মিসেস চৌধুরী পর্ব-০৮

0
1731

#মিসেস_চৌধুরী
#Part_08
#Writer_NOVA

রাতে একসাথে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছে ফিহা ও আনিস চৌধুরী।দুপুরের মিটিংয়ের কথা আবদুল সাহেবের কাছ থেকে শুনেছেন তিনি।ফিহা যে প্রথম বার দূর্দান্ত বক্তব্য রেখে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে, সেটা শুনে আনিস চৌধুরী বেশ খুশি।
নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটেছে তার।তিনি সবদিক থেকে পারফেক্ট একটা মেয়ে চুজ করেছেন।অনিয়া একটা মেয়ে সার্ভেন্টে কোলে নিয়ে ঘুরছে।টেবলেট অনিয়ার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।

আনিসঃ আজকের মিটিং কেমন হলো বউমা?

ফিহাঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো বাবা।আমি ভাবতেই পারিনি এতো কথা বলতে পারবো।পূর্ব কোন অভিজ্ঞতা ছাড়া এতো কথা কি করে বললাম তাতে আমি নিজেই কনফিউশানে পরে গিয়েছিলাম।প্রথম প্রথম তো অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।আবদুল চাচা ভয় ভেঙে দিলো।উনি যদি আজকের মিটিংয়ে না থাকতো তাহলে আমি ভয়ে হার্ট অ্যাটাক করে ঐখানেই চিৎপটাং হয়ে মরে পরে থাকতাম।

আনিসঃ ভয়ের কিছু নেই বউমা।আমি জানি তুমি পারবে।তাই তো তোমাকে আমি চয়েজ করেছি।তোমার চোখে আমি জেতার অদম্য শক্তি দেখেছি।যা আর কোন মেয়ের চোখে দেখতে পাইনি।তোমাকে যে শক্ত হাতে সবকিছুতে সামলে নিতে হবে।

ফিহাঃ বাবা আপনি চিন্তা করবেন না।আপনি শুধু রেস্ট নিন।আপনার ধারণা আমি একদিন অবশ্যই সত্যি করবো।

আনিসঃ মা রে আমায় মাফ করে দিও।নিজের স্বার্থের জন্য তোমাকে কতগুলো দায়িত্বে বেঁধে রেখেছি।আফিস,সংসার,মেয়ে আরো কতকিছু তোমায় সামলাতে হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করো বউমা আমি যে নিরুপায়।আমার হাতে এছাড়া আর কোন পথ ছিলো না।আমি এই বয়সে কখনো এতকিছু সামলাতে পারতাম না।টেনশনে টেনশনে শেষ হয়ে যেতাম।তখন আমার দিদিভাই টার কি হতো?সেটা ভেবেই তোমাকে নিয়ে এসেছি।আমি যে তোমার মাঝে মাতৃত্ব দেখেছি।
ওর মা হওয়ার আগ্রহ, যোগ্যতা দেখেছি।ওর জন্য তোমার মনে মায়া, ভালোবাসা, স্নেহ খুঁজে পেয়েছি।তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে আমাদের সাথে জরিয়ে ফেলেছি।

ফিহাঃ আমি কিছু মনে করি নি বাবা।বরং অনেক খুশি হয়েছি।কারণ আমি নিজের বাবা ও মেয়ে পেয়েছি। পেয়েছি সুন্দর একটা ছোট পরিবার।এখন আমিও সবার কাছে মাথা উঁচু করে বলতে পারবো আমারও একটা পরিবার আছে।আমারও মাথার ওপরে বাবা নামক ছায়া আছে।আমি এতিম নই।না,আমি এখন সত্যিই এতিম নই। আমার একটা পরিচয় আছে। আনিস চৌধুরীর মেয়ে আমি।আমি এখন মিসেস চৌধুরী। আপনি আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছেন।মাথা উঁচু করে বাঁচার তাগিদ দিয়েছেন।সবার কাছে পরিচয় করে দিয়েছেন আমি অনিয়ার মা। এটাই তো আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া বাবা।

আনিসঃ বউমা তুমি দেখো, একদিন তুমি অনেক বড় হবে।আমি দোয়া করে দিলাম তোমাকে।তবে বউমা কখনও অন্য পাঁচজন মেয়ের মতো আমাকে ও আমার নাতনিকে দূরে ঠেলে দিয়ো না।তাহলে যে সে দিনই হবে আমার শেষ দিন।

ফিহাঃ ছি:ছি:বাবা এসব কি বলেন?এখন যা আছে সবই আপনাদের।আমি তো শুধু আপনাদের আমানতদার।আপনাদেরকে এবং অফিস দেখে রাখার দায়িত্ব আমার।এগুলো আগে আপনাদের ছিলো, সারাজীবন আপনাদেরি থাকবে।আমার এগুলো চাই না।আপনি ও আমার মেয়ে আমার পাশে থাকলেই চলবে।আর কিছু লাগবে না আমার।আপনি মনে হয় আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না,তাই না বাবা।আমি সঠিক বলেছি তো??

আনিসঃ না বউমা সেটা নয়।আমি শুধু তোমার কাছে অনুরোধ করছি।আমি তোমাকে অনেক বিশ্বাস করি।কারণ আমি তোমাকে টাকার কথা বলে আনতে চেয়েছিলাম।কিন্তু তুমি তা প্রত্যাখান করো।যখনি অনির কথা বললাম তখন তুমি রাজী হলে।অনিয়াকে লালন-পালনেও তুমি কোন টাকা নিতে রাজী হলে না।
এমনকি আমাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিলে তুমি কখনও মাতৃত্ব টাকার বিনিময়ে বিক্রি করবে না। ঠিক তখনি বুঝে গেছি তুমি কি রকম মেয়ে। তরপরও ভয় হয় বউমা।কখন মানুষের মন পাল্টে যায়।সেটাতো বলা যায় না।জানো বউমা,মানুষের মনকে আকাশের রংয়ের সাথে তুলনা করা হয়।কারণ দুটোই খনে খনে রং বদলায়।

ফিহাঃ আপনি আমাকে নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকুন বাবা।আমি আপনাকে বাবা বলে ডেকেছি। কোন মেয়ে কি তার বাবার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে?কেউ যদি করেও থাকে,আমি কখনও আমার বাবার সাথে বৈঈমানী করবো না।নিজের সর্বস্ব দিয়ে আপনাদের সাহায্য করবো।এখন যে সবকিছু আমার।যেমন আপনি,অনিয়া।আপনি তো আমাকে অধিকার দিয়েই দিয়েছেন।তাই তো আমি বলতে পারি আমার বাবা,আমার মেয়ে।এর থেকে বেশি আমার মতো এতিম মেয়ের আর কি লাগে বলুন তো?

আনিসঃ একদম কথায় কথায় এতিম বলবে না।আমি ও অনি কি মারা গেছি।যেদিন আমরা থাকবো না সেদিন বলবে তুমি এতিম।আমরা বেঁচে থাকতে কখনও নয়।তুমি আমার মেয়ে আর অনি তোমার মেয়ে।কথাটা মনে রেখো বউমা।

আনিস চৌধুরীর কথা শুনে চোখ খুশিতে দুটো চকচক করে উঠলো ফিহার।একটা এতিম মেয়ের এর কাছে এটা যে কতবড় খুশির সংবাদ সেটা শুধু মাত্র সেই জানে।আনিস চৌধুরীর চোখের আড়ালে ফিহা নিজের চোখের পানি মুছে নিলে।গাল বেয়ে দুই ফোঁটা পানি খুশির কারণে পরে গিয়েছিল। কিন্তু সে তো সাফান ছারা নিজের চোখের পানি আর কাউকে দেখায় না।তাই জলদী করে মুছে নিয়েছে।

খাবার শেষ করে ফিহা অনিয়াকে নিয়ে রুমে চলে গেল। কিছু সময় অনিয়াকে ঘুম পারানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো।কিন্তু ব্যর্থ চেষ্টা আর সফল হলো না।অনিয়া ওর মায়ের সাথে দুষ্টুমী করতে লাগলো।

ফিহাঃ কি হচ্ছে এগুলো মাম্মাম?তুমি ইদানীং ভীষণ ফাজিল হয়ে যাচ্ছো।মাম্মিকে জ্বালানোর ধান্দায় থাকো।খাবার খেতে গেলে আর ঘুমাতে গেলে তোমার দুষ্টুমী শুরু হয়ে যায়।এটা তো ঠিক কথা নয়।এরকম তো পঁচা মেয়েরা করে।তুমি কি পঁচা মেয়ে বলো?মোটেও না।তুমি তো আমার ভালো মেয়ে। আমার লক্ষ্মীসোনা,জাদুর কণা।তুমি যদি মাম্মিকে এভাবে জ্বালাতন করো তাহলে মাম্মি তো বিরক্ত হয়ে তোমাকে বকা দিবো।তখন কি তোমার ভালো লাগবে বলো। একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরো মানিক।তুমি জেগে থাকলে তো আমি ঘুমাতে পারবো না।সারাক্ষণ তোমার টেনশন হবে।আর কিছু সময় পর পর জেগে উঠবো।জলদী করে ঘুমিয়ে পরো।সকালে উঠে আমাদের আবার অফিসে যেতে হবে।সেটা কি তুমি ভুলে গেছো মাম্মাম??

খাটের কোণা থেকে টেবলেট উঠে এসে ফিহার পায়ের কাছে চুপটি করে বসে রইলো।একটু আগে তারও রাতের ডিনার হয়েছে। সারাদিন অনিয়াকে সময় দেয় বলে টেবলেট মহাশয়ের চোখেও রাতে ঘুম ভির করে।চাইলে অন্য কুকুরের মতো টেবলেটও সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাতে পারে।কিন্তু সেটা সে করে না।অনিয়া জেগে থাকুক বা ঘুমিয়ে সবসময় ওর দোলনার পাশে কিংবা ওর সাথে থাকবে।মনে হয় না সারাদিনে এক মিনিটের জন্যও চোখ দুটো লাগায় টেবলেট।

ফিহাঃ জানিস টেবলেট যতদিন যাচ্ছে ততই তোর,অনির আর বাবার মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছি।জানি না এই মায়া কাটিয়ে উঠতে পারবো কি না।রাতে ঘুমের ঘোরে, সকাল ভোরে অনির মুখটা না দেখলে মনটা ছটফট করে।তোকে সকালের ব্রেকফাস্টে খুঁজে না পেলে মনে হয় কি যেনো একটা নেই নেই। বাবার সাথে রাতের খাবার না খেলে মনে হয় সারাদিন কিছু একটা বাকি পরে গেছে। যখন তোর মালিক আকশি আসবে তখন তো তার হাতে সব তুলে দিয়ে আমি চলে যাবো।কিন্তু বিশ্বাস কর আমি তখন ভালো থাকবো না রে।আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসবে।সেসব কথা ভাবলেই এখনি আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে।

একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অনিয়াকে কোলে তুলে নিলো ফিহা।অনির মুখটা কি মায়াবী! এই মুখের হাসির জন্য সে শত কষ্ট করতেও রাজী আছে।কারণ সে যে এখন অনিয়ার মা।হোক সে জন্ম দেয়নি কিন্তু দায়িত্ব তো ওালন করছে।তাতেই ফিহা দাবী করতে পারে এটা ওর মেয়ে।টেবলেটও বেশ কয়েকবার কুই কুই করে শব্দ করে ফিহার সাথে ঘেঁষে বসলো।

ফিহাঃ মায়া জিনিসটা বড় অদ্ভুত। যার ওপর পরে যায় হাজার চেষ্টা করেও তার থেকে উঠানো যায় না।তোদের সবার ওপর আমার এই কয়েকদিনে এতো মায়া হয়ে গেছে যে আমার মনে হয় তুই, অনিয়া,বাবা সবাই আমার আপনজন।সবকিছু আমার, আমার মনে হয়।কোথা থেকে যেনো অধিকাটা পেয়ে যাই।আল্লাহ বাচ্চাদের জন্মের সাথে সাথে চেহারায় অনেক মায়া দিয়ে দেয়।যাতে করে মা-সহ সবাই বাচ্চার মায়ায় পরে যায়। তাহলে আমি কেন অনির মায়ায় পরবো না বলতো।যেখানে ও নিজেই জানছে আমি ওর মা।আমিতো দিনকে দিন শুধু ওর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছি।আমি এটাও বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছি যে অনি আমার নিজের মেয়ে। আমার মনে হয় ও আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। এখন ওকে আলাদা করে বাঁচা বোধ হয় আমার সম্ভব নয় রে টেবলেট। আমি যে অনিকে সত্যি নিজের মেয়ে ধরে নিয়েছি।ও বোধ হয় আমাকে নিজের মা মনে করে।তাহলে আমি ওকে ছেড়ে কি করে যাই বলতো।

ফিহা হঠাৎ থেমে গেল।আজ সব কিছু টেবলেটের সাথে শেয়ার করলো সে।নিজের মনটা অনেক হালকা মনে হচ্ছে। টেবলেটও বুঝতে পেরে চুপটি করে ওর দিকে তাকিয়ে ওর মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করছে।ফিহা সেটা বুঝে টেবলেটের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
তারপর জোর খাটিয়ে কড়া গলায় বললো।

ফিহাঃ কোথাও যাবো না আমি তোদের ছেড়ে। বাকি জীবনটা আমি তোদের সাথেই কাটাতে চাই।এখন যে তোরাই আমার সব।

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে অনিয়াকে শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো ফিহা।মনে হচ্ছে ফিহা ছেরে দিলেই কেউ অনিয়াকে ওর কাছে থেকে নিয়ে যাবে বহুদূরে। অনিয়াও মায়ের উষ্ণ পরশ পেয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে