মনোহারিণী পর্ব-০৫+০৬

0
898

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (৫)+(৬)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। চাইলে শেয়ার করতে পারেন।)

যেকোনো আচার-অনুষ্ঠান শুরুর আগে পারিবারিক বৈঠক হয়! এই বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমেই একটা অনুষ্ঠানের যাবতীয় বিষয় উঠে আসে। এমনটা হওয়ার কথা ছিল! এই বৈঠকটারও প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি যে থমথমে ভাব বজায় রেখেছে তা দেখে অনিকের ভ্রু কুঁচকে আছে! বিয়েসাদীর আয়োজন, টাকা-পয়সা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু তার বাবার চেহারা বলছে অন্য কথা! আজ সারাদিন মাইসারা রুমের বাইরে বের হয়নি! দুপুরের পর অনিক, আলিফ, আরমান সাহেব তিনজনই আঞ্জুমান আরা’র জানা’যায় উপস্থিত ছিলেন। মাশফিকে দেখে তার খোঁজখবরও নিয়ে এসেছেন। তারমধ্যে একবার শুধু মাইসারার সাথে কয়েক মিনিট কথা বলেছে সে! ভাইকে স্বান্তনার বাণী শুনানো ছাড়া ওই মুহূর্তে আর কিছুই করার ছিল না তার। তবুও নিজে শক্ত থেকে অবুঝ ভাইকে স্বান্তনা দিয়েছে! বলেছে, হোস্টেলে গেলে দেখা করবে! মাশফি এতে যথেষ্ট খুশিও হয়েছে।

বড়োদের এই বৈঠকে সবাই উপস্থিত থাকলেও মাইসারা আর ত্বোয়া সেখানে নেই। দুই বোন এক রুমে বসে অযথাই সময় পার করছে! যতক্ষণ না অনুমতি আসছে ততক্ষণ বড়োদের সামনে যাওয়া বেয়াদবি। তাই বসে বসে অযথা সময় অতিবাহিত করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তাদের। রাতের এই সময়ে নাহিয়ান ঘুমিয়ে পড়েছে! আলোচনার বিস্তারিত তুলে ধরার উপযুক্ত সময় এটাই! আরমান সাহেব যথেষ্ট চিন্তিত! কারণ এই মুহূর্তে তিনি যা বললেন তা ঠিক প্রভাব ফেলবে অনিকের উপর সেটা ভেবেই একটু কঠিন সময় পার করছেন তিনি। তবুও তো বলা উচিত। বিয়ের সময়টাও এগিয়ে এসেছে। এখনই আলোচনা না হলে, পরে সময় পাবেন না। নামিরাও হয়তো অপেক্ষা করবে না! গভীর চিন্তার ভার দূরে সরিয়ে দুই ছেলের থেকে তাকালেন। তাদের উৎসুক দৃষ্টি দেখে মুচকি হাসলেন। ফারজানার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-“নামিরা মেয়েটাকে তোমার কেমন লাগে?”

ফারজানা হাসলো। এই বাড়িতে দ্বিতীয়জন আসা মানে কতটা ঝা’মে’লা সেটা সে জানে। কিন্তু না এনেও তো উপায় নেই। দুই ভাই যেহেতু, বউও দু’জন হবে নিশ্চয়ই। সে একাই যে রাজত্ব করতে পারবে সেটা তো তার ভুল ধারণার একটা। গতকাল যখন নামিরা এসেছিল তখনই সে তাকে বলেছিল,

-“আমরা এখানে দুই বোনের মতোই থাকবো।”

পক্ষান্তরে নামিরা শুধু হেসেছিল। কোনো জবাব দেয়নি। যদিও ফারজানার জানা নেই জবাব না দেয়ার কারণ। তবুও ভেতরে একটা দুঃশ্চিন্তা অকারণ উঁকি মা’র’লো তার। মুরব্বি মানুষটার মুখের উপর নিজের চাওয়া-পাওয়ার ভা’র দিতে পারলো না। চাইলেও তো আর স্বর্গ হাতে পাওয়া যায় না। এই সম্পত্তি, ভাগাভা’গি এসবও এরকমই। ধৈর্য ধরে, বুদ্ধি দিয়ে আদায় করতে হয়! মিথ্যে হাসির আড়ালে নিজের অস’ৎ চিন্তাভাবনা লুকিয়ে বলল,

-“ও অনেক ভালো বাবা। নম্র, ভদ্র, শান্তশিষ্ট! আমার তো খুব পছন্দ হয়েছে! ও এই ঘরে আসলে ঘরটা পরিপূর্ণ হবে!”

ফারজানার এই কথা সত্য! নামিরা যথেষ্ট শান্ত। অযথা ত’র্ক করে না, ঝ’গ’ড়া করে না এমনকি রা’গারাগিও করতে দেখা যায় না তাকে। এই বাড়িতে প্রায়শই আসা-যাওয়া আছে তার। এজন্য তার সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আছে সবার। আরমান সাহেব এই জবাবে সন্তুষ্ট হলেন। সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। বললেন,

-“সারাকে কেমন লাগে?”

প্রচণ্ড ধাক্কা খেল ফারজানা! ঠোঁটমুখ বাঁকিয়ে দ্রুত ভ্রু কুঁচকে নিল সে। বুঝতে পারেনি এমন একটা ভাব বজায় রেখে বলল,

-“মানে! এখানে সারার কথা আসছে কেন?”

-“যা বলছি তার উত্তর দাও!”

ফারজানা জবাব দেয়ার আগেই অনিক এই কথার মাঝখানে আসতে বাধ্য হলো। বাবার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল,

-“তুমি সারার কথা জিজ্ঞেস করছো কেন? আলোচনাটা নামিরাকে নিয়ে হবে। এখানে সারা কেন আসছে?”

আরমান সাহেব মুচকি হাসলেন! ফারজানার দিকে আবারও দৃষ্টি রেখে বললেন,

-“তোমাকে যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দাও!”

বড্ড দু’টানায় পড়লো ফারজানা। ভদ্রলোকের চিন্তাভাবনার দৌড় জানা নেই তার। আইডিয়ার ভেতরেও নেই। এই মুহূর্তে কোনো ত’র্কে বা ঝামে’লায় যাওয়াটাও বিপজ্জনক। নিশ্চুপে অনিকের দিকে তাকালো সে। অনিক নিজেও বিস্মিত বাবার এই অহেতুক আচরণে! বুঝা গেল, সে-ও কিছু বুঝতে পারেনি! কিছুক্ষণ ভেবে ফারজানা বলল,

-“সারা কেমন তা কি আমরা জানি না বাবা! ওর মতো মেয়ে হয় নাকি!”

-“গুড! বুঝে বলছো তো বৌ’মা?”

-“হ্যাঁ! বুঝেই বলছি। আমরা তো সারাকে ভালোমতো জানি! আপনি কি ওর বিষয়ে কিছু ভাবছেন বাবা?”

আরমান সাহেব মাথা নাড়লেন। বললেন,

-“যদি মানিয়ে নিতে পারো, তাহলে পরের মেয়ে টে’নে আনার প্রয়োজন নেই। দু’দিন পর নামিরার সাথে নয়, সারার সাথে অনিকের বিয়ে হবে। আমি আশা করবো আমার এই সিদ্ধান্ত তোমরা খুশিমনেই গ্রহণ করবে। আর যদি কারও কোনো আপত্তি থাকে সেটাও জানাতে পারো। তবে আমি কারও আপত্তি শুনবো না। আমি চাইবো, আমার মেয়েটা সারাজীবন আমার চোখের সামনে থাকুক! আলিফ, তোর যদি কিছু বলার থাকে আমাকে বলতে পারিস! অনিক, তুই আমার সাথে আয়। জরুরী কথা আছে!”

অসময়ে এমন কথা ফারজানা আর অনিক এই দু’জনের মাথায় বা’জ ফেলে দিল! অবিশ্বাস্য চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো দু’জন। শুধু আলিফ প্রশান্তির হাসি ফুটালো! যেন এটাই সে চেয়েছিল! তার সেই হাসিতে বুঝা গেল, মাইসারাকে সে-ও চিরদিনের জন্য এই বাড়িতে রাখতে রাজি! একগাল হেসে বলল,

-“আমার কোনো আপত্তি নেই বাবা! সারা এখানে থাকলেই আমি খুশি হবো!”

*****

রাগে দু’চোখে আ’গুন জ্বলছে ফারজানার! অকারণ রুমের ভেতর হাঁটাহাঁটি করছে সে! ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার পেপার দেখছে আলিফ। ফাঁকে ফাঁকে স্ত্রীর চিন্তিত চেহারার দিকে তাকাচ্ছে! মনে মনে তার এমন চক কষার ধরণ টের পেয়ে দু’দিকে মাথা নাড়লো সে! আবারও মনোযোগ দিল পেপারে! দু’চারটে পেপার দেখে সেগুলো ভাঁজ করে তুলে রাখলো নির্দিষ্ট একটা জায়গায়! ফারজানার হাত ধরে তাকে পাশে বসালো! খানিকটা বিরক্তই হলো মেয়েটা। ঝা’ড়ি দিয়ে বলল,

-“কী, হয়েছেটা কী তোমার? অযথা বিরক্ত করছো কেন?”

-“অকারণ চিন্তা তো করছো তুমি!”

-“বাবা কী এটা ঠিক করলেন? বিয়ের দাওয়াত দেয়া শেষ। কার্ড বিলি হয়ে গেছে। কমিউনিটি সেন্টার বুকিং হয়ে গেছে! রাত পোহালেই আত্মীয়স্বজনের ঠে’লাঠেলি শুরু হবে বাড়িতে। তারমধ্যে সবাই যখন জানবে পাত্রী বদল হচ্ছে তখন সম্মান কি আর থাকবে? তাছাড়া সারা এখনো পড়ছে। ও কি প্রস্তুত বিয়ের জন্য? ওর মতামত না নিয়েই এতটা বাড়াবা’ড়ি কেন করছেন তিনি?”

আলিফ জবাব দিল না। সে আসলেই বুঝতে পারছে না ফারজানার এই অহেতুক চিন্তাভাবনার কারণ! আরমান সাহেব না বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়ার মানুষ নন। তিনি বরাবরই চেয়ে এসেছেন সারা এখানেই থাকুক। কিন্তু যখন নামিরাদের পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসলো, অনিককেও সেদিকে পজেটিভ দেখা গেল তখন আর মাইসারার বিষয়টা তুলে ধরতে পারেননি তিনি। ভেবেছেন, ছেলের সিদ্ধান্তকে সম্মান দিয়ে তার ইচ্ছের মূল্য দিবেন। এটাই হয়েছিল! অনিকের না বলার কোনো কারণ ছিল না। তারা দু’জন একে-অপরকে যতটা বুঝে ততটা অন্য কেউ বুঝবে না কোনোদিন, হয়তো এ কারণেই অনিকও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নামিরাকেই বিয়ে করবে, অর্ধাঙ্গিনীর সম্মান দিয়ে এই বাড়িতে এনে তুলবে! কী এমন হলো যে, হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো! পুরো বিষয়ের একমাত্র এই দিকটাই বুঝতে পারছে না আলিফ! তবে তার মনে হচ্ছে, আরমান সাহেবের সিদ্ধান্ত যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ! তিনি সবদিক ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন!

-“সারার আপত্তি করা উচিত! পড়াশোনা ছেড়ে এক্ষুণি বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলা উচিত হবে না ওর! ভালো ডাক্তার হলে পাত্রের কী অভাব পড়বে নাকি? অনিককেই কেন ওর দায়িত্ব নিতে হবে?”

ফারজানার এমন রু’ক্ষ মেজাজের কথা হজম হলো না আলিফের! ক’ড়া চোখে তাকালো সে স্ত্রীর দিকে। বলল,

-“আমার ভাই কি খুব খারাপ? ওর সাথে মানাবে না? তোমার সমস্যাটা কোথায়? কেন মানতে পারছো না? এটা তো ভালোই যে, দূরে কোথাও যেতে হলো না সারাকে। সবসময় আমাদের চোখের সামনেই থাকলো!”

ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ ভাবলো ফারজানা। মুচকি হেসে বলল,

-“তুমি শুধু সারার কথা ভাবছো, নামিরার কথা ভাবছো না! মেয়েটার সম্মানে আঙুল উঠবে না?”

এই কথায় যথেষ্ট যুক্তি টের পেল আলিফ। আসলেই তাই। বিয়ের আসরে পাত্রী বদল হওয়া ঠিক কতটা অসম্মানের সেটা টের পেতে দেরী হলো না তার। তবুও বলল,

-“গতকাল তো নামিরা এসেছিল! বাবার সাথে কিছু কথাও বলেছে। নিশ্চয়ই তার নিজেরই এই বিয়েতে আপত্তি আছে!”

ভ্রু’যুগল কুঞ্চিত করে আলিফের দিকে তাকালো ফারজানা। এমনভাবে তো ভাবেনি সে। গতকাল নামিরা এসে আরমান সাহেবের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছে, এমনকি সবগুলো শপিংব্যাগ ত্বোয়ার আলমারিতে রেখে গেছে। কেন? তবে কি এসব নামিরার ইচ্ছেতেই? ভাবনারা একত্রিত হতেই রাগ বেড়ে গেল ফারজানার। মনে মনে কিছু একটা ভেবে নিল! যেভাবে হোক, এই বিয়ে থাকে আটকাতেই হবে। নয়তো বিয়ের পর সংসারের অর্ধেক দায়িত্ব চলে যাবে মাইসারার হাতে! কেউ তখন তাকে আর গুরুত্ব দিবে না। ফেল’না মনে করে ঘরের এক কোণে ঠে’লে দেবে সবাই।

*****

আরমান সাহেবের পাশে বসে আছে অনিক। তার চেহারায় যথেষ্ট চিন্তার ছা’প! হুট করে বাবার এরকম সিদ্ধান্তের কোনো যুক্তিই দাঁড় করাতে পারছে না সে। আজ সারাদিন নামিরাও কল করেনি! কাল যখন শেষ রাতে ফোন করে বলেছিল, আঞ্জুমান আরা মা’রা গেছেন তখন সব শুনে ওপাশ থেকে নামিরা শুধু বলেছিল,

-“তোমার উচিত সারার পাশে থাকা! কোথাও তুমি তোমার দায়িত্ব অবহেলা করছো না তো অনিক?”

অনিক অবাক হয়ে পালটা প্রশ্ন করেছিল! কিন্তু বিস্তারিত কোনো কথাই বলেনি সে। শুধু বলেছে, সময় আসুক সব বলবো! অনিকের মনে হলো, নামিরা এমন কিছু বলতে চায় যা সে জানে না! কিন্তু কী? সেটাই তো ভেবে পাচ্ছে না সে। দু’জনার বন্ডিং এতই ভালো যে, কেউ কারও থেকে আজ অবধি কোনো কথা লুকোয়নি! তবুও অনিকের মনে হচ্ছে, আসলেই নামিরার সম্পর্কে সে সব জানে না! তবে কি বাইরের সব আচরণ ভুল? ভেতরে অন্যকিছু ছিল? বুঝতে পারছে না অনিক। এমন কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবে জানলে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলতো না সে! তবে কি হ্যাঁ বলেই ভুল করে ফেলেছে? আরও গভীরভাবে ভেবেচিন্তে এগোনো উচিত ছিল কী? কতশত ভাবনায় ডুবে আছে অনিক। তার সেই ভাবনা থামলো বাবার হাতের স্পর্শে! তিনি খুব যত্নে ছেলের ডানহাতটা ধরে রেখেছেন! এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে ছোটো বাচ্চার জায়গায় আবিষ্কার করলো অনিক! বুঝতে পারলো, বাবা তাকে কিছু বলতে চান! সহনীয় নাকি অসহনীয় সেটা বোধগম্য হলো না তার। তবে হাতের বাঁধনটা মজবুত করে বলল,

-“বলো কী কথা বলতে চাও! আমি সব শুনবো।”

আরমান সাহেব তৃপ্তির হাসি ফুটালেন ঠোঁটে! বললেন,

-“এমন পরিস্থিতি আসবে আমরা কেউ-ই তা বুঝিনি! গতকাল নামিরা যা বললো তাতে মনে হলো, ওর ভাবনাটা ঠিক! ও যেভাবে ভেবেছে, সেভাবে আমরা ভাবিনী। ফলস্বরূপ ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি!”

-“ভুল? বুঝতে পারছি না কিছু!”

-“আমাকে একটা কথা বল! সারার অগোচরেই তার সব দায়িত্ব তুই পালন করছিস! বিয়েটা কেন নামিরাকে করতে চাইছিস? সারাকে কেন নয়? ও কি তোর স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখে না? অপ্রকাশ্যে যে কাজটা করতে দ্বিধা আসছে না, প্রকাশ্যে তা করতে কেন আপত্তি তোর?”

এই কথার কোনো জবাব খুঁজে পেল না অনিক! সারার দায়িত্ব নিতে তার আপত্তি নেই, কিন্তু আপত্তি অন্য জায়গায়! কিন্তু এখন এসব কথা কেন আসছে সেটাই বুঝলো না সে? নামিরা কী এমন বললো, যার কারণে আরমান সাহেব এত দ্রুত এমন সিদ্ধান্ত নিলেন! অনিকের মনে হলো, দ্রুত নামিরার সাথে কথা বলা উচিত! জানা উচিত, ঠিক কী কথা হয়েছে দু’জনার! ছেলের চেহারার এমন গুরুগম্ভীর ভাব, নীরব হয়ে বসে থাকা চিন্তিত চেহারা দেখে বললেন,

-“আমি সবসময়ই চেয়েছি সারা এখানে থাকুক! কিন্তু তুই যখন বললি, নামিরার সাথে তোর বন্ডিং ভালো তখন বুঝলাম সারা সঠিক পাত্রী নয়! কিন্তু এখন সবদিক বিবেচনা করে এইটুকুই মনে হচ্ছে, সারার জন্য উপযুক্ত যদি কেউ থাকে তবে সেটা তুই! আমি তোকে জো’র করবো না। তোকে ভাববার সুযোগ দিব! তুই বরং ভাব! প্রয়োজনে সারার সাথে কথা বল! যদি দু’জনের আপত্তি থাকে তবে আমি এগোবো না! কিন্তু বিয়ের দিন নামিরা এই বাড়িতে আসার প্রস্তুতি নিবে না!”

-“কেন?”

চমকে উঠলো অনিক! এত আয়োজন, এত ছোটাছুটি সবকিছু কি তবে মিথ্যে? হুট করে কেনই’বা সব এলোমেলো হচ্ছে! তবে কি নামিরা অন্য কাউকে ভালোবাসে? এমনটা হলে সে নিশ্চয়ই জানতো! কীসের জন্য সিদ্ধান্ত বদলালো মেয়েটা সেটাই তো পুরোপুরি পরিষ্কার হলো না! সারাকে নিয়েও তো এমন ভাবনা তার আসেনি! কারণ সে সারার মনের খবর জানে! জানে বলেই, নিজের লিমিট সে বুঝেই চলে। যতটুকু দায়িত্ব নেয়া প্রয়োজন মনে হয়েছে ততটুকুই সে পালন করছে! তবে এখন? এখন কেন পুরো জীবনের দায়ভা’র চলে আসছে তার কাঁধে! অবশ্য দায়িত্ব নিতে কোনোকালেই তার আপত্তি ছিল না, এখনও নেই। সমস্যা তো অন্য জায়গায়! এটা জানলে সারা তো ভীষণ কষ্ট পাবে! কী করা উচিত তার? কী করবে এখন? ভাবতে ভাবতেই বাবার হাতটা আরও শক্ত করে ধরলো অনিক!

-“তুমি যেমন আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করো, আমিও তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। কিন্তু আমার ওদের দু’জনের সাথেই কথা বলতে হবে! জানতে হবে, কী কারণে নামিরা তার সিদ্ধান্ত পাল্টালো! এটাও জানতে হবে, আমাকে নিয়ে সারা কতটা পজেটিভ। কিন্তু একটা সত্যি কথা কি জানো, কখনো ভাবিনী, সারার সব দায়িত্ব নিতে এই পথটাকেই বেছে নিবে তুমি!”

-“তুই এই সিদ্ধান্তে অখুশি?”

-“এমনটা নয় বাবা! সমস্যাটা অন্য জায়গায়! তবে তুমি নিশ্চিত থাকো, আমি তোমার ইচ্ছের মর্যাদা দিব!”

দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে সব গোপন কথাকে থামিয়ে দিল অনিক! দ্রুত ছুটে আসলো নিজের রুমে। মোবাইল হাতে তুলে ঝটপট ডায়াল করলো নামিরার নাম্বারে। কিন্তু ওপাশের নাম্বারটা তখন সুইচড অফ শুনালো। পর পর কয়েক বার একই কথা শুনে বিরক্ত হয়ে গেল সে। ফোন রেখে রওনা দিল মাইসারার রুমের দিকে! যা কথা হওয়ার এখনি হোক, নয়তো পরে মাইসারা অভি’যোগ দিয়ে বসবে, অনিক সব জেনেও কেন বিয়েতে অমত করলো না!

*****

চলবে…

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (৬)

যানবাহনে আরোহণের পর সবচেয়ে বেশি বিরক্তিকর ব্যাপার হচ্ছে হুটহাট চলন্ত গাড়ির থেমে মাঝপথে তৈরী করা জ্যাম! সামনে, পিছনে, ডানে, বায়ে সব জায়গায় যখন চলন্ত গাড়ি থেমে গিয়ে মানুষজনের কপালে বিরক্তির ভাঁজ সৃষ্টি করে। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানোর সময় পেরিয়ে সেই অনির্দিষ্ট সময়ের জ্যামটা তখন সহজ কাজের বাঁধা মনে হয়! একটা নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছার আগে কোনো ব্যক্তিকে কেউ যদি মারাত্মকভাবে হয়রানিতে ফেলে তবে সেটা হলো, এই মাঝরাস্তার হুটহাট জ্যাম! ঠিক এরকমই একটা তাড়াহুড়োর সময়ে বিরক্তি নিয়ে বাইকে বসে আছে অনিক! বার বার এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফাঁকফোকর খোঁজার চেষ্টা করছে, যদি কোনোভাবে বেরোনো যায়। অথচ কোনো ফাঁকই তার সামনে নেই। খানিক পর পর ঘড়ি দেখছে সে! ফোন চেক করছে! আবার নামিরাকে অপেক্ষা করতে রিকুয়েস্ট করছে। মেয়েটা হয়তো এতক্ষণে মহাবিরক্ত হয়ে বসে আছে। বিরক্ত হওয়ারই কথা! অহেতুক বসে থাকতে কারই’বা ভালো লাগবে?

আধঘণ্টা পর জ্যাম থেকে মুক্তি মিললো অনিকের। অপেক্ষা করতে করতে কাঠফাটা রোদে ঘেমে-নেয়ে একাকার সে! ক্যাফেতে ঢুকে ঝটপট দু’তলায় চলে এলো। কর্ণারের একটা টেবিলে তখন নামিরাকে দেখা গেল। অনিককে দেখতে পেয়ে হাত তুলে ডাকলো নামিরা। দ্রুত সেই টেবিলের কাছে গিয়ে পাশের চেয়ারে বসলো। নামিরার সাথে থাকা ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে। বলল,

-“হাই! আ’ম তানভীর! আপনি অনিক! আপনার কথা অনেক শুনেছি ওর কাছে। কেমন আছেন আপনি?”

খুব স্বাভাবিকভাবে তাকালো অনিক! নামিরা তার কথা সবার সাথে আলোচনা করে এটা সে জানে! কিন্তু এই ছেলেটা…। হাত উলটে নামিরার দিকে তাকালো। মিষ্টি হেসে তানভীরের হাতটা শক্ত করে ধরলো সে। বলল,

-“আমরা বিয়ে করেছি দোস্ত! প্লিজ, কোনো রাগ চে’পে রাখিস না! আমার কেন জানি না মনে হলো, আমি তানভীরকে ছাড়া থাকতে পারবো না। তারজন্য…!”

চারপাশে চোখ ঘুরালো অনিক। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলো তানভীরের সাথে! ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো। ওয়েটার তখন অর্ডারকৃত কফি নিয়ে আসলো। অনিক নির্দ্বিধায়, বিনা দুঃশ্চিন্তায় তাতে চুমুক দিল! বলল,

-“এটা আগে বললেই পারতি! শুধু শুধু সবাইকে হয়রানি!”

-“সরি!”

কানে হাত দিয়ে নরম কণ্ঠে সরি শব্দটা উচ্চারণ করলো নামিরা! অনিক ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসলো! বলল,

-“তানভীরকে বিয়ে করবি ঠিক আছে! বিয়ে ভাঙ’বি সেটাও ঠিক আছে! মাঝখানে সারাকে টে’নে আনলি কেন?”

নামিরা এবার স্বাভাবিক হয়ে বসলো। কপিতে চুমুক দিতে দিতে নিজেকে গুছিয়ে নিল পুরোটা! তারপর ধীর ধীরে বলল,

-“তুই তো জানিস, সারা কতটা একা! আমি চিন্তা করে দেখলাম, আমাদের মাথার উপর ভরসার হাত আছে। সেটা হোক বাবা-মা কিংবা স্বামী! কিন্তু ওর সেরকম কেউ নেই। আন্টি মা’রা যাওয়ার কথা শুনে সত্যিই খুব খারাপ লেগেছে! তখন আমি ভাবলাম, আমার সাথে তোর বিয়ে না হলে খুব একটা ক্ষ’তি নেই। কিন্তু সারাকে বিয়ে করলে ওর একটা খুঁটি তৈরী হবে। তুই তো জানিস তোর ভাবীর ব্যবহার, যদি সারা ওই ঘরে পার্মানেন্ট হয়ে যায় তাহলে উনি আর খারাপ ব্যবহার করতে পারবেন না ওর সাথে! অন্তত ওর ক্ষ’তি করার আগে দু’বার ভাববেন। এখন ঘা’ড়ের বোঝা ভাবছেন, কিন্তু পরবর্তীতে ঘরের একজন ভাবতে বাধ্য হবেন। এতে ওর থাকার কোনো ক্ষ’তি হবে না, আবার পড়াশোনাটাও ঠিকঠাক এগোবে।”

নামিরার এই কথাটা ফেলে দেয়ার নয়! যথেষ্ট যুক্তি দেখিয়ে বলছে মেয়েটা। পুরোটা শুনে উপরনিচ মাথা ঝাঁ’কা’লো অনিক। তারপর বলল,

-“কিন্তু সারা তো রাজি হবে না!”

-“তুই যা ভাবছিস, সেরকম না-ও হতে পারে! আমি আংকেলের সাথে সব শেয়ার করেছি! এমনকি ত্বোয়ারও সাপোর্ট ছিল! সারার সব কথাই সে জানে। ভয় পাস না। তুই একবার কথা বলে সবকিছু কনফার্ম করেনে। হাতে সময় তো বেশি নেই।”

-“মাত্রই আন্টি মা’রা গেলেন। এই মুহূর্তে ওর সামনে এসব তুলে ধরা কি ঠিক হবে? রাতে কথা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ঘুমিয়ে পড়েছিল দেখে ঘুম ভা’ঙাইনি! আমি আসলে অন্য বিষয়টা নিয়ে কনফিউজড! একটু ভয় লাগছে, আবার দুঃশ্চিন্তাও বাড়ছে! তবে হ্যাঁ, তোর উপর রাগ, অভি’যোগ কিছুই নেই। আগেই বলে ফেলেছিস, এতেই ভালো হয়েছে। নয়তো বিয়ের দিন মা’রাত্মক ঝা’মেলা হতো!”

সবকিছু আলাপ-আলোচনার পরেও অনিকের দুঃশ্চিন্তা কমলো না। সে একমনে কিছু ভেবে চলেছে! অবশ্য দুঃশ্চিতার কারণটা অতি সাধারণ, অথচ অনিক সেটা নিয়ে রীতিমতো আপসেট! কেন যে এত ভয় পাচ্ছে সে, সেটাই বোধগম্য হলো না তার। হাত বাড়িয়ে অনিকের হাতটা শক্ত করে ধরলো নামিরা। বলল,

-“চিন্তা করিস না! সব স্বাভাবিকভাবেই হবে!”

-“তুই বুঝতে পারছিস না, এই ব্যাপারটা কতটা প্রভাব ফেলবে সারার উপর! হয়তো আমাকে খা’রাপও ভাবতে পারে।”

-“ফা’ল’তু কথা বলিস না তো! তুই তাকে বাঁচাতে চাইছিস এটা জেনেও সে তোকে খা’রা’প কেন ভাববে? বাদদে, তোকে কিছু বলতে হবে না, যা বলার আমিই বলবো। কাল আমরা আসছি! সব সমস্যার সমাধান করে দেব!”

আরও কিছুক্ষণ আড্ডা চললো। ক্ষণিকের মধ্যে তানভীরের সাথে অনিকের এতটা গভীর ভাব তৈরী হলো যে, যেন এরা একে-অপরকে কতদিন ধরে চেনে, জানে! অথচ মাত্রই তাদের পরিচয় হলো! হাসি, আনন্দ আর আড্ডাতে পরবর্তী এক ঘণ্টা খুব দ্রুত চলে গেল। সন্ধ্যার আগে আগে দু’জনকে বিদায় দিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল অনিক।

*****

ফেরার পথে সানোয়ারের সাথে দেখা হলো অনিকের। সেদিনের মতো একগাদা হাঁসের দল নিয়ে পুকুর থেকে খামারের দিকে ফিরছিল সে। ছোটাছুটিতে হাঁসগুলো বাইকের উপর পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। অনিক দ্রুত ব্রেক কষে বাইক থামিয়ে পথের একপাশে দাঁড়ালো! সানোয়ার পাশে এসে বলল,

-“দিচ্ছিলি হাঁসের বারোটা বাজিয়ে! সেদিন তো সারার দৌঁড়ানি খেয়ে চারটে হাঁস হারিয়ে ফেললাম। কোনদিক যে গেল…!”

মন খারাপের সুরে গলায় আফসোস নিয়ে বললো সানোয়ার। অনিক অবাক হয়ে বলল,

-“বলিস কী! খুঁজে পাসনি?”

-“সারা গ্রাম খুঁজেছি ভাই। তা-ও পাইনি।”

অনিক ততক্ষণে পকেট থেকে দুই হাজার টাকা বের করে সানোয়ারের দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল,

-“এই টাকা দিয়ে হাঁস কিনে নিস! তবু সারাকে বকিস না দোস্ত!”

টাকা দেখে তার বন্ধু অবাক চোখে তাকালো। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে ব্যাপারটা বুঝে বাঁ’ধা দিয়ে বলল,

-“আরে দূর, টাকা লাগবে না। সারাদিন ওগুলোর সাথে সময় কা’টে। হারিয়ে গেলে কষ্ট লাগে, এইজন্যই একটু মন খারাপ হয়! ওকে বকবো কেন!”

অনিক মুচকি হাসলো। বন্ধুর খারাপ লাগা বুঝে তার কাঁধে হাত রাখলো। বলল,

-“বেকার থাকার চেয়ে এই কাজটাই বা কম কীসের বল! ভিক্ষাবৃ’ত্তি আর চু’রি-ডাকা’তির চেয়ে সৎ পথে উপার্জনের পঞ্চাশ টাকারও অনেক মূল্য আছে!”

সানোয়ার দীর্ঘশ্বাস ফেললো! বলল,

-“দু’জনে একসাথে পড়ালেখা করলাম! অথচ কপালের দো’ষে ফেল করে আজ…!”

-“মন খারাপ করিস না। তুই তো কোনো অন্যায় পথে টাকা ইনকাম করছিস না। নিশ্চয়ই আল্লাহ চেয়েছেন বলে এই ব্যবস্থাটা হয়েছে!”

-“আচ্ছা যাই, পরে কথা হবে।”

মন খারাপের ঢালি নিয়ে কথা এড়িয়ে যেতে চাইলো সানোয়ার। অনিকের দৃষ্টিতে তা এড়ালো না। সে দিব্যি বন্ধুর মনের অবস্থা আয়ত্তে আনতে পারছে। কাঁধে হাত রেখে বাইক স্টার্ট করলো আবার। বলল,

-“বিয়েতে আসিস!”

-“শুনলাম সারাকে বিয়ে করছিস! সত্য?”

সানোয়ারের কথার অর্থ ধরতে পেরে উপরনিচ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো অনিক! সানোয়ার হাসলো। বলল,

-“বাহ্!”

-“আসবি কিন্তু। অপেক্ষায় থাকবো!”

ফাঁকে জোরপূর্বক বন্ধুর পকেটে টাকা ঢুকিয়ে দিল অনিক। সানোয়ার সহজে টাকা নিবে না। প্রয়োজনে মাথার ঘাম পায়ে পেলে উপার্জন করবে তবুও কারও কাছে হাত পাতবে না। তার এই সততা আর সাহসের ধরনটা ভীষণ ভালো লাগে অনিকের। এজন্য সুযোগ পেলে মাঝেমধ্যে বন্ধুকে সাহায্য করা থেকে পিছিয়ে আসে না সে। এই খামারটাই তো তার ভরসা! মাইসারা নাহয় দুষ্টামি করে না বুঝে এই অন্যায়টা করে ফেলেছে, কিন্তু সে তো জানে। তাই জেনেশুনে বন্ধুর ক্ষ’তি হতে দিতে পারলো না। এজন্যই অল্পস্বল্প সাহায্যের মাধ্যমে তাকে বুঝানো, এই টাকাটা তার হক্ব! বিনা হক্বে সে কারও থেকে পাঁচ আনাও নিবে না! ভাগ্যিস মাইসারার অজুহাতে দেয়া গেল। এতে সানোয়ারের মনটাও ছোটো হবে না, বরং উপলব্ধি হবে তার শ্রমটা কোনো অংশে কম নয়! সানোয়ার হাঁস নিয়ে ওই সীমানা ত্যাগ করলে কম স্পীডে বাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরলো অনিক! তার চেহারায় এখন আর দুঃশ্চিন্তা নেই। বরং নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে সে যথেষ্ট সৎ, অপকট, নির্ভীক!

*****

ফোনের স্ক্রিনে একটা মেইল শো করছে। মেইলটা এসেছিল আজ থেকে এগারো মাস আগে। প্রায় বছর ঘুরে যাচ্ছে অথচ আর কোনো মেইল আসেনি। এটাই শেষ মেইল ছিল! এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে দু’চোখ ঝাপসা অনুভব করলো মাইসারা! ঝটপট চোখের পানি মুছে নিল। এই মেইলটার কথা প্রায় ভুলে গেছে সে। অথচ আজকেই, হঠাৎ করেই আবারও পুরনো সবকিছু চোখের সামনে ঝকঝকে আয়নার মতো ভেসে বেড়াতে লাগলো তার। চাইলেও মুছে ফেলা যায় না এসব যন্ত্রণাময় স্মৃতি! থেকে থেকে সেসব হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায়, বুঝিয়ে যায়, পৃথিবীতে কেউ কথা দিয়ে কথা রাখতে জানে না। সে-ও রাখেনি! বলেছিল ফিরবে, ফিরেনি। উলটে উচ্চ ডিগ্রী গ্রহণ করতে আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছিল, তখন সারা সবে মেডিকেলের প্রথম ধাপের ছাত্রী। সেখানে গিয়েও টুকটাক খোঁজখবর নিয়েছিল মানুষটা। একটা সময় যোগাযোগ বন্ধ হওয়া শুরু হয়। শেষ একবার ফোন করে বলেছিল, আমেরিকাতেই সেটেল্ড হবে। বিদেশিনী ম্যামের ভালোবাসার জা’লে জড়িয়ে সানভি শেষ মেইলে স্বান্তনার বাণী শুনিয়ে বলেছিল,

-“আমাকে ভুলে যাও সারা! নতুন করে আবারও জীবন শুরু করো তুমি! আমি আর ফিরবো না। অহেতুক অপেক্ষার প্রহর গুণে নিজের সুন্দর জীবন নষ্ট করো না। গুছিয়ে নিও নিজেকে। ভালো থেকো সবসময়! আল্লাহ হাফেজ!”

ব্যস এইটুকুই! এই সামান্য ম্যাসেজ যে হৃদয়ে কতখানি ক্ষ’ত তৈরী করেছে তা কেবল মাইসারাই উপলব্ধি করতে পেরেছিল সেদিন। নীরবে, গোপনে দিনের পর দিন অশ্রু বিসর্জন দিয়ে এখন সে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, নির্জীব, নিষ্প্রাণ শক্ত পাথরের মতো হয়ে গেছে। বিশ্বাস ভা’ঙা’র শব্দ যদি কাউকে শুনানো যেত, তাহলে পার্শ্ববর্তী মানুষও বোধহয় সেই আওয়াজটা শুনতে পেত। বুঝতে পারতো, কারও মন ভে’ঙেছে। বিশ্বাস ভে’ঙেছে। অথচ এই ভা’ঙ’নের কোনো আওয়াজ হয় না। খুব গোপনে, বিনা আওয়াজেই হঠাৎ করে ভে’ঙে যায়। কেউ তা টেরও পায় না, জানতেও পারে না। অদ্ভুত হলেও অনিক ঠিকই এই ভা’ঙ’নের শব্দ উপলব্ধি করেছিল সেদিন! কারণ অজান্তে, নিঃশব্দে তারও মনটা ভে’ঙে’ছিল কোথাও! যা সে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয়নি কাউকে, বুঝতে দেয়নি কোনোদিন! প্রকাশও করেনি লুকানো অনুভূতির তীব্র জ্বা’লাময়ী যন্ত্র’ণা! সে বুঝে গিয়েছিল, কিছু অনুভূতি অপ্রকাশ্যই জীবন্ত! তাই তাকে প্রকাশ করতে ভয় ছিল তার।

আনমনেই আঙুলের টাচে মেইলটা ডিলেট করে দিল মাইসারা! যে মানুষটা জীবনে নেই, আসবে না কোনোদিন, তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন বাঁচিয়ে রাখাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়! আসলেই নিজেকে গোছানো উচিত, তাই বলে অনিকের সাথে বাঁধা পড়বে সে? এমনটা তো কল্পনাতেও আসেনি কখনো! অনিক কীভাবে এই ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিবে? সে তো জানতোই, মাইসারা কাউকে ভালোবাসে! জেনেশুনে কেন সে আগু’নে ঝাঁ’প দিচ্ছে? যেখানে মনটা ভে’ঙেচুড়ে তছন’ছ হয়ে গেছে, সেখানে পুনরায় ভালোবাসার চাষ করা কি আদৌ সম্ভব? কতশত কঠিন ভাবনা, এসব ভাবনার নির্দিষ্ট কোনো সমাধানও জানা নেই তার।

মাইসারার সব ভাবনায় জটিল আরেক ভাবনার উদয় হলো! তার মধ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের কিছু ভয়ানক তথ্য ভেসে বেড়াতে লাগলো! মনে হলো, এসব কথা শীঘ্রই অনিকের সামনে তুলে ধরা উচিত। নয়তো তাদের একটা ভুল, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অভিশা’প হয়ে দাঁড়াবে! কিন্তু এসব তথ্য, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়েই চরম লজ্জার মুখোমুখি দাঁড়াবে সে! অনিকই বা ব্যাপারটা কীভাবে নিবে! নিজেকে শক্ত করলো মাইসারা! দ্রুত রুম ছেড়ে বেরোলো। যেভাবে হোক, লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে সবকিছু অনিককে বুঝাতে হবে! সে তো একজন ডাক্তার! আর ক’দিন পরই চেম্বার খুলে বসবে! তখন রোগীদের সাথে কতশত বিষয় নিয়ে খোলামে’লা আলাপ করতে হবে! এভাবে লজ্জা পেয়ে গুটিয়ে গেলে চলবে না। মনে সাহস নিয়ে বুঝাতে হবে!

এমনিতেও সকালবেলা পাশের বাড়ির এক ভদ্রমহিলা এসে মাইসারা চেহারা দেখে গালে হাত বুলিয়ে চুমু খেয়ে বলেছিলেন,

-“মাশা’আল্লাহ্! আমাদের সারা তো অনেক রূপবতী! ভাই সাহেব ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন! তুই চিরকাল এ ঘরেই থাক মা। তোকে দূরে দিয়ে এই বাড়ির কেউ শান্তিতে থাকবে না!”

তখন থেকে লজ্জায় আর কারও সামনে বেরোয়নি। এরইমধ্যে গ্রামের সবাইকে দাওয়াত দেয়ার কাজটাও শেষ হয়ে গেছে। দাওয়াত দেয়ার দায়িত্বে যে লোক নিয়জিত থাকে, তাকেই সকালে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছেন আরমান সাহেব! অবশ্য এর আগে সারার সাথে টুকরো কথার ঝুড়ি খুলে বসেছিলেন তিনি! সারা শুধু সব শুনেছে কোনো জবাব দেয়নি। ওই মুহূর্তে জবাব আসেনি তার। শুধু বলেছিল, তিনি যা ভালো বুঝেন। কিন্তু এখন সে টের পাচ্ছে, কোথাও কিছু একটা গণ্ডগো’ল আছে! নয়তো নামিরা এত সহজে কীভাবে সরে দাঁড়ালো? আজকাল মানুষ এত ভালো হয় নাকি! সবাই-ই মুখো’শের আড়ালে ভদ্রবে’শী অ’ভদ্র!

*****

রান্নাঘরে ফারজানার সাথে কাজে হাত লাগাচ্ছে মাইসারা। গতকাল থেকে কেমন থম মে’রে কাজ করছে ফারজানা। মাইসারা সেটা টের পেলেও সাহস হচ্ছে না কিছু বলার! আগ বাড়িয়ে কথা বলতেও দ্বিধা তৈরী হচ্ছে মনে। রান্নার মাঝখানে বার বার চেয়েও মুখ খুলতে পারেনি সে। সবকিছু গুছিয়ে ফারজানা নিজেই বলল,

-“খাবারটা তুই-ই দিস। এখন থেকে তো তুই এই ঘরের কর্ত্রী! সবার খেয়াল রাখিস কেমন?”

ফারজানার কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন শুনালো। রু’ক্ষ মেজাজ! খটখটে আওয়াজ! চোখের ভাবভঙ্গিতেও যথেষ্ট রাগ! সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে মাইসারা তার হাত ধরলো। বলল,

-“আমার উপর কেন এত রাগ তোমার?”

-“ওমা! রাগের দেখলি কী! আমি তো এমনই! এভাবেই কথা বলি! মাথাটা ভীষণ ধরেছে, আজ আর শরীর মানছে না আমার! তুই থাক, আমি গেলাম।”

অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে ফারজানার চলে যাওয়া টের পেতে দেরী হলো না মাইসারার। কেন যে এই নারী তাকে সহ্য করতে পারে না সেটা সে আজও জানে না! বাড়তি লোক বলেই কি শুধু, নাকি অন্য কোনো কারণ? ঠিক সেই মুহূর্তে ত্বোয়া এসে রান্নাঘরে উপস্থিত হলো। মাইসারাকে চিন্তিত দেখে বলল,

-“দাঁড়িয়ে কী ভাবছিস বলতো!”

চমকে গেল মাইসারা! খানিকটা কেঁপে উঠলো তার শরীর! চোখমুখে ভয়ের আভাস ছড়িয়ে পড়লো মুহূর্তেই! ত্বোয়াকে দেখে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁটের চারপাশ ভিজিয়ে ভয় দূর করে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো! আমতা আমতা করে বলল,

-“ওহ, তুই! ভয় পাইয়ে দিয়েছিস তো।”

-“কী ভাবছিস? ভাইয়া চা খাবে! দু’জনই ড্রয়িংরুমে বসে বাবার সাথে গল্প জমিয়েছে! কাজ শেষ হলে তুইও আয়! অনেকদিন একসাথে বসা হয় না। বাই দ্য ওয়ে, তুই কি কোনো কারণে লজ্জা পাচ্ছিস?”

-“ন না তো!”

থেমে থেমে উচ্চারণ করলো মাইসারা! ত্বোয়া তার দু’কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিয়ে বলল,

-“ভাবিনী, আমার চাওয়াটা এইভাবে পূরণ হয়ে যাবে! খুব খুশি লাগছে জানিস! তোকে বলে বুঝাতে পারবো না, তুই এ ঘরের বউ হলে কতটা আনন্দিত হবো আমি! একটা বন্ধু, যাকে আমি চিরকাল পাশে চেয়েছি সেটা কেবল তুই! ভাবী হোস কি বোন, তুই চিরকাল আমার কাছে যেমন ছিলি তেমনই থাকবি! আদরের, আবদারের, কান্নাহাসির একমাত্র মাধ্যম হয়ে!”

মাইসারা এতক্ষণ এসব ভেবে ভয় পায়নি, তবে ত্বোয়ার কথাতে এখন খানিকটা ভয়ই পাচ্ছে সে। চা নিয়ে কীভাবে অনিকের মুখোমুখি দাঁড়াবে সেই ভয়ই তাকে জড়ো করে ফেলছে নিজের জায়গায়। স্থির হয়ে এক জায়গায় বসে হাতের নখ কা’মড়াচ্ছে সে। ত্বোয়া সেটা দেখে মুচকি হাসলো। বলল,

-“একটা কথা কি জানিস সারা, তোর স্বপ্ন পূরণের পথে এই পর্যন্ত যতটুকু সহায়তা এই বাড়ি থেকে হয়েছে সবই ছোটো ভাইয়া আর বাবা করেছে। তুই মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এখন অবধি ভাইয়া একাই এগিয়ে গেছে! যেন তোর পড়াশোনার ক্ষ’তি না হয়! এই কারণে বড়ো ভাবী রোজ ভাইয়াকে কথা শুনায়! সেদিন তো তোকেও বলল, ছোটো ভাইয়া নাকি নিজের স্বা’র্থ মে’পে চলে। অথচ তোর আর পড়াশোনা এগোতোই না, যদি না ছোটো ভাইয়া এগিয়ে আসতো! চলার পথে এমন একজন মানুষ যদি সঙ্গী হয়, তবে সে পথ কখনো পিছু হটে না। সামনের দিকে এগিয়ে যায়! তুই পিছনেরটা ভুলে যা সারা! সামনের দিকে এগো। স্বপ্ন পূরণ হতে, আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। এরপর তুই চাইলে উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরেও যেতে পারিস! তোর সব পদক্ষেপে তুই ভাইয়াকে পাশে পাবি।”

মাইসারা জবাব খুঁজে পেল না! যতটুকু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভেতরে ছিল সবই বিলীন হয়ে গেছে! তবে মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগছে, এতকিছু অনিক কেন করছে? শুধু কি দায়িত্ব ভেবে? নাকি অন্যকিছু? তবুও অস্ফুটস্বরে বলল,

-“এজন্যই কি বড়ো ভাবী এরকম আচরণ করে? আমি যতদূর বুঝলাম, সংসারে বড়ো ভাইয়া টাকা ঢালছে! অথচ সকালে ভাবীর হাতে চাচ্চু নিজে এই মাসের খরচ হিসেবে পনেরো হাজার টাকা তুলে দিয়েছেন! যদি বড়ো ভাইয়া টাকা দেয়, তবে চাচুর টাকা কোথায় যায়? ক্ষেতের ধান আছে, শাকসবজি আছে, মাছেরও অভাব নেই। তবে এত টাকা কোথায় খরচ হয়?”

ত্বোয়া নিশ্চুপ রইলো! এই ব্যাপারটা যে মাইসারার চোখে পড়বে ভাবেনি সে। এজন্যই ফারহানকে সহ্য হয় না তার। প্রতিবার এখানে আসার পর যাওয়ার পথে ফারজানা লুকিয়ে হলেও ভাইয়ের হাতে টাকা ধরিয়ে দিবে! গতদিনও তাই করেছে। বাড়তি যে একাউন্ট আছে, সেখানেই প্রতি মাসে টাকাগুলো গচ্ছিত রাখে সে। মূলত এটা নাহিয়ানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই! অথচ এই কথা আলিফ আজও জানে না! এসব কিছু তারই আড়ালে, অগোচরে হচ্ছে। প্রতি মাসে কত টাকা খরচ হচ্ছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে বিনা খেয়ালেই মাস শেষে টাকা ধরিয়ে দিচ্ছে, যেন সংসারে অভাব অনটন না আসে!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে