মিসেস চৌধুরী পর্ব-১৪

0
1943

#মিসেস_চৌধুরী
#Part_14
#Writer_NOVA

পূর্ব দিগন্তে ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটা উঁকি দিচ্ছে। একটু পর হয়তো তার কিরণ সারা ভূবন আলোকিত হয়ে উঠবে।ফিহা খুব শক্ত করে নিজের সাথে অনিয়াকে মিশিয়ে রেখেছে।আজ অনেক দিন পর সূর্য উদয় দেখছে ফিহা।অনিয়া তার মায়ের বুকে মুখ গুঁজে পরম নিশ্চিন্তে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ফিহা মায়াবী চোখে অনিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ ফিহা অফিস যাবে না।সারাদিন অনিয়ার সাথে সময় কাটাবে।অফিসের কাজের জন্য আজকাল অনির দিকে খেয়াল দেওয়া হয় না।টেবলেট ওর ছোট ঘর আরামে ঘুমাচ্ছে। এই বোবা প্রাণীটার ওপর দিনকে দিন ফিহার মায়া বেড়েই যাচ্ছে। আর অনিয়া তো এখন ওর কলিজার টুকরো। ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে ফিহা একা একা কথা বলছে।

ফিহাঃ পাগলী মেয়ে আমার।ভোর সকালে উঠে আমাকে জ্বালিয়ে এখন ঘুমানো হচ্ছে। আমি নাহয় নামাজ পরতে উঠেছি কিন্তু তোমার কেন উঠতে হবে।দিনকে দিন মা-মণি তোমার পাঁজি পানা বেড়েই যাচ্ছে। আমি সাথে না থাকলে ঘুমের থেকে জেগে যাও।এটা কিন্তু ভালো কথা নয়।

আনিসঃ কার সাথে কথা বলছো ছোট বউমা?

ফিহাঃ আরে বাবা আপনি?কখন এলেন?কিছু লাগবে?আমায় ডাক দিলেই হতো।নয়তো কাউকে পাঠাতেন।আপনি কেন কষ্ট করে উঠে এলেন।
আনিসঃ তুমি ব্যস্ত হয়ো না মা।আমি ঠিক আছি।

ফিহাঃ এত সকাল করে কেন উঠেছেন বলুন তো।নামাজ পরে শুয়ে থাকলেও তো পারেন।এত সকালে তো এখনো সূর্যও উঠেনি।

আনিসঃ শুয়ে, বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছি বউমা।সারাদিন তো এসবের মধ্যেই থাকি।একা এতবড় বাড়িতে থাকতে আর ভালো লাগে না।আমার দিদিভাই কেমন আছে?

ফিহাঃ আপনার দিদিভাই আজ রাতে ঘুমায়নি।কিছু সময় পর পর কান্না করে উঠেছে।আযানের আগে একটু চোখ লাগিয়েছিলো কিন্তু আমি নামাজ পরতে উঠার সাথে সাথে জেগে গেছে। এখন আবার ঘুমালো।

আনিসঃ রাতে কান্না করেছে কেন?(চিন্তিত সুরে)
ফিহাঃ জানিনা বাবা।কখনও তো এমন করে না।আজ কিছু সময় পর পর ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠেছে।কিন্তু কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।

আনিসঃ দিদিভাই হয়তো কিছুতে ভয় পেয়েছে।তাই এরকম বিহেভ করছে।

ফিহাঃ আমিও বুঝতে পারছি না আসলে কি হয়েছে? দুই দিন ধরে এতো ব্যস্ত ছিলাম যে ওর দিকে ভালোমতো খেয়ালও দিতে পারি না।সেজন্য আজ আমি ঠিক করেছি অফিসে যাবো না।সারাদিন অনিকে ও আপনাকে সময় দিবো।অফিসে থাকার দরূণ আপনার যত্নও নিতে পারি না।কি খান,কি করেন কিছুই জানি না।আজকে আমি বাড়িতে থেকে নিজের হাতে সবকিছু রান্না করবো আর আপনাদের দুজনের কেয়ার করবো।আজ অফিসে না গেলে কি কোন সমস্যা হবে বাবা?

অানিসঃ এটা কেমন কথা হলো বউমা?তোমার সংসার,অফিস,তোমার বাবা, তোমার মেয়ে।সবকিছু যেখানে তোমার সেখানে আমি বলার কে?

ফিহাঃ বাবা এসব কিছু আমার কাছে আমানত।আমার কোন হক নেই তাতে।

আনিসঃ কি বলো তুমি বউমা?আমি সবকিছু তোমার হাতে তুলে দিয়েছি।এখন আমার যা ছিলো আর যা আছে সব তোমার।আমার এসবে কোন অধিকার নেই। এবার শান্তিমত দুচোখ বন্ধ করতে পারলেই আমার মুক্তি।

ফিহাঃ এতো বিশ্বাস করেন আমায়।(ছলছল চোখে)
আনিসঃ নিজের থেকেও বেশি তোমায় ভরসা করি বউমা।অনি দিদিভাই ঘুমিয়ে গেছে। ওকে বিছানায় শুইয়ে দেও।বড্ড জ্বালাতন করে তোমায়?

ফিহাঃ যত দিন যাচ্ছে আমার প্রতি পাগল হয়ে যাচ্ছে। কোথাও অনিকে ছারা যেতে পারি না।এখন তো আমার ওয়াস রুমে যাওয়া দায় হয়ে পরেছে।আমার সাথে সবসময় লেপ্টে থাকে।আগে তাও কারো কোলে যেতো। কিন্তু এখন আমায় ছারা কিছু বুঝে না।

অনিকে বিছানায় রেখে গায়ের ওপর হালকা করে কম্বল মেলে দিলো।যদি ততটা শীত নয়।তবুও ঠান্ডা লাগার সম্ভাবনা আছে।আনিস চৌধুরী মুগ্ধ চোখে ফিহার দিকে তাকিয়ে আছে।

আনিসঃ অনি তোমায় অনেক বিরক্ত করে তাই না বউমা।যার জন্য তোমার মাঝে মাঝে ওর, আমার ওপর রাগ হয়।

ফিহাঃ ছি ছি বাবা কি বলেন এসব?কোন মা কি তার মেয়ের ওপর বিরক্ত হতে পারে।আর কোন মেয়ে কি তার বাবার ওপর রাগ করে থাকতে পারে।অনি যেমন আমার মেয়ে তেমনি আপনিও আমার বাবা।এটা সত্যি যে আমি অনির নিজের মা নয় কিংবা আপনি আমার নিজের বাবা নন।কিন্তু আমি সেটা মানি না।আপনি আমার নিজের বাবা,অনি আমারি মেয়ে। আপনাদের দুজনকে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না।

আনিসঃ আমি আমার অনি দিদিভাইয়ের জন্য একজন সত্যিকারের আদর্শ মা আর নিজের জন্য একটা মেয়ে নিয়ে এসেছি।আমার আর কিছু চাই না।
আজ যদি আমার আকশি থাকতো তাহলে আমি তোমাকে সত্যিই নিজের ছোট বউমা বানিয়ে নিতাম।

ফিহাঃ ওহ্ এখন মেয়েকে ভালো লাগছে না।তাই বউ বানানোর চিন্তায় আছেন।তার মানে দাঁড়ালো আপনি আমায় একটুও ভালোবাসে না।আমি ঠিক বলেছি না বাবা?আমি মনে হয় আপনাদের যত্ন নিতে পারছি না।যার কারণে মেয়ে থেকে বউ করবেন ভাবছেন।
(মুখ গোমরা করে)

আনিসঃ আমি তা বুঝাইনি বউমা।তুমি আমার বউমা এবং মেয়ে দুটোই।তোমারজায়গায় আজ অন্য কোন মেয়ে থাকলে হয়তো আমার সবকিছু নিঃশ্ব করে পালিয়ে যেতো।কিন্তু তুমি তা করো নি।এই বুড়ো বাপ আর এতিম বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে অবিবাহিত হয়েও সমাজের কাছে বিবাহিত হওয়ার দাগ লাগিয়েছো।নিজের জন্য একটুও ভাবো না।

ফিহাঃ বাবা,আপনি আবারও উল্টো পাল্টা কথা বলছেন।আপনাকে না আমি বলেছি একদম নিজেকে এত ছোট ভাববেন না।আর অনিকে কখনও এতিম বলবেন না।অনির মা ফিহা চৌধুরী এখনও বেঁচে আছে।তাই আমার অনি এতিম নয়।আপনি নিজেকে কেন একা ভাবেন বলুন তো।আপনার মেয়ে ফিহা যতদিন আছে ততদিন আপনারা কেউ নিঃস্ব বা একা নন।কথাটা মনে রাখবেন।

আনিসঃ বাহ বাহ আমার মেয়ে দেখছি আজকাল আমার ওপর রাগও করে।

ফিহাঃ হুম, বাবার ওপর মেয়ে রাগ করতেই পারি।এবার আমাকে বলুন বাবা, কি খাবেন? চা নাকি কফি?

আনিসঃ এক কাপ চা হলে ভালো হতো।

ফিহাঃ তাহলে আপনি বসুন আমি চা করে আনছি।আপনি এখানেই বসে থাকবেন।কোথাও যাবেন না কিন্তু। আজ একটু ঠান্ডা পরেছে। ঠান্ডার মধ্যে আপনার হাঁটা চলা কম করতে হবে।

আনিসঃ আমি আমার দিদিভাইয়ের সামনেই বসে আছি। তুমি গিয়ে চা নিয়ে এসো।

ফিহা খুশি মনে চা তৈরি করতে চলে গেল।আনিস চৌধুরী বড় করে দীর্ঘ শ্বাস ছারলো। নিজের মনের মাঝে তিনি আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন।যাক, তিনি নিজের ও অনির জন্য একজন খাঁটি মনের মানুষ খুঁজে পেয়েছেন।এর থেকে বেশি আর কি লাগে?

ফিহা চা তৈরি করে নিয়ে এলো।বউ শ্বশুর মিলে কিছুখন ব্যবসা বাণিজ্যের কথা বললো।ফিহা নিজ হাতে আনিস চৌধুরীকে ঔষধ খাইয়ে বিশ্রাম করতে ঘরে পাঠিয়ে দিলো।ফিহার শ্বশুর চলে যেতেই ভেবেছিলো একটু ঘুমাবে।তাই বিছানায় অনির পাশে বালিশে মাথা হেলিয়ে দিলো।কিন্তু বেশ কিছু সময় এপাশ ওপাশ করেও ফিহা ঘুমাতে পারলো না।তাই উঠে আলতো করে অনির কপালে চুমু খেতে গিয়েও থেমে গেল।

ফিহাঃ ছোট বেলায় গুরুজনদের বলতে শুনেছিলাম ঘুমন্ত বাচ্চাকে কিসি করতে নেই। তাহলে নাকি বাচ্চারা অনেক পাঁজি, রাগী ও জিদ্দি হয়।যদিও আমি এসব মানি না।তারপরেও আমি তোমাকে ঘুমের মধ্যে কিসি দিবো না। তুমি আমার মানিক চাঁদ। মাশাল্লাহ, কত কিউট দেখতে আমার পরীটা।ঘুমন্ত মানুষকে নাকি অনেক সুন্দর লাগে।বাচ্চাদের তো আরো বেশি। আমার পরীকে না দেখলে আমি কখনও এটা বিশ্বাস করতাম না।ঘুমিয়ে থাকলে চেহারাটা আরো বেশি মায়াবী লাগে।ইচ্ছে করে সারা মুখে আদরের পরশ দিয়ে দিতে।এই মায়াবী চেহারা দেখে আমি সারাজীবন পার করে দিতে পারবো।আমার কোন কষ্ট হবে না।বরং আমি তোমার মুখের হাসির জন্য সারা দুনিয়ার কাছে নিজের জীবন বাজি রাখতে রাজি আছি।কারণ আমি এই ছোট্ট সোনামণিটার মা।

মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কথাগুলো বললো ফিহা।
দুধ গুলিয়ে ঘুমের মধ্যে অনিকে খাইয়ে দিলো।
তারপর উঠে চলে এলো টেবলেটের ঘরের কাছে।রুমের উত্তর পাশে খুব সুন্দর একটা ছোট্ট ডগ ঘর।সেটায় টেবলেট থাকে।

ফিহাঃ টেবলেট আর কত ঘুমাবি বল তো?কত বেলা হয়ে গেছিস তুই জানিস।যদিও আজকে অফিস যাবো না।কিন্তু আমার যখন ঘুম আসছে না তাহলে তোকেও আমি ঘুমাতে দিবো না।উঠ না।এতো পরে পরে ঘুমালে চলে।আমি ভাবলাম তোকে নিয়ে বাইরের বাগানে ঘুরতে যাবো।আর তুই এখনো আলসেমি করে শুয়ে আছিস।আমাকে আজ রান্না করতে হবে।তিন বেলার খাবার আজ আমি রান্না করবো।তুই যদি আজ আমার সাথে বাইরে না যাস তাহলে তোর দুপুরের খাবার মাইনাস।

ফিহার এতগুলো কথার একটাও বোধ হয় টেবলেটের কানে ঢুকলো না।কারণ সে যেহেতু শুনেছে আজ ফিহা অফিস যাবে না সো টেবলেটের আজ কোন কাজ নেই। তাই সারাদিন পরে পরে ঘুমাবে।টেবলেট ফিহার দিকে ঘুম ঘুম চোখে একবার তাকিয়ে হাই তুললো।তারপর আবার মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ করে নিলো।মোট কথা ফিহার কোন কথাকেই সে পাত্তা দেয়নি।এখন সে আরামচে ঘুমাবে।ফিহা টেবলেটের ওপর বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বিরবির করতে করতে চলে গেল।

ফিহাঃ ধূর,টেবলেট টা এলো না।ও এলে আমি একটু বাইরে যেতাম।আপাতত এখন আমার মেয়ে উঠবে না।একা একা বাইরে যেতেও ভালো লাগছে না।কি করব, কি করব?বাড়িতে তো কোন সার্ভেন্ট ও জেগে নেই। আবদুল চাচাকে ফোন দিয়ে আজকে অফিস সামলাতে বলে দিতে হবে।আমি এখন কি করবো?(একটু ভেবে)পেয়েছি!!! পুরো বাড়িটা আমার এখনো ঘুরে দেখা হয়নি।আমি বরং এখন পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখি।কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবো।আচ্ছা, অনিল ভাইয়া ও লিয়া ভাবীর রুমটা আগে ঘুরে দেখলে কেমন হয়?ইয়েস ঐ রুমেই আগে যাবো।

যেমন ভাবা তেমন কাজ।ধীর গতিতে অনিলের রুমের দিকে হাঁটতে লাগলো ফিহা।রুমের দরজায় ছিটকিনি লাগানো।তালা মেরে রাখা হয়নি।কেউ এদিকে আসে না বলে তালা মারার প্রয়োজন মনে করে না।দরজার ছিটকিনি খুলে ফিহা ভেতরে প্রবেশ করলো।রুমটা ঘন কালো কুচকুচে অন্ধকার। বাইরের ছিটেফোঁটা আলোয় হাতরে লাইটের সুইচ খুঁজে লাইট জ্বালালো।বহুদিন ব্যবহার না করায় রুমে একটা গুমোট গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তবে পুরো রুম সাজানো গোছানো।দেখে মনেই হয় না রুমে কেউ থাকে না।

পুরো রুমে চোখ বুলাতে বুলাতে একটা ছবির কাছে এসে চোখ আটকে গেল।ধীর পায়ে সেই ছবির সামনে এসে দাঁড়ালো ফিহা।দেয়ালে টাঙানো বিশাল বড় একটা ফ্রেম।যেখানে অনিল,লিয়া ও অনিয়া আছে।লিয়াকে এই প্রথম দেখলো ফিহা।অসম্ভব সুন্দরী, চোখের মণি দুটো ধূসর রঙের।ছবিতে লিয়া ঘুমন্ত অনিয়াকে কোলে নিয়ে আছে।অনিয়া তখন খুব ছোট। লিয়া দুই হাতে জাপটে ধরে রেখেছে অনিকে।আর অনিল, লিয়াকে এক হাতে জরিয়ে ধরেছে।লিয়ার মাথার সাথে হালকা করে নিজের মাথা হেলিয়ে রেখেছে।দুজনের পরনে হালকা আকাশি কালার ড্রেস। ফিহার কাছে ছবিটা পৃথিবীর বেস্ট ছবি মনে হলো।কারণ এখানে একটা ছোট্ট পরিবার আছে।বাবা,মা এবং তাদের ছোট সোনামণি। এর থেকে ভালো ছবি আর কি হতে পারে?তবে আফসোস তারা সারাজীবন এভাবে থাকতে পারলো না।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে