মিসেস চৌধুরী পর্ব-০৩

0
1840

#মিসেস_চৌধুরী
#Part_03
#Writer_NOVA

ল্যাপটপে এক ধ্যানে কিছু একটা করছিলো আকশি।সারা পৃথিবীর কাছে সে মৃত হলেও আসলে সে মৃত নয়।ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে। সেটা অবশ্য সম্ভব হয়েছে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড আদিয়াতের জন্য। খাটের মধ্যে বসে দুই পা মুড়ে ল্যাপটপে মনোযোগ সহকারে কাজ করছে আকশি।তখনি খুব দ্রুত রুমে ঢুকলো আদিয়াত।চোখ মুখে তার বিস্ময়।

আকশিঃ কি হয়েছে আদি?এনিথিং রং?এরকম করে হা করে কি দেখছিস?
আদিয়াতঃ আকশি তুই বিয়ে করেছিস?

আদিয়াতের প্রশ্ন শুনে আকশি ল্যাপটপের স্ক্রীনটা বন্ধ করে ওর দিকে তাকালো। চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকালো।আদিয়াতের এই প্রশ্নটা আকশির হজম হলো না।ছেলেটা কি ভর দুপুরে উল্টো পাল্টা কিছু খেয়ে এসেছে নাকি?

আকশিঃ আর ইউ ওকে?তুই কি এই দুপুরে ড্রিংক করেছিস?মাথা ঠিক আছে তো ভাই।
আদিয়াতঃ আমার কথার উত্তর দে।তুই কি আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করেছিস।
আকশিঃ প্রচুর খিদে পেয়েছে। যা গিয়ে খাবার তৈরি কর।আমার এসব মজা করার কোন ইচ্ছে নেই।
আদিয়াতঃ আমি মজা করছি না আকশি।আমি সিরিয়াসভাবে জিজ্ঞেস করছি।তুই কি সবাইকে না জানিয়ে কোন বিয়ে করেছিস?আর তোর কি কোন মেয়ে আছে?

আদিয়াতের কথা শুনে আকশি কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকালো। কারণ আদিয়াত কোন মজা করছে না।বরং সিরিয়াস ভাবে কথাগুলো বলছে।

আকশিঃ আদি তুই ভালো করে জানিস আমি এখনো বিয়েই করিনি।তাহলে আমার বাচ্চা আসবে কি করে?
আদিয়াতঃ তুই সত্যি বলছিস তো?
আকশিঃ আমি সত্যি বলছি।আমি বিয়ে করবো আর তুই জানবি না তা কি হয়?
আদিয়াতঃ তাহলে ঐ মেয়েটা আর বাচ্চাটা কে?
আকশিঃ কোন মেয়ে আর কোন বাচ্চা?
আদিয়াতঃ একটা মেয়ে তোর বউয়ের পরিচয়ে তোদের কোম্পানি চালাচ্ছে। ওর সাথে সবসময় একটা মাস ছয়েকের একটা বাচ্চা থাকে।আর মেয়েটা সবার কাছে বলে সেটা তোদের বাচ্চা।
আকশিঃ হোয়াট??কি বলছিস তুই? (অবাক হয়ে)
আদিয়াতঃ আমি সত্যি বলছি।তুই সত্যি আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে নিস নি তো।
আকশিঃ কি সব কথা বলছিস বল তো?আই এম সিউর মেয়েটা ফ্রড।আমাদের টাকা, পয়সা,সম্পত্তি হাতানোর জন্য এসব মিথ্যে নাটক করছে।
আদিয়াতঃ তোর বাবা পুরো কোম্পানির দায়িত্ব মেয়েটার ওপর দিয়ে দিয়েছে।এখন তোদের সবকিছু মেয়েটা সামলায়।
আকশিঃ বাবা কোম্পানি ওর হাতে তুলে দিছে।কিন্তু কেন?আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না।
আদিয়াতঃ তুই কি মেয়েটা কে চিনিস?
আকশিঃ আমি কি করে মেয়েটা কে চিনবো?
আদিয়াতঃ আমি তোকে মেয়েটার ছবি দেখাচ্ছি। দেখতো চিনিস কি না।

আদিয়াত মোবাইল বের করে ফিহা ও অনিয়ার একসাথে থাকা একটা ছবি দেখালো।আকশি চোখ মুখ শক্ত করে বললো।

আকশিঃ আমি এই মেয়েকে চিনি না। জীবনে কোন দিন দেখিও নি।কিন্তু বাচ্চাটা মনে হচ্ছে অনিয়ার মতো।আমি সিউর মেয়েটা কোন বাজে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে।আমি নিশ্চিত আমাদের প্রোপার্টি হাত করে পালাবে।
আদিয়াতঃ পালানোর হলে এতদিন বসে থাকতো না।আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি মেয়েটা পনেরো দিন হলো তোদের বাসায় আছে।তোর বাবা পুরো কোম্পানির দায়িত্ব মেয়েটার ঘাড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে হাফ ছাড়ছে।যদি মেয়েটার পালানোর ইচ্ছে থাকতো তাহলে এত দিন বসে থাকতো না।তোর ভাষ্য মতে বুঝলাম যে বাচ্চাটা অনিয়া হবে।
আকশিঃ কিন্তু মেয়েটা কে?কি উদ্দেশ্য মেয়েটা আমার বউ বলে সবার কাছে পরিচয় দিচ্ছে?সবকিছু কি রকম ঘোলাটে লাগছে আমার কাছে।
আদিয়াতঃ আমার মনে হয় কি, তোর ভাই ভাবী যেহেতু মারা গেছে সে কারণে হয়তো অনিয়াকে লালন-পালন করার জন্য তোর বাবা মেয়েটাকে এনেছে।
আকশিঃ সে না হয় বুঝলাম।কিন্তু আমার বউয়ের পরিচয়, কোম্পানি চালানোর ব্যপরটা তো বুঝলাম না।তুই তো আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলি।
আদিয়াতঃ তোদের নাকি দুই বছর আগে বিয়ে হয়েছে?
আকশিঃ কি-ই-ই-ই?
আদিয়াতঃ এমনটাই তো সবার মুখ থেকে শুনলাম।
আকশিঃ নিশ্চয়ই এর পেছনে বড় কোন রহস্য আছে। সেই রহস্য আমায় খুঁজে বের করতে হবে। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না।কাজে লেগে পর।মেয়েটার সব ডিটেলস আমার চাই। কোথা থেকে এসেছে,ওর উদ্দেশ্য কি,আমার বউ বলে কেন পরিচয় দিচ্ছে, অনিকে আমার মেয়ে কেন বলছে সবকিছু।
আদিয়াতঃ বাহ্ আকশি!! তুই দেখছি বউয়ের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য উঠে-পরে লেগেছিস।যাই বলিস মেয়েটা কিন্তু দেখতে মাশাল্লাহ। তোর সাথে হেব্বি মানাবে।যাকে বলে পারফেক্ট জুরি।(মুখ টিপে হেসে)
আকশিঃ তুই একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়েও মজা করছিস।আমি মেয়েটাকে কখনও দেখি নি।আর বিয়ে করা বউ কি করে হতে পারে বল।মেয়েটার পেছনে লোক লাগিয়ে দে।ওর সব ইনফরমেশন আমার চাই। বাসায়, অফিসে সব জায়গায় সি সি টিভি ফুটেজ লাগাবি।যাতে ২৪ ঘন্টা আমি মেয়েটাকে চোখে চোখে রাখতে পারি।
আদিয়াতঃ ভালবাসা মনে হচ্ছে উথলে পরছে।এতো ভালবাসিস বউকে।এক মিনিটের জন্য চোখের আড়াল করতে চাচ্ছিস না।আমার তো মনে হচ্ছে সত্যি মপয়েটা তোর বউ ।
আকশিঃ বেশি কথা না বলে চুপচাপ যা বলেছি তাই কর।আমার কালকের মধ্যে সব কমপ্লিট চাই।
আদিয়াতঃ হঠাৎ তুই এতো সিরিয়াস হয়ে গেলি কেন?
আকশিঃ কারণ আমার মেয়েটাকে যাচাই করে দেখা উচিত।এমনো হতে পারে মেয়েটা আমাদের শত্রু পক্ষের।যদি বাবা ও অনিয়ার কোন ক্ষতি করে ফেলে।বর্তমানে আমার পরিবারের দুইজন ছারাতো আর কেউ বেঁচে নেই।
আদিয়াতঃ আরেকজন আছে তোর এই বউ।মেয়েটা কিন্তু দেখতে অনেক সুন্দরী। চেহারাটা কি মায়াবী?ভাই তোর পছন্দ না হলে আমাকে দিয়ে দে।আমি বিয়ে করে নেবো মেয়েটাকে।
আকশিঃ তোর এই ফালতু কথা বন্ধ করে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা কর।আর আমি যা বলেছি তা যাতে কালকের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়।
আদিয়াতঃ যথা আঙ্গা মহারাজ। আপনি যা বলেছেন তা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো।কালকের মধ্যে তোদের বাড়ি ও অফিসের সি সি টিভি ফুটেজ তোর ল্যাপটপে থাকবে।
আকশিঃ কথার যাতে হেরফের না হয়।
আদিয়াতঃ সবই বুঝলাম কিন্তু একটা জিনিস মাথায় ঢুকছে না।তুই মেয়েটাকে নিয়ে এতো হাইপার হচ্ছিস কেন?প্রেমে-টেমে পরে যাস নি তো।
আকশিঃ তুই কি এখান থেকে যাবি।নাকি আমার হাত দুটো তোর মুখে প্রয়োগ করবো।
আদিয়াতঃ যাচ্ছি যাচ্ছি। পারিস তো ঐ একটাই।তবে আরেকটা কথা।
আকশিঃ আবার কি?
আদিয়াতঃ তুই নিজেকে গা ঢাকা দিয়ে এই দূর্গম পাহাড়ে কেন লুকিয়ে রেখেছিস।তুই তো নিজে গিয়ে কোম্পানি চালাতে পারতি।
আকশিঃ সময় হলে সব বলবো।এখন জলদী করে খাবারের ব্যবস্থা কর।
আদিয়াতঃ তুই কি আমাকে তোর চাকর ভাবিস।
আকশিঃ তার থেকেও কম কিছু ভাবি।
আদিয়াতঃ হারামী,আমি এত কষ্ট করে সবকিছু করি।আর তুই আমার সাথে এমন করিস।আমি দোয়া করে দিলাম তোর কপালে এই মেয়েটাই পরবে।তুই মিলিয়ে নিস।আমার কথা কখনো ভূল হয় না।
আকাশিঃ কথা না বলে জলদী ভাগ।
আদিয়াতঃ যাচ্ছি যাচ্ছি। আমার হয়েছে যত জ্বালা।

আদিয়াত খাবারের সন্ধানে বের হয়ে গেল।আকশি বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। মাথাটা তার ঝিমঝিম করছে। কিছু তেই অঙ্ক মিলাতে পারছে না।সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। তিন মাস ধরে এখানে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। সামনে তাকিয়ে পাহাড় দেখতে মনোযোগ দিলো আকশি।চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। বাইরের দিকে তাকালে মনটা এমনিতে ভালো হয়ে যায়।এখনো সেদিনের কথাটা মনে হলে নিজে নিজে অবাক হয়ে যায়।কি করে বেঁচে গেল সে।

লন্ডন থেকে ফিরে গাড়িতে উঠে ছিল সে। কিন্তু তার আর বাড়ি ফিরে যাওয়া হলো না।রাস্তা থেকে কিডন্যাপ হয়েছিল।পুরোনো একটা ভাঙাচোরা বাড়িতে টানা তিনদিন না খেয়ে পরে ছিলো।তারপর ওকে ইচ্ছে মতো মেরে শহর থেকে দূরে একটা পরিত্যক্ত জায়গায় ফেলে দেয়।প্রচুর মার দেওয়ার কারণে আকশি নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।কিডন্যাপাররা মৃত ভেবে ফেলে চলে যায়।আদিয়াত অনেক কষ্ট করে ওকে খুঁজে বের করে। তারপর আকশিকে নিয়ে এই দূর্গম পাহাড়ে চলে আসে।সুস্থ হতে বেশ কিছু দিন লেগে যায়।তারপর খবর পায় ওর ভাই-ভাবী কার এক্সিডেন্টে মৃত্যু। ওর কাছে ব্যপারটা আরো রহস্যজনক লেগেছে। যার কারণে সব কিছুর উত্তর খুঁজতে এখানে রয়ে যায়।

দুপুরের খাবারের পর আদিয়াত বের হয়ে গেল।আকশি এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসে ছিলো।গায়ে কালো টি-শার্ট, কালো টাউজার।যদিও আকশি ততটা ফর্সা নয়।তারপরও কালো পরলে ওকে ভীষণ ভালো লাগে। গায়ের রং টা চাপা ফর্সা।বয়স ২৭ এর কাছাকাছি।চেহারার মাঝে সবসময় গম্ভীরতা ফুটে থাকে। উচ্চতা ৬ ফুটের কাছাকাছি। আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছিলো আকশি।ধীর পায়ে আদিয়াত এসে ওর সাথে দাঁড়ালো।

আকশিঃ কি ব্যাপার তুই চলে এলি যে?
আদিয়াতঃ এখানে থেকে ঐসব কাজ করা অনেক টাফ হয়ে যাবে।তোর লাইফ রিস্ক হয়ে যেতে পারে।সবচেয়ে বড় কথা অনিয়া ও আঙ্কেলের ক্ষতি হবে।
আকশিঃ কিন্তু কেন?(কপাল কুঁচকে)
আদিয়াতঃ তোকে হন্যি হয়ে তোর শত্র পক্ষ খুঁজছে।এখন যদি তুই এসব কাজ করতে যাস তাহলে ওদের অনেক সহজ হবে তোকে খোঁজার জন্য।
আকশিঃ আমার সাথে কার শত্রুতা ও কেন?সেটাই আমি বুঝতে পারছি না।
আদিয়াতঃ এখন আমরা কি করবো?

আকশি কিছু সময় ভেবে আদিয়াতকে বললো।
আকশিঃ চল আদি।
আদিয়াতঃ কোথায় যাবো?
আকশিঃ আমরা আজি ঢাকায় ফিরে যাবো।
আদিয়াতঃ পাগল হয়ে গেছিস তুই। এখন তোর ওপর হামলা হতে পারে।
আকশিঃ তুই কথা না বলে সব গোছানো শুরু কর।আমরা আজ রাতের মধ্যে ফিরে যাবো।
আদিয়াতঃ তুই কি ঠিক আছিস? কি বলছিস এসব?
আকশিঃ এখানে যেহেতু আমরা গা ঢাকা দিয়ে আছি।কেউ আমাদের চিনতে পারে নি।তেমনি ঢাকায় আমরা ছদ্মবেশে ঐ মেয়েটার দিকে খেয়াল রাখবো।পাশাপাশি আমার কিডন্যাপের পিছনে কে আছে সেটা বের করবো।

কথাটা বলে আকশি সদা শার্ট ও কালো প্যান্ট নিয়ে ওয়াস রুমে চলে গেলো।ফিরে এসে কালো কোর্টটা গায়ে জরিয়ে নিলো।সাথে দুই হাতে কালো হান্ড গ্লাবস পরে নিলো।

আদিয়াতঃ তুই যতটা সহজ ভাবছিস ততটা সহজ নয় ব্যাপারটা।
আকশিঃ চুপচাপ রেডি হয়ে নে।আমরা এখনি বের হচ্ছি।সবকিছু প্যাক করিস।
আদিয়াতঃ আমি বলতে—
আকশিঃ আর কোন কথা নয়।জলদী চল।

আদিয়াত মুখ গোমরা করে তৈরি হতে চলে গেল।আকশি কিছু একটা ভেবে মুচকি হেসলো।

আকশিঃ আকশি চৌধুরীর বউকে তো একটু দেখতেই হয়।আমার বিয়ে হয়েছে সেটা আমিই জানি না।ব্যাপারটা কি রকম হাস্যকর।আমার একটা সুন্দরী বউ ও বাচ্চা আছে।আগে জানলে তো আরো আগে ঢাকায় ফিরতাম।কি অদ্ভুত কথা!! আমার বউ এখনো আমি দেখিনি।বউ রেডি থেকো।তোমার স্বামী আসছে তোমার কাছে। ভয় পেয়ো না।এখন থেকে ২৪ ঘন্টা তোমার খেয়াল রাখবো।শত হোক আমার বউ বলে কথা।

কথাগুলো নিজের মনে মনে বলে রহস্যময়ী হাসি দিলো আকশি।তারপর খুব শীঘ্রই আদিয়াতকে নিয়ে রওনা দিলো ঢাকার উদ্দেশ্য।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে