মনোহারিণী পর্ব-০৯+১০

0
847

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (৯)+(১০)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।)

বাদ্য-বাজনা ছাড়াও অল্প সময়ে, অল্প খরচে পবিত্র বন্ধনের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যায়, যদি পাত্র-পাত্রী এমনকি পরিবারের কারও দিকে কোনো সমস্যা দেখা না দেয়! বর্তমান সময়ে বিয়েসাদী মানেই হৈ-হুল্লোড়, আমোদ-ফুর্তি, গান-বাজনা ছাড়াও জম্পেশ খানাপিনার আয়োজনকেই বুঝায়! অথচ বিয়ে পবিত্র বন্ধন! এখানে যেমন মনের মিল জরুরী তেমনি জরুরী পারিবারিক মিল-মহব্বত! তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো মোহরানা! এই মোহরানা নিয়ে তো এই সময়ে প্রচুর প্রতিযোগতা হচ্ছে। অথচ মোহরানা হবে পাত্রের আয়ের উপর নির্ভর করে। পাত্র-পাত্রী দু’জনের সম্মতিতেই একটা সংখ্যা তুলে মোহরানা দেয়া উচিত! লক্ষ, লক্ষ টাকা মোহরানা শুধু নামেই কাবিননামা উঠে, নগদে আসে না! কুরআন হাদিস, এই ফাঁকিবা’জিকে সমর্থন করে না। সামর্থ অনুযায়ী মোহরানা নগদেই পরিশোধ করা উচিত!

অনিকও এই মোহরানার ব্যাপারটা নিয়ে আগেই আলাপ করে নিয়েছিল, যার কারণে মাইসারা কিংবা কারও কোনো আপত্তির আসেনি আর! আকদের পুরো কাজ শেষে মসজিদের ভেতরে আগত অতিথিকে খেজুর আপ্যায়নের মাধ্যমে বিয়ের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা হয়! এরজন্য অবশ্য মাইসারাকে মসজিদে আসতে হয়নি, বরং তার দিকটা বাড়িতেই সামলে নেয়া গেছে!

*চিকিৎসাবিজ্ঞান অবশ্য রক্ত সম্পর্কের বিবাহকে বেশি উৎসাহ দিতে রাজি নয়। বলা হয় ফার্স্ট কাজিনদের (সরাসরি খালাতো, মামাতো, চাচাতো বা ফুফাতো ভাইবোন) জিনগত মিল প্রায় সাড়ে বারো শতাংশ, অর্থাৎ তারা বংশপরম্পরায় অনেক জিন একইভাবে বহন করে চলেছেন। এ কারণে যেসব রোগবালাই তাদের বংশে রয়েছে, সেসব তাদের সন্তানদের মধ্যে আরো প্রকটভাবে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে।

নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের কারণে সন্তানের যেসব ঝুঁ’কি বাড়ে তা হলো :
১. গ’র্ভপা’ত, মৃ’ত সন্তান প্রসব।
২. শারীরিক ত্রুটিসং’বলিত শিশুর জন্ম স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি হয়।
৩. প্রথম বছর বয়সে শিশুর অস্বাভাবিক মৃ’ত্যু।
৪. হঠাৎ অজানা কারণে শিশুমৃ’ত্যু।
৫. যথাযথভাবে শিশুর বৃদ্ধি না হওয়া।
৬. শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি ও বুদ্ধি প্রতিব’ন্ধিতা।
৭. মৃ’গী রোগ।
৮. অজানা রোগ।
৯. নানা রকমের রক্তরোগ যেমন সি’কেল সেল ডি’জিজ ও বি’টা থ্যালা’সেমিয়া। (সূত্র : গুগল)*

বিয়ের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দুঃশ্চিতার চরম শিকড়ে পৌঁছে গিয়েছিল মাইসারার ছোট্ট মন! বার বার দু’চোখের সামনে উঁকিঝুঁকি মারছিল নানান কথাবার্তা! একটা সুস্থ সন্তান জন্ম দেয়ার পরেও তার বাবা-মা তাকে ফেলে গেছে, সেখানে যদি একটা অসুস্থ সন্তান তার কোলে আসে তখন অনিক সেই মুহূর্ত কীভাবে ফেইস করবে? এই ভয়টাই তাকে রীতিমতো দিশেহারা অবস্থায় ফলে দিয়েছিল! কারণ তারা কাজিন! আর বিজ্ঞানের তথ্যানুযায়ী কাজিনদের মধ্যে বিয়ে হলে, পরবর্তীতে সন্তান অসুস্থ থাকে। যেকোনোভাবে চার সন্তানের মধ্যে এক সন্তানের শারিরীক সমস্যা হতে পারে! ভয়, আত’ঙ্ক, দুঃশ্চিন্তা যখন পুরোদমে তার মনকে দুর্বল করে দিচ্ছিলো, তখনই অনিকের ছোট্ট একটা ম্যাসেজ হাজারও ব্যথা-বেদনায় ঔষধের মতো কাজ করেছে!

হাতের মোবাইলটা তখনো তার হাতে। স্ক্রিনের আলো জ্বলজ্বল করছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ত্বোয়া। দু’হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দিচ্ছে। মাইসারার মামা-মামি, মামাতো ভাই-বোনেরা এসেছে আজকে। বোন মিমিও পাশে বসে সামিল হয়েছে। কখনো গল্প করছে, কখনো কাঁদছে, আবার কখনো হাসছে! বহুদিন পর মাইসারা টের পেল, এই ম্যাসেজটা আরও আগে আসা উচিত ছিল! যদি আসতো, তবে সে কখনো ভুল মানুষের জন্য চোখের জল ফেলতো না! ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলালো আবারও। তাতে স্পষ্ট লেখা আছে,

-“জীবনটা খুব ছোট্ট সারা। এই ছোট্ট জীবনই আমাদের আনন্দ দেয়, বেদনা দেয়, দেয় সুখ-দুঃখের ছোটো ছোটো স্মৃতি! এই স্মৃতিটুকু আমাদের উপলব্ধি করায়, জীবন এগোয় সামনের দিকে। পিছনের অধ্যায় যেমনই হোক, হাসির হোক কিংবা বেদনার, কখনো তাকে স্মরণ করে বর্তমানকে দূরে সরিয়ে দিস না! আমি জানি না, সামনের গন্তব্য আলোর নাকি আঁধারের। তবে যাই থাকুক, তোর সামনের পথ কখনো একার হবে না। ছায়া ভাব, নতুবা সঙ্গী, এই আমিটা একান্তই তোর দুঃখ কমানোর আশ্রয় হবো! তাই বলছি, মিছেমিছি সব ভয় দূরে সরিয়ে দে। কেননা, ভবিষ্যৎ তখনই অন্ধকার হবে, যখন বর্তমানটা ভুল সময়ে ভুল মানুষকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিবে! আমি যে সঠিক মানুষ তা বলছি না, ভুল আমারও হয়। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখ; যতক্ষণ আমি আছি ততক্ষণ তুই একা নোস! ভবিষ্যতে যদি তেমন কোনো পরিস্থিতি আসে, আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তা ফেইস করবো। কখনো, নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে পালিয়ে যাব না। বরং যে আসবে সে যদি অ’ন্ধও হয়, জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া হিসেবে তাকে আগলে নিব! আমি চাই সে দেখুক, বাবা-মা সর্বাবস্থায় সন্তানদের আগলে রাখতে জানে। আমায় সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবি সারা? একটা সুযোগ দিবি তোর হাসিকে সারাজীবন বাঁচিয়ে রাখার?”

কতটা যত্ন, ভালোবাসা মিশে আছে এই টুকরো কথাতে, তা বিন্দুমাত্র জানা নেই তার। শুধু জানে, এই মানুষটাকে তার প্রয়োজন! খুব করে প্রয়োজন! যে বাঁচতে শেখায়, যে সাহস জোগায়, যে আগামীর স্বপ্ন দেখায় তাকে হারিয়ে ফেললে যে, জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে তার। জেনেশুনে কেউ কীভাবে তা হারিয়ে ফেলতে পারে? মাইসারাও পারেনি। তাই সমস্ত দ্বিধার দেয়াল দূরে সরিয়ে চিরদিনের জন্য এই সুতোয় বাঁধা পড়েছে দু’জন। বাধ্য হয়ে নয়, নিজের ইচ্ছে এবং মনের ডাকে সাড়া দিতেই, মন থেকে ‘আলহামদুলিল্লাহ্ কবুল’ শব্দটি উচ্চারণ করে পবিত্র সম্পর্কে গ্রহণ করে নিয়েছে।

*****

বিয়েতে যত মেহমানরা এসেছিলেন একে একে সবাই বিদায় নিলেন। মাইসারার মামা-মামীও যাওয়ার আগে দু’জনকে দো’আ করে গেলেন। সবাই চলে যাওয়ার পর বাড়িটা ফাঁকা হলো! চিন্তিত চেহারায় নিজের সাজপোশাক পাল্টাচ্ছে ফারজানা! দু’দিন ধরে তার মন-মেজাজ ভালো নেই। দরকারি জিনিসটা কোথায় যে রাখলো, আর তা পাওয়া গেল না। বাড়ির লোকজন কাউকে জিজ্ঞেস করারও সাহস নেই। এসব লুকানো কথা প্রকাশ্যে আনা মানেই কার্য সম্পাদনের আগেই হে’রে যাওয়া। এত দ্রুত নিজের হা’র মানতে রাজি নয় সে। কিছু তো একটা করবেই। কিন্তু কী করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না সে। আগামীকাল বিকেলেই মাইসারা চলে যাবে তার দৈনন্দিন জীবনে! তাকে আর চাইলেও হাতের সামনে পাওয়া যাবে না। তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে গেলেই তো ফেঁ’সে যাবে। অথচ হাতে সময় একদমই নেই। কী ভেবে যেন রুম ছেড়ে বেরোলো সে! হাঁটতে হাঁটতে ড্রয়িংরুমের সামনে এলো। সেখানে দুই ভাই জমিয়ে গল্প করছে, মাইসারা কিংবা ত্বোয়া কেউ-ই সেখানে নেই। বুদ্ধি করেই মাইসারার কাছে গেল সে।

পরনের ভারী লেহেঙ্গা ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে মাইসারা! সুন্দর একটা কাতান থ্রি-পিস পড়েছে। যা-সব নামিরার নামে কেনা হয়েছিল, সবই তার জন্য! এই ব্যাপারটা সহজে মাথায় ঢুকাতে পারছে না সে। এইযে এত শাড়ি, ড্রেস কেনা হলো, সবই তার। অথচ সে জানতো, এগুলো নামিরার। ভাগ্য কাকে কোথায় এনে দাঁড় করাবে জানা নেই কারও। সে-ও জানতো না, এইভাবে হুটহাট জীবনের মোড় ঘুরে যাবে। সবকিছু গুছিয়ে রাখতে ত্বোয়া পাশে বসে হাতে হাত লাগাচ্ছিল। ফারজানা ভেতরে ঢুকেই বলল,

-“তোদের শেষ হলো? সবার জন্য একটু চা-নাশতা করলে ভালো হতো না? শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে। হাড়গোড় ব্যথা! ত্বোয়া, পারবি কিছু নাশতা তৈরী করতে?”

শুকনো মুখের এমন কথাতে গলে গেল দু’জনে। সারাদিন ধরেই ফারজানার দৌড়টা দেখেছে দু’জনে। এতজন বাড়তি লোকের খাবার-দাবারের মেন্যু সামলে রাখা চারটে খানে কথা নয়! কাজের লোকজন সাহায্য করেছিল বলে, কিছুটা চা’প কমেছে। তবুও ক্লান্ত হওয়াটা স্বাভাবিক তার জন্য। মাইসারা সামনে এসে বলল,

-“তুমি যাও ভাবী। বিশ্রাম নাও। আমি সামলে নিব!”

-“না না, তা কী করে হয়! সবে বিয়ে হলো আজ, এক্ষুণি রান্নাঘরে ঢুকবি? আচ্ছা দেখি, আমি যাই।”

মলিন মুখে বেরিয়ে যেতে চাইলো ফারজানা। মাইসারা তাকে আটকে বলল,

-“যাও তো, বিশ্রাম নাও। ত্বোয়া, তুই আয়। আমরা বরং একসাথেই কাজ করি। এখন তো ওতো ঝা’মে’লা নেই। হয়ে যাবে দ্রুত।”

ফারজানা চলে যাওয়ার পর হাতের কাজ সেরে রান্নাঘরে আসলো দু’জনে। কয়েক ধরনের সবজি ঝটপট কে’টে নিল মাইসারা। কুচি কুচি করে কা’ট’লো। এরপর তাতে প্রয়োজনীয় মশলা, সামান্য ময়দা দিয়ে মাখা মাখা করে নিল। ত্বোয়াকে আর কোনো কাজ করতে হলো না। এসব নাশতার নানা রেসিপি তৈরীতে মাইসারার হাত চলে দ্রুত। তাই সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে গেল। খানিকক্ষণ পর গ্যাস অন করে কড়াই বসিয়ে দিল। তেল ঢেলে তা গরম হওয়ার অপেক্ষা না করে সেই ফাঁকে চায়ের ক্যাটলিতে পানি এনে বসিয়ে দিল চুলায়। ত্বোয়া কাপ, পিরিচ সবকিছু পরিষ্কার করে ট্রে’তে সাজিয়ে রাখছিল।

কড়াইতে পকোরা ভাজতে গিয়েই খেয়াল করলো সিলিন্ডারের মুখে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে! সেই আগুনের তাপ সরাসরি তার শরীরে এসে লাগছে! হাতের কাছে নেভানোর জন্য কোনোকিছুই পাচ্ছে না সে। ধীরে ধীরে আগুনটা বাড়তে দেখেই চিৎকার দিল মাইসারা! সেই চিৎকারে সবাই ছুটে এলো। ভয়ে কেঁপে উঠলো ত্বোয়া নিজেও। হাত থেকে কাপ-পিরিচ সব নিচে পড়ে ঝনঝন শব্দ হলো। এক ছুটে রান্নাঘর ছেড়ে বাইরে চলে আসলো দু’জনে। অনিক দ্রুত শুকনো একটা কাপড় এনে সিলিন্ডারটা পেঁ’চি’য়ে নিল। রেগুলেটর বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে এলো।

ধীরপায়েই মাইসারার দিকে এগোলো সে। মেয়েটা ভয়ে কাঁপছে তখনো। ত্বোয়াও যথেষ্ট ভয় পেয়ে গেছে। সোফায় একে-অন্যকে স্বান্তনা দিচ্ছে। এমন কিছু হবে, তাদের কারোরই ধারণাতে ছিল না। মাইসারা বার বার পিঠে হাত দিচ্ছে! খানিকটা তাপ লেগেছিল বলে, জ্বালাপো’ড়া শুরু হয়েছে! তার এই হাত নাড়াচাড়া দেখে অনিক জানতে চাইলো,

-“বেশি লেগেছে?”

-“সামান্য!”

কেঁপে কেঁপে জবাব দিল মাইসারা! অনিক রাগী চোখে তাকালো। তার চোখেমুখে ভয়ের ছা’প স্পষ্ট। এমন ভয়ানক চিৎকার শুনলে যে কারও প্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। আর সে যদি হয় কাছের মানুষ, তবে তো কথা নেই। তবুও নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে বলল,

-“কে বলেছিল এখন রান্নাঘরে যেতে? মাত্রই ঝা’মে’লা শেষ হলো! এক্ষুণি ওইদিকে না গেলে হতো না তোর?”

মাইসারা জবাব দিল না। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো। পিঠে যতটুকু জ্ব’ল’ছে তা সামান্যই। এতে এতটা ঘাবড়ানোর কিছু নেই। হুট করে আগুন দেখেই ভয় পেয়েছিল সে! ভাবেনি তার সেই চিৎকারে মানুষটা এত ভয় পাবে। জানলে এত জো’রে চিৎকার দিত না। ততক্ষণে আরমান সাহেবও বেরিয়ে এসেছেন। সবার এই চিৎকার চেঁচামে’চি শুনে বুঝলেন, সিলিন্ডারের মুখে আগুন লেগেছে! তবে কারও কোনো ক্ষতি হয়নি, এটা শুনে যথেষ্ট রিল্যাক্স হলেন তিনি। তাও অনিক তখনো চোখ গরম করে মাইসারার দিকে তাকিয়ে আছে। মাইসারার চোখ পড়তেই কিছু একটা বিড়বিড় করলো অনিক। তা দেখে নববধূ মুচকি হেসে চলে গেল!

*****

পর পর দুটো ঘটনা কাকতালীয় নাকি একই সূত্রে গাঁথা, আর কোনো হিসাব পাচ্ছে না অনিক। রান্নাঘরে পা রাখলেই একটা না একটা দুর্ঘটনার জড়িয়ে পড়ছে মাইসারা! কেন? আগে তো এমন হয়নি। এ ঘরের প্রতিটা কোণায় কী থাকে সবই তার মুখস্থ। তবুও এমন সব দুর্ঘটনা ঘটছে, তা ভাবনায় আনাও দুষ্কর। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ভেবেছিল রাতের সময়টা বিশ্রাম নিবে, অথচ অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা তার ক্লান্তি, দুঃশ্চিন্তা দুটোই বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাবতে ভাবতেই রুমের ভেতরে চোখ বুলালো অনিক। মাইসারা মাত্রই রুমে এসেছে। খাওয়া, দাওয়া শেষে সবকিছু গুছিয়ে রাখতেই দেরী হয়েছিল তার। গ্যাসের ধারেকাছেও যায়নি আর। মাটির চুলাতেই রান্নার বাকি কাজ সামলে নিয়েছে ফারজানা।

ভেতরে ঢুকে খুব স্বাভাবিকভাবেই দরজা আটকে দিল সে। ভয় কিংবা জড়তা কোনোকিছুই তার চেহারায় নেই৷ অথচ এই দিনে বর-কনে দুজনই নার্ভাস থাকে! নতুন সম্পর্ক নিয়ে কতশত চিন্তাভাবনার খেলা চলে মাথায়। সেদিক থেকে মাইসারা নির্বিকার। নিত্যদিনের মতো অভ্যস্ত হাতে এটা-সেটা গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় আসতেই থমকে গেল সে। গোলাপ ফুলে সাজানো সাদা বিছানার চাদরে, বালিশের উপর পা রেখে আয়েশি ভঙ্গিতে শুয়ে আছে অনিক। একপাশে শুয়ে দু’পা লম্বা করে বালিশের উপর রেখেছে। অন্যপাশে যাওয়ার রাস্তাটাও নেই! মাইসারা তার পা নাচানোর ভাবভঙ্গি দেখে বলল,

-“পা সরাও!”

-“পরে। আগে মালিশ কর।”

-“কী? এতরাতে? কী হয়েছে পায়ে?”

-“মনে হচ্ছে, ব্যথা করছে!”

দাঁত কেলিয়ে জবাব দিল অনিক। তার বলার ধরন দেখে ভ্রু কুঁচকে নিল মাইসারা। ড্রেসিংটেবিলের সামনে থেকে ব্যথার মলমটা এনে বিছানার কোণে বসলো। পা’দুটো নিজের হাতে তুলে বলল,

-“কোন জায়গায় ব্যথা?”

-“এইযে, এইদিকে। গোড়ালিতে!”

-“কীভাবে ব্যথা পেলে? হোঁচ’ট খেয়েছো কোথাও?

দু’জনের ভাবভঙ্গি এমন যে, এই মুহূর্তটা তারা ইগনোর করতে চাইছে। যেমন মাইসারা, তেমনি অনিক। কেউ-ই নিজেদের নার্ভাসনেস প্রকাশ করতে চাইছে না। দূরত্ব নেই, আবার কাছেও নেই। কেমন যেন একটা গা-ছাড়া ভাব চলছে এই সম্পর্কে! যদিও এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। হুট করে কেউ-ই চাইবে না, মন দেয়া-নেয়ার আগে কিছু হোক। তবুও এটা এখন অন্যসব সম্পর্কের মতো না। এই সম্পর্ক অনেক দামী। তাই সম্পর্ককে দু’জনেরই আগলে রাখা উচিত।

কিছুক্ষণ পায়ে মালিশ করলো মাইসারা। অনিক দু’চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে শুয়ে রইলো। যখন পুরো রুমে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করলো, অনিকের গাঢ় নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ কানে আসলো তখনই হুঁশ ফিরলো মাইসারার। পা দু’খানা জায়গা মতো রেখে ব্যথানাশক মলম সরিয়ে নিল। পাতলা নকশিকাঁথা পায়ের কাছে রেখে বাতি নিভিয়ে দিল। হলদেটে, অস্পষ্ট আলোয় ভরে গেল পুরো রুম। ধীরপায়েই জানালার পর্দা সরালো সে। একপাশের কাঁ’চ খুলে বাইরে দৃষ্টি দিল! দূরের ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ, জ্যোৎস্নার একফালি আলো আর বাতাসের মৃদু বয়ে চলাতে রাত্রির নিস্তব্ধতা তাকে আঁকড়ে ধরলো পুরোটাই!

অনেকক্ষণ কে’টে গেল। মাইসারা তবুও বিছানায় এলো না। দু’চোখে আজ ঘুম নেই। তার ভেতরের তুফান সামলাতে ব্যস্ত সে! কেন এমন হয়? এত কীসের দ্বিধাদ্বন্দ্ব তার? সহজ সম্পর্ক, সহজ সবকিছু, অথচ কোথাও গভীর এক দেয়াল তৈরী হয়েছে। যে দেয়াল ভে’ঙে চাইলেও ছুটে যাওয়া যায় না। অথচ গত দু’দিনে সে টের পেয়েছে, অনিকের না বলা কথা! কিছু গোপন কথা মুখের বলাতে নয়, চোখের আদান-প্রদানেই বুঝে নেয়া যায়। সে-ও বুঝেছে। যত্নে বেড়ে ওঠা অনুভূতি সে গোপনেই আগলে রেখেছে। প্রকাশ করেনি, আর করবেও না। গ্রিলে মাথা ঠে’কি’য়ে বাইরের পরিবেশটাকেই উপভোগ করছিল সে। খেয়াল করলো, অনিক এক পাশ থেকে অন্যপাশ ফিরে শুয়েছে! হয়তো চোখে রাজ্যের ঘুম। নয়তো মানুষটা একজনকে নির্ঘুম রেখে কীভাবে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে পারে? এটা কি শুধু এই মুহূর্তটা এড়ানো? এমনই চলবে?

*****

চলবে…

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১০)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

মন খারাপের পরমুহূর্ত বোধহয় মানুষ নীরবতাকেই সবচেয়ে আপন, বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে বেছে নেয়। রাত্রির এই নিস্তব্ধতাকে আলিঙ্গন করতে পেরে খুব বেশি খারাপ লাগছে না মাইসারার। চোখে ঘুম নেই আজ! মাঝেমধ্যেই তার এমন হয়! অকারণ নির্ঘুম রাত কা’টা’তে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। কখনো কখনো ডিউটির ফাঁকে রিপার সাথে চায়ের কাপে আড্ডা জমতো। সেই আড্ডা চলতো ভোররাত্রি পর্যন্ত। আজও যদি আড্ডার মধ্য দিয়ে রাত পেরিয়ে ভোরকে স্পর্শ করা যেত, তবে মন্দ হতো না। সময়টা আরও বেশি উপভোগ্য হতো, যদি পাশাপাশি কেউ থাকতো। একাকী জীবন অতিবাহিত করতে গিয়ে সে অনুভব করেছে, আসলে সে একা নয়! তার পিছনে এই যে কিছু মানুষের এতটা ভালোবাসা, যত্ন, খেয়াল, খুশি জড়িয়ে আছে তাতে কোনোভাবেই প্রমাণ হয় না সে একা। আজ তো জীবনটা পুরোপুরি ঘুরে গেল। তার ভরসা হয়ে কেউ একজন জড়িয়ে গেল জীবনে, চাইলেও এই মানুষটার চোখের আড়াল সে কখনোই হবে না। একাকীত্ব আসা সে তো অনেক দূরের চিন্তাভাবনা!

কত-শত আজেবা’জে চিন্তায় ডুবেছিল সে। ঘোর ভাঙ’লো কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে। অনিক পিছনে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,

-“রাত জেগে অকারণ দুঃশ্চিন্তা করিস না, সারা। অসুস্থ হয়ে পড়বি। ডাক্তারদের অসুস্থ হওয়া সাজে না। তাদের সবসময় ফিট এন্ড স্ট্রং থাকতে হয়! নয়তো, অন্যদের তারা সামলাবে কী করে?”

-“ঘুম আসছে না!”

অনিক হয়তো বুঝলো, তার ঘুম না আসার কারণ। তাই কথা ঘুরাতে বলল,

-“রিটার্ন টিকিট কে’টে এসেছিলি?”

মাইসারা মাথা নাড়লো। পরমুহূর্তেই চমকে গেল পুরোটাই! আচমকাই নিজেকে শূন্যে আবিষ্কার করে ভয়ে কেঁ’পে উঠলো! দু’হাতে টি-শার্ট আঁকড়ে ধরে বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। অনিক বাঁধা দিল না। আলগোছে তাকে বিছানায় শুয়ালো। চুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে বলল,

-“চোখ বন্ধ কর। ঘুম আসবে। আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি!”

অনেকদিন পর মাইসারা টের পেল সে ছোটো বাচ্চার মতো আবেগী, আহ্লাদী হয়ে গেছে! তার পাশে বটবৃক্ষের ন্যায় বিশাল সাইজের ছায়া পড়েছে। সে ছায়া তাকে আগলে রাখছে, যত্ন নিচ্ছে, দুঃখ-সুখের ভাগিদার হচ্ছে। যার সংস্পর্শে এখন সে পুরোটাই নিরাপদ! হাত উলটে আঙুলের ভরে চোখের পানি মুছে নিল সে। সামান্যতম উষ্ণ স্পর্শের জন্য, শান্তিতে মাথা গুঁজে দু’চোখে প্রশান্তির ঘুম টে’নে আনতে খানিকটা এগোলো সে। যেভাবে টি-শার্ট আঁকড়ে ধরেছিল, সেভাবে আবারও আঁকড়ে ধরে পরম শান্তির জায়গায় মাথা ঠে’কা’লো। বলল,

-“আমি এখানে ঘুমাই?”

মাইসারার দিকে দৃষ্টি দিল সে। তার চোখের চাহনি বলে, এটা ছোটোখাটো কোনো আবদার নয়। সারাজীবন ভরসা করার, পাশে থাকার সহজ অথচ নীরব স্বীকারোক্তির কথা শুনবে বলেই নিশ্চুপে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। ভরসা হওয়া উচিত তো তার। এখন তো আর তাদের সম্পর্ক দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর নয়, বরং সানন্দে তা গ্রহণ করার সময়। এই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটার জন্যই বুঝি, এতদিন ধরে অপেক্ষার প্রহর গুনেছিল সে। বুঝতে পেরে অনিক জবাবটা মুখে আট’কে নিল। নির্দ্বিধায় অধর ছুঁইয়ে দিলো কপালে! স্পর্শের গভীরতা দিয়ে বুঝিয়ে দিল, কতখানি অনুভূতি বাঁচিয়ে রেখেছিল সে। পরক্ষণেই দু’হাতের বাঁধনে বুকে আগলে নিল। ক্ষীণস্বরে বলল,

-“এইখানে মাথা রাখার অধিকার শুধু তোর! সারাজীবন থাকবি, যত্নে!”

-“দূরে সরিয়ে দিবে না তো? বাবার মতো…!”

-“সবাই এক হয় না সারা! মানুষে মানুষে পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যের জন্যই ভালো-মন্দের সৃষ্টি হয়েছে! সবাই যদি খা’রা’প হয়, ভালোর তালিকাতে কাদের নাম উঠবে?”

-“এই পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র ব্যক্তি, যাকে আমি নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি! আমি জানি, আমার সব ভুল তুমি ক্ষমা করে দিবে। সানভিও আমার অল্প সময়ের ভুল ছিল। বড্ড দেরী করে ফেলেছি না? আরও আগে বুঝা উচিত ছিল! কেন বলোনি তুমি? কেন গোপন রেখেছিলে সব কথা? যাকে বিশ্বাস করি, ভরসা করি, তার অনুভূতিগুলো জানার পরেও তাকে ফিরিয়ে দিতাম বুঝি?”

-“মেয়েদের চোখ তো সব বুঝতে পারে। ছেলেদের দৃষ্টি কী বলে, সেটাও ধরতে পারে! তবে তুই পারিসনি কেন?”

-“তুমি সেভাবে তাকাওইনি! সবসময় মুরব্বিদের মতো শাসন করেছো, বকেছো, আবার বুঝিয়েছো। অনুভূতি প্রকাশ করেছো কখনো? করোনি। তাছাড়া আমি তো তখন উলটোপথে হাঁটছিলাম, বুঝিনি কার অনুভূতির গভীরতা কতটা বেশি!”

-“তবুও তোর বুঝা উচিত ছিল!”

মাইসারা জবাব দিল না। কথা বলতে ভালো লাগছে না তার। শুধু এই সুখকর সময়টাকে উপলদ্ধি করতে ইচ্ছে করছে। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে, এই মানুষটার সাথে। সবসময়ই কি বলতে হবে ভালোবাসি? থাক না কিছু কথা গোপনে, তবুও তো জানে মানুষটা তাকে কতখানি যত্নে আগলে নিয়েছে। এই ছোটো ছোটো কথাবার্তাতেই না বলা কথা বুঝা হয়ে গেছে তার। থাকুক এসব এভাবেই। এমনই। অনুভূতিকে তো এভাবেই বাঁচিয়ে রাখে মানুষ! তারাও রাখবে, জীবন্ত, সুন্দর, সুখস্মৃতি হিসেবে! এতগুলো বছর কা’টলো না পাওয়ার হিসাব কষতে কষতে, এবার থেকে নাহয় প্রাপ্তিগুলোর হিসাব কষা হবে। দেরীতে হলেও মাইসারা উপলব্ধি করলো এই সময়টা তো সুন্দর, একান্তই দু’জনার, পাশাপাশি থাকার, ভরসা হওয়ার।

*****

হুটহাট যদি জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত সুখ এসে ধরা দেয়, তখন ব্যক্তি নিজেকে সুখী এবং পরিপূর্ণ ভাবে! মাইসারার আজকের সকালটাও তেমন। সুখে, প্রাপ্তিতে পরিপূর্ণ। কোথাও কোনো ফাঁক নেই সেটা সে জানে কিন্তু তারপরেও জীবনের হিসাবগুলো ঘুরে যাবে। প্রতিনিয়ত হসপিটালের সময়টা রোগীর পিছনে কাটাতে হতো, তখন প্রয়োজন ছাড়া অনিকের সাথে কিংবা বাড়ির কারও সাথে আলাপ হতো না, ব্যস্ততায় দিন কা’ট’তো তার। অথচ এখন সময়ে, অসময়ে এই মানুষটার খোঁজ নিতে হবে তাকে। যে তার ভালো-মন্দের দায়িত্ব নিয়েছে, তাকে ভালো রাখার দায়িত্ব তো এবার তারই নেয়া উচিত। সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার পাশাপাশি, ভরসা আর বিশ্বাসকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যেন দু’জনের মাঝখানে আর কোনো তৃতীয় ব্যক্তি না আসে! চোখ মেলে তাকিয়ে এসব চিন্তাভাবনার খেয়ালে মজে ছিল মাইসারা। দু’দিকে হাত প্রসারিত করে হাই তুলে ঘুম ঘুম ভাবটাকে দূরে সরানোর চেষ্টা করলো। বহুদিন পর, ঘুমটাও তাকে প্রশান্তি দিয়েছে। হুট করেই মনে হলো, গতকাল রাত্রের ঝা’মে’লার পর আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ে নামাজ পড়া হয়নি। অথচ বিবাহিত দম্পতির নতুন জীবনের সূচনার আগে এই নামাজটা জরুরী! কষে একটা চ’ড় নিজের গালে মা’র’তে পারলে শান্তি পেত বোধহয়। বিছানা ছাড়তে ছাড়তেই অনিকের পিঠে আলতো করে হাত রাখলো। নাম ধরে ডাকতেও সংকোচ হচ্ছে আবার ভাইয়া ডাকতেও রুচিতে বাধছে। একরকম বিস্ময়কর অনুভূতিকে সঙ্গী করে খানিকটা ঝুঁকে গেল সে। চুলে হাত রেখে মুঠো পাকিয়ে খুব জো’রে টা’ন মা’র’লো। অনিকের প্রায় চিৎকার দেয়ার জোগাড় হলো। ধড়ফড়িয়ে উঠে সোজা হয়ে বসলো। ততক্ষণে খিলখিল হাসিতে পুরো ঘরকে প্রাণবন্ত করে ফেলেছে মাইসারা! চোখমুখ কুঁচকে বলল,

-“তুই আমার চুল ছিঁ’ড়ে ফেলবি মনে হচ্ছে। আর কিছু পাস না? চুলে ব্যথা দিস ক্যান! ফা’জি’ল।”

-“তো কী করবো? রাতের নামাজটা যে বাদ গেল, তার কী হবে। চলো ফ্রেশ হও। একসাথে নামাজ পড়বো।”

-“শুধু নামাজ পড়লেই হবে না, আমার অন্যকিছু চাই।”

অনিকের চোখমুখ বলছে সে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে কিছু বুঝাতে চেয়েছে। মাইসারাও তাকালো। বিড়বিড় করে বলল,

-“অন্যকিছু আবার কী! নামাজ মিস হয়েছে তাই সেটা আদায় করে নিলেই হবে।”

-“শুধু নামাজ মিস হয়নি, অন্যকিছুও মিস হয়েছে। বাসররাতে কি নির্দিষ্ট নামাজ আর দো’আ পড়ে? আর কিছু করে না?”

কথা শেষ করে ঝটপট ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো অনিক। মাইসারার মনে হলো, অনিকের না তার নিজেরই চুল ছিঁ’ড়া উচিত হবে এখন। কেন যে যেচে বাঁদরা’মি করতে গেল, কে জানে! কী দিয়ে মূল্য চোকাবে সেটা ভেবেই অস্থির হওয়ার দশা হলো তার।

নামাজে বসে দু’জনেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো। এই সম্পর্কটাকে অটুট রাখার জন্য শত বাসনা পেশ করলো। দিন-দুনিয়ার মালিক যদি তা কবুল করেন, তবে এই সম্পর্কটায় আর কোনো কিন্তু থাকবে না। নামাজ শেষেও গুটিসুটি মে’রে জায়নামাজে বসে রইলো মাইসারা! তার ভেতরে অনিকের কথাখানি বাজছে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছে সে। যদিও সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকার তবুও মনে ভয়, পাছে এই মানুষটা অদ্ভুত আবদার না করে বসে। মাইসারা তখনো ভাবনায় বিভোর! খেয়ালই করেনি, কখন যে ফাঁক পেয়ে অনিক রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।

অনেকক্ষণ পর যখন দু’কাপ ইন্সট্যান্ট কফি এনে চোখের সামনে বাড়িয়ে ধরলো অনিক, তখনই হুঁশ ফিরলো মাইসারার। সে বসে থাকা অবস্থাতেই ইলেকট্রিক ক্যাটলিতে পানি ফুটিয়ে কফি তৈরী করে নিয়েছে তার জীবনসঙ্গী। চমকে গিয়ে কফির কাপ দেখে মুচকি হাসলো মাইসারা। ভ্রু নাচিয়ে বলল,

-“তুমি বানিয়েছো?”

মাথা নাড়লো অনিক। হাতে এনে তাতে চুমুক দিল দ্রুত। বলল,

-“পারফেক্ট!”

-“হবে না কেন? শুধু পানি ফুটিয়েছি। এরপর প্যাকেট ছিঁ’ড়ে মগে মিশিয়ে নিয়েছি। ব্যস, তৈরী হয়ে অনিকের জা’দুর হাতে ছোঁয়া এই স্পেশাল কফি। এক চুমুকেই তৃপ্তি আসতে বাধ্য।”

প্রশান্তির হাসি ফুটালো মাইসারা। তার ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। অনিক যে শুধু মজা করেই তখনকার কথা বলেছে, এটা বুঝতে দেরী হলো না তার। আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল সে। চোখে সুখের জল জমা হলো৷ গড়িয়ে পড়ার আগেই অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। অনিক তা দেখেও না দেখার ভান করে বলল,

-“চল ছাদে যাই। ভোরের দৃশ্যটা একসাথে উপভোগ করি। বিকেলেই তো চলে যাবি। এভাবে আর একসাথে বসা হবে না। এই মুহূর্তটা মিস করতে চাইছি না।”

নির্ভয়ে মাথা নাড়লো মাইসারা। জায়নামাজ ভাঁজ করে জায়গামতো রেখে অনিকের হাতটা ধরলো। সজ্ঞানে, এই প্রথম স্বচ্ছ এক চাওয়া-পাওয়াকে আলিঙ্গন করেই হাতের বাঁধনটা শক্ত করলো আবারও। মনে হলো, এই ছোটো ছোটো ইচ্ছেগুলোর মূল্য দেয়া উচিত। কিছু সুন্দর মুহূর্তকে ছুঁয়ে দেয়া উচিত। ভালোবাসা আজ না হোক, কাল তো নিশ্চয়ই হবে। যেহেতু ভরসা দিব্যি আছে। সেখানে এই অহেতুক জড়তাকে কেন প্রশ্রয় দিবে। এই ইচ্ছেগুলোর মাধ্যমেই সম্পর্কটা আরও সহজ হোক দু’জনার।

*****

নিজের রুমে এসে আলনার কাপড়গুলো ইস্ত্রি করছিল মাইসারা! পরক্ষণেই তা ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিচ্ছে ঝটপট। আর কিছুক্ষণ পরই বেরিয়ে পড়বে সে। ফের কবে আসবে ঠিক নেই। তবে একেবারে কোর্স শেষে বাড়ি ফিরবে এমনটাই সিদ্ধান্ত নিল মনে মনে। ব্যাগ হাতড়াতে গিয়েই ট্রেনের টিকিটটা হাতে আসলো তার। কী মনে করে সেটা ছিঁ’ড়ে কুচি কুচি করে ফেললো। জানালার পর্দা সরিয়ে আলগোছে বাতাসের সাথে উড়িয়ে দিল দূরে। এরপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লো, কাপড় গোছানোর কাজে।

আরমান সাহেবের পাশে বসে অনেকক্ষণ চোখের পানি ফেললো মাইসারা। তিনি মাথায় হাত রেখে ভরসা হয়ে বললেন,

-“এত কাঁদিস না মা। এখন তো এই ঘর, এই ঘরের মানুষ সবাই তোর আপন। আগের তুলনায় আরও বেশি আপন। যখন মন টানবে চলে আসিস!”

-“আর ছুটি পাব না চাচ্চু!”

ভদ্রলোক জবাব দিলেন না। আড়ালে তিনিও চোখের পানি মুছলেন। ত্বোয়াও সুযোগ পেয়ে গা কাঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। তার সেই কান্না দেখে রেগে গেল অনিক। মাথায় গা’ট্টা মে’রে বলল,

-“ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদিস না তো। একেবারেই যাচ্ছে না। আবারও ফিরবে। ফিরতে হবে তো!”

অনিকের এই কথাটা মাইসারার কানে গেল। অভিমানী চোখে তাকালো শুধু। হাত বাড়িয়ে নাহিয়ানকে জড়িয়ে ধরলো। কপালে, গালে অসংখ্য চুমু খেয়ে বলল,

-“একদম দুষ্টামি করবে না। গুড বয় হয়ে থাকবে। বাবা-মায়ের কথা শুনবে। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। ফুপ্পি আবার আসবো৷ তখন অনেক মজা করবো।”

সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফারজানার কাছে গেল। সে চলে যাবে অথচ ফারজানা সামনেও আসছে না। যদিও এই ব্যাপারটা খুব একটা প্রভাব ফেলে না মাইসারার উপর, তবুও কোথাও যেন মন খারাপের জন্ম হলো হঠাৎ। দরজায় নক করে রুমে ঢুকলো। তখন আলিফও পাশে ছিল। বিয়ের উছিলায় স্কুল থেকে ক’টাদিন ছুটি নিয়েছিল সে। এজন্যই ফাঁক পেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। ব্যস্ততায় রোজ রোজ বিশ্রাম নেয়া হয় না। সকাল, বিকেল এমনকিও রাতেও ব্যস্ততা থাকে। মাইসারাকে দেখে ঠোঁট বাঁ’কা’লো ফারজানা। মেকি হাসি ফুটিয়ে বলল,

-“চলে যাচ্ছিস তবে? আর দুটোদিন থেকে গেল হতো না?”

-“হসপিটালটা আমার নিজস্ব মতামতে চলে না ভাবী। তাদের রুলস মেনেই চলতে হয়। থাকলে বরং তোমাদেরই অসুবিধা হবে। অযথা অসুবিধার কী দরকার!”

আলিফ কিছু বলতে চাইছিলো। ইশারায় তাকে তা বলতে নিষেধ করলো মাইসারা। আলিফ সব বুঝেও চোখ গ’র’ম করে তাকালো। সেটা দেখে অনুরোধের সুরে বলল,

-“প্লিজ!”

পক্ষান্তরে মাথা ঝাঁকালো আলিফ। মাইসারা ম্লানমুখে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো। ড্রয়িংরুমে এসে কাঁধে ব্যাগ তুলতেই হাতে বাঁধা পড়লো। চুঁ মে’রে নিজের হাতেই ব্যাগটা টে’নে নিল অনিক। দ্রুত পায়ে বাইরে গিয়ে বাইকের পিছনে শক্ত করে আট’কে দিল সেটা। ত্বোয়াকে সাথে নিয়ে উঠোনে আসলো মাইসারা। বাইকে ব্যাগ দেখে অবাক হয়ে বলল,

-“ব্যাগ ওখানে রেখেছো কেন? গাড়ি ডাকোনি? আমি একা যেতে পারবো।”

-“চুপচাপ বস!”

অযথা কথা বাড়ালেই ঝগড়া বাঁধাবে দু’জন। যাওয়ার বেলা কোনো প্রকার মনমালিন্য চাইছে না মাইসারা। বাধ্য মেয়ের মতোই পিছনে বসলো। ত্বোয়া আবারও এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। বলল,

-“আবার কবে আসবি?”

-“ঠিক নেই। ভালো থাকিস। ভাবীর সাথে ত’র্কে যাস না। চাচ্চু মনে আঘাত পান এমন কোনো কাজ করিস না। যথাসম্ভব সাবধানে থাকবি আর নিজের যত্ন নিবি!”

ত্বোয়া মাথা নাড়লো। বাইক স্টার্ট করে ধীরে ধীরে দূরের পথে এগিয়ে গেল তারা। এলাকা পেরিয়ে মূল রোডে এসে অনিক নিজেই বলল,

-“শুধু শুধু টিকিট ছিঁ’ড়’লি। আমাকে বললেই পারতি! এতদূর একা ছাড়তাম?”

মাইসারা জবাব দিল না। আসলেই সে চেয়েছিল, আজকের এই দূরের পথটা একান্তই দু’জনার হোক। মুখে বলতে পারবে না দেখেই টিকিট ছিঁ’ড়ে ফেলেছিল। অথচ সেটা অনিকের চোখে পড়ে গেছে। কতদিকে যে খেয়াল রাখে এই মানুষটা! সেটা ভেবেই নিজেকে সুখী আবিষ্কার করলো মাইসারা। কাঁধে হাত রেখে শক্ত করে চে’পে ধরলো। অন্য হাতে চোখের পানি মুছে পেটের কাছটায় জড়িয়ে ধরলো। পিঠে মাথা ঠে’কি’য়ে বলল,

-“যেতে ইচ্ছে করছে না!”

কান্নার ভারে শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে তার। অনিক সেটা সহ্য করতে পারছে না। একেই তো অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য দূরত্ব, তার উপর এই ইমোশনাল কান্না। মেজাজটাই খিচড়ে যাচ্ছে তার। রাগ দেখিয়ে চোখমুখ গরম করে বলল,

-“কান্না থামা নয়তো অ্যাক্সিডে’ন্ট হবে। মাথাটাথা ফা’ট’লে তখন আর আমাকে দোষতে আসবি না। চ’ড় মে’রে গাল লাল করে দিব, স্টুপিড!”

-“বকো না প্লিজ।”

চেহারার কাঠিন্যতা ধরে রাখলো অনিক। বলল,

-“এতদিন তো বাড়িতে আসতে চাইতি না, এখন এসে যেতে চাইছিস না। তোর সমস্যাটা কি বলবি? আমার এত চেষ্টা, এত ধৈর্য, সবকিছুকে বিফল করে দিবি! আরতো মাত্র কয়েকটা মাস সারা, দেখতে দেখতে কে’টে যাবে। এত আপসেট হোস না।”

রগরগে মেজাজে নিজের দুর্বলতাকে দূরে সরিয়ে রাখলো অনিক। মাইসারা সেসব কথা কানেও তুললো না। হাতের বাঁধন শক্ত করে ওভাবেই লেপটে রইলো সাথে। বিড়বিড় করে বলল,

-“তুমি খুব খারাপ!”

-“হ্যাঁ! তুই অনেক ভালো। ভালো হয়েই থাক। আবেগকে প্রশ্রয় দিস না। এই দূরত্বটা ক্ষণিকের। শীঘ্রই আবারও একসাথে হবো আমরা! তখন তোর চেহারায় কোনো ইমোশনকে দেখতে চাই না। একজন জয়ী, সাবলম্বী, পরিপূর্ণ ডাক্তারকে দেখতে চাই, যার মধ্যে থাকবে প্রচুর মনোবল আর আত্মবিশ্বাস। যা তোকে প্রতি পদে পদে বুঝাবে, কখনো আবেগী হয়ে সবকিছুকে বিচার করতে নেই। বিবেক-বুদ্ধি এবং ধৈর্যকেই পুঁ’জি করে জয়কে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে হয়!”

কথাগুলো আবারও হৃদয়ে তৃপ্তি এনে দিল তার। গভীর করে শ্বাস টানলো মাইসারা। স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে যেভাবে এগিয়েছে, সেভাবেই জয়কে ছি’নি’য়ে আনতে হবে হাতের মুঠোয়। ততদিন দুর্বল হওয়া চলবে না তাকে। শত বাধা-বিপত্তিকে পিছনে ফেলেই এগোতে হবে সামনে। যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে, সুন্দর এক রৌদ্রজ্বল দিন!

*****

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে