে তার। লোক-টা চলে যায় না কেন! ফোনের স্কিনে তারিখ দেখে নিলো রিয়ানা। সাজ্জাদের ভিসার মেয়াদ ফুরোতে আর ২০দিন বাকি। এরপর! এরপর তো তার মুক্তি। কিন্তু সাজ্জাদকে এই দিন ফেইস করবে কি করে? এমনিই সেদিনের কথার পর গোঁটা একমাস সাজ্জাদের মুখোমুখি হতে, সে কথা বলতে আসলে রিয়ানা ভেতর থেকে বিরক্তি ছাড়া কিছু-ই অনুভব করেনি। কারোর প্রতি অনুভূতি না আসলে! সে কি করবে? সাজ্জাদ যে কেনো বিষয়-টা বুঝতে চায় না! রিয়ানার মাথায় ঢোকেনা। রিয়ানার আকাশ-কুসুম চিন্তার মাঝেই ওয়েটার কফি নিয়ে আসতেই তার সামনে দুম করে কোথা থেকে জানি সাজ্জাদ এসে বসে পরলো। এরপর ওয়েটারের দিকে তাকিয়ে নিজের জন্যও এক মগ কফি অর্ডার দিলো। ওয়েটার চলে যেতেই সাজ্জাদ রিয়ানার দিকে দৃষ্টি মেললো। রিয়ানা কফির মগ হাতে তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাজ্জাদ ঠোঁটের কোণে চমৎকার ভাবে হাসির রেখা ফুঁটিয়ে বললো,

“কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে ফেলো।”

“কফি খাওয়া যায় না। এটা পানীয়, পান করা যায়।”

রিয়ানা বিরক্তিমাখা কণ্ঠে উচ্চারণ করলো। সাজ্জাদের হাসির রেখা প্রশস্ত হলো। বললো,

“সবদিকেই খেয়াল থাকে। শুধু আমার কথা তোমার মনে বেখেয়ালি ভাবে পরে রয়। একটুও খেয়াল করো না।”

“প্লিজ স্টপ। আমি আর সহ্য করতে পারিনা সাজ্জাদ ভাই।”

“একটা কথা কি জানো এটিটিউড কুইন? ”

রিয়ানা এক ভ্রু ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। কফির মগে চুমুক দিয়ে বললো,

“কি কথা?”

“‘তুমি তোমার জীবদ্দশায় একবার আমার বৃক্ষের মত যত্ন নিলে, আমি আমার পুরো জীবদ্দশায় তোমার জন্য ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো। কখনও ছেড়ে যাবো না। কিন্তু তুমি আমায় ঝড়ে যাওয়া পাতার মতো ছুড়ে মারছো রোজ।”

রিয়ানা মৃদু হাসলো। সাজ্জাদের কথার জবাবে বললো,

“প্রেম করার চেয়ে,প্রেমে পড়ার মুহুর্তগুলো অনেক সুন্দর। এখন প্রেমে পরেছেন বলে, এত অনুভূতি কাজ করছে। প্রেম করতে ধরলে তখন শুধু বিরক্তিই আসবে আমার প্রতি। আমি মানুষ-টাই এমন।”

” তোমার মুখের হাসি হোক সবার জন্য! আর ভালোবাসা হোক প্রিয় আমার জন্য! আমায় একবার ভালোবাসো, প্রেম করতে বলছিনা। বিয়ে করে নিবো সোজা।”

“সহজে পাওয়া হোক সেটা জিনিস বা মানুষ! গুরুত্ব কমে যায়। পাওয়ার পর মনে হয়, পেয়েই তো গেলাম। গুরুত্ব দিলেও আমার। না দিলেও আমার।”

“কথাতেই যত্ন, কথাতেই বিচ্ছেদ রিয়ু। আমার থেকে কখনও গুরুত্বহীন কথা পেলে চলে এসো। বাধা দিবো না।”

“এরপর জমবে হাজারও স্মৃতি। আর কিছু তারিখ আমাদের আজীবন মনে থাকবে হয়তো বিরহে নয়তো ভালোবাসায়। আমি কোন-টায় ভুগবো তখন? ভালোবাসা নাকি বিরহ?”

৩৪,
রিয়ানার বলা কথার মাঝেই সাজ্জাদের কফি এসে যায়। সাজ্জাদ মুচকি হেসে কফির মগ হাতে নিয়ে বলে,

“আর তুমি আমায় যে অবহেলা করছো! আমি চলে গেলে তো এই তারিখগুলো আজীবন আমার মনে থাকবে।”

“ভুলে যাবেন। কিছু জিনিস মনে রাখতে নেই।”

“রাখতে হয়না। থেকে যায়।”

“কথা বাড়িয়ে কাজ নেই। বাসায় চলুন। জানিনা কি করে যেখানে যাই হাজির হয়ে যান।”

“ডাবল মাস্টার্সের জন্য সামার সিজনে এপ্লাই করবো। আমার থেকে পিছু ছুটাতে চাচ্ছো! আমি তোমার পিছু-ই পরে থাকবো। একদিন না একদিন তো ঠিকই আমার উপর মায়া দয়া হবে তোমার।”

“ভুল ধারণা, আমি পাথর। আমার মাঝে এসব অনুভূতি নেই।”

সাজ্জাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রিয়ানার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“আমায় কি একটু ভালোবাসা যায় না রিয়ানা?”

“গেলে হয়তো ভালোবাসা জন্ম নিতো এতদিনে।”

“আমার অনুপস্থিতি একদিন ভীষণ করে পোড়াবে তোমায়। সেদিন তুমি চাইলেও আমায় তোমার সামনে পাবেনা। কথা বলার জন্য মনের মাঝে হাহাকার করবে! কিন্তু আমার ভয়েজ অব্দি শুনতে পাবে না তুমি।”

রিয়ানা একটু শব্দ করেই হাসলো। সাজ্জাদ আশাহত হলো। এই মেয়ের কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসেনা। কেমন নিষ্ঠুরের মতো হাসছে! সাজ্জাদ উঠে দাড়ালো। কফির বিল পে করে বেরিয়ে পরলো। রিয়ানার টা সহ বিল পে করেছে দেখে রিয়ানা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পরলো। দ্রুতপদে এসে সাজ্জাদের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো,

“যে ভালোবাসার জন্য আমায় নিজেকে বদলাতে হবে! সেই ভালোবাসা আমার চাইনা সাজ্জাদ ভাই।”

“তোমায় তো বদলাতে বলিনি। শুধু বাংলাদেশের সাথে মানানসই ড্রেস পরবে। আর তোমার বদ অভ্যাস গুলো বাদ পরবে বিডিতে গেলে। এই টুকুই। চেষ্টা করে যাচ্ছি রোজ তোমায় একটু নিজের মতো গড়ে তোলার! তুমি সুযোগ দিয়েও দূরেই রয়ে গেলে!”

সাজ্জাদ হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়ে বললো কথাটা। রিয়ানা আলতো হেসে দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সেখানে কিছু সাদা গোলাপের গাছ। সেই দিকল তাকিয়ে-ই রিয়ানা বললো,

“ফুল দেখতে সুন্দর বলেই আমরা আকর্ষিত হই তার প্রতি। সে যদি তার ন্যাচার ছেড়ে অন্য কিছুতে পরিণত হয়! তার প্রতি আমাদের কি সেই আগের আগ্রহ থাকবে? তেমনই আমি মনে করি, আমি বদলালে আপনিও বদলে যাবেন। এখন রাগী, বদমেজাজি, বেপরোয়া, উচ্ছৃঙ্খল আমি-কে দেখে পছন্দ করেছিলেন। আমি পাল্টে গেলে আমার সেই নতুন রুপের সাথে আপনার এডজাস্ট করতে কষ্ট হবে। মনে হবে, এই মেয়েকে তো ভালোবাসিনি। আর মানুষ সুখের পাগল, কষ্ট পেলে কষ্টের কারণ-টাকেই উপরে ফেলে। আপনিও আমার প্রতি আগ্রহ হারাবেন।”

রিয়ানা কথা বাড়ালো না আর। হনহনিয়ে হেঁটে বাসার কাছাকাছি আসায় দরজায় দাড়িয়ে কলিং বেল বাঁজালো। আয়াত এসে দরজা খুলে দিতেই বাসায় ঢুকে পরলো। পেছনে পেছনে ঢুকলো সাজ্জাদ। সাজ্জাদের বিমূঢ় দৃষ্টি শুধু রিয়ানায় আবদ্ধ। আয়াত বিষয়-টা খেয়াল করেছে। সে দরজা আঁটকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাজ্জাদকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“আমরা বেশিরভাগ সময় জীবনে একবার হলেও ভুল মানুষের প্রতি দুর্বল হয়ে পরি সাজ্জাদ ভাই। রিয়ানা আপনার সেই ভুল। মা মারা যাবার পর বড় হওয়ার পাশাপাশি যখন থেকে বুঝেছে বাবার ওর প্রতি ভালোবাসা নেই। অনুভূতি শূণ্য করেছে নিজেকে। আর আপনি সেই অনুভূতি শূণ্য মানুষের মনে জায়গা করতে উঠেপরে লাগলেন? দুনিয়ায় আর মেয়ে পাননি!”

সাজ্জাদ আয়াতের দিকে তাকালো। মলিন হেসে বললো,

“আমরা সবসময় হয়তো ভুল মানুষকেই ভালোবাসি আয়াত।”

এরপর পা বাড়ালো রুমের দিকে। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে সব কথা-ই কানে পরলো রিয়ানার। সে-ও লম্বা এক শ্বাস নিয়ে আনমনে বিরবির করে বললো,

“আজ কষ্ট পাচ্ছেন, একদিন এই ফিরিয়ে দিয়েছি বলে বাহবা দিবেন! বলবেন ভাগ্যিস ফিরিয়ে দিয়েছিলে রিয়ানা। নয়তো আমার ভালো থাকা হারিয়ে যেত।”

৩৪,
ডায়েরীর ভাজে সেই শুকনো ডেইজি ফুলগুলো এক হাতে নাড়াচাড়া করছে রিয়ানা। আজ অনেক মাস পর পুরোনো ডায়েরী নিয়ে বসেছে সে। তার যে রোজ ডায়েরী লেখার স্বভাব ছিলো! ভুলে বসেছিলো প্রায়। কিন্তু ডায়েরী-টা তার সবসময়ের সঙ্গী। যেখানেই যাক, সাথে থাকে। আজ ডায়েরী-টা খুলতেই সেই শুকনো ফুলগুলো নজরে পরায় পুরোনো কিছু কথা মনে পরে গেলো তার। বিছানায় বসে খাটের বোর্ডের সাথে বালিশ হেলান দিয়ে সে আধশোয়া হয়ে বসে ডায়েরীর শুকনো ফুলগুলোয় হাত বুলাচ্ছিলো, আর পুরোনো কথা ভাবছিলো। ডায়েরী-টা বন্ধ করে দিলো রিয়ানা৷ বালিশে মাথা এলিয়ে একহাতে তর্জনী ও বুড়ো আঙুলে কপাল চেঁপে ধরে পরপর কয়েক-টা লম্বা শ্বাস নিলো। ফোন-টা পরে আছে পাশেই। তা অন্য হাতে উঠিয়ে নেটে ঢুকলো। আবারও সাজ্জাদের আইডিতে ঢুকে স্ক্রল করতে করতে ভাবলো,

“আমার কথাগুলো কেমন একটা মিলে যাচ্ছে তাইনা সাজ্জাদ ভাই! শুধু আপনার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষা। অদ্ভুত ভাবে আপনার কথাগুলোও মিলে গেলো। আপনাকে সরাসরি দেখার তৃষ্ণা, আপনার ভয়েজ শোনার তীব্র ইচ্ছে! রোজ মনের গহীনে দাফন হচ্ছে। ইশশ, যদি একবার দেখা হতো! মুচঁকি হেঁসে বলতাম, আমার কথা মিললো তো! কিন্তু আপনার কি জবাব আসবে! এই ভয়েই আর মুখোমুখি হওয়ার সাহস হয়না। আপনি ভালো আছেন! এই তো শান্তি।”

“রিয়ু আপু, এই রিয়ু আপু! কোথায় তুমি?”

রোজার গলার স্বরে হাঁক ডাক শুনে উঠে বসলো রিয়ানা। ধরফরিয়ে উঠে বসলো। ডায়েরী-টা বালিশের তলায় চাপা দিলো। রোজা রিয়ানার রুমে ঢুকতে ঢুকতে বিষয়-টা খেয়াল করলো। কিন্তু কিছু বললো না। রিয়ানা রোজাকে দেখে জিগাসা করলো,

“কোনো জরুরী বিষয় রোজা?”

“হ্যাঁ, আম্মু ডাকছে তোমায়। আয়াত আপুকেও। আপু তো রাতের খাবার বানাচ্ছিলো। তাই ফ্রেশ হতে গেছে। তুমিয়ো ঝটপট ফ্রেশ হয়ে একটু ড্রেস পাল্টে নাও প্লিজ! বাসায় বাবা আছে।”

রিয়ানা বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাড়ালো। পরনে শর্ট জিন্স আর লেডিস টিশার্ট। হানিফ সাহেব বাসায় নেই। দু মেয়েকে রেখে উনি গ্রামে গেছেন নিজের মৃত বাবা মায়ের জন্য এতিম বাচ্চাদের খাওয়াবেন বলে। আয়াত যেতে চাইলেও রিয়ার মন সায় দেয়নি। পরে আয়াতও আর যায়নি বোনকে রেখে। এজন্য রিয়ানা বাসায় নিজের ইচ্ছেমতো-ই ড্রেস পরে ঘুরে। জন্মদিনের পর মাঝখানে কেটে গেছে ৫টা দিন। সে বাসাতেই বন্দী। বের হয়না, আবার বাসাতেও কেউ আসেনা। এজন্য নিজের ইচ্ছে মতোই ড্রেস পরে। রিয়ানা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের উপর হাত রেখে আনমনে বললো,

“কি করবো বলো তো রোজা! বড় হওয়ার পরপরই ওয়েস্টার্ন কালচার, ড্রেসআপ মিশে গেছে নিজ সত্তায়। কমফোর্ট ফিল-টা এসব ড্রেসে-ই সীমাবদ্ধ। এজন্য চাইলেও ইচ্ছে করেনা লং ড্রেস পরতে। তবুও মাঝে মাঝে পড়ি, কারণ এটা জার্মানি না, বাংলাদেশ। এখানে সাধারণ বাঙালি বাবা মা এত শর্ট ড্রেস এলাউ করবেনা এটাই স্বাভাবিক।”

রোজা মুচঁকি হাসলো রিয়ানার কথায়। মেয়ে-টা এতটাও অবুঝ নয় তবে। রিয়ানা ওয়ার্ডরোব থেকে একটা সুতির থ্রিপিস বের করে ওয়াশরুমে গিয়ে পরে নিলো। এরপর বেরিয়ে এসে চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপে আঁটকে নিয়ে রোজাকে বললো,

“চলো যাওয়া যাক!”

চলবে?

ভুলত্রুটি মার্জনীয়, আসসালামু আলাইকুম।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে