মনেরও গোপনে পর্ব-২৮+২৯

0
261

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৮
(মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)

সবুজ সিগারেটের বাকি অংশ না শেষ করেই মাটিতে ছুঁড়ে ফেললো সেটা। রুহুল কবিরের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ঠিক কিন্তু কিছু না বলেই দোকান থেকে বেরিয়ে গেলো সে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ তার বিপক্ষে। বিকেলের দিকেই পাশের গ্রামে কুলসুমের সাথে দেখা করতে যায় সবুজ। কুলসুম দেখতে সুন্দরী, যথেষ্ট আকর্ষণীয়। আর সেই মোহে মজেছে সবুজ। কুলসুমের বিষয় এই গ্রামে মোটামুটি সবাই জানে। অনেকেই বলে অনেকগুলো বিয়ে করেছিলো সে। আবার অনেক পুরুষের সাথে বিনা বিয়েতেও শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে। এতকিছু সবুজ জেনেও এই মেয়ের জন্যই উতলা হয়ে আছে। অবশ্য কুলসুম কীসের জন্য সবুজকে পাত্তা দিচ্ছে সেটা কারো বোধগম্য হচ্ছে না। কারণ সবুজ তো আর্থিকভাবে সচ্ছল না।
বিকেলের ম্লান রোদ্দুরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে কুলসুম। বাড়িতে সদস্য বলতে কেউ নেই। একা একটা টিনের বাড়িতে থাকে সে। মাঝে মধ্যে লোকের বাড়িতে গিয়ে কাজকর্ম করে কুলসুম। কিন্তু সবাই কুলসুমের সাথে মেশে না।
সবুজ বারান্দায় চেয়ারে বসে একদৃষ্টি তাকিয়ে আছে কুলসুমের পাতলা শাড়ির দিকে। শাড়ি ভেদ করে তার দৃষ্টি এখন কুলসুমের শরীরের ভাঁজে। কুলসুম সবুজের দিকে দৃষ্টিপাত করলো।
” কী দ্যাখতাছেন?”
সবুজ হাসলো। হাসির বদলে কুলসুম ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে সবুজের পাশে এসে বসলো। কুলসুমের কাছে ইশারা পেয়ে সহসাই সবুজ কুলসুমের হাত চেপে ধরে। কুলসুম আলতো করে হাত ছাড়িয়ে নিলো।
” বোঝোস না তুই? আর কতো দূরে দূরে থাকবি! এবার তো কাছে আয়।”
” আমারে পাওন এত্তো সোজা না সবুজ মিয়া। তা আফনের বউয়ের কোনো খবর পাইছেন? ”
সুমির কথা তুলতেই চকিতে মুখ গম্ভীর করে ফেলে সবুজ। মনে হচ্ছে সুমি নামটা এই মুহুর্তে অসহ্য লাগছে।
” জানি না। তয় ও ফিরলেও আমি তালাক দিমু।”
” দেহেন কী করবেন। তয় আমি আবার ভাগাভাগি করতে পারুম না। আমার সব লাগবো। ”
” তয় একখানা সমস্যা আচে।”
” কী সমস্যা? আফনের বউয়ের কাবিনের টেহা বেশি? ”
” আরে না কুলসুম। ওর পেটে তো বাচ্চা এহন। আর হুজুর কইলো এই অবস্থায় তালাক হইবো না।”
” ওওও। ”
কুলসুম বারান্দা পেরিয়ে বাইরে নামে। পিছনে পিছনে সবুজও হাঁটে। দুই গ্রামের লোকজন আড়ালে কানাকানি করে। সুমির মতো ভালো মেয়েটাকে কীভাবে সবুজের সাথে বিয়ে হয়েছিল সেসব নিয়ে কতো কথা।
দিন দিন শরীর খারাপ হচ্ছে সুমির। কিন্তু সেসব সুমি মিহিকে বলে না। কারণ সুমি জানে সবুজের অমানবিক মারধরের জন্য হয়তো শরীরে এত কষ্ট। এমনও হয়েছে রাতে ঠিকমতো তৃপ্তি মেটাতে না পারায় এই অবস্থায় পেটে,পিঠে লাথি মেরে*ছে সবুজ। রাত গভীর কিন্তু চোখে ঘুম নেই। মিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সুমি। দৃষ্টি জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে খোলা আকাশের দিকে। শরীরের এই অবস্থা রুদ্র কিংবা মিহিকে জানানো উচিত। নিজের জন্য না হলেও অনাগত সন্তানের জন্য তো বটেই। সারারাত বালিশে মাথা রেখে এই সিন্ধান্ত নিয়েছে সুমি। তাই সকাল হতেই মিহিকে বলার জন্য ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছে সুমি। রহমান চাচা প্রতিদিনের মতো খাবার তৈরি করে টেবিলে রেখে দিয়েছে। মিতু আগেই খেয়ে নিজের ঘরে বসে টিভি দেখছে। টিভি যন্ত্রটা একেবারে নতুন মিতুর কাছে। তাই এ বাড়িতে আসার পর থেকেই টিভিতে বিভিন্ন কার্টুন দেখছে সে।
” সুমি মা তোমাকে এত অস্থির লাগছে কেনো? শরীর ঠিক আছে তো?”
রহমান চাচা সুমির পাশের চেয়ারে বসলেন। সুমিকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে উনার। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
” আসলে শরীলডা কেমন লাগে ইদানীং। হেই লাইগা আপারে কমু।”
” ওই তো মিহি আসছে। ”
সিড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় সুমির কথাগুলো শুনেছে মিহি।
” তোমার শরীর খারাপ আগে বলোনি কেনো?”
” আগে তো বেশি ছিলো না এইজন্য কমু কমু কইরা কওয়া হয়নাই। ”
” ঠিক আছে। তুমি নাস্তা করে রেডি হয়ে নাও, আমার আজ ক্লাস নেই। তোমাকে নিয়ে হসপিটালে যাবো।”
মিহি নাস্তা খেতে খেতে বললো। রুদ্র কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে। যেদিন মিহির ক্লাস থাকে না সেদিন একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে সে। সুমি তেমন কিছু খেলো না কেবল এক টুকরো পাউরুটি খেয়ে পানি পান করলো।
” আমারে মাফ কইরা দিয়েন আপা। আফনেরে এতো জ্বালা দিতাছি।”
” আরে পাগলি কীসের কষ্ট? যাও মিতুকেও রেডি করো। কিছু জামাকাপড় কিনে দিবো ওকে।”
সুমি কিছু বললো না শুধু কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ঘরে গিয়ে মিতুকে রেডি করে নিজেও বোরকা পরে নিলো। হসপিটালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা বারোটা বেজে গেছে প্রায়। এখানে সব ডাক্তারের রোগীদের সিরিয়াল অনুযায়ী দেখা হয়। কিন্তু মিহি বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই রুদ্রকে সিরিয়ালের ব্যবস্থা করতে বলায় অসুবিধা হয়নি। ডাক্তার তামান্না ইসলামের চেম্বারে বসে আছে মিহি ও সুমি। মিতু শরীফের সাথে বাইরে আছে। তামান্না ইসলাম গাইনী বিশেষজ্ঞ।
” আপনি ডক্টর রুদ্র চৌধুরীর স্ত্রী? ”
তামান্না ইসলাম মিহিকে ভালো করে দেখে নিলেন একবার। সুমির পোশাক-আশাক আর মিহির পোশাক-আশাকের আকাশ পাতাল পার্থক্য। মিহির পরনে মেরুন রঙের দামী থ্রি-পিস আর সুমির আপাদমস্তক কালো রঙের বোরখা দিয়ে আবৃত।
” জি। ”
” রোগী আপনার কী হয়?”
” আমাদের অতিথি। আপনি কাইন্ডলি ভালো করে দেখুন ম্যাম ওর কী সমস্যা। ”
” আপনি গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ুন। আমি আসছি।”
মিহি সুমিকে ইশারায় রোগীর সিটে গিয়ে শুতে বলে। সুমি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলো। ডাক্তার তামান্না সুমির কাছে গিয়ে প্রেশার মাপলেন। চোখ,জিহ্বা দেখলেন। তারপর ফের মিহির পাশে এসে বসলো সুমি।
” মিসেস রুদ্র আমি কিছু টেস্ট লিখে দিচ্ছি এগুলো আজকের মধ্যেই করানোর চেষ্টা করুন।”
” অ্যানিথিং সিরিয়াস ডক্টর? ”
” যেটা আন্দাজ করছি সেটা হলে অবশ্যই সিরিয়াস ইস্যু। যাইহোক নেগেটিভ ভেবে মন খারাপ করবেন না। টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আসুন।”
এমনিতেই সুমি ভীতু তার উপর ডাক্তারের ভারিক্কি কথোপকথনে আরো ঘাবড়ে গেছে। মিহি সুমিকে নিয়ে চেম্বারের বাইরে বেরোতেই রুদ্রকে দেখলো। রুদ্র দাঁড়িয়েছিলো এতক্ষণ।
” ভাইয়া আমার মাইয়া কই?”
” মিতু শরীফের সাথে আছে। বাইরে গেলো একটু আগেই। কী বললেন ডাক্তার? কোনো টেস্ট দিয়েছেন? ”
” আপাতত এই টেস্টগুলো করাতে হবে। আপনিও আমাদের সাথে চলুন।”
” ঠিক আছে চলো। দোতলায় ডায়াগনস্টিক ল্যাব। ”
” ওকে।”
সুমিকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করানোর উদ্দেশ্যে দোতলায় গেলো রুদ্র ও মিহি।

বাসার সামনেই একটা ছোটো পার্ক আছে আদ্রিয়ানদের। সেখানেই স্বামীকে নিয়ে এসেছেন রিনা বেগম। সকালে হুট করেই সালমান খুরশিদ বললেন কতদিন একসাথে হাঁটা হয়নি দুজনের। কথাটা তলিয়ে ভাবতে রিনা নিজেও তার সত্যতা উপলব্ধি করে। তাই রাহিকে বাসায় রেখে দু’জন হাঁটতে বের হয়েছে। অবশ্য বাসায় মর্জিনাও আছে। আদ্রিয়ান অফিসের কাজে কক্সবাজার গিয়েছে গতকাল। রাহিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু মায়ের বারণে আর জোর করেনি আদ্রিয়ান। রাহির অবশ্য তাতে একটু মন খারাপ হয়েছে। কারণ আদ্রিয়ানের সাথে সমুদ্রের পাড়ে হাঁটার সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেছে এবারের মতো। পার্কের এক পাশে বেঞ্চে বসেছেন সালমান খুরশিদ ও রিনা বেগম।
” কী হলো শরীর ক্লান্ত লাগছে? ”
” নাহ মিহির মা। এমনি বসলাম। কেনো জানি আজকে খুব পুরনো দিনগুলো মনে পড়ছে। তোমার মনে পড়ে আমাদের বিয়ের পরে কত ঝগড়া হতো?”

রিনা বেগম হাসলেন। পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতেই হাসির মাত্রা দ্বিগুণ হলো।
” হ্যাঁ সেসব কি ভোলার মতো? আমিই তো ছিলাম সব ঝগড়ার হোতা। তুমি তো কখনো নিজে থেকে সেধে ঝামেলা করতে না।”
” সেইজন্যই তো সবার আড়ালে ঝগরুটে রিনা বলে ডাকতাম। ”
” আচ্ছা আমি কি এখনও আগের মতো ঝগরুটে আছি?”
” ঝগরুটে না থাকলেও কূট বুদ্ধি মাথা ভর্তি।”
রিনা বেগম চোখ বড়সড় করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালে স্বামীর দিকে। সালমান খুরশিদ স্ত্রী’র অঙ্গভঙ্গিতে হাসলেন আবারও।
” এখনো এরকম চোখ বড়সড় করে তাকানোর দরকার কী? আমি তো এখন তোমার অনুচর হয়ে আছি। স্বাধীনতা কাকে বলে বিয়ের পরে আর মনে নেই। মনে হচ্ছে পাকিস্তানিরা তাদের বংশধর রেখে গেছে। ”
আজকে বড়োই ফুরফুরে মেজাজে আছেন সালমান খুরশিদ। রিনা বেগম স্বামীর পাগলামিতে ক্ষেপলেন না। আজ অনেক বছর পর উনি এরকম মজা করছেন।
” হ্যাঁ ভালো হয়েছে। তুমি তো মুক্তিবাহিনীর বংশধর। ”
” থাক থাক মুখ গোমড়া করে রেখো না। চলো বাসার দিকে এগোই। ”
” হুমম রাহি একা আছে, চলো।”

চলবে,

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৯
(মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)

” হ্যাঁ ভালো হয়েছে। তুমি তো মুক্তিবাহিনীর বংশধর। ”
” থাক থাক মুখ গোমড়া করে রেখো না। চলো বাসার দিকে এগোই। ”
” হুমম রাহি একা আছে, চলো।”
” হ্যাঁ চলো। ”
যৌবনের শুরু থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত একে অপরের হাত ধরে এভাবেই পথ চলে এসেছে এই দম্পতি। ভালোবাসা সুন্দর যদি মানুষটা সঠিক হয়। হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান নয় তেমনই পৃথিবীর সকল নারী-পুরুষও এক রকম না। কেউ কেউ আজীবন থেকে যায়, আগলে রাখে।

তামান্না ইসলামের চেম্বারে বসে আছে মিহি ও সুমি। শরীফ মিতুকে বাইরে থেকে বিভিন্ন খাবার খাইয়ে নিয়ে এসে এখন কেবিনের বাইরে অপেক্ষা করছে। রুদ্র যদিও নিজের চেম্বারে রোগী দেখতে গেছে কিন্তু কোনো প্রয়োজন হলে মিহিকে কল দিয়ে জানাতে বলেছে। ডাক্তার তামান্না বেশ মনোযোগ দিয়ে সুমির রিপোর্টগুলো দেখছেন। সুমির চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এতো যন্ত্র তার অচেনা। টেস্ট করার পুরোটা সময় মিহি সাথে ছিলো তার।
” মিসেস রুদ্র, উনার উপর সৃষ্টিকর্তা খুব প্রসন্ন। এজন্য এ যাত্রায় উনার কোনো ক্ষতি হয়নি কিন্তু.. ”
” কিন্তু কী ডক্টর? ”
” কী হইছে ডাক্তার আপা? আমার বাচ্চা ভালা আচে তো!”
সুমির আঁখি যুগল ছলছল করছে। মনের ভেতর কেমন অস্থির লাগছে। মিহি সুমির হাত ধরে শান্ত হতে বলে ইশারায়।
” সরি টু সে,উনার বেবিটা বেঁচে নেই। অনেক আগেই মারা গেছে। কোনো আঘাতের ফলেই এরকম হয়েছে মনে হচ্ছে। এতদিন গর্ভে থেকেও মায়ের কোনো প্রকার ইনফেকশন হয়নি। কিন্তু অনেক বড়ো ক্ষতি হতো পারতো..”
ডাক্তার তামান্না ইসলামের কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো।
” আর কী ক্ষতি হইতো আমার! আমার বাচ্চা যহন বাঁইচা নাই তহন আর আমার বাঁইচা কী হইবো আপা? আমি বাঁচতে চাই না মিহি আপা। মিতুর বাপ আমার বাচ্চা মাইরা ফালাইলো।”
” সুমি শান্ত হও। মিতুর জন্য তোমাকে বাঁচতে হবে। মিতু তোমার মেয়ে। আমি হয়তো মায়ের কষ্ট বুঝতে পারছি না কিন্তু যে আছে তার জন্য না বেঁচে যে নেই তার জন্য কেনো নিজেকে শেষ করবে বোন? মিতুর কি অধিকার নেই ওর মায়ের সাথে বাঁচার? আর সবুজ ঠিক ওর কর্মের ফল ভোগ করবে। আল্লাহ যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্য করেন।”
” আপনি উনাকে একটু শান্ত করুন। বুঝতেই পারছেন এটা হসপিটাল। আপনারা যতো দ্রুত সম্ভব অপারেশন করে বাচ্চাটা বের করান। ”
মিহি সুমির মাথায়, গালে হাত বুলিয়ে শান্ত করলো কিছুটা। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে রুদ্রকে কল দিয়ে সবকিছু বলে। তারপর শরীফ মিহি, সুমি ও মিতুকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। শরীফের মনটাও ভীষণ খারাপ লাগছে। সুমিকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে মোটেও ভালো লাগছে না। কিন্তু তার হাতে তো কিছু নেই। বাড়ি ফিরে মিহি সুমির সাথে সাথে থাকে সারাদিন। মেয়েটার মনটা একেবারে ভেঙে গেছে। দুপুরে খাবার খাওয়ার পরে মিহি নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। সুমিকে এক প্রকার জোরাজোরি করে খাইয়ে দিয়েছে মিহি। মিতুও মায়ের মন ভালো করতে চেষ্টা করছে। বালিশের পাশ থেকে ফোন হাতে নিলো মিহি রাহির কাছে কল দিবে ভেবে । সুমির খবরটা জেনে মিহির মনটা কেমন ভয় ভয় লাগছে। যদিও সুমির বিষয় আলাদা। সবুজের অত্যাচারের ফলেই সুমির বাচ্চা গর্ভে থাকতেই শেষ হয়ে গেছে।
” আসসালামু আলাইকুম ভাবি,কেমন আছো তুমি? ”
” আলহামদুলিল্লাহ মিহি। তোমরা কেমন আছো বলো।”
” এমনিতে ভালোই। তুমি সাবধানে চলাফেরা করবে বুঝলে? আর ভারী কাজকর্ম করবে না। ভাইয়াকে বলে ডাক্তারের কাছে যেও একবার। ”
” আরে পাগলি এইতো কয়েকদিন আগেই ডাক্তারের কাছে গেলাম। কী হয়েছে বলো তো? এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে আছো!”
” সুমির বেবিটা বেঁচে নেই ভাবি। ডাক্তার দ্রুত অপারেশন করে বাচ্চাটা বের করতে বললো আজ।”
” ইশশ! সুমির কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
” না,আল্লাহ সব দিক থেকে কাউকে শেষ করে দেন না। বাড়ি ফিরুক ডাক্তার সাহেব, তারপর আলোচনা করে দেখি কবে অপারেশন করাবেন। ”
” সুমিকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিও তুমি। আর শরীফকেও বলবে সুমিকে সময় দিতে। ”
” ঠিক আছে। রাখছি এখন টেইক কেয়ার। ”
” সেইম টু ইউ। ”
রাতে রুদ্র বাসায় ফেরার পরে সব শুনে ঠিক করে আগামীকাল বিকেলেই অপারেশন করা হবে সুমির। যতো দ্রুত সম্ভব অপারেশন করতে হবে বলেই এত তাড়াতাড়ি অপারেশন করানোর কথা বললো রুদ্র। প্রথমে সুমির মানসিক অবস্থা ভীষণ খারাপ থাকার জন্য অপারেশনের বিষয় খেয়াল ছিলো না। কিন্তু রাত পেরুতেই সুমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেছে। অপারেশন শব্দটা গ্রামে থাকতে শুনলেও এরকম ছুরি দিয়ে পেট কাটবে শুনতে*ই কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে তার। কিন্তু এছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।

” বিশ্বাস করো সুমি তুমি কোনো ব্যাথা টের পাবেনা। এমন মেডিসিন দিবে তখন শরীর অসার হয়ে যাবে। যদিও সেটা কেবল কোমরের নিচ থেকে পা পর্যন্ত। ”

গাড়িতে বসে আছে মিহি ও সুমি। মিতুকে সাথে আনেনি, রহমান চাচার সাথে তাদের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
” আপা আমার খুব ভয় লাগে, আগে তো কহনো এসব কাটাকাটি হয়নাই। ”
” কিছু হবে না সুমি। আমরা তোমার সাথে আছি।”
সামনে থেকে শরীফ বললো। মিহি সুমির হাত ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই হসপিটালে পৌঁছালো ওঁরা। সুমি হঠাৎ হঠাৎ কাঁদছে, অনাগত সন্তানকে নিয়ে কতশত স্বপ্ন বুনেছিল সে। আজ তাকেই এভাবে বের করতে হবে তা-ও মৃত! এসব ভাবতেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মিহির। মাতৃত্বের চেয়ে বড়ো কোনো সুখ মেয়েদের জন্য হয় না। আর যখন সেই সন্তান নিজের শরীরে থাকা অবস্থায় প্রাণ হারায় তখন একটা মেয়ের মন কতটা উতলা হতে পারে তারই প্রমাণ সুমি।
” আর কয়েকটা বিস্কিট দিবো নাতি?”
মিতুকে উদ্দেশ্য করে বললেন ফুলবানু। রহমানের স্ত্রী তিনি। মিতুকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছেন ভদ্রমহিলা। স্বামীর কাছ থেকে সুমির বিষয় সবকিছুই শুনেছেন তিনি। মেয়েটার জন্য খুব আফসোস করেছেন ফুলবানু। রহমান মিতুর জন্য বাইরে থেকে ঝালমুড়ি আর চকলেট কিনে নিয়ে এসেছেন। সেগুলো দেখে মিতু অকপটে বললো,
” আমি ওইগুলান খামু এহন,মুড়ি মাহানো ওইডা আগে দাও। ”
ফুলবানু ও রহমান হাসলেন। শিশুর মন কতটা অবুঝ! মায়ের অপারেশনের কথা জেনেও খেয়াল নেই।
” ঠিক আছে। ফুলবানু তুমি ওগুলো ওকে খেতে দ্যান।”
” হ্যাঁ দিচ্ছি। ”
ফুলবানু কাগজের ঠোঙা থেকে ঝালমুড়ি বের করে একটা বাটিতে করে সেগুলো মিতুকে খেতে দিলো। মিতু হাসি হাসি মুখ করে সেগুলো নিয়ে খেতে শুরু করলো। ফুলবানু মিতুর কাছ থেকে সরে রহমানের পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বললেন,
” মিহি মা’কে একবার কল দিয়ে দেখতেন, অপারেশন কতদূর হলো।”
রহমানের নিজেরও বেশ চিন্তা হচ্ছে।
” হ্যাঁ দিবো একটু পর। অপারেশন শুরু হলো আধঘন্টা হবে। ”
” ঠিক আছে। ”
ফুলবানু আবারও মিতুর পাশে গিয়ে বসলেন। হঠাৎ মিতুর মায়ের কথা মনে পড়তেই চোখমুখ মলিন হয়ে গেছে। খাবার পাশে রেখে অস্থিরতা মিশ্রিত নয়নে রহমানের দিকে তাকিয়ে বললো,
” নানা আমারে মায়ের কাছে নিয়া চলেন তো। মায়ের অপারেশন হয়নাই এহনো? নানা অপারেশনে কী হয়!”
রহমান নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে মিতুর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
” অপারেশন করলে মা সুস্থ হয়ে যাবে। একটু পরেই মায়ের কাছে নিয়ে যাবো তোমাকে। তুমি চিন্তা না করে খাওয়া শেষ করো।”
” জানেন নানা, গ্যারামে থাকতে মায়েরে আব্বা কত মারতো। আমার খুব কষ্ট হইতো তয় কিচ্ছু করবার পারতাম না। এইহানের সবাই কত্ত ভালা! আফনেরা,ওই বাড়ির সক্কলে তারপর শরীফ চাচায়।”
ছোটো মেয়েটির কথা বলতে বলতে চোখমুখ হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ফুলবানুও মিতুর পাশে বসে। শ্যামবতী বললে কোনো ভুল হবে না মিতুকে। ডাগর ডাগর আঁখি যুগল তার। মায়ের মতো হাসলে গালে টোল পড়ে।
” ওসব ভেবে কষ্ট পেও না। এখন তো আমরা সবাই আছি।”
” হ নানী। আপনি ওই বাড়ি যাইয়েন,আমরা একলগে ঘুরতে যামু।”
” ঠিক আছে। তোমার মা সুস্থ হোক তারপর সবাই একসাথে ঘুরবো পাঁকা মেয়ে। ”
মিতু শেষ মুঠো ঝালমুড়ি মুখে পুরে হ্যাঁ বোধক ইশারা করে মাথা নাড়িয়ে।
চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে