মেঘবদল পর্ব-০৮

0
630

#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৮

‘মেঘবদল’ বড়ই অদ্ভুত নাম। ঢাকা শহরের অলিগলিতে বিচিত্র ঘটনা ঘটে থাকে সেটা সবাই জানে। কিন্তু এমন বিচিত্র নামের বাড়িও যে থাকতে পারে সেটা ফারিয়া জারিফ কারো ধারনা ছিল না। এমন অদ্ভুত নাম রাখার কারণটা কেউই খুজে পেলো না। জানার তীব্র ইচ্ছা থাকলেও নতুন হিসেবে প্রশ্নটা করতে সায় দিলো না মন। তাই দুজনেই নিজের কৌতূহল দমন করে সোফায় বসে আছে। তাদের ঠিক সামনেই বসে আছে নুরুল রহমান আর ইভান। নিজেদের পরিচয় পর্বটা সেরে নিচ্ছে তারা। আর মাহমুদা ততক্ষণে কথা শেষ করে চলে গেছে। রান্না ঘরে নাস্তা বানাতেই ব্যস্ত। অতিথি এসেছে বাড়িতে। প্রতিদিনের নিয়ম ভেঙ্গে নতুন কিছু আয়োজনের পায়তারা তার। কলিং বেলের আওয়াজে তাদের কথার মাঝে বাধা পড়ল। ইভান বলল
–আমি দেখছি।

দরজা খুলে ঈশাকে দেখেই সকাল সকাল তার মনটা ভালো হয়ে গেলো। ঈষৎ হাসির রেখা মিলল ঠোটের কোনে। দৃষ্টি গভির হল। কিন্তু ইভান কে দেখে ঈশার মনের অবস্থা ঠিক বিপরীত। রাগ আর অভিমান ভিড় করলো পুরটা জুড়ে। একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলো ঈশা। ইভান মুচকি হেসে সরে দাঁড়াল। ঈশা ভেতরে ঢুকেই দুজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষকে দেখে থেমে গেলো। চোখে মুখে কৌতূহল তার। নুরুল সাহেব ঈশাকে হাতের ইশারায় তার কাছে ডাকল। ঈশা দাড়াতেই তিনি বেশ উতফুল্যতার সাথে বললেন
–আমার বন্ধু ফিরোজের মেয়ে আর তার জামাই। তোদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকবে এখন থেকে।

ঈশা সৌজন্য হাসল। নুরুল রহমান উঠে দাড়িয়ে বললেন
–আমার একটু কাজ আছে। আমি বাইরে যাবো। তোমরা থাক তাহলে। পরে কথা হবে তোমাদের সাথে। আর কোন অসুবিধা হলে ঈশাকে বলবে। আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে। তোমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে।

কথা শেষ করে নুরুল সাহেব চলে গেলেন। মাহমুদা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সবাইকে টেবিলে বসতে বলল খাওয়ার জন্য। ফারিয়া, জারিফ আর ইভান বসে পড়ল। ঈশা মাহমুদার সাথে রান্না ঘর থেকে খাবার এনে দিলো টেবিলে। মাহমুদা রান্না ঘরে যেতে যেতে ঈশাকে বলল
–তুইও বসে পড়। খেয়ে নে।

ঈশা অভিমানি দৃষ্টিতে ইভানের দিকে একবার তাকাল। সে খাবার নিয়ে খাওয়াতে ব্যস্ত। ক্লান্ত সরে বলল
–আমি খাব না বড় মা। মা খাবার পাঠিয়েছিল তাই দিতে এসেছিলাম।

বলেই পা বাড়াতেই ইভান হাত ধরে ফেললো। ঈশা অবাক চোখে তাকাল তার দিকে। ভীষণ বিরক্ত হল তার উপরে। রাগে নাক কাঁপতে লাগলো। বিরক্ত হলেও অপরিচিত দুজন মানুষের সামনে খারাপ ব্যবহার করলো না। ইভান শান্ত সরে বলল
–খেয়ে তারপর যাবি।

ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। যার অর্থ সে খাবে না। হাত টান দিতেই ইভান হাতের জোর আরও বাড়িয়ে দিলো। আঙ্গুলের দাগ চেপে বসে গেলো হাতে। পাশের চেয়ারটায় ইশারা করে কঠিন গলায় বলল
–সময় নষ্ট না করে বসে পড়।

ফারিয়া জারিফ দুজনেই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে বিস্ময় নিয়ে। সবটা বুঝতে না পারলেও তাদের মাঝে অব্যক্ত কোন মান অভিমান আছে সেটা ভালোভাবেই বুঝে গেলো দুজন। তাদের দৃষ্টির কৌতূহল আর বিস্ময় ইভান খেয়াল না করলেও ঈশা ভালো করেই দেখতে পেলো। তাই আর কথা বাড়াল না। বসে পড়ল টেবিলে। খানিকবাদে মাহমুদা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই বলল
–তোমরা কিন্তু দুপুরেও খাবে।

ফারিয়ার বিষয়টা ভালো লাগলো না। প্রথম দিন এসেই তাদের এমন বিরক্ত করার ইচ্ছা তার নেই। তাই তীব্র আপত্তি জানালো। বলল
–না আনটি আমরা একটা ব্যবস্থা করে নিবো।

মাহমুদা অবাক সরে বলল
–এটা কেমন কথা? এখনও গুছিয়ে উঠতে পারো নি। পুরো বাড়ি গোছাতে অনেক সময়ের ব্যপার। আর এই অবস্থায় রান্না করার কোন দরকার নেই।

ফারিয়া জারিফ দুজনেই আপত্তি জানালেও মাহমুদার তীব্র জেদের কাছে আর কোন কথা বলতে পারল না। ঈশা বলল
–রাতের খাবারটা আমাদের বাসায়। আজ আমার ছোট বোনের জন্মদিন। তাই ছোট করে একটু আয়োজন করা হয়েছে রাতে। আপনারা কিন্তু থাকবেন।

ঈশার জোরে রাজি হয়ে গেলো তারা। টেবিলেই সেরে নিলো পরিচয় পর্ব। সবাই মিলে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর মাহমুদা ঈশাকে পাঠিয়ে দিলো ফারিয়ার সাথে বাড়ি গোছাতে।

———–
অফিসের বাইরে একটা মিটিং শেষ করতেই নাহিদের বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। বেশ তাড়াহুড়ো করছে বাড়ি যাওয়ার জন্য। কারন আজ ইলুর জন্মদিন। বিকেলের মধ্যেই সবাইকেই বাসায় থাকতে বলেছে। আর সেও কথা দিয়েই বেরিয়েছিল ঠিক সময় মতো চলে আসার। কিন্তু কথা রাখতে না পারায় বেশ খারাপ লাগছে। লিফটের বাটন প্রেস করে দাড়িয়ে থাকল। লিফট নিচ থেকে উপরে উঠছে। ঠিক সেই সময় ফোন বেজে উঠলো তার। ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত ইভান বলল
–ভাইয়া তুমি কোথায়? এখনও আসছ না কেন?

নাহিদ ক্লান্ত সরে বলল
–আর বলিস না। একটা কাজে দেরি হয়ে গেলো। আমি চলে আসছি এখনই। বেশী সময় লাগবে না।

আরও দুই একটা কথার মাঝেই লিফট এসে থেমে গেলো। দরজা খুলতেই চোখে ঠেকল এক বিবর্ণ দৃশ্য। মৃন্ময়ীর পাশে এক সুদর্শন যুবক। দুজনের হাতের ভাজে হাত। মৃন্ময়ীর সাজ সজ্জা চোখে লাগার মতো। শাড়িতে জড়ান শ্যাম বর্ণের নারী এক যুবককে আঁকড়ে ধরে দাড়িয়ে আছে। লিফটের দরজা বন্ধ হতেই ছেলেটি আবার বাটন চাপ দিলো। দরজা খুলে গেলেই নাহিদ তার সম্ভিত ফিরে পেলো। ভেতরে ঢুকে এক পাশে দাঁড়াল। ছেলেটিকে চিনতে নাহিদের অসুবিধা হল না। আগেরদিনেও এই ছেলেকেই দেখছে সে। মৃন্ময়ী নাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। এই মুহূর্তে তার সাথে দেখা হওয়ায় বেশ অপ্রস্তুত সে। নাহিদ কথা বলার মতো আগ্রহ খুজে পেলো না। মৃন্ময়ী কয়েকবার চোখের পলক ফেললো। কথা বলতে গিয়েও গলায় কেমন ঠেকল। তবুও সৌজন্য হিসেবে কিছু তো বলতেই হয়। নাহলে বিষয়টা কেমন দেখায়। শুকনো ঠোট জোড়া ভিজিয়ে নিয়ে মৃদু সরে বলল
–আপনি এখানে?

নরম কণ্ঠ কানে লাগতেই নাহিদ চোখ তুলে তাকাল। শান্ত সরে বলল
–একটু কাজ ছিল। তাই এসেছিলাম।

‘ওহ’ বলেই থেমে গেলো দুজনে। পিনপতন নিরবতায় লিফট এসে থামল। নাহিদ আগে বের হতেই পেছন থেকে ফিসফিসানির আওয়াজ কানে এলো। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই ছেলেটি পেছন থেকে ডাকল
–নাহিদ ভাইয়া?

নাহিদ থেমে পিছনে ঘুরে তাকাল। ছেলেটি মৃন্ময়ীর হাত ছেড়ে দিয়ে নাহিদের দিকে এগিয়ে আসছে। তার কাছে এসে বলল
–আপনি নাহিদ ভাইয়া তাই না?

নাহিদ মাথা নাড়াল। ছেলেটি এক গাল হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
–আমি মামুন। মৃন্ময়ী আমার আপু।

নাহিদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। ছেলেটির কথা মাথায় ঢুকতেই ঠোট এলিয়ে হেসে হাত মেলাল। মৃন্ময়ী এগিয়ে এসে দাঁড়াল। মামুন অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল
–দেখুন না। আপু আমাকে একবারও আপনার কথা বলল না। আগেই যদি বলতো তাহলে এতক্ষনে পরিচয় হয়েই যেতো।

নাহিদ হাসল। কি উত্তর দিবে ভেবে পেলো না। শুধু নিজের চিন্তা ভাবনার উপরে বিরক্ত হল। না জেনে কাউকে এভাবে সন্দেহ করা একেবারেই ঠিক না। মৃন্ময়ীর সম্পর্কে কতো কিছুই না ভেবে বসেছে সে। নিজের ভাবনা নিজের কাছেই বাজে ঠেকতেই সে ভীষণ লজ্জিত ভঙ্গিতে তাকাল মৃন্ময়ীর দিকে। মৃন্ময়ী এগিয়ে এসে বলল
–৫ তলায় আমার খালার বাসা। আমি সেখানেই থাকি। আর মামুন ওর কলেজের হোস্টেলে থাকে। একটু বাইরে যাচ্ছিলাম দুজনেই।

নাহিদ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল
–ওহ আচ্ছা।

থেমে আবার বলল
–কোনদিকে যাবেন আপনারা?

মামুন হেসে বলল
–ঐ সামনে একটা শপিং মল আছে ওখানেই যাবো।

নাহিদ বিনয়ের সুরে বলল
–আমার গাড়িতে যেতে পারেন। কোন সমস্যা নেই।

মৃন্ময়ী এগিয়ে এসে মামুনের হাত ধরে বলল
–না না। কাছেই। আমরা রিক্সা নিয়ে চলে যাবো।

মামুন বোনের কথা শুনল না। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
–আমরা যাবো ভাইয়া। এর ফাকে ভাইয়ার সাথেও কথা হয়ে যাবে।

মৃন্ময়ীর কথা সেখানে আর খাটল না। সবাই মিলে গাড়িতে উঠে বসল। বেশ গল্পের সাথেই জাত্রা শেষ হল। শপিং মলের সামনে গাড়ি থেকে নেমে গেলো দুজন। নাহিদ মৃন্ময়ীর দিকে তাকাল। সেদিন কোন কারনে এতো গভির ভাবে দেখার সুযোগ হয়ে উঠেনি। কিন্তু আজ তার চোখে মৃন্ময়ীর সৌন্দর্যের গভিরতা ধরা দিলো। কিছু বলতে চেয়েও বলা হয়ে উঠলো না। মৃন্ময়ী মৃদু হেসে বিদায় নিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে। নাহিদ গভির দৃষ্টিতে তাকাল। সেদিন এমন ভাবে খেয়াল না করলেও আজ তার মনে হল মেয়েটির মাঝে অদ্ভুত এক মায়া আছে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে