মিসেস চৌধুরী পর্ব-০২

0
2401

#মিসেস_চৌধুরী
#Part_02
#Writer_NOVA

বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক কাপ কফি হাতে নিয়ে আকাশ দেখছে ফিহা।বেবি দোলনায় অনিয়া শুয়ে আছে। টেবলেট দোলনাটা ধাক্কা দিচ্ছে। আর অনিয়া খিলখিল করে হাসছে।অনিয়ার হাসি রুমে ঝংকার দিয়ে ফিহার কানে এসে বাজছে।হাসির শব্দে ফিহার মনটা ভালো হয়ে গেছে। দুই -তিন বার বারান্দা থেকে উঁকি মেরে ফিহা অনিকে দেখে নিলো।কফির মগে চুমুক দিয়ে বড় করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছারলো। ফিহা বাসায় অল টাইম সেলোয়ার-কামিজ পড়ে থাকে।অফিসে শাড়ি পড়ে যায়। তখনি রুমে ঢুকলো আনিস চৌধুরী। অনির দোলনার কাছে গিয়ে ওর সাথে কথা বলতে লাগলো।

আনিসঃ আমার দিদিভাই টা কোথায়?দিদিভাই আজ মায়ের সঙ্গে অফিস করে এসেছে। তুমি একাই তো পুরো অফিসটা সামলাতে পারো।মাম্মিকে কষ্ট করে কি জন্য যেতে হবে?তুমি বড় হয়ে একাই সব সামলাবে।তুমি কিন্তু দিদিভাই একদম মাম্মিকে জ্বলাবে না।মাম্মি সারাদিন কত কষ্ট করে? তুমি যদি জ্বালাও তাহলে মাম্মি এতো কিছু একা সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে পরবে।

দাদা-ভাইয়ের কন্ঠ পেয়ে অনিয়া এক ধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অনিকে দেখে যে কেউ কোলে নিতে চাইবে চাহনিটা যে কি মায়াবী তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।গাল দুটো বেশি গুলোমুলো।দেখলেই ইচ্ছে করে গাল টেনে দিতে।দাদা-নাতনীর কথার মাঝে ফিহা পিছনে এসে দাঁড়ালো।

ফিহাঃ বাবা কখন এলেন?আমায় বলতে পারতেন আমি নিজে আপনার সাথে দেখা করতাম।কিছু লাগবে আপনার?আপনি কষ্ট করে কেন উঠে এলেন।

আনিসঃ তুমি ব্যস্ত হয়ো না বউমা।আমি ঠিক আছি।

ফিহাঃ আপনি দুপুরে ঠিকমতো ঔষধ গুলো খেয়েছেন তো।আমি তো অফিসের জন্য আপনার ঠিক মতো খেয়ালও রাখতে পারি না। অফিস থেকে ফিরে ভেবেছিলাম একবার আপনার রুমে যাবো।কিন্তু ফ্রেশ হয়ে দেখি প্রচন্ড মাথা ধরেছে।তাই এক কাপ কফি নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।তারপরও আমি একবার আপনার রুমে উঁকি দিয়ে ছিলাম।কিন্তু দেখলাম আপনি শুয়ে রয়েছেন।আমি ভাবলাম আপনি ঘুমিয়ে আছেন তাই ডিস্টার্ব করি নি।

আনিসঃ ঠিক আছে বউ মা। আমি কিছু মনে করি না।
অনিলের মা মারা গেছে ১৮ বছর ধরে। ব্লাড ক্যান্সার ধরা পরেছিলো ওর।হাজার চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারি নি।আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে গেছে। ১৮ টা বছর অনিলের মা কে ছারা থাকলাম।আমার একা থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে বউমা।বড্ড বেশি ভালবাসতাম অনিলের মাকে।তাই ২য় বিয়ে করিনি।ছেলে দুটোকে নিয়ে অনেক কষ্ট করে আজ বাংলাদেশের অন্যতম বিজনেস ম্যানের জায়গা দখল করেছি।দুটো ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে সেটা আমি জানি বউমা।

ফিহাঃ বাবা আপনি আমার জন্য একদম চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক সবকিছু সামলে নিবো।

আনিসঃ তোমাকে আমি একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতে ঠেলে দিয়েছি।আমায় মাফ করে দিও বউমা।আমার বয়স হয়ে গেছে তার মধ্যে এই বয়সে এক্সিডেন্ট। নয়তো আমি একা অনি কে সামলে নিতাম।আমার মনে হলো অনির জন্য একটা মা এবং আমাদের অফিসের জন্য একজন শক্ত গঠনের মালিকের প্রয়োজন। তাই তোমায় সিলেক্ট করে নিয়েছি।

ফিহাঃ আমি নিশ্চয়ই আপনার কথার মর্যাদা রাখতে পারবো।আমার জন্য দোয়া করবেন বাবা।ছোট বেলায় কেউ এতিমখানায় রেখে গেছে। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে আমি অনুভব করেছি বাস্তবতাকে।আমি জানি মা ছারা থাকতে কতটা কষ্ট দায়ক।দিনের পর দিন কুঁড়ে কুঁড়ে মরেছি। কিন্তু কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নি।নিজের বাবা-মা কে আমি জানি না।তাদের প্রতি কোন অভিযোগ নেই আমার। আমার জীবনটাই এরকম।আমি মেনে নিয়েছি আমার ভাগ্যকে।আমি বাবা-মায়ের কষ্ট পেয়েছি কিন্তু অনিকে পেতে দিবো না।আমি আমার স্বর্বস্ব দিয়ে ওর খেয়াল রাখবে। এখন আমার বেঁচে থাকার কারণটাই যে অনিয়া।হ্যাঁ,এটা সত্যি আমি ওর মা নই।তবে বাবা, আমিও একটা মেয়ে। আমার মাঝেও মাতৃত্ব নামক বস্তুটা আছে।

আনিসঃ আমি সব দিক ভেবেই তোমাকে সিলেক্ট করেছি বউমা।আমি জানি তুমি কি?তোমার কাজের প্রতি ধৈর্য্য দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই।

ফিহাঃ এতিমখানায় তো আমার কেউ ছিলো না। কিন্তু এখন আমি এই জায়গায় এসে আমার বাবাকে পেয়েছি, আমার নিজের মেয়ে পেয়েছি। হোক না অনিয়া, অনিল ভাইয়া ও লিয়া ভাবীর মেয়ে।কিন্তু এখন যেহেতু সে নেই তাহলে আমিই অনিয়ার মা,বাবা দুটোই।আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।

আনিসঃ তোমার ওপর ভরসা আছে দেখেই তো আমি সবকিছুর ভার তোমার ওপর দিয়ে আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি।আমি জানি তুমিই পারবে সব সামলাতে।অনিল,বড় বউমা,আকশি সবাই কে হারিয়ে আমি যে নিঃশ্ব হয়ে গেছি।তোমাকে পেয়ে আমি আশার আলো খুঁজে পেয়েছি।এখন আমার সবচেয়ে বড় আমানত অনিয়া কে তুমি আগলে রাখবে। আর এই বুড়োটাকে সামান্য আশ্রয় দিলেই হবে মা।আমি যে আর পারছি না।আল্লাহ আমার কাছে থেকে কেন আমার বেঁচে থাকার কারণটাকে নিয়ে যায়।

কথাগুলো বলে ডুকরে কেঁদে উঠলো আনিস চৌধুরী। ফিহা এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বললো।

ফিহাঃ আপনি চিন্তা করবেন না বাবা।আমি আছি তো।আপনার ভরসা আমি নিশ্চয়ই রাখবো।এখন যে আপনি আর অনিয়া আমার সব।আপনি যদি এভাবে ভেঙে পরেন তাহলে আমার কি হবে?আমি যে মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে পরবো।

আনিসঃ আমি নিজেকে শক্ত করে নিবো।আমাকে যে শক্ত হতেই হবে তোমার ও আমার দিদিভাইয়ের জন্য। তোমাকেও বউমা সব সামলে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে।

ফিহাঃ আমাকে যে পারতেই হবে বাবা।আমার মেয়ের জন্য হলেও নিজেকে গড়ে নিতে হবে। যেটা ছেলেরা পারতো আজ সেটা মেয়েরাও করে দেখাচ্ছে।এখন মেয়েরা ঘরের কাজের পাশাপাশি অফিসও সামলাতে পারে।তাহলে আমি কেন পারবো না।সর্বশেষে একটা কথাই বলবো বাবা,”আমরা নারী,আমরা সব পারি।”

আনিসঃ আমার দোয়া সবসময় তোমার সাথে থাকবে বউমা।এখন উঠি।এশারের আযান হচ্ছে। নামাজ পরতে হবে।তুমিও পরে নেও।দুপুরে যোহরের নামাজ পরেছিলে তুমি?

ফিহাঃ হ্যাঁ,বাবা।অফিসে নামাজ পরে নিয়েছি।এখন নামাজ পরে নেই। তারপর দুজন একসাথে রাতের খাবার খেয়ে নিবো।

আনিসঃ আমি সত্যি একটা বউমা নয় নিজের মেয়ে খুঁজে পেয়েছি। খুব শখ ছিলো আমার একটা মেয়ে থাকবে।আল্লাহ শেষ বয়সে এসে সেই শখটা পূরণ করে দিলো।

ফিহার উত্তরে কিছু বললো না।বিনিময়ে মুচকি হাসলো।আনিস চৌধুরী নিজের রুমে চলে গেলেন।ফিহা অনিয়াকে ফিটারে করে দুধ খাইয়ে নিজে নামাজ পরে নিলো।আশ্চর্যজনক একটা বিষয় হলো
টেবলেট অনিয়ার সাথে থাকলে অনিয়া কখনও কান্না করে না।খিলখিল করে হেসে টেবলেটর সাথে খেলা করে।টেবলেট থাকায় ফিহার অনেক সুবিধা হয়েছে। যেমনঃ অনিকে সবসময় ছায়ার মতো দেখে রাখা,অনি কান্না করলে তা দৌড়ে গিয়ে ফিহাকে জানান দেওয়া,অনির জামা-কাপড় এগিয়ে দেওয়া,অনির সাথে খেলা করা।এই জন্য ফিহা ওকে ভীষণ ভালোবাসে।বোবা প্রাণী যে মানুষের এতো উপকার করতে পারে, তা টেবলেট কে না দেখে কখনও বুঝতে পারতো না ফিহা।

নামাজ শেষ করে ফিহা জায়নামাজটা ড্রয়ারে রেখে দিলো।তখনি ওর চোখে পরলো উত্তর দিকের দেয়ালে কালো কাপড় দিয়ে কিছু একটা ঢেকে রাখা হয়েছে। ভালো মতো না তাকালে বোঝা যায় না।

ফিহাঃ কি হতে পারে এটা?এভাবে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখার কারণটাই বা কি?কি এমন জিনিস আছে।এতদিনে তো খেয়াল করি নি।আসলে এমনভাবে রাখা হয়েছে দূর থেকেতো দেখে বোঝাই যায় না যে এখানে কিছু আছে।কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখার রহস্যটাও তো আমার কাছে ঘোলাটে লাগছে।

বরাবরের মতোই আমরা মানুষ বড় কৌতূহলী।যেটা আমাদের থেকে লুকানো হয় সেটার প্রতি তো আরো বেশি।ফিহা কালো কাপড়টা ধরে টান দিতেই দেখলো একটা বিশাল বড় পেইন্টিং। একটা ছেলে তার পোষা কুকুর কোলে নিয়ে বসে আছে। ছেলেটা যে আকশি চৌধুরী সেটা বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই ফিহার।আর কুকুরটা টেবলেট।এলোমেলো চুল,ডান হাতের দুটো আঙ্গুল উঁচু করে রেখেছে। আরেক হাতে টেবলেটকে ধরে রেখেছে। টেবলেটর পরনে ওর গায়ের রং বাদামী বর্ণের একটা গেঞ্জি।জিহ্বা বের করে রেখেছে সে।একটা জিনিস খেয়াল করে ফিহা হেসে উঠলো।

ফিহাঃ আমার কাছে দুটোকেই কুকুর ছানা মনে হচ্ছে। মালিকও গলায় বেল্ট বেঁধে রেখেছে। পাশাপাশি তার কুকুরের গলায় ও বেল্ট আছে।মি.আকশি চৌধুরী কি তখন নিজেকে টেবলেটর মতো সাজিয়েছিলো নাকি?আমার তো তাই মনে হচ্ছে।

আকশি ও টেবলেট দুজনের গলায় ডগি বেল্ট দেখে ফিহার ভীষণ হাসি পাচ্ছে।মুখ টিপে কিছু সময় হেসে নিলো। এই মানুষটা পারেও।কি দরকার ছিলো টেবলেটের মতো নিজেকে সাজানোর।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে