মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি ২ পর্ব-১৮+১৯

0
401

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৮ [ কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য ]

ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোর কাছাকাছি। রাতভর নে”শা করে গভীর নিদ্রায় শায়িত নরেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী নরেনের কাছে বেলা হয় দুপুর একটা, দুইটা নাগাদ। নিশাচর প্রাণীর ন্যায় রাত জেগে দিনের বেলা ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে। নিজের ঘরে এ মুহূর্তে সে ব্যতীত আর কেউ নেই। ঘরের দরজা বন্ধ কিন্তু অর্ধ উন্মুক্ত জানালা। সূর্যের কিরণ অবলীলায় প্রবেশ করছে ঘরে। হঠাৎই ঘুমে ব্যাঘাত। দরজায় জোরে জোরে আঘাতের শব্দ। এত জোরে শব্দ হচ্ছে যে পুরো ঘর কেঁপে উঠছে। ঘুমন্ত স্নায়ু লম্ফ দিয়ে জাগ্রত হলো। ত্বরিত ঘুম থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো নরেন। আকস্মিক কাণ্ডে জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপছে সারা শরীর। ঝাপসা চোখে সব হযবরল দেখছে। ঝিমঝিম করছে মাথা। বি”ষযন্ত্রনা হচ্ছে বুঝি! কিয়ৎক্ষণ বাদে একটুখানি ধাতস্থ হয়ে বি শ্রী গালমন্দ করলো সে। রাতের নে শা এখনো কাটেনি। বিছানা ছেড়ে নেমে এলো। টালমাটাল পদযুগল। হেলেদুলে দরজার কাছে গেল নরেন। নাহলে দরজায় অত্যাধিক আঘাতে তার দুই রুমের বাসা উড়ে যাবে বুঝি। নে শায় আচ্ছন্ন নরেন দরজা খুলতে না খুলতেই বুক বরাবর জোরসে এক লা থ। ঝড়ো বাতাসে উড়ে যাওয়া কাগজের ন্যায় কয়েক কদম দূরে ছিটকে পড়লো নরেন। মেঝেতে পড়ে শরীরে আঘাত পেল। ক্রো-ধান্বিত চাহনিতে তাকালো দরজা বরাবর। কার এতবড় বুকের পাটা তাকে লা থ মা-রে! হতবিহ্বল হলো দোরগোড়ায় দণ্ডায়মান, পুলিশের পোশাক পড়ুয়া এসপি তাঈফকে দেখে!

” পু লি শ! ”

হ্যাঁ। এসপি তাঈফ ই তাকে লা থ মে-রেছে। নরেন অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে! পুলিশ! পুলিশ কি করছে এখানে! এখানকার ঠিকানাই বা পেল কোথায়? কোন অপরাধের দায়ে আজ তার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পুলিশ। জানা নেই। ঝাপসা চোখ দু’টো হালকা জ্ব’লছে। ঘেমে যাচ্ছে নে-শায় টালমাটাল শরীর। সহসা মন্থর পায়ে দরজার বাঁ পাশে সরে দাঁড়ালো তাঈফ। তার জায়গা দখল করে হাজির হলো চৌধুরী। ইরহাম চৌধুরী। শুভ্র পোশাক পরিহিত মানুষটির অন্তরে আজ নেই শান্তিপূর্ণ ভাব। নভোনীল চক্ষুদ্বয়ে অপরিমেয় আ-ক্রমণাত্মক কাঠিন্যতা। মুষ্টিবদ্ধ পেশিবহুল দু হাত। সবুজাভ রগ দৃশ্যমান চামড়ার আবরণে। এই বুঝি চামড়া চিঁ’ড়ে বেরিয়ে আসবে। সুঠামদেহী লম্বা চওড়া মানুষটির অপ্রত্যাশিত অবয়বে হকচকিয়ে গেল নরেন! সে চিনেছে ইরহামকে। মানুষটির অনাকাঙ্ক্ষিত নয়া অবতারে কম্পিত অভ্যন্তর। চৌধুরীর এ কি নয়া রূপ! লহমায় ধ্বং স করে দেবে সব। ছাড়বে না কাউকে। হলোও তাই। মাত্র কয়েক মিনিট। নে-শাগ্ৰস্থ নরেনকে সামান্য কৌশল অবলম্বন করে বাজেভাবে কুপোকাত করে ফেললো ইরহাম।

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু’জনে। ইরহামের শক্তপোক্ত লৌহসম হাত চেপে বসেছে নরেনের ঘাড়ে। একদম সন্নিকটে দু’টো মুখ। বিপরীতে দণ্ডায়মান মানুষটির চক্ষুদ্বয় হতে নিঃসৃত বহ্নি শিখায় জ্ব’লেপুড়ে ছারখার নরেন। টলে উঠছে দেহ। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে মৃ ত্যু। আজ বুঝি নেই নিস্তার। দ্বিতীয়বারের মতো শুধালো ইরহাম। অত্যন্ত শীতলতম স্বর। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সকল লোমকূপ।

” কোথায় পাঠিয়েছিস ওকে? ”

” জা-নি-না। ”

এলোমেলো স্বরে বললো নরেন। ঘাড়ের ওপর আরো চেপে বসলো শক্তপোক্ত হাত। হাড্ডি গুঁড়ো করে ফেলবে কি? ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো নরেন। তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে পুনরায় একই প্রশ্ন করলো ইরহাম। নরেন ভয়ে কিংবা আত্মগ্লানিতে কিছু বলতে যাচ্ছিল। অকস্মাৎ ভণ্ডুল হলো সব। ধীরলয়ে দুই বার ঈষৎ কেঁপে উঠলো শরীর। উল্টে যাবার উপক্রম চক্ষুদ্বয়। ধীরে ধীরে ভারসাম্য হারালো শরীর। মাথা লুটিয়ে পড়লো ইরহামের ডান কাঁধ বরাবর।

” হেই! ”

শঙ্কিত ইরহাম নরেনের গালে চাপড় মে রে ডাকতে লাগলো। কোনো সাড়া নেই। হঠাৎ এ কি হয়ে গেল? ত্বরিত অর্ধ উন্মুক্ত জানালায় তাকিয়ে বাড়ির বাইরে ছুটলো তাঈফ এবং দু’জন পুলিশ অফিসার। যখন সবটা বোধগম্য হলো তখন ইতিমধ্যে সব হাতের নাগালের বাইরে। নরেনের পিঠ চুঁয়ে র’ক্তিম তরল গড়িয়ে পড়ছে। দু দু’টো বু:লেট বি দ্ধ হয়েছে পিঠে। জানালা হতে কেউ গু লি করেছে। সাইলেন্সার যুক্ত
পি স্ত ল। তাই ওরা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। মৃ ত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পূর্বে, ইরহাম নামক মানুষটির কানের কাছে নরেন বেদনাময় ক্ষীণ কণ্ঠে কিছু বললো,

” প-দ! ”

এই শেষ। আর বলা হলো না। পরলোকগমন করলো নরেন। চোখের সামনে একজনের মৃ ত্যু। মৃ ত্যুর পূর্বে বলা অদ্ভুত ফিসফিসিয়ে বার্তা। এ কোন সর্বনা’শা তুফানের ইঙ্গিত! শত্রুপক্ষ জানতো তাদের আজকের এই আগমন। তাই তো হৃদি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলার পূর্বেই নরেন’কে প্রাণে মে রে দিলো। এটা নিশ্চিত যে হৃদির অ-পহরণের পেছনে বাগেরহাটের হিন্দু ধর্মাবলম্বী নরেন দায়ী। সে-ই করেছিল হৃদি’কে
কি ড ন্যা প। একবিন্দু আশার আলো দেখা দিয়েও হারিয়ে গেল। হতাশা ঘিরে ফেললো আষ্টেপৃষ্ঠে। আস্তে ধীরে নরেনের নিথর দেহ মেঝেতে শুয়ে দিলো ইরহাম। তার পরিহিত শুভ্র পাঞ্জাবিতে এক অপরাধীর র ক্ত লেপ্টে। চোখের সামনে দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত অঘটন ঘটে গেল। কিচ্ছুটি করতে পারলো না সে। ব্যর্থ চৌধুরী। নিজের স্ত্রীকে সুরক্ষা করতে ব্যর্থ। ব্যর্থ কারোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। অসীম ব্যর্থতায় নিষ্পিষ্ট ইরহাম দু হাতে মসৃণ চুল খামচে ধরলো। ধপ করে বসে পড়লো একটি কাঠের চেয়ারে। চশমার অন্তরাল হতে দুঃখময় চোখে তাকিয়ে রইলো নিথর দেহে।

” প। দ। মৃ ত্যুর আগে কি বলতে চাইছিল নরেন? ইয়া আল্লাহ্! রহম করো। ”
_

তাঈফ তৎক্ষণাৎ বাড়ির বাইরে ছুটে গিয়েও ব্যর্থ হলো। কালো পোশাকধারী অজ্ঞাত দু-র্বৃত্ত ততক্ষণে সঙ্গীর বাইকে চড়ে ছুটেছে অজানার পথে। বাইকের নম্বর প্লেটে আঁকিবুঁকি করা। বোঝাই যাচ্ছে নকল নাম্বার। রাগে মাটিতে পা ঠুকলো তাঈফ।

” শিট! শিট! ”

” নেতাজী! কাম হইয়া গেছে। ”

ওপাশ থেকে মিললো কাঙ্ক্ষিত খুশির সংবাদ। প্রসন্ন হলেন আজগর সাহেব। অধরে ফুটে উঠলো শয়তানি হাসি। সাবাশি জানিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন। স্টাডি টেবিলের ওপর যান্ত্রিক ডিভাইসটি রেখে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন টেবিলে রাখা ল্যাপটপে। উজ্জ্বল বদনে ল্যাপটপের পর্দায় উপস্থিত মানুষটিকে বললেন,

” গেম ওভার। নরেন ইজ নো মোর। ”

আজগর সাহেব ওপাশ হতে প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া পেলেন না। এহেন কাণ্ডে ঈষৎ চমকালেন। ‘সে’ অমন নিশ্চুপ কেন? খুশি নয় এ সংবাদে? কি চলছে তার মনে? সে কি খুব বেশিই ক্রু-দ্ধ! নাকি অতি খুশিতে বাকশূন্য! দ্বিতীয়টি হবার সম্ভাবনা মাত্র পাঁচ পার্সেন্ট। ‘সে’ অতি খুশিতে আত্মহারা হবার মতো জীব নয়। সে তো…! ওনার অন্তরে লুকায়িত ভাবনাকে সঠিক প্রমাণ করে আকস্মিক রুদ্রনীল নিজ ল্যাপটপ বরাবর ঝুঁকে এলো। অতি সন্নিকটে এখন মুখাবয়ব। ভয় হানা দিলো বয়স্ক মানুষটির অন্তরে। যেন যান্ত্রিক পর্দা ভেদ করে যেকোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে দা-নবটি। ওপাশ হতে শোনা গেল হিসহিস ধ্বনি মিশ্রিত কণ্ঠস্বর,

” প্রথমবার ভুল করেছো মাফ করে দিলাম। দ্বিতীয়বার এই একই ভুল তোমার ম-রণের কারণ হতে পারে। রিমেম্বার ইট। ”

বিষাদময় আভা ছড়িয়ে পড়লো আজগর সাহেবের মুখে। আনম্র লহু স্বরে বলে উঠলেন,

” তোমার বাবা হই রুদ্র। ”

তাচ্ছিল্য করে হাসলো রুদ্রনীল। অতঃপর গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বরে আদেশ সূচক ভঙ্গিমায় বললো,

” বাপ মাই ফুট। লিসেন কাল সন্ধ্যা নাগাদ চল্লিশটা মেয়েকে বাই সি(sea) শ্রীলঙ্কা পাঠাবে। সেখান থেকে ইউরোপীয়ান কান্ট্রি। কোনো মিস্টেক যেন না হয়। এলস্.. ”

অপূর্ণ বাক্যটি বুঝে গেলেন আজগর সাহেব। চল্লিশটা মেয়ে পা-চার হতে চলেছে। দুই কোটি টাকার ডিল। সবচেয়ে দামী মা’ল তো ওই ইরহাম পত্নী। ওকে বিক্রি করেই মিলবে বাংলাদেশী অর্থমূল্যে দশ লাখ টাকার বেশি। অর্থের লো ভে চকচক করে উঠলো দু চোখ। উজ্জ্বল হলো মুখ। কিয়ৎক্ষণ পূর্বের বিষাদ এখন হাওয়ায় মিশে। আজগর সাহেব দ্রুততার সহিত বললেন,

” না না বুঝেছি। সব প্লান মাফিক হবে। তুমি চিন্তা করো না। ওই চৌধুরী যতই ডানা ঝাপটাঝাপটি করুক না কেন কিচ্ছু করতে পারবে না। ওর বউ অধরাই রয়ে যাবে। নাকের ডগা দিয়ে ফুরুৎ। ”

বাপ বেটা একত্রে জ”ঘন্যতম হাসিতে সংক্রমিত হলো। অতঃপর অপরাধ জগতের আরো কিছু বিষয়াদি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলাপণ হলো। আধ ঘন্টা বাদে বিচ্ছিন্ন হলো ভার্চুয়াল সংযোগ। উচ্ছ্বসিত বদনে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন আজগর সাহেব। বিড়বিড় করে আওড়ালেন,

” চৌধুরী তুই তো শেষ। আমার এত ক্ষতি করে ভালো থাকবি তা কি করে হয়? সব শেষ। সব। ধুকে ধুকে ম-রবি তুই। এ আমার প্রতিশ্রুতি। ”

চক্ষু বন্ধ করলেন আজগর সাহেব। বড় শ্বাস ফেলে মশগুল হলেন ভাবনায়। চুনোপুঁটি চৌধুরীর জন্য ওনার এখন অবধি কম ক্ষতি হয়নি। একের পর এক কুকর্মে ব্যঘাত। দেশসেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়া ইরহাম চৌধুরী। পুরোদমে মা:দক বিরোধী অভিযান শুরু করেছে গত বছর হতে। এতেই আজগর সাহেবের চরম ক্ষতি আরম্ভ। ওনাদের কুকর্মের অন্যতম মূল অংশ মা:দকদ্রব্য। বিভিন্ন পন্থায় দেশে বিদেশে মা:দক সরবরাহ করেন। তন্মধ্যে সবচেয়ে কার্যকারী উপায় হলো সমুদ্র পথে এবং ট্রেনে করে। বেশ কয়েকমাস পূর্বের কথা…

আঁধারিয়া রজনী। চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। আঁধার চিড়ে সরু রেলপথ ধরে এগিয়ে চলেছে একটি দীর্ঘকায় ট্রেন। ট্রেনে স্বল্প কিছু যাত্রী এবং অসংখ্য মালামাল। একটি বগিতে চারজন বসে। পরিবারের সদস্য তারা। স্বামী স্ত্রী এবং বৃদ্ধ পিতা সঙ্গে কনিষ্ঠ ভ্রাতা। বৃদ্ধ মানুষটি বগির একটি সিটে শয্যাশায়ী। বয়সের ভারে নুয়ে দেহ। ওনার বিপরীত দিকে স্বামী স্ত্রী বসে। কনিষ্ঠ ভ্রাতা পাশের সারির সিটে বসে পত্রিকা পড়ছে। অন্ধকারের মাঝে চলমান তাদের বহনকারী ট্রেন। এরা কারা? সাধারণ আমজনতা? ট্রেনের যাত্রী? উঁহু। সম্পূর্ণ ভুল। সাধারণ জনগণের বেশে এরা একেকজন অপরাধী। মা:দক পা-চারকারী। এরা দুর্দান্ত চতুরতার সহিত ট্রেন মাধ্যমে দেশের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্তে মা-দক সরবরাহ করে থাকে। একটা দু’টো করে কয়েকটি স্টেশন অতিক্রম হলো। চতুর্থ স্টেশনে এসে থামলো ট্রেনটি। বেশকিছু সাধারণ যাত্রী নেমে গেল। আর মাত্র দু’টো স্টেশন বাকি। সারা ট্রেনে মাত্র নয় দশজন যাত্রী অবশিষ্ট। ভিন্ন ভিন্ন বগিতে বসে তারা। কেউ কেউ তন্দ্রাচ্ছন্ন। কেউ মোবাইলে মগ্ন। কেউবা আলাপচারিতায় লিপ্ত। সবই তাদের অভিনয়। কুটিলতা। অবশিষ্ট এ কয়েকজন যাত্রীর ছদ্মবেশে অপরাধী। ট্রেন দাঁড়িয়ে স্টেশনে। যেকোনো মুহূর্তে চলতে আরম্ভ করবে। যে মূহুর্তে ট্রেন চলতে আরম্ভ করবে ঠিক তখনই ভেতরে প্রবেশ করলো কয়েকজন। নৈশকালীন সময়ে তাদের আকস্মিক উপস্থিতি বড় ভূতুড়ে লাগলো। কেমন গা ছমছম পরিবেশ। বগিতে থাকা কয়েকজন ছদ্মবেশী অপরাধী নতুন লোকের আগমনে নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে লাগলো। চিনতেও পারলো না এই নতুন আগন্তুকের দল, পেশাগত জীবনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচিত। তন্মধ্যে চলতে আরম্ভ করেছে ট্রেনটি। নতুন উদিত আটজন কোনো নির্দিষ্ট সিটে বসলো না। বরং এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। হাঁটতে লাগলো এদিক ওদিক। তীক্ষ্ণ তাদের চাহনি। যে চাহনিতে ভীতসন্ত্রস্ত হলো পূর্ব হতে উপস্থিত যাত্রীবৃন্দ অর্থাৎ অপরাধীরা। অতিবাহিত হলো কিছু মুহূর্ত।

অতঃপর একসময় কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পেয়ে আরম্ভ হলো দু পক্ষের লড়াই। মা:দকবিরোধী অভিযান। আকস্মিক আক্রমণে হকচকিয়ে গেল অপরাধীরা। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যেই স্বরূপে ফিরে এলো। করতে লাগলো পাল্টা আঘাত। ঘুটঘুটে আঁধারে চলমান র ক্তক্ষয়ী খেলা। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। ক্ষুদ্র বগির ভেতরে গোঙানির শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে। র ক্তে রঞ্জিত হচ্ছে ট্রেনের আসন। দু পক্ষের পরপর কয়েকটি দেহ নিথর রূপে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। চলমান রইলো সে শত্রু শত্রু খেলা। আঁধারিয়া রজনীতে বিপদ ঘনিয়ে এলো! আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বনাম পা:চারকারী। লড়াই চলমান। ঘন গাছপালায় আচ্ছাদিত সরু লাইন ধরে এগিয়ে চলেছে ট্রেনটি। স্বল্প সময়ের মধ্যেই ছোটোখাটো এক মৃ*ত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে যেন। দুই পক্ষের বেশকিছু সদস্য আহত, নিহত হলো। অবশেষে এলো আকাঙ্ক্ষিত সফলতা। ট্রেনের সিটের নিম্ন ভাগ, বার্থ, ওয়াশরুম, ছদ্মবেশী যাত্রীদের নকল মালপত্র হতে দেশী বিদেশী প্রায় পঁচিশ লাখ টাকার মা:দকদ্রব্য উদ্ধার হলো। গ্রেফতার হলো কয়েকজন পা:চারকারী। কেউবা চলন্ত ট্রেন হতে লাফ দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পলায়ন করলো।

আজগর সাহেব খবর পেলেন ওই অপ্রত্যাশিত মা:দক বিরোধী অভিযানে ইরহামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সে নিপুণতার সহিত সহায়তা করেছে। কিন্তু কিভাবে, কোন পন্থায় করেছে আজও ওনার অজানা। বহু চেষ্টা করেও জানতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে নির্বাচনী লড়াইয়ে ইরহাম ওনায় পরাজিত করেছে। তৃতীয়ত, ওনার প্রেরিত দু-র্বৃত্তদের রাতের অন্ধকারে চরমভাবে ধরাশায়ী করে মৃ-ত্যুর মুখ থেকে বেঁচে গেছে। এছাড়াও কিছুদিন পূর্বে সংসদে বিল পাশ করে ওনার এক ধূর্ত পরিকল্পনা ধুলিসাৎ করেছে। আরো কত কি উপায়ে ওনার জীবনটা তেজপাতা বানিয়ে ফেলেছে ওই চৌধুরী। দু’দিনের চুনোপুঁটি! সে কিনা খন্দকার আজগর মল্লিক’কে টেক্কা দেয়! কতবড় স্পর্ধা! এছাড়া ওই ইরহাম পত্নী! ওটাও কম নয়। ঠিক স্বামীর ভাও পেয়েছে। মুহিত কেসে কিভাবে জড়িয়ে পড়লো!
__

ভার্সিটির প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট মুহিত। ভর্তি হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই সিনিয়র ভাইদের কু প্ররোচনায় নে-শাগ্ৰস্থ হয়ে পড়লো। ভার্সিটিতে গোপন একটি চক্র রয়েছে। টাকার লো ভে তারা সহজ-সরল শিক্ষার্থীদের মা:দকে আসক্ত করে তোলে। চতুর্থ বর্ষের সজীব এই চক্রের মূল হোতা। আজগর সাহেবের বেআইনী দলের হয়ে কাজ করে। মা:দক সরবরাহ করে নিরীহ শিক্ষার্থীদের নিকটে। অল্প সময়ের মধ্যেই মা:দকাসক্ত হয়ে পড়ে ওরা। এতেই তাদের মুনাফা। টাকা আর টাকা। মুহিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। প্রথম প্রথম হাতখরচের টাকা দিয়ে মা:দকের মূল্য জোগান দিতে পারলেও পরবর্তীতে আর পারলো না। আর্থিক সংকটে পড়ে নে শার অভাবে পা-গলপ্রায় অবস্থা। সজীব কিছুতেই বিনামূল্যে মা:দকদ্রব্য দেবে না। মা:দকাসক্ত একজন যখন হঠাৎ করে নে শা হতে দূরে চলে যায় সে সহ্য করতে পারে না। জীবন সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। শরীর অস্থির। মানসিক চাপ, যন্ত্রণা ঘিরে ফেলে আষ্টেপৃষ্ঠে। খিটখিটে মেজাজ। বেসামাল চালচলন। চোখের সফেদ অংশ র-ক্তলাল। মুহিতও তার ব্যতিক্রম নয়। বাড়ি থেকে ঘনঘন টাকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আর সজীব বিনামূল্যে নে শাদ্রব্য দেবে না। মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেল। বারকয়েক ঝামেলা হলো সজীবের সঙ্গে। এমনিতেই শরীরটা বড্ড খারাপ যাচ্ছে। নিজেকে পা’গল পা’গল লাগছে। নে-শার অভাবে একদিন ভার্সিটি করিডোরে কেমন উ-ন্মাদনা আরম্ভ করে দিলো মুহিত। সজীব বাধ্য হয়ে ওর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল ভার্সিটির শুনশান এক জায়গায়। চলতি পথে তা দেখে নিলো হৃদি। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে কিছু বুঝতে পারলো না। সজীব সেদিন কোনরকম বুঝিয়েসুজিয়ে ছেলেটাকে শান্ত করতে সক্ষম হয়েছিল।

মুহিত দিনদিন অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। পা’গলামি করছিল নে-শার জন্য। বাড়িতে একসময় মা-বাবা এসব টের পেয়ে গেল। অশান্তি হলো ঘরে। মা-বাবা খুব কষ্ট পেলেন। বকলেন। প্রথমবারের মতো ছেলের গায়ে হাত তুললেন বাবা। চরমভাবে মানসিক অস্থিরতার শিকার মুহিত। কয়েকবার হু’মকি দিলো সজীবকে, নে-শার ব্যবস্থা না করে দিলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সমস্ত কুকর্ম জানিয়ে দেবে। দু’দিনের এক ছোকড়ার জন্য আজগর সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন। অবশেষে আদেশ দিলেন একে মে রে ফেলার। উটকো ঝামেলা সমূলে উৎপাটন করা উচিত।

সেদিনও বাড়িতে বেশ ঝামেলা হলো। পা:গলপ্রায় মুহিত মানসিক অবসাদে ভুগছে। নে-শার অভাবে দুর্দশা। ঘরেবাইরে রোজ অশান্তি। ঝামেলা। সিদ্ধান্ত নিলো আত্মহ-ত্যা করবে। অন্ত হবে সকল সমস্যার। সে-ই মতো একটা নির্দিষ্ট দিন নির্বাচন করলো। ভার্সিটির নীরব শুনশান এক জায়গা বেছে নিলো আ-ত্মহননের জন্য। কম্পিত হাতে কাঁদতে কাঁদতে মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে ছোট্ট চিরকুট লিখলো। তবে তার দুর্ভাগ্য। সেথায় মৃ ত্যুদূত রূপে অপ্রত্যাশিত ভাবে হাজির হলো সজীব ও এক সিনিয়র ভাই। মিষ্টি কথার জা:দুতে ছলেবলে কৌশলে মুহিতকে মানিয়ে নিলো সজীব। ওর হাতে তুলে দিলো তরল দ্রব্য। নে-শাজাতীয় দ্রব্যের অন্তরালে যা হৃদক্রিয়া উত্তেজক ড্রা গ। এতদিন পর মা-দকের স্বাদ! আহ্! লো ভ সংবরণ করতে পারলো না। মৃ ত্যু চিন্তা ভুলে সরল মনে এতদিন পর নে শা করলো মুহিত। হাত ফসকে বাতাসে উড়ে গেল সু-ইসাইড নোট। আনন্দিত চিত্তে কম্পিত হাতে নিজের অজান্তেই বরণ করে নিলো মৃ ত্যু। হৃদক্রিয়া উত্তেজক ড্রা গ টি ওর হৃদযন্ত্র সইতে পারলো না। হাত ফসকে পড়ে গেল তরল পদার্থের সিসি। বুকে অসহনীয়-অসহ্যকর ব্যথার আনাগোনা। তীব্র শ্বাসকষ্টে পানি বিহীন জলজ প্রাণীর ন্যায় ছটফটানি। শ্বাস প্রশ্বাসের চলাচল অত্যন্ত করুণ। ঘোলা হয়ে আসছে দু চোখ। ডান হাতে শক্ত করে হৃৎপিণ্ড বরাবর বুকের চামড়া চেপে ধরলো। ঘোলাটে চোখে দেখলো বে-ইমানের হাসিমুখ। ওরা। ওরা ওকে এ কি দিলো? মে-রে ফেলছে ওকে। মৃ ত্যু যন্ত্রণা এত্ত কষ্টদায়ক! সে তো একটু আগেও স্বেচ্ছায় ম-রতে চেয়েছিল। শুধু বি-ষ কেনা বাকি। তবে কেন এখন বাঁচার এত আকাঙ্ক্ষা? কেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে মা-বাবার মুখখানি। উহ্! আর সহ্য করা যাচ্ছে না। ভেতরে যেন এক গ্যালন এ;সিড জ্ব’লেপুড়ে সব ছারখার করে দিচ্ছে। আর নাহ্। সইতে নারাজ শরীর। আস্তে ধীরে বুজে আসছে আঁখি পল্লব। টালমাটাল পদযুগল ধীরে ধীরে ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো এক তরতাজা দেহ। ওষ্ঠাধরের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে এলো ফেনাযুক্ত শ্লেষ্মা। একসময় ধীরে ধীরে মৃ ত্যুর কোলে ঢলে পড়লো মুহিত। হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃ ত্যুবরণ। সজীব বক্র হেসে পকেট হতে রুমাল বের করলো। হাঁটু গেড়ে বসলো নিথর দেহের পাশে। ঘৃণিত অভিব্যক্তি প্রকাশ করে সাবধানী ভঙ্গিতে মুহিতের মুখে লেগে থাকা শ্লেষ্মা মুছে দিলো। এবার দেখতে একদম ঠিকঠাক লাগছে। স্বাভাবিক
মৃ ত্যু। বিন্দুমাত্র ঝামেলা নেই। প্রসন্ন চিত্তে সজীব তরল পদার্থের সিসি হাতে উঠে দাঁড়ালো। সেথা হতে প্রস্থান করলো ওরা দু’জন। দিনেদুপুরে ঠাণ্ডা মাথায় এক তরুণ শিক্ষার্থীর খু ন হলো। অবুঝ পাখপাখালি ব্যতীত জানলো না কেউই।

ফরেনসিক বিভাগে নিজস্ব লোক রয়েছে। তাই অতি সহজেই সবটা নিয়ন্ত্রনে আনলেন আজগর সাহেব। মুহিতের মৃ ত্যু স্বাভাবিক মৃ ত্যু বলে গণ্য হলো। বিপত্তি দেখা দিলো হৃ’হামের জন্য। অপ্রত্যাশিত ভাবে হৃদি পেল সে-ই সু-ইসাইড নোট। ইরহামের সঙ্গে গেল পুলিশ স্টেশন। কাগজটা জমা দিয়ে নিজের জানা খুঁটিনাটি সকল তথ্য জানালো। হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্ট নিশ্চিত করলো সু:ইসাইড নোটে ওটা মুহিতেরই হাতের লেখা। এছাড়াও হৃদি জানালো ও কয়েকবার সন্দেহজনক ভাবে সজীব ভাইয়ের সঙ্গে মুহিতকে দেখেছে। ওর বলা ছোট ছোট তথ্য কেসে মোড় ঘুরিয়ে দিলো। এ পৃথিবীতে সকলে খারাপ নয়। আজও রয়েছে ভালো মানুষের অস্তিত্ব। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সৎ ব্যক্তিদের দ্বারা নতুন করে তদন্ত শুরু হলো। এতেই আজগর সাহেবের মাথায় হাত। রুদ্রনীল ফোন করলো গোয়া হতে। ওনার সঙ্গে রাগারাগী করলো বোকামির জন্য।

ব্যাস। ক্ষে’পে গেলেন আজগর সাহেব। আদেশ প্রদান করলেন ইরহাম পত্নীকে তুলে ফেলার। এক ঢিলে কয়েক পাখি ম-রবে। হঠকারিতার জন্য শাস্তি পাবে হৃদি। বউ ছাড়া মানসিকভাবে বিধ্ব-স্ত হয়ে পড়বে ইরহাম। সহজেই দুর্বল শত্রুকে পরাস্ত করা যাবে। নিজের হাতে শাস্তি দেবেন ওই চৌধুরীকে। এমনতর বেশকিছু মনোরঞ্জক পরিকল্পনা আজগর সাহেবের। তবে সে ভাবনায় বিধিবাম। থেমে নেই ইরহাম চৌধুরী। নতুন উদ্যমে তার হৃদরাণীর খোঁজ করে চলেছে। ইনশাআল্লাহ্ ধরা দেবে সফলতা।

আচ্ছা জোঁক তো। একবার ধরলে ছাড়ার নামগন্ধ নেই। চৌধুরীর প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করলেন আজগর সাহেব। বিড়বিড় করে উঠলেন,

” হ*তচ্ছাড়া। ”

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৯ ( প্রথমাংশ ) [ প্রাপ্তমনস্কদের জন্য ]

” প এবং দ বর্ণ দিয়ে যত জায়গা আছে সব চেক করে দেখো। আ’ম ড্যাম শিওর ও কাছাকাছি ই আছে। ”

অধীনস্থ সহচরদের গুরুগম্ভীর স্বরে আদেশ প্রদান করলো ইরহাম। শেষের বাক্যটিতে কণ্ঠস্বর কেমন কোমল হয়ে উঠলো। তার হৃদি কাছেই রয়েছে। সে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে না। শীঘ্রই ফিরবে ইনশাআল্লাহ্।

মধ্যাহ্নের শেষ প্রহর। আলোকজ্জ্বল এক ঘরে উপস্থিত তারা ছয়জন। এমপি সাহেব। তার সিকিউরিটি হেড রুস্তম, বন্ধু তাঈফ এবং তিনজন দেহরক্ষী। আয়তাকার টেবিলের ওপর বিছিয়ে রাখা বড়সড় একটি মানচিত্র। দেশের মূল শহর, জেলা, উপজেলা সব রয়েছে এ মানচিত্রে। গুমোট পরিবেশ। ওরা পাঁচজন তীক্ষ্ণ চাহনি বুলিয়ে চলেছে মানচিত্রে। প ও দ বর্ণ দু’টো পাশাপাশি উপস্থিত রয়েছে এমন সকল জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে। ইরহাম বলেছে যখন সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা পঁচাশি পার্সেন্ট। তারা ঝুঁকি নিতে নারাজ। সবার হাতেই ম্যাগনিফাইং গ্লাস। গ্লাসের আবরণ ভেদ করে মানচিত্রের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে চক্ষুজোড়া। প ও দ উপস্থিত এমন স্থান খুঁজে বেড়াচ্ছে মরিয়া হয়ে। ইরহাম তাদের থেকে স্বল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে। গম্ভীর বদনে গুরুত্বপূর্ণ ফোনালাপে লিপ্ত। পার্টির উপদেষ্টার সঙ্গে আলাপণ করছে। শান্ত অথচ শীতল স্বরে জানাচ্ছে নিজস্ব মতামত। একটু পরপর অন্তরে উঁকি দিচ্ছে আশার আলো। এই বুঝি মিলবে ‘তার’ খোঁজ!
.

গোধূলি লগ্ন। দুর্বলতার দরুণ ভেঙে আসছে শরীর। প্রায় পঁয়ষট্টি ঘন্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেল। এই তমসাচ্ছন্ন ঘরে একঘেয়ে বন্দী অবস্থায় কাটছে দিন। যাচ্ছে রাত। সময়ের কোনো হুঁশজ্ঞান নেই। কখন সকাল শেষে দুপুর গড়িয়ে পড়ছে, কখন সন্ধ্যা হারিয়ে রাত। জানা নেই। শক্ত রশির বন্ধনে আবদ্ধ হাত-পা ইদানিং কেমন ভরশূণ্য অকেজো প্রায় অনুভূত হয়। ফাঁকা লাগে মস্তিষ্ক। স্নায়ু যু-দ্ধে চরমভাবে পরাজিত সৈনিক সে। অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়তে পড়তে এখন বিলুপ্ত হবার পথে। বিগত ঘন্টা, মিনিট দু চোখ ছাপিয়ে আর অশ্রু নামেনি। আর কত কাঁদবে? পরিস্থিতির ন্যায় বে-ইমানি করছে অশ্রু কণাও। অস্থিমজ্জায় এখন শুধু যন্ত্রণা। আস্তে ধীরে হারিয়ে ফেলছে মুক্তির আশা। আগামীকাল সন্ধ্যা। তাদের সমুদ্রপথে পা চা র করা হবে। কোথায়, কোন পন্থায় নিয়ে যাবে জানা নেই। হৃদি তার অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে। আপনজনদের ছেড়ে তার বুঝি ঠাঁই হতে চলেছে ইউরোপের কোনো দেশে। অজানা পরিবেশে এক স্লা* হিসেবে! এক নারীর জন্য এ পরিচয় নিঃসন্দেহে অত্যন্ত অপমানজনক। বি”শ্রী তকমা। কেউ কি স্বেচ্ছায় এমন নোংরা পথে আসতে চায়? চায় না। নিজেকে বিকিয়ে অর্থ উপার্জন। এমন উপার্জন কোনো নারীর না হোক। এই অন্যায়, হারাম পন্থা ইহকাল ও পরকাল দুইই নষ্ট করে ফেলে। শেষ হয়ে যায় এক কোমলমতি প্রাণ। আমৃ-ত্যু ধুঁকে ধুঁকে ম রে তারা। চাইলেও পারে না নোংরা বেড়াজাল হতে মুক্ত হতে। আর আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ? তারা রাতের আঁধারে মজা লুটে, দিনের আলোয় অপবাদ দেয়। নোংরা নোংরা তকমা লাগিয়ে দেয় কলুষিত কোমল দেহে। সমাজের সে-ই বিদঘুটে শ্রেণীর পুরুষদের প্রতি এক বুক ঘৃণা জন্ম নিলো। চোখমুখে দৃশ্যমান সে ঘৃণার বহর।

আনমনা হৃদির ভাবনায় ছেদ পড়লো। গুনগুন করে ক্রন্দনের ধ্বনি প্রবেশ করছে শ্রবণেন্দ্রিয়ে। অন্ধকারে কাঁদছে কে? দেয়াল ঘেঁষে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বসে হৃদি। একটুখানি সোজা হয়ে বসলো। চিড়চিড় করে উঠলো দুর্বল দেহের যত্রতত্র। যাতনা সয়ে এদিক ওদিক তাকালো হৃদি। হলদে রঙা লো ভোল্টেজ বাল্বের আলোয় ডান পাশে আবছা দেখতে পেল। শঙ্কায় হাত-পা গুটিয়ে কাঁদছে একটি মেয়ে। নড়াইলের মেয়ে। বয়স কত? মাত্র উনিশ। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে এবার। ইনুর মতো। লহমায় চোখে বাষ্প জমলো। বাড়ির লোকেরা কেমন আছে? তাকে স্মরণ করছে কি? সে যদি চিরতরে ইউরোপের বুকে হারিয়ে যায় ওরা কি ভুলে যাবে তাকে? সময়ের পরিক্রমায় তাদের জীবন হতে হৃদি নামক অস্তিত্ব কি মুছে যাবে! হয়তো হাঁ। এটাই তো করুণ বাস্তবতা। হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো একসময় স্মৃতির পাতা হতেও হারিয়ে যায়। সেথায় ঠাঁই নেয় জীবিত-বর্তমান মানব অবয়ব। সে-ও বুঝি হারিয়ে যাবে। আপনজনদের জীবন হতে। তাদের স্মৃতি হতে। একান্ত মানুষটির জীবনে আসবে এক নয়া জন। কোনো রূপসী কন্যা। সকলে ভুলে যাবে তারে। হৃদিরে। বুকের বাঁ পাশে অসহনীয় যন্ত্রণা আরম্ভ হলো। অস্থির হৃদক্রিয়া। স্বেদজলে সিক্ত কায়া। অন্তঃপুরে আঘাত হানছে সুনামি। হৃদয়ের দ্বার পাখির ডানার ন্যায় ঝাপটে চলেছে। মাথাটা একসময় ঠেকে গেল দেয়ালে। র’ক্তিম দু চোখে হাহাকার। আপনজনের নিকটে ফিরে যাওয়ার আকুতি। ধীরে ধীরে বুঁজে গেল অক্ষিপুট। নিশ্চুপ হয়ে পড়ে রইলো ইরহামের হৃদরাণী!

.

ঘড়ির কাঁটা তখন সন্ধ্যা সাতটা বেজে দশ মিনিট নির্দেশ করছে। রায়না দুপুর নাগাদ ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ গিয়েছে। আদুরে ভাবীর শোকে সে-ও আহত। ও বাড়িতে ইদানিং ঘনঘন আসা যাওয়া করছে। জহির সাহেব জোরালো ভাবে নিষেধ করেননি অবশ্য। তবে উনি যে এসব পছন্দ করছেন না ওনার হাবভাবে স্পষ্ট। পল্লবী পরিপাটি রূপে প্রস্তুত। এখন ও বাড়ি যাবেন। দশটার দিকে একেবারে ফিরবেন মেয়েকে নিয়ে। বাড়ির প্রাঙ্গনে এসে পল্লবী উপলব্ধি করলেন ভুলবশত পার্স আনেননি। অগত্যা পিছু ঘুরে বাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অজ্ঞাত এ নারী ঘুণাক্ষরেও টের পেল না কতবড় দুঃস্বপ্ন তার অপেক্ষায়।
_

” আরে গা-ধার দল। তোদের ওখানে চোট্টা** করতে রাখা হয়নি। মেয়েগুলো যেন টাটকা থাকে সে খেয়াল রাখিস। যদি একটু এদিক ওদিক হয় না? তোর লিভার-কিডনি-ফুসফুস বেঁচে হলেও টাকা উসুল করবে ওঁরা। সে-ই সঙ্গে ফ্রি ফ্রি ওপরে যাওয়ার টিকিট। মনে রাখিস। ”

ফোনের ওপাশ হতে কিছু বললো ব্যক্তিটি। যা শুনে তেঁতে উঠলেন জহির সাহেব,

” ওরে হারা*। জানিস না ওটা কার বউ? ওই ঘা-ড়ত্যাড়া ইরহাম চৌধুরীর বউ। একটু দাপাদাপি না করলে চলে? ওই মালটাকে ভালোমতো চোখে চোখে রাখবি। খবরদার চেখে দেখতে যাস না যেন। দুবাইয়ের এক শেখ ওকে কিনবে। রেট বেড়ে গেছে। দশের জায়গায় এখন আঠারো লাখ। সো, ওটাকে দেখে দেখে রাখবি। ভুলেও পালিয়ে যায় না যেন।… আরে হাঁ জানি। চিন্তা করিস না। এখন রাখছি। ওটাকে দেখে রাখিস। শুধু কাল সন্ধ্যার অপেক্ষা। হা হা হা। এরপর টাকাই টাকা। ”

লো ভে চকচক করছে আঁখি জোড়া। ভুলে গেলেন জাগতিক হুঁশ। অভ্যন্তরে কুটিলতা। আরো ঠাট্টা তামাশা করে জহির সাহেব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন। হাস্যবদনে পিছু ঘুরে হলেন স্তব্ধ! পল্লবী হতবিহ্বল বদনে দাঁড়িয়ে! চোখেমুখে অবিশ্বাস ও ঘৃণার মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সাড়ে সর্বনা’শ হয়ে এলো! ওহ্ শিট। ত্বরিত বিছানায় মোবাইল ছুঁড়ে বউয়ের পানে অগ্রসর হলেন উনি। ভয়ে-আতঙ্কে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পিছপা হচ্ছেন পল্লবী। আঙ্গুল নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে নিষেধ করছেন। জহির সাহেব শুনলে তো? আচমকা স্ত্রীর হাত টেনে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন। চোখে চোখ রেখে যথাসম্ভব শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

” এখানে কি করছো? ফিরে এলে যে? ”

পল্লবী ঘৃণায় হাত মুচড়ে চলেছেন। সরে যেতে চাইছেন স্বামী নামক পশুটির সান্নিধ্য হতে। এতেই তেঁতে উঠলেন জহির সাহেব। হাতের কবজি আরো শক্ত করে আঁকড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

” সব শুনে নিয়েছিস তাই না? কলিজা অনেক বড় হয়ে গেছে? ”

এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলেন পল্লবী। ক্রন্দনরত মুখখানি লালিমায় ছেয়ে। উনি জোরালো শব্দে জানালেন নিজস্ব ঘৃণ্য অনুভূতি,

” অমানুষ হয়ে গেছো তুমি! শেষমেষ এত নিচে নামলে? আপন ভাগ্নের বউকে অবধি ছাড়লে না? জা-নোয়ারে পরিণত হয়েছো এখন। সামান্য কয়টা টাকার লো ভে সততা, মূল্যবোধ সব বিক্রি করে ফেলেছো? ছিঃ! ”

প্রথমবারের মতো স্ত্রীর তীব্র প্রতিবাদের মুখে জহির সাহেব। অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে উনি। আকস্মিক একপেশে হেসে করতালি দিতে দিতে বললেন,

” আরে বাহ্! আমার বিড়াল কিনা শেষমেষ আমাকেই বলে ম্যাঁও? আনবিলিভেবল! ”

পল্লবী প্রতিবাদী অবতারে রূপান্তরিত হলেন,

” হাঁ আজ বলছি। কারণ দিনেদিনে তুমি সকল অন্যায়ের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছো। সত্যি করে বলো হৃদি কোথায়? ওকে কেন লুকিয়ে রেখেছো? ”

সশব্দে হেসে উঠলেন জহির সাহেব। শার্টের হাতা গুটিয়ে কনুইয়ে তুলতে তুলতে বললেন,

” বিক্রি হয়ে গেছে তোমাদের আদরের বৌমা। দুবাইয়ের এক শেখ দরদাম করে ওকে কিনে নিয়েছে। আঠারো লাখে। জীবনে একসাথে দেখেছো কখনো? ”

চরম আশ্চর্যান্বিত পল্লবী বাকশূন্য হয়ে পড়লেন! এ কি বলছে লোকটা? হৃদি’কে তারা বিক্রি করে দিয়েছে! নাহ্। এ.. এ হতে পারে না। জহির সাহেব শার্টের দু হাতা গুটিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসছেন। কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলেন পল্লবী। অতঃপর আর সহ্য করতে পারলেন না। তেড়ে গিয়ে ডান হাতে স্বামীর কলার চেপে ধরলেন। তেজদীপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে বললেন,

” তোমরা? তোমরা ওকে বেঁচে দিচ্ছো! ইরহাম তোমাদের কাউকে ছাড়বে না। সত্যি করে বলো হৃদি কোথায়? কোথায় ও? ”

ইরহাম তাদের ছাড়বে না? হোয়াট অ্যা জোক! অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন জহির সাহেব। এক ধাক্কায় নিজের থেকে সরিয়ে ফেললেন স্ত্রীকে। ধাক্কার ফলস্বরূপ পল্লবী কয়েক পা ছিটকে দূরে সরে গেলেন। জ’ঘন্য লোকটির স্ত্রী হিসেবে আজ এক সমুদ্র ঘৃণা-অনুশোচনা হচ্ছে। ছিঃ! জহির সাহেব বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বললেন,

” তোর ওই ইরহাম কচু করবে রে কচু। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বউ ফুরুৎ। কু** পাগল হয়ে অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু বউ আর মিলবে না। বউ তার পদ্মা পাড় হতে রাতারাতি উধাও হয়ে যাবে। কিচ্ছু করতে পারবে না ওই হারা**। ”

ভাগ্নের নামে এমন জঘন্য শব্দমালা আর সহ্য করা গেল না। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো শরীরে। জীবনে প্রথমবারের মতো অভাবনীয় প্রতিবাদ করে বসলেন পল্লবী। ডান হাতে সপাটে চ ড় মা*রলেন স্বামীর গালে। ঘৃণা মিশ্রিত স্বরে বললেন,

” তোমার মতো অমানুষ সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। পুলিশে দেবো তোমায়। তোমাকে তো আমি.. ”

আর বলা হলো। স্ত্রীর হাতে জীবনে প্রথমবারের মতো আঘাত। পুরুষালি সত্তা চিৎকার করে উঠলো। গরম হলো র-ক্ত। স্বল্প সময়ের মধ্যেই পা-গলাটে কুকুরের ন্যায় আঘাতে আঘাতে চুরমার করে দিলেন এক প্রতিবাদী নারীকে। র ক্তে র-ঞ্জিত হতে লাগলো শুভ্র রঙা টাইলস। এক নারীর করুণ ভ-য়ানক আর্তনাদ চাপা পড়ে গেল চার দেয়ালের মাঝে। জাগতিক হুঁশ হারিয়ে জহির তখন বে:ল্ট দিয়ে আঘাত করে চলেছেন।

অকস্মাৎ! পাপের বিনাশ যে অবধারিত। ক্ষি প্র গতিতে বাবা নামক ন*রপশুকে মায়ের কাছ থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেললো রাহিদ। মেঝেতে ছিটকে পড়ে কপালে আঘাত পেলেন জহির নামক পশুটি। আতঙ্কিত রাহিদ দু হাতে জাপটে ধরলো জন্মদাত্রী মা’কে। চিৎকার করে ডাকতে লাগলো মা’কে। র ক্তে র-ঞ্জিত মমতাময়ী মা সাড়া দিলো না। বন্ধ তার চক্ষু। ভয়ে আতঙ্কে উ:ন্মাদ হয়ে গেল রাহিদ। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে শক্তপোক্ত দু হাতে পাঁজাকোলে তুলে নিলো মা’কে। মায়ের অচেতন মুখখানি মিশে তার প্রশস্ত বুকে। দ্রুত পায়ে ঘর হতে মা’কে নিয়ে বেরিয়ে গেল রাহিদ। আর জহির? পুলিশের দুই পালোয়ান মতো অফিসার টেনেহিঁচড়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে বিরূপ পরিস্থিতি দেখেছে পুলিশ সদস্যরা। স্ট্রং কেস তারা নিজেরাই বানিয়ে নেবে। জহির নামক প-শুর দ্য এন্ড ঘনিয়ে এলো বলে।

.

আঁধারিয়া রজনী। হাসপাতালের ওয়েটিং জোন এ বসে বাকশূন্য রাহিদ। নিঃশব্দে কপোল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু বিন্দু। বাঁ পাশেই বসে ছোট বোন রায়না। ভাইকে জড়িয়ে সশব্দে কেঁদে চলেছে মেয়েটা। মায়ের এ কি হয়ে গেল? ভালো মানুষ দেখে গেল বাড়িতে। সে-ই মা আজ র-ক্তাক্ত অচেতন অবস্থায় সফেদ বিছানায় পড়ে। তার চিকিৎসা চলছে। বাবা নামক মানুষটি এতটা নিচ! পশু! মা’কে একটুও ছাড় দিলো না। কুকুরের মতো…! ক্রন্দন আরো বৃদ্ধি পেল। হাউমাউ করে কেঁদে চলেছে রায়না। রাহিদ কিচ্ছুটি বললো না। বাঁধাও দিলো না। পরিস্থিতি অনুধাবন করে এগিয়ে গেলেন আবেগপ্রবণ মালিহা। ওকে টেনে দাঁড় করালেন। জড়িয়ে নিলেন বুকে। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। ইনায়া স্বল্প দূরত্বে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। নীরবে কাঁদছে। আর কত ঝড় উঠবে তাদের জীবনে?

বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। ইরহামের নির্দেশে পুরো হসপিটাল সুরক্ষিত বলয়ে আবদ্ধ। চারিধারে সতর্ক ভঙ্গিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিরাপত্তা রক্ষীরা। ব্যস্ত ইরহাম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে হসপিটাল কতৃপক্ষের সঙ্গে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কথা বললো। মামীর জন্য সর্বোত্তম চিকিৎসা, সেরা চিকিৎসকের ব্যবস্থা করলো। ইরহাম চৌধুরীর মামী হয় পল্লবী। তার চিকিৎসায় একটুও হেলাফেলা বরদাস্ত করবে না সে। সর্বোৎকৃষ্ট চিকিৎসা নিশ্চিত করে তবেই শান্ত হলো। উঁহু ঠিক শান্ত নয়। এ প্রলয় সৃষ্টিকারী ঝড় ওঠার পূর্বাভাস। অত্যধিক শান্ত। নীরব। দু চোখে তখন আ-গ্নেয়গিরির উত্তাপ। দপদপ করে জ্বলছে রগ। লহমায় ধ্বং স করে দেবে সব। ছাড়বে না একটাও ন:রপশুকে।

.

রাত তখন দশটা বেজে বিশ মিনিট। পল্লবীর শারীরিক অবস্থা এখন অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত। শরীরে অসংখ্য আ’ঘাতের চিহ্ন। আইসিইউতে রয়েছে সে। তার চিকিৎসার দায়িত্বে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এক বয়স্ক ডক্টর। সেরা চিকিৎসাসেবা প্রদান করে চলেছে।

তৃতীয়তলায় কাঁচের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ইরহাম। নভোনীল চক্ষু জোড়া তাকিয়ে বাহিরে। রাতের শহর দেখছে সে। আঁধারে চকচক করে চলেছে তার শুভ্র অবয়ব। বহিরাগত কৃত্রিম আলোকছটা আছড়ে পড়ছে সুঠামদেহে। মস্তিষ্কে এক ঝুড়ি চিন্তার আনাগোনা। মিলছে না একদণ্ড স্বস্তি। প্রহেলিকার মায়াজালে আঁটকে সমস্ত ক্লু। ধরাছোঁয়ার বাহিরে সমস্ত আশার আলো। এ কোনো দুর্ভেদ্য জালে আঁটকে পড়লো সে! যখনই একটু আশার আলো দেখছে তখনই হারিয়ে যাচ্ছে আলোর হাতছানি। নানারকম চিন্তায় জর্জরিত মানুষটি পাশে কারোর উপস্থিতি টের পেল। তাকালো ডানে। দুঃখ ভারাক্রান্ত রাহিদ দাঁড়িয়ে। চোখমুখ লাল। কিছু না বলে ওর পানে বাড়িয়ে দিলো নিজের মোবাইল। ইরহাম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোবাইলটি হাতে নিলো। অতিবাহিত হলো কিছু মুহূর্ত। বি:স্ফোরিত নজরে তাকিয়ে ইরহাম। ইতিবাচক মাথা নেড়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো রাহিদ। নোনাজলে ভিজে যাচ্ছে ইরহামের কাঁধের দিকের পাঞ্জাবি। অবিশ্বাস্য চাহনিতে মোবাইলের পানে তাকিয়ে মানুষটি। অবশেষে ধরা দিলো আলোর হাতছানি! এবার জমবে খেলা।

” আর একটু ধৈর্য ধরো হৃদরাণী। আসছে তোমার ইরহাম। ”

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৯ ( শেষাংশ )

রাতের শেষ প্রহর। নিস্তব্ধতা বিরাজমান সর্বত্র। চন্দ্র লুকিয়ে মেঘের অন্তরালে। চারিধারে পিনপতন নীরবতা। নিশাচর প্রাণী ব্যতীত ঘুমিয়ে সকলে। মাঝেমধ্যে ঝিঁ ঝিঁ পোকার কলরব প্রবেশ করছে শ্রবণেন্দ্রিয়ে। এমন ভূতুড়ে আঁধার হটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দশজনের একটি দল। পড়নে তাদের পুলিশের পোশাক। সমান্তরাল রেখার ন্যায় সাবধানী ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছে তারা। অত্যাধিক সতর্ক তাদের চাহনি। পথপ্রদর্শক হিসেবে সম্মুখে এসপি তাঈফ। তাকে অনুসরণ করে যাচ্ছে বাকি নয়জন। তাদের হাতে পি:স্তল। আগত শত্রুর তরে তাক করে রাখা সেগুলো। একবার দেখা মিলুক, ঝাঁ:ঝরা করে দেবে বুক। মিটিয়ে দেবে শত্রুর নামনিশানা। অন্যদিকে নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলকে গোলাকার ভাবে কেন্দ্র করে গাছপালার আড়ালে আবডালে লুকিয়ে আরো দশজন। ঝোপঝাড় তাদের অবয়ব লুকিয়ে রাখতে ব্যস্ত। রাতের শেষ প্রহরে বইছে মৃদু শীতল হাওয়া। শিরশির করে উঠছে কায়া। চন্দ্র জ্যোতি পিছলে যাচ্ছে দেহে। তাদের দলনেতা হিসেবে উপস্থিত চৌধুরী। ইরহাম চৌধুরী। একজন সাংসদ হিসেবে পুলিশি অভিযানে সে অংশ নিতে পারে না। এ নিয়ম বহির্ভূত। তবে বেপরোয়া এই মানুষটিকে আজ কিছুতেই টলানো গেল না। তার হিমশীতল কণ্ঠে, নভোনীল চক্ষুদ্বয়ের দাপটে ব-শীভূত হলেন পুলিশ কমিশনার। কোনো বাক্যেই মানানো গেল না তাকে। তার মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দমালা, বাক্য ছিল জা-দুকরী। ব-শীভূত করার মন্ত্র। বন্ধুর ছেলে তো। ইরহামের এই বেপরোয়া ভিন্ন রূপটি তার জন্য চমকপ্রদ ছিল! ইরহাম অতি সহজেই নিজ ব্যক্তিত্ব, গোছানো কথাবার্তা দ্বারা তাকে মানিয়ে নিলো। নিরূপায় হয়ে উনি অনুমতি প্রদান করলেন। তবে কড়া কণ্ঠে একটাই উপদেশ দিলেন,

” আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ো না যেন। সাবধান। ”

খুদে বার্তাটি মান্য করে আজ এ মুহূর্তে এখানে, পদ্মার এপার হতে এক কিলোমিটার দূরত্বে পুলিশি অভিযানে উপস্থিত ইরহাম। তার দেহরক্ষীরা কাছাকাছি গুপ্ত অবস্থায় অপেক্ষারত। বসের একটিমাত্র ইশারা। ক্ষুদ্র আদেশ। তারা ঠিক ঝাঁপিয়ে পড়বে। বীরত্বের সহিত অংশগ্রহণ করবে উদ্ধার অভিযানে।

নিশুতি রাতকে গোপন হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সতর্কতার সহিত গন্তব্যস্থল অর্থাৎ একতলা রঙচটা ভবনের কাছে পৌঁছে গেল তাঈফ এবং তার অনুসারীরা। ইরহামের বিশ্বস্ত খোচর হতে প্রাপ্ত গোপন সূত্র মোতাবেক হৃদি এবং অপহৃত আরো কয়েকজন নারী এখানেই বন্দী। এ ভবনেই কাটছে তাদের বন্দী জীবন। আজ রাতটার ই শুধু অপেক্ষা। আগামীকাল সন্ধ্যা নাগাদ তাদের সমুদ্রপথে পা চা র করে দেয়া হবে। তাঈফ এবং তার অনুসারী পুলিশ সদস্যরা ত্বরিত গাছের আড়ালে নিজ অবয়ব লুকিয়ে ফেললো। পাছে কেউ দেখে না নেয়। প্রকাণ্ড উদ্ভিদসমূহ তার দা-নবীয় দেহের আড়ালে লুকিয়ে নিলো এদের। তাঈফ বাহিনী হতে কিছুটা পেছন দিকে বেশ কয়েকটি গাছের আড়ালে অবস্থান করছে ইরহাম বাহিনী। ইরহামের হাতে স্মার্টফোন। থাম্বস আপ দেখিয়ে পাশের জনকে ছোট্ট এক ইশারা দিলো মানুষটি। অতঃপর ফোনের সাথে সংযুক্ত একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ক্ষুদ্র ড্রোন উড়াল দিলো রাতের আঁধারকে সাঙ্গ করে। নিঃশব্দে বিনা বাধায় ড্রোনটি পৌঁছালো ভবনের সম্মুখভাগে। আস্তে ধীরে ঘুরে বেড়াতে লাগলো ভবনের সকল দরজা, জানালার কাছে। ক্যামেরায় ধারণ হতে লাগলো শত্রুদের অবস্থান। তাদের সংখ্যা। অ-স্ত্রের পরিমাণ। ইরহামের পাশে দাঁড়িয়ে একজন এই ড্রোন পরিচালনা করছে। চৌধুরীর ইশারা মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে ড্রোনটি। মিনিট সাতেকের মধ্যে ভবনের হালচাল অবলোকন করা হয়ে গেল। কানে সংযুক্ত ইয়ারবাড। তাতে আলতো টোকা দিলো ইরহাম। গম্ভীর অথচ উদ্দীপ্ত স্বরে পুলিশ রূপী বন্ধুকে বললো,

” বাহিরে আটজন। ভেতরে তিনজন। টোটাল ইলেভেন। লেটস্ ডু ইট ব্রো। ”

তাঈফের ডান পাশে দাঁড়িয়ে এক অফিসার। তার হাতে স্মার্টফোন। ডি.জে.আই অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে দু’টো স্মার্টফোন সংযুক্ত ড্রোনটির সঙ্গে। ইরহাম এবং তাঈফ উভয়েই ড্রোনের মাধ্যমে ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবলোকন করলো। স্বল্প দূরত্ব সত্ত্বেও একে অপরের দিকে তাকালো দুই বন্ধু। তাদের অধরকোণে ফুটে উঠলো দুর্বোধ্য রেখা। অতঃপর! অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো ন্যায়। নির্ভীকচিত্তে এগিয়ে গেল পুলিশ। ইরহাম ও তাঈফ দুই বাহিনীর সদস্যরা একত্রে তুফানি ঝড় উঠালো। এরপরের সময়টা ছিল লো;মহর্ষক! আঘাত পাল্টা আঘাত। ঝড়তে লাগলো র ক্ত। আকস্মিক আক্রমণে খেই হারিয়ে ফেলেছিল শত্রুপক্ষ। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যেই তারা স্বরূপে ফিরে এলো। গো-লাগুলি চলছে বাহিরে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। সাংসদ ইরহাম অ স্ত্র নয় বরং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নিজ স্টাইল অর্থাৎ ‘ ক্রভ মাগা ‘ কৌশল অবলম্বন করে শত্রুদের পরাস্ত করতে মশগুল।
_

রাতের শেষ প্রহর। ঘুমে আচ্ছন্ন দুর্বল বন্দীরা। আকস্মিক ঘুম ছুটে গেল তাদের। ধড়ফড় করে উঠলো বুক। বৃদ্ধি পেল শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ। কানের পোকা যেন উড়ে গেল। হৃৎপিণ্ড উত্তেজিত চরমভাবে। স্বেদজল উপস্থিত ললাট কার্নিশে। গো-লাগুলি! সোজা হয়ে বসলো ওরা। হাত-পা বেঁধে রাখায় এর বেশি নড়তে ব্যর্থ। অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে হৃদি ও বাকিরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। বাহিরে কিসের হট্টগোল! কে বা কারা লড়াইয়ে লিপ্ত? ক্ষণে ক্ষণে গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। তবে কি মুক্তি আসন্ন নাকি নতুন কোনো বিপদের আগমন? বাঁধা হাত-পা মুক্ত করতে প্রাণপণে চেষ্টা করছে মেয়েগুলো। হয়তো তাদের দুর্দিন কেটে যাচ্ছে। উদ্ধারে এগিয়ে এসেছে কোনো বড় হৃদয়ের মানুষ। সৎ মানুষ। তাদের মুক্ত হতেই হবে। অপেক্ষায় যে আপনজন। ফিরে যেতে হবে তাদের তরে।

মহান স্রষ্টার নাম স্মরণ করে হৃদি মোচড়াতে মোচড়াতে হাত-পায়ের বাঁধন খোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। শক্ত বাঁধন। খুলতে অক্ষম সে। ঝাপসা হয়ে আসছে নেত্র জোড়া। কেঁপে কেঁপে উঠছে কায়া। আল্লাহ্ আল্লাহ্ জিকির করতে করতে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে ফেলতে চাইছে মেয়েটা। চামড়া চিঁ’ড়ে বেরিয়ে আসছে র ক্ত। অসীম যন্ত্রণায় ভেতরটা চিঁড়ে ফুঁড়ে যাচ্ছে। দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা। তবুও চেষ্টারত সে। হাল ছেড়ে দেবে না। আজ তাকে সফল হতেই হবে। অন্যথায় চিরকালের বন্দীত্ব, নোংরা জীবন বরণ করতে হবে। অসম্ভব তা। স্বেচ্ছায় প্রাণ দেবে সে। তবুও সম্ভ্রমে বিন্দুমাত্র আঘাত হানতে দেবে না। তার ওপর একমাত্র অধিকার তার হালাল সঙ্গীর। তার ইরহামের। কিয়ৎক্ষণ বাদে গোঙানির মতো ক্ষীণ শব্দ কর্ণপাত হলো,

” ইরহা-ম! ”
_

শত্রুপক্ষ প্রায় কুপোকাত তখনই ঘটলো বিপত্তি। আকস্মিক কোথা থেকে উদয় হলো পনেরো জনের শত্রুদল। তাদের ছোঁড়া অপ্রতিরোধ্য-অপ্রত্যাশিত বু*লেটে ঝাঁ ঝ রা হলো কিছু পুলিশের বক্ষস্থল। র-ক্তক্ষয়ী সং ঘ র্ষে এখন দুর্বল ইরহাম ও তাঈফ বাহিনী। তখনই সন্তর্পণে লুকায়িত দাবার চাল ব্যবহার করলো ইরহাম। বক্র হেসে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,

” দিস ইজ দ্য টাইম অফ চেকমেট! ”

অতঃপর ইয়ারবাডের মাধ্যমে লুকায়িত সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে পেশ করলো ছোট্ট এক খুদে বার্তা,

” কাম। ”

হাতেগোনা অল্প মুহূর্ত। চিতার ন্যায় অকস্মাৎ আড়াল হতে বেরিয়ে এলো। শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ইরহামের দেহরক্ষীরা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তারা দক্ষতার সহিত শত্রু নিপাত করে চলেছে। শত্রুপক্ষ ভেবেছিল তারা একাই চতুর। ভুলে গিয়েছিল বাপেরও বাপ থাকে। তাই তো এই বেহাল দশা। অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে এলো। পাঁচজন পুলিশ সতর্কতার সহিত ভবনটির প্রবেশদ্বার ঘিরে ফেলেছে। সুযোগ পেয়ে এক মুহুর্তও বিলম্ব নয়। ক্ষি-প্রতার সহিত ভবনের ভেতরে প্রবেশ করলো ইরহাম। স্বভাবসুলভ গম্ভীর-শান্ত মানুষটি আজ নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ। বুকের ভেতর চলমান অস্থিরতা-ভয়-আকাঙ্ক্ষা এখন অভাবনীয়। অপরিমেয়। কাউকে বোঝানোর মতো নয়। তার প্রতিটি পদধ্বনিতে হৃৎপিণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। ‘সে’ কি রয়েছে অন্দরে! এতগুলো ঘন্টা, মিনিটের বিচ্ছেদ কি তবে শেষের পথে! দেখা দেবে কি তার হৃদয়ের রাণী! নিশ্চয়ই। তাকে দেখা দিতেই হবে। দিতেই হবে। সুঠামদেহী অস্থির মানুষটি দৌড়ে অন্দরে প্রবেশ করলো। চোখের তারায় ধরা দিলো ভেতরকার পরিবেশ। তিনটে রুম ভেতরে। কোথায় বন্দী তার একান্ত নারী! কোন ঘরে সে! উ:দ্ভ্রান্তের ন্যায় এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে ইরহাম। চারজন পুলিশ দু’টো ভিন্ন রুমে দু’জন করে প্রবেশ করেছে। বন্দীদের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তারা। এলোমেলো পায়ে ডান দিকের ঘরের দোরগোড়ায় উপস্থিত হলো ইরহাম। তৃষ্ণার্ত চোখ দু’টো বন্দীদের মাঝে খুঁজে বেড়াচ্ছে ‘তাকে’। সামনে। পেছনে। মাঝের দিকে। পুলিশ হাত-পা খুলে দিচ্ছে। না। নাহ্। দেখা মিললো না তার। হতাশায় জর্জরিত মানুষটি তপ্ত শ্বাস ফেলে ছুটলো মাঝের ঘরের উদ্দেশ্যে। মস্তিষ্কে রাশি রাশি ভাবনা। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধড়ফড়ানি। জ্বা’লা হচ্ছে বক্ষ মাঝারে। মাঝের ঘরের দোরগোড়ায় শ্লথ পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষটি। স্মরণ করে চলেছে সারা জাহানের মালিক। মহান রব’কে। হৃদি। তার হৃদরাণীর যেন দেখা মেলে! ইয়া আল্লাহ্!

এ ঘরেও পুলিশ উদ্ধার কর্মে লিপ্ত। দুরুদুরু বুকে অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো ইরহাম। সদা কাঠিন্যতায় মোড়ানো হৃদয় আজ ভয়ে কাঁপছে। হ্যাঁ। ইরহাম চৌধুরীও ভয় পায়। হৃদয়ের রাণীকে হারানোর বেদনামিশ্রিত ভয়। আকুল হয়ে এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে চলেছে সে। হঠাৎ কর্ণ গহ্বরে ধাক্কা খেল মৃদু হাওয়া। কেউ ডেকে উঠলো কি! ব্যাকুল হয়ে সারা ঘরময় ঘুরতে লাগলো। কে ডাকলো তাকে! কোথায় লুকিয়ে ‘সে’! হঠাৎ! তৃষ্ণার্ত চক্ষু জোড়ায় পানি জমলো। ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে লাগলো অন্তর্দাহ। মেঘমেদুর মুখখানা লহমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ওই তো। ওই তো বসে তার হৃদি। একান্ত নারী। এদিকেই স্বামীর পানে তাকিয়ে। চোখেমুখে বেদনাময় উজ্জ্বলতা। অশ্রুসজল নয়ন জোড়া তাকে ডাকছে। কাছে ডাকছে। বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে প্রিয়তমার পানে ছুটলো মানুষটি। উপস্থিত সকলে দেখলো এক স্বামীর, এক প্রেমিক পুরুষের পা”গলপারা রূপ। ছুটে গিয়ে হৃদির বিপরীতে হাঁটু মুড়ে বসলো ইরহাম। আনন্দ অশ্রু ঝড়ে পড়ছে দু জোড়া চোখ হতে। সিক্ত হচ্ছে গাল। কেঁপে কেঁপে উঠছে ওষ্ঠাধর। একে অপরের পানে অনিমেষ নেত্রে তাকিয়ে তারা। চোখে অশ্রু ঠোঁটে খুশির ছোঁয়া। কিছু বলতে চেয়েও অপারগ। রূদ্ধ উভয়ের কণ্ঠনালী। হিমশীতল রূপে জমায়েত শব্দমালা। অবশেষে দেখা পেয়েছে তার। হারিয়ে যায়নি সে। তাকে একাকী ফেলে যায়নি সে। ও পৃথিবী! শুনছো তুমি! হৃদরাণী তারে দুঃখ সাগরে ভাসিয়ে যায়নি। প্রিয়তমের বুকে ফিরে এসেছে সে। আকস্মিক একান্ত নারীকে দু হাতে জড়িয়ে নিলো ইরহাম। শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ বেষ্টনীতে বন্দী হলো হৃদি। মানুষটি তাকে বক্ষপিঞ্জরে লুকিয়ে নেবে কি? হাঁ। আড়াল করে নেবে সকল কলুষতা-জটিলতা হতে। একমাত্র মৃ ত্যু ব্যতীত এ বুক হতে ছিন্ন হবে না তার হৃদি। শক্তপোক্ত আলিঙ্গনে দুর্বল দেহটি ব্যথায় চিড়চিড় করে উঠলো। বিকৃত হলো মুখভঙ্গি। তবুও বাঁধা দিলো না মেয়েটি। হাত-পা বাঁধা। অদম্য ইচ্ছে সত্ত্বেও পারলো না স্বামীকে একটুখানি ছুঁতে। গম্ভীর আনন্দ উচ্ছল মুখে পেলব হাত দু’টো বুলাতে। প্রাণ ভরে স্বামী নামক একান্ত পুরুষটিকে দেখতে। ইরহাম তখন আবেগের আতিশয্যে উ;ন্মাদ। প্রিয়তমার সারা মুখ জুড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরশ বুলিয়ে চলেছে। এলোপাথাড়ি ছোঁয়া অঙ্কিত হচ্ছে কোমল ত্বকে। মুক্তির স্বাদ মিললো তবে। ইরহাম এসেছে তার উদ্ধারে। হৃদির উজ্জ্বল মুখখানি ধীরে ধীরে মিইয়ে গেল। তবুও অধরে লেপ্টে তৃপ্তিময় ঝলক। আস্তে ধীরে বুজে গেল মেয়েটির অক্ষিপুট। হালকা স্বরে শুনতে পেল এক আর্তনাদ,

‘ হৃদি! ‘

সুবাহ লগ্ন। আঁধারিয়া আচ্ছাদন হটিয়ে সগৌরবে উদিত হচ্ছে দিনমণি। পদ্মা নদীর নিকটবর্তী স্থানীয় এক হাসপাতাল তখন কড়া নিরাপত্তা বলয়ে ঘেরা। ভেতরে চিকিৎসা চলছে এমপি ইরহাম চৌধুরীর সহধর্মিণীর, বন্দী আরো বেশকিছু নারীর, আহত পুলিশ এবং শত্রুদের। সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য এবং ইরহামের দেহরক্ষীরা। ঢাকা থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আরো সদস্য আসছে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছে যাবে। কেননা উদ্ধারকৃত নারীবৃন্দ ও আহত শত্রুদের একসাথে একই জায়গায় রাখা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বিপজ্জনক। শত্রুপক্ষ যেকোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সাবধানের মা:র নেই।

ওয়েটিং জোনে বসে ইরহাম। কালো মেঘে ছেয়ে মুখখানি। পোশাকে লেপ্টে ধূলোবালি, র-ক্তের ছাপ। উ:ন্মাদের ন্যায় দেখাচ্ছে তাকে। রিমলেস চশমা বিহীন চোখ দুটোয় চরম হাহাকার। দু হাতের করতলে ঢেকে নাকমুখ। ঝুঁকিয়ে রাখা চেহারা। চিকিৎসা চলছে তার স্ত্রীর। বিগত কয়েকদিনের মানসিক অস্থিরতা, দুর্বলতা, অনাহার এবং অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার দরুণ অচেতন হৃদি। তার বাহুবন্ধনেই মেয়েটি বেহুঁশ হলো। স্বচক্ষে দেখলো স্ত্রীর দৈন্যদশা। ভালো নেই তার হৃদরাণী। বিগত কয়েক দিনে প্রচুর কষ্ট সয়েছে। প্রতিকূলতার মধ্যেও রক্ষা করেছে নিজেকে। লড়াই করে বেঁচেছে তার হৃদি। লড়াকু তার একান্ত নারী। সে গর্বিত এমন একজনার জীবনসঙ্গী হতে পেরে। ধীরে ধীরে র-ক্তলাল দু চোখে বাষ্প জমলো। কখন চোখ মেলে তাকাবে মেয়েটি! মাথা এলিয়ে দেবে তার চওড়া বুকে। কখন!

অতিবাহিত হলো কিছু প্রহর। সময়জ্ঞান হারিয়ে বসে ইরহাম। হঠাৎ পাশে এসে দাঁড়ালো তার সিকিউরিটি হেড রুস্তম। বসের পানে মাথা ঝুঁকিয়ে মৃদু স্বরে বললো,

” স্যার। পুলিশ কমিশনারের কল। ”

মোবাইল বাড়িয়ে রুস্তম। ইরহাম ক্লান্ত চোখ তুলে তাকালো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সময় নিয়ে। রুস্তমের খারাপ লাগছে স্যারের অবস্থা দেখে। কিইবা করার আছে! নিরূপায় তারা সকলে। সব এখন আল্লাহ্’র ইচ্ছে। তাদের পূর্ব নির্ধারিত তাকদীর। মুহুর্তের মধ্যেই ইরহাম বদলে গেল। প্রিয়তমার বিরহে উ:ন্মাদ স্বামী হতে রূপান্তরিত হলো এক দায়িত্বশীল নাগরিকে। এক সাংসদ রূপে। মোবাইল হাতে উঠে দাঁড়ালো মানুষটি। মন্থর পায়ে হাঁটতে আরম্ভ করলো। দাঁড়ালো এক নীরব শুনশান স্থানে। কানে ঠেকলো মোবাইল। স্বরূপে ফিরে গম্ভীর স্বরে বললো,

” হ্যালো! আসসালামু আলাইকুম। ”

গুরুত্বপূর্ণ ফোনালাপ সেরে এদিকে এলো এসপি তাঈফ। বন্ধুকে গুরুগম্ভীর স্বরে কথা বলতে দেখে ঈষৎ চমকালো! অবেলায় কার সঙ্গে কথা বলছে! ঠোঁট নাড়িয়ে শুধালো রুস্তমকে কার সাথে কথা বলছে ও। রুস্তমও নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে জবাব দিলো। তাঈফের কপালে পড়লো ভাঁজ। পরিস্থিতি ভালো নয়। দেশব্যাপী এক আলোড়ন সৃষ্টি হতে চলেছে। প্রভাবশালী কিছু নাম জড়িয়ে যে এই কেসে। গোটা বিষয়টা বেশ ভেজাল। জটিল। ক্ষমতার জেরে সবটা ওলটপালট না হয়ে যায়! ন্যায়ের জয় হবে তো আদৌ? নাকি ক্ষমতার অপব্যবহারে ধরাশায়ী হবে সততা-ন্যায়ের পথ!

চলবে.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে