মায়া পর্ব-০৩

0
1136

#মায়া
#পর্ব_০৩
#ওয়াহেদ_মাহমুদ

মেয়ে পূর্ণতার কান্নার আওয়াজ শুনে দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায় সুরাইয়া। রুমে গিয়ে দেখে পূর্ণতা নিচে পড়ে গিয়েছে খাট থেকে। এতক্ষণে সুরাইয়ার হুঁশ আসে। পূর্ণতার কাপড় চেঞ্জ করার সময় তাকে খাটের এক কোনায় রেখে শ্বাশুড়ির কাছে গিয়েছিলেন রান্না করার জন্য অনুমতি নিতে কারণ তরকারিতে ঝাল বেশি হওয়ায় শাশুড়ি খেতে পারেনি। ছোট বাচ্চা হওয়াতে পূর্ণতার মাথায় লেগে মাথা ফুলে যায়। ব্যথা পাওয়াতে পূর্ণতা কান্না করতে থাকে। মেয়েকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই যে কখন ঘুমিয়ে যায় বুঝতেই পারেনি সুরাইয়া।

কিছুক্ষণ পর শাশুড়ির চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় সুরাইয়ার। শাশুড়ি রেগেমেগে বলতে থাকে জমিদারের মেয়ে হয়েছে যখন তখন ঘুমানো এত ঘুমালে রান্না করবে কে?

সুরাইয়া তখন করুণ কন্ঠে বলে মা আজ শরীর টা খারাপ লাগছে অনেক। আজ কাজের মেয়ে টা রান্না করুক কাল থেকে আমি প্রতিদিন রান্না করবো। আর পূর্ণতা খাট থেকে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছে ওর কাছে থাকতে হবে। অনেক কান্না করছে।

শ্বাশুড়ি তখন মিট মিট করে হাসতে থাকে আর বলতে থাকে তুমি থাকতে কাজের মেয়ের কেনো প্রয়োজন । কাজের মেয়েকে নিষেধ করে দিয়েছি তাকে আর আসতে হবে না। আজ থেকে বাসার সব কাজ তুমি করবে সারাদিন তো বসে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই। এতো আরামে থাকা চলবে না। কিছু টাকা বেঁচে যাবে।

কিন্তু মা ডাক্তার তো আমাকে ভারি কাজ করতে মানা করেছে মাত্র দশ দিন হয়েছে সিজার করেছি। আর কয়েকদিন রেস্ট নিতে হবে। না হলে সমস্যা হবে। বেশি কাজ করলে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারি। কাজের মেয়েটা আর কয়দিন আসুক তারপর থেকে সব কাজ আমি করব।

শ্বাশুড়ি তখন সুরাইয়ার কাছে গিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে তুমি হয়তো ভুলে গিয়েছ আগেই বলে দিয়েছি এই বাসায় থাকতে হলে আমার কথা অনুযায়ী থাকতে হবে‌ । আর না হলে এই বাসা থেকে চলে যেতে পারো।

সুরাইয়া কাজ করেছিল আর ওয়াহেদের কথা মনে করছিল। ওয়াহেদ কে একদিন প্রশ্ন করেছিল আচ্ছা আমি যখন প্রেগন্যান্ট থাকব তখন তো কাজ করতে পারব না আমি। তখন তোমাকে কাজে সাহায্য করতে পারব না। তখন ওয়াহেদ মুচকি হেসে বলেছিল স্বামী স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক । একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। আমি তো আছি চিন্তা করার দরকার নেই। আর মা তো আছে তোমাকে অনেক কাছে সাহায্য করবে।
কিন্তু আজ সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। কেউ কথা রাখেনি। নিজের স্বপ্নগুলো নিজের মধ্যে দাফন করতে থাকে সুরাইয়া।

ওয়াহেদের কথা মনে পড়ায় সুরাইয়া ওয়াহেদকে ফোন দেয়। দুই বার ফোন দেয়ার পর ওয়াহেদ ফোন রিসিভ করে। ওপাশ থেকে ওয়াহেদ হ্যালো বলে।
সুরাইয়া বলে কেমন আছো কিন্তু কোনো শব্দ আসে না ওপাশ থেকে। অনেকবার ওয়াহেদ বলে ডাকার পরেও কোনো শব্দ আসে না। ওয়াহেদ কোনো কথা বলে না।

সুরাইয়া ভাবছে হয়তো ওয়াহেদ কথা বলবে না তার সাথে। তাই ফোনে রেখে আবার কাজে মনোযোগ দিতে থাকে। আধাঘণ্টা পরে ওয়াহেদের নাম্বার থেকে সুরাইয়ার নাম্বারে ফোন আসে। কিন্তু ওপাশ থেকে ওয়াহেদ না অন্য কেউ কথা বলে। সে বলে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে। আপনার নাম্বার কল লিস্টের প্রথমে আছে তাই আপনাকে ফোন দিলাম। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসেন। সুরাইয়ার আর বুঝতে বাকি রইলো না ছেলে মেয়ে দুটা বলতে আর কেউ নয় ওয়াহেদ আর আফসানাকে বুঝিয়েছে। সুরাইয়ার মনে হচ্ছে পায়ের নিচে থাকে মাটি সরে যাচ্ছে। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।

সুরাইয়া দৌড়ে শ্বাশুড়ির কাছে চলে যায় আর সব খুলে বলে।
গিয়ে শ্বশুড়ি কে সব বলার পর প্রায় অজ্ঞান মতো অবস্থা শ্বাশুড়ির। তারপর শ্বাশুড়ির মাথায় পানি দিয়ে তেল দিয়ে নিজ হাতে ধরে শ্বাশুড়ি কে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

শ্বাশুড়ি কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ছেলের অবস্থা দেখে আবার অজ্ঞান হয়ে যায়। ওয়াহেদ ও অজ্ঞান অবস্থায় আছে। মাথা ফেটে রক্ত বাহির হচ্ছে। শরীরের থেকে অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে।

ডাক্তার এসে বললেন অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে রক্ত দিতে হবে। রক্তের গ্রুপ “এ” পজেটিভ। আপনাদের মধ্যে কারো থাকলে দিতে পারেন। আর যদি না থাকে তাহলে অন্য জায়গা থেকে ম্যানেজ করেন। ওখানে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন কিন্তু কারোর গ্রুপ পজেটিভ না। ওয়াহেদের শ্বশুরের রক্তের গ্রুপ মিল থাকলেও না করে দিলেন কারণ তার নাকি রক্ত দিতে ভয় করে।

শ্বাশুড়ির কাছে থেকে ফিরে এসে সব জানতে পেরে সুরাইয়া রক্ত দিতে রাজি হলো। কিন্তু সুরাইয়ার তো কয়েকদিন আগে সিজার হয়েছে। সে কিভাবে রক্ত দিবে আর রক্ত দিলে অনেক সমস্যা হবে‌। কিন্তু কারোর কোনো কথা উপেক্ষা না করে ওয়াহেদ কে রক্ত দিলেন সুরাইয়া। হাজার হলেও স্বামী বলে কথা। স্বামীর খারাপ সময়ে স্ত্রী পাশে না থাকলে থাকবেই বা কে।

আফসানার অবস্থা ততটা মারাত্মক না। কারণ বাইক চালানোর সময় হেলমেট টা আফসানার মাথায় ছিল ওয়াহেদ নিজে ইচ্ছায় হেলমেট দেয়নি। আফসানা কে হেলমেট টা মাথায় দিতে বলে। খুব বেশি ব্যথা না পেলেও ভালো ব্যথা পেয়েছ। হাত দিয়ে রক্ত বাহির হয়েছে। ওয়াহেদ হাসপাতালে থেকে যায় আফসানা বাসায় চলে যায়।

মোট এক সপ্তাহে থাকতে হয়েছিল ওয়াহেদ কে হাসপাতালে কিন্তু এক মূহুর্তের জন্য ওয়াহেদের কাছে থেকে দূরে যায়নি সুরাইয়া। সব সময় ওয়াহেদের পাশে ছিল সুরাইয়া। এই এক সপ্তাহ ধরে শুধু ওয়াহেদের সেবা যত্ন করেছে সুরাইয়া।

কিন্তু আফসানা এই এক সপ্তাহে একবারের জন্যও দেখতে আসেনি ওয়াহেদ কে। ওয়াহেদ সুরাইয়া কে অনেকবার বলেছে আফসানা আসছে না কেনো আমাকে দেখতে। কিন্তু সুরাইয়া আফসানার প্রতি একবারের জন্যও কোনো অভিযোগ করেনি। চাইলে সুরাইয়া আফসানা কে নিয়ে অনেক খারাপ খারাপ বলতে পারতো।
ওয়াহেদ কে অনেক ভাবে বুঝিয়ে যে আফসানা বাসায় রেস্ট নিচ্ছে আফসানাও এক্সিডেন্টে অনেক ব্যথা পেয়েছ। কিন্তু সত্যি হলো আফসানা গুরুতরভাবে কোন আঘাত পাইনি। চাইলে সে এখানে এসে ওয়াহেদের সেবা যত্ন করতে পারতো। অত্যন্ত দেখে যেতে পারে।

সুরাইয়ার শ্বাশুড়ি ও আফসানার প্রতি অনেক নারাজ। আট দিন পর আজ ওয়াহেদ কে বাসায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ডাক্তার বলে দিয়েছে দেখে শুনে রাখতে হবে। মাথায় অনেক আঘাত পেয়েছে মানসিক ভাবে তাকে যেনো আঘাত না দেয়া হয়। বাসায় এসে শ্বাশুড়ি সুরাইয়া কে বলে মা যাও তুমি রেস্ট নাও তুমি অনেক ক্লান্ত। সুরাইয়া শ্বাশুড়ির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। শ্বাশুড়ির মাঝে অনেক পরিবর্তন। আজ কোনো খারাপ ব্যবহার করছে না। কোনো কাজ করতে বলছে না। ঘরের দরজা দিয়ে আটকিয়ে রাখছে না। খাবার খেতে দিচ্ছে না।

শ্বাশুড়ি আফসানাকে ডেকে বলে আজ দুপুরের রান্না টা তুমি করবে। তরকারিতে ঝাল কম দিবে। সুরাইয়ার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে আফসানা। শ্বাশুড়ি কে উদ্দেশ্য করে বললো কাজের মেয়ে আসবে না?
শ্বাশুড়ি বললেন না। মানা করে দিয়েছিলাম কিন্তু কাল থেকে নিয়মিত আসবে।

সুরাইয়া হাসি মুখে গিয়ে গোসল করে ঘুমিয়ে আছে। বিকালে সুরাইয়াকে ডাক দেয়া হলো খাওয়ার জন্য। আজ খাবার পরিবেশন করছে আফসানা। ওয়াহেদ ও খাবারের টেবিলে বসে আছে। তরকারি দেয়ার সময় মাংসের ঝোল পড়ে যায় সুরাইয়ার কাপড়ে। কিন্তু সুরাইয়া কিছু না বলে কাপড় পরিষ্কার করে এসে আবার খাবারের খাওয়া দাওয়া করে‌।

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ওয়াহেদ, আফসানাকে বলে আজ সুরাইয়া কাছে থাকবে। সুরাইয়ার প্রতি সবার ভালোবাসা আফসানার মোটেও সহ্য হচ্ছে না।

সকালের খাওয়ার সময় আফসানা সবার উদ্দেশ্যে বলে। সেদিনের এক্সিডেন্টের জন্য দায়ী আর কেউ না সুরাইয়া। শ্বাশুড়ি অবাক চোখে বলে কি বলছো এসব সুরাইয়া কেন দায়ী হবে‌।
আফসানা তখন মুচকি হেসে বলে সেদিন যদি আফসানা ওয়াহেদ কে ফোন না করতো তাহলে সেদিন এক্সিডেন্ট হতো না। বাইকে থাকা অবস্থায় সুরাইয়ার ফোন ধরতে গিয়ে এক্সিডেন্ট হয়েছে। সেদিন যদি সুরাইয়ার ফোন না করতো তাহলে আমার আর ওয়াহেদের এমন অবস্থা হতো না। সুরাইয়া কে আবার শ্বাশুড়ির চোখে খারাপ করার জন্য এমন কথা বলে আফসানা।

আফসানার কথা শুনে শ্বাশুড়ি সুরাইয়ার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর খাবারের প্লেট টা সামনে থেকে নিয়ে নেই। আর কিছু বলার আগেই ওয়াহেদ সুরাইয়ার হাত ধরে অন্য রুমে নিয়ে যায়।

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে