মনেরও গোপনে পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0
329

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#শেষ_পর্ব
(মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)
অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিলো সুমির। পাঁচ দিন পর সুমিকে আজ বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। এই পাঁচ দিন হসপিটালের বেডের পাশে ছায়ার মতো বসে ছিলো শরীফ। মিতুকেও মাঝে মধ্যে সুমির কাছে নিয়ে এসেছিলো। আনন্দে কেঁদে ছিলো সুমি। একটা মানুষ তাকে এতটা ভালোবাসে ভাবতেই শরীর শিউরে উঠে তার। রুদ্র এদিকে তালাকনামা তৈরি করে ফেলেছে। সুমির সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলো এতদিন। সুমিকে দেখাশোনা করতে ফুলবানু আসেন প্রায়ই। আর রহমান তো থাকেনই। এক জীবনে এতটা ভালোবাসে পাবে ভাবতেও পারেনি হতভাগী সুমি।
” তোমার শরীর এখন কেমন আছে সুমি?”
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে রুদ্র মিহিকে নিয়ে সুমির ঘরে এসেছে। সুমি বিছানায় শোয়া ছিলো রুদ্রকে দেখে উঠতে চাইলে মিহি পাশে বসে সুমিকে আবারও শুইয়ে দেয়। ঘরের টিভিটা নষ্ট হয়ে গেছে বলে মিতু বসার ঘরে টিভি দেখছে।
” ভালা আছি ভাইজান। আফনেগো যে ক্যামনে ধন্যবাদ দিমু হেই ভাষা আমার জানা নাই। ”
” ধুরর পাগলি,ধন্যবাদ দেবে কেনো? এটা আমাদের কর্তব্য। আচ্ছা শোনো,তোমার অনুমতি নিয়েই তো শরীফ আমাকে তোমার স্বামীর সাথে ডিভোর্সের কথাটা বলেছিলো। আমার সমস্ত কাজ শেষ। তুমি অনুমতি দিলে কালই তোমাদের গ্রামে যাবো সবুজের সাইন নিয়ে আসতে। ”
” আমার কোনো আপত্তি নাই ভাই। ওই জানোয়ারের জইন্য আমার বাচ্চা মইরা গেছে। ”
মুহুর্তেই ঝাপসা হয়ে গেছে সুমির চক্ষুদ্বয়। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা কোনো মা ভুলতে পারে না কখনো। স্বামী শত অত্যাচার করলেও তাকে হয়তো ক্ষমা করা যায় কিন্তু সন্তান হত্যাকারী স্বামীকে কোনো মা মন থেকে কখনো ক্ষমা করতে পারে না।
” ঠিক আছে। ”
” তয় ও কি সই করবো? মনে হয় না। ও নিশ্চয়ই আমারে এত সহজে মুক্তি দিবো না। ”
” এজন্যই তো সরাসরি আমি যাবো। যাতে টাকাপয়সার লোভ দেখিয়ে কাজটা হাসিল করতে পারি। আমি ভাবছি অন্য কথা। ”
” কী ভাবছেন আপনি আবার? ”
মিহি রুদ্রর চিন্তাযুক্ত মুখাবয়ব দেখে শুধালো। রুদ্র ম্লান স্বরে বললো,
” সুমির বাবা-মা কেমন বলো তো? এমন একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিলো!”
” আসলে ভাইজান তহন আমার বাপের মাথায় খালি একটাই চিন্তা ছিলো। শরীফের লগে বিয়া না হওয়ার চিন্তা। তাই ঠিকমতো খোঁজ না নিয়াই তার লগে বিয়া দিয়া দিলো।”
” সবকিছুর উর্ধ্বে তকদীর বলতে একটা বিষয় আছে সুমি। আমাদের প্রত্যেকের নিয়তি উপরওয়ালা যেমন লিখেছেন তেমনই হবে। এটা ভেবে নিজের মনকে শান্ত করো। ”
” হ আপা।”

” কী করছো?”
খিলখিল করে হাসতে হাসতে আদ্রিয়ানকে প্রশ্ন করলো রাহি। ছেলেটা তখন থেকে রাহির পেটে কান লাগিয়ে বসে আছে। রাহি বিছানায় শুয়ে আছে আর আদ্রিয়ান বসে মাথা ঝুঁকিয়ে আছে।
” বুঝতে পারছো না? আমাদের বেবি কী বলছে সেটা শুনতে চেষ্টা করছি। ”
” তাই বুঝি? তা কী বলছে শুনি!”
” বলছে, আমার বাবার মতো হবো আমি। মায়ের মতো মোটেও দুষ্ট হবো না। ”
” আমি দুষ্ট! ”
রাহি আদ্রিয়ানের পিঠে আলতো ঘুষি মারলো কয়েকটা। আদ্রিয়ান বসা থেকে শুয়ে পড়লো রাহির পাশে।
” তা নয়তো কী? মনে নেই বিয়ের আগে কতো দুষ্টমি করতে? কতোবার আমাকে ভয় দেখাতে মনে আছে? আমি প্রচুর জেলাস ছিলাম বলে প্রায় ছেলে বন্ধুদের নাম নিয়ে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করতে। ”
” সেটা তো মজা করতাম। ”
” হ্যাঁ আমি জ্বলে যেতাম। ”
” আগের মতো তো এখন ভালোবাসো না!”
রাহির দৃষ্টি উপরের দিকে। হঠাৎ মাঝখানের অসময়ের স্মৃতি মনে পড়ে গেছে। না চাইতেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো রাহির বুক চিড়ে। আদ্রিয়ানের কেমন অপরাধী লাগছে নিজেকে। আলতো করে রাহিকে জড়িয়ে ধরে। ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে হাতে হাত রেখে আদ্রিয়ান বললো,
” যা হয়ে গেছে তা কখনো বদলাতে পারবোনা আমি। কিন্তু কথা দিচ্ছি আমৃত্যু আমি তোমার থাকবো এবং ভালোবাসবো। প্লিজ কষ্ট পেও না লক্ষ্মীটি। ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি… ”
” ঠিক আছে হয়েছে। আর বলতে হবে না, এখন ঘুমাও।”
” আচ্ছা। শুভ রাত্রি। ”

সকাল হতেই কুলসুমের বাড়িতে এসেছে সবুজ। বিয়ের জন্য যেনো তর সইছে না। কিন্তু কুলসুমের এক কথা! সুমিকে তালাক না দেওয়া পর্যন্ত সে সবুজকে বিয়ে করবে না।
” সুমিরে আমি কই পামু বল তো কুলসুম? ”
” হেইডা আমি ক্যামনে কমু? আপনার মাথা আপনার ব্যাথা। ”
সবুজ আর কোনো কথা বাড়ালো না। হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো কুলসুমের বাড়ি থেকে। দু-এক দিনের মধ্যে শহরে যাবে সুমিকে খুঁজতে। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করে। বাড়ি ফিরতে প্রায় দুপুর হয়ে যায়। কিন্তু বাড়ির সামনে যেতেই দেখে বড়সড় একটা চার চাকার গাড়ি। চমকায় সবুজ। এতো বড়ো গাড়ি তা-ও তার নিজের বাড়ির সামনে? গাড়ির সামনে যেতেই ভেতরে একজন লোককে কোট,সুট – বুট পরে বসে থাকতে দেখলো। এক নজর তাকিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে যাবে এমন সময় তার নাম ধরে ডাকলো রুদ্র।
” এই যে সবুজ মিয়া!”
লোকটার মুখে নিজের নাম শুনে তো সবুজের বিস্ময় কাটে না। রুদ্র এতক্ষণ নিশ্চিত ছিলো না এই লোকটাই সবুজ। কিন্তু যখন বাড়ির মধ্যে ঢুকতে গেলো তখন বুঝলো। সবুজ আবারও গাড়ির কাছে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো।
” হ আমি সবুজ,তয় আফনে কেডা?”
রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে সবুজের সামনে দাঁড়ায়।
” আমাকে আপনি চিনবেন না তবুও ভদ্রতার খাতিরে পরিচয় দিতে হয়। আমি রুদ্র চৌধুরী, শহরের ডাক্তার। আপনার সাথে জরুরি কথা ছিলো।”
” আমার লগে আফনার জরুরি কথা! আসেন ঘরে আসেন বইয়া কথা কইবেন।”
সবুজের চোখদুটো লোভে চকচক করে উঠলো। শহর থেকে এসেছে তা-ও তার কাছে না-কি জরুরি কাজ! মনে মনে ভাবলো নিশ্চয়ই কয়েকটা টিকটক ভিডিও করে সে ভাইরাল হয়ে গেছে। তাই কোনো বড়ো মানুষ এসেছে কথা বলতে। এসব ভেবে রুদ্রকে নিয়ে নিজের ঘরে বসালো। টিনের ঘরে প্রচন্ড রোদের তাপ দুপরবেলা। রুদ্র গলার টা-ই আলগা করে গরমে হাসফাস করছে।
” তো সবুজ মিয়া যে কারণে এসেছিলাম, আপনার স্ত্রী সুমি ও মেয়ে মিতু এখন আমার বাসায় আছে।”
রুদ্রর কাছ থেকে এ ধরনের কথা আশাতীত ছিলো সবুজের। তাই স্বাভাবিকভাবেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। তবুও কুলসুমের কথা ভাবতেই মন ভালো হয়ে গেলো। এবার তাহলে সুমিকে তালাক দেওয়া যাবে।
” ও ভালা তো। আফনে তারা গিয়া বইলেন আমি তারে মুখে তালাক দিলাম। এক তালাক,দুই তালাক,তিন তালাক।”
সবুজের আচার-আচরণে রুদ্রর রাগ উঠে গেছে। একটা মানুষ এতটা জানোয়ার হয় কীভাবে? এতদিন পরে স্ত্রী, সন্তানের কথা শুনেও একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করালো না কেমন আছে? অবশ্য ভালোই হয়েছে। কোনো ঝামেলা ছাড়া তালাক দিয়ে দিবে।
” এভাবে মুখে বললে তো তালাক হয় না। আপনি বরং এই কাগজে সাইন করে দিন।”
রুদ্র নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো। কিন্তু সবুজ লেখাপড়া জানে না একবারেই। বিষয়টা রুদ্র আগেই আন্দাজ করেছিলো বলে টিপসই এর ব্যবস্থা রেখেছিল সাথে। সবুজ কোনো প্রথম প্রশ্ন না করেই ডিভোর্স পেপারে টিপসই দিয়ে দিলো। রুদ্র আর এক মুহুর্তও দেরি না করে বেরিয়ে আসে সবুজের বাড়ি থেকে। ইচ্ছে করছিলো কয়েক ঘা দিতে। কোথায় শরীফ আর কোথায় এই অসভ্য সবুজ! এসব ভাবতে ভাবতে গাড়িতে বসে ড্রাইভ করতে শুরু করলো রুদ্র।

ডিসেম্বরের রাত! ঢাকা শহরে মোটামুটি শীতের প্রকোপ বেড়েছে। শহরের অলিতে-গলিতে সোডিয়াম আলোর ছড়াছড়ি। জানালা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে শরীর এলিয়ে দিলো রুদ্র।
” লোকটা কতবড় অসভ্য! ”
মিহি বিস্ময় নিয়ে বললো কথাটা। রুদ্র ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে আছে মিহির দিকে। সবুজের কর্মকাণ্ডের কথা শুনে মেয়েটা অবাক হয়েছে।
” হুম। মনে হয় সুমিকে ডিভোর্স দিয়ে বেঁচে গেলো।”
” বেঁচে গেছে সুমি,ওর মতো অসভ্য লোকের থেকে। আমি ভাবতেই পারছিনা! ”
” থাক এসব তোমার ভাবতেও হবে না মিহির দানা। তুমি বরং দেখো তো আমার ঠোঁট কেমন ফেটে গেছে। ”
রুদ্র কনুইতে ভড় দিয়ে শুয়ে আছে। মিহি বালিশ থেকে উঠে রুদ্রকে ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে নিজে তার বুকে শোয়। রুদ্র হাসছে। মিহি জানে এই হাসির মানে কী!
” বয়স তো কম হলো না। তা এতো ঢং কীভাবে করেন?”
” বউয়ের সাথে ঢং করা দোষের কিছু না। ”
” দাঁড়ান আসছি।”
” এই শীতে বুক ছেড়ে কই যাও?”
” আসছি বললাম না।”
মিহি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে পাশের ড্রয়ার থেকে ভ্যাসলিনের কৌটা নিয়ে ফের রুদ্রর পাশে বসলো। রুদ্র আগের মতো শুয়ে আছে। মিহি কৌটা থেকে আঙুলে ভ্যাসলিন নিয়ে রুদ্রর ঠোঁটে ভালো করে লাগিয়ে দিলো। রুদ্র বোকার মতো তাকিয়ে রইলো শুধু।
” এই নিন ডাক্তার সাহেব, আপনার ঠোঁটের চিকিৎসা। ফাটাফাটি বন্ধ হবে এবার।”
” মিহির দানা! ”
” জি বলুন। ”
” তুমি এত দুষ্ট হলে কবে?”
” যেদিন থেকে আপনি ন্যাকামি শুরু করেছেন সেদিন থেকেই। ”
রুদ্র মিহিকে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। গভীর আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো মিহি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেও যখন কাঙ্খিত জিনিস পেলো না তখন তাকিয়ে দেখলো রুদ্র মিটমিটিয়ে হাসছে।
” পাজি লোক একটা। যান আর কখনো আদর করতেই দিবো না। ”
” তুমি পারবে কাছে না এসে থাকতে?”
” বেশ পারবো।”
” কিন্তু আমি তো পারবোনা। আমার একমাত্র বউকে আদর না করে, ভালো না বেসে আমি থাকতেই পারবোনা। ”
” হয়েছে। আপনাকে না বললাম একটা ছাতা কিনে নিতে?”
” কালকে ভিজেছি বলে বলছো?”
” হ্যাঁ। অসময়েও তো বৃষ্টি আসে।”
” তা আসে। আমার ছাতাটা কয়েক বছর আগে খোয়া গেছে। ”
” হারিয়ে গেছে না-কি? ”
ছাতার কথা ভাবতেই মিহির পুরনো স্মৃতি মনে পড়লো। সেই ছাতাটা আজও রাখা আছে ও বাড়িতে।
” আরে না। একজনকে দিয়েছিলো আমার বন্ধু। গাড়িতে ছিলাম। বাইরে বৃষ্টি! এরমধ্যে দেখলাম একজন যুবতী ভিজতে ভিজতে কোথাও যাচ্ছে। হাতেই ছিলো ছাতাটা,শালা আমার হাত থেকে নিয়ে জানালা দিয়ে মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিলো।”
মিহির বুকটা কেমন কেঁপে উঠলো। কী শুনলো এটা? সেই মেয়েটা কী মিহি ছিলো? বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্য মিহি শুধালো,
” তারপর মেয়েটা ফিরিয়ে দেয়নি? ”
” ফেরাবে কী করে বলো! গাড়ি তো থামাইনি। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেছিলো যে মেয়েটা সম্ভবত দেখতে পর্যন্ত পায়নি কে দিয়েছে ছাতা।”
” আপনার বন্ধুর পরনে কী রঙের শার্ট ছিলো?”
” কেনো বলো তো মিহির দানা? ”
” আরে বলুন আগে তারপর বলছি।”
মিহির চোখমুখ কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে। বিষয়টা বুঝতে পেরে রুদ্র আর কালক্ষেপণ না করে বলতে শুরু করে।
” নীল রঙের শার্ট পরে ছিলো আর আমি মেরুন রঙের। ”
মিহির সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। মানুষটা তাহলে রুদ্রর পরিচিত কেউ! মিহির চোখমুখ দেখে রুদ্র প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
” তোমার কী হলো তাতে?”
” ওইদিন ওই মেয়েটা আমি ছিলাম। আপনার ছাতা এখনো যত্নে রাখা আছে। ”
” কী! দারুণ তো। তাহলে ওই বাড়িতে গিয়ে ছাতাটা নিয়ে এসো পরে। ”
” হ্যাঁ যাবো। এখন ঘুমান,রাত হয়েছে অনেক।”
” ঘুমাবো মানে? আজকে একুশে ডিসেম্বর, বছরের সবচেয়ে বড়ো রাত। সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে না?”
রুদ্র হেসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মিহিকে। কিন্তু মিহির মনে অন্য কিছু চলছে। মন আর মস্তিষ্কের মধ্যে লড়াই চলছে তার। রুদ্র তার বর্তমান আর লোকটা কেবল দূরের মানুষ। এসব ভাবনা না ভেবে এই মানুষটাকে নিয়ে ভালো থাকাটাই এখন উচিত।
” কী হলো চুপ করে রইলে কেনো?”
” আপনি আমাকে ভালোবাসেন ডাক্তার সাহেব? ”
” অবশ্যই! বউকে তো ভালোবাসবোই। ”
” আজীবন এভাবেই ভালোবাসবেন তো?”
” নিসন্দেহে। কেবল ভালোবেসে বসে থাকবো না একটা ক্রিকেট টিমও গড়বো।”
মিহি হাসলো মুচকি। আলতো করে রুদ্রর ললাটে চুম্বন এঁকে দিলো। ভালোলাগা আর ভালোবাসা এক নয়। এই মানুষটাকে ভালোবাসে মিহি আর অদেখা মানুষটাকে ভালোলাগে। কিছু ভালো লাগা সারাজীবন মনের গোপনে রেখে দিতে হয়। এক জীবনে সবকিছু পাওয়া সম্ভব হয় না যে!
কয়েকদিনের মধ্যেই সুমি আর সবুজের তালাক সম্পন্ন হয়। সুমির শরীরও আগের চেয়ে মোটামুটি ভালো। মিতুকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে রুদ্র। মিহিও মন দিয়ে সংসার করছে রুদ্রর সাথে। সময় চলছে তার আপন গতিতে। সামনের বৈশাখে সুমি ও শরীফের বিয়ে হবে বলে ঠিক করেছে সবাই। এরমধ্যে মিতু আরেকটু বড়ো হোক,আর সুমিও সুস্থ হোক একেবারে।
কয়েক মাস পর….
রাহির প্রসব বেদনা উঠেছে। প্রথমে নরমাল ডেলিভারিতে হওয়ার জন্য বেশ কিছুক্ষণ বাড়িতে নার্স আনিয়ে অপেক্ষা করেন রিনা বেগম। কিন্তু যখন নার্স বললেন বেবির পজিশন ঠিক নেই তখনই হসপিটালে নিয়ে ছুটলো সবাই। যদিও মিহি শুরু থেকেই হসপিটালে নিতে বলেছিলো। কিন্তু রিনা বেগমের কথামতো বাড়িতে নার্স এসেছিলো। আদ্রিয়ান অপারেশন রুমের বাইরে পায়চারি করছে। বাইরে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। মাগরিবের আজান দিয়েছে। সালমান খুরশিদ বসে আছেন করিডোরের চেয়ারে। মিহি এক পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি করছে। কারণ আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে আগেই জানা গেছিলো বেবির পজিশন ঠিক নেই। কিন্তু মিহির মায়ের খামখেয়ালি কথা, ডাক্তাররা না-কি ওরকম বলে যাতে সিজার করায় পেসেন্ট। আর সিজার করলেই তারা টাকা পায়!
” শোনো মা তোমার এসব আজগুবি কাজকর্মের জন্য যদি ভাবির কিছু হয় তাহলে কিন্তু তোমাকে কখনো ক্ষমা করবে না কেউ। ”
” চুপ কর তুই। কিছু হবে না আমার নাতিনাতনির। রাহিও সুস্থ থাকবে। এখানে ওর বাবার বাড়ির লোকজন আছে এসব আলোচনা বন্ধ কর।”
আসলেই রাহির বোন,দুলাভাই আছে এখানেই। তাই মিহি চুপ করে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার অপারেশন রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আদ্রিয়ান ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো তার সামনে।
” ডক্টর আমার স্ত্রী কেমন আছে? আর বেবি?”
” বেবি মোটামুটি সুস্থ আছে কিন্তু অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। সরি টু সে মি.আপনার স্ত্রী’কে বাঁচাতে পারিনি আমরা।”
আদ্রিয়ানের কানের মধ্যে কেমন একটা ঝিমঝিম শব্দ হচ্ছে। কথাগুলো মনে হচ্ছে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মাথার মধ্যে। কোনো কিছু বলতে পারলোনা সে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো ফ্লোরে। মিহি দৌড়ে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। রিনা বেগম অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে। সালমান খুরশিদ দাঁড়িয়ে রইলেন শুধু। সবাই যেনো একটা ঘোরে আঁটকে গেছে।
” কী বলছেন ডক্টর? আমার বোন আর নেই! ”

রাহির বোন মিথিলা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। মিথিলার স্বামী পারভেজ তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। একটা নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আনতে গিয়ে হারিয়ে গেলো আরেকটা প্রান!

কুলসুম সবুজকে বিয়ে করেনি শেষ পর্যন্ত। শুধু পিছনে ঘুরিয়েছে এতদিন। এজন্য আজ সবুজ রেগেমেগে কুলসুমের কাছে এসেছে।
” তুই আমারে বিয়া করার কতা কইয়া করবি না ক্যান?”
” তোর মতো মাতালরে কেডায় বিয়া করবো? আমি কী সুমির মতো বলদি?”
সবুজ চমকায়! এত বড়ো অপমান?
” কুলসুম তুই নিজে কী? বারোবাতাড়ি মাইয়া একটা তুই। পুরুষ মাইনষেরে ভাইঙ্গা খাস তুই। ”
কুলসুম এগিয়ে এসে সপাটে চড় মারে সবুজের গালে। সবুজ রাগে কটমট করতে করতে কুলসুমকে মারতে যাবে এমন সময় দু’জন পুরুষ এসে মারতে শুরু করে সবুজকে। যখন সবুজের অবস্থা খারাপ হয়ে যায় তখন তারা কুলসুমের কথা মারা বন্ধ করে।
” বলছি না আমি সুমি না। মাইয়াডা ভালো ছিলো বইলা তর মতো বেডার লগে এতো বছর আছিলো। এরপর যদি তরে এই গ্যারামের আশেপাশে দেহি তাইলে পরাণ নিয়া ফিরতে পারবি না।”
সবুজের কিছু বলার মতো সাহস কিংবা অবস্থা কোনোটাই নেই। অনেক সময় নিয়ে কুলসুমের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে সে। পকেটে ভাগ্য করে কিছু টাকা ছিলো বলে গাড়িতে চড়ে বাড়ি ফিরতে সক্ষম হয়। আজ এত বছর পর সুমির গুরুত্ব বুঝতে পারছে সবুজ। কিন্তু কথায় আছে না দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য বোঝে না। তেমনই সময় গেলে আর সাধন হয় না।
সময় গড়ায় তার আপন খেয়ালে। সময়ের সাথে সবকিছুই বদলে যায়। এই গল্পের চরিত্রগুলোর জীবনও সময়ের সাথে সাথে আবর্তিত হবে। কিন্তু গল্পের সমাপ্তি এখানেই টানলাম। পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম সুমি আর শরীফের পরিণতি। তারা নিজের মতো করে সাজিয়ে নিক এদের পরিণয়। আর সদ্য জন্মানো শিশু অর্পার ভবিষ্যতও!

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে