ভুল সত্য পর্ব-১৪

0
106

ভুল সত্য
১৪

দরজা খুলে আমি যতটা না অবাক হলাম খুশি হলাম তার চাইতে অনেক বেশি। রেহানা আন্টি কতদিন পর বাসায় এসেছে। আমি উকি দিয়ে তিথিকে খুঁজতে লাগলাম। আন্টি হাসতে হাসতে বললেন

ও আসছে একটু পরেই
আমি হরবর করে অনেক কথা বলতে লাগলাম। তারপর আন্টিকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলাম। উনি আশেপাশে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললেন

তোর শাশুড়ি কোথায়?
ঘরে। একেবারে নামাজ গোসল শেষ করে খেতে আসবেন। তুমি আমাদের সঙ্গে খাবে তো?
খাব। তিথি আসুক তারপর একসঙ্গে খাবো। রান্না কি তুই করলি নাকি?
হ্যাঁ আজকে আমার ক্লাস ছিল না। আমি রান্না করেছি
রেহানা আন্টি ভুরু কুচকে বললেন
প্রতিদিন তোকে রান্না করতে হয় নাকি?
কাজের একটা মহিলা আসে। আমার ক্লাস থাকলে ওই করে।
কে? নাজু?
হ্যাঁ তুমি দেখি সবকিছুই জানো
আরে, নাজুকে তো আমি ব্যবস্থা করে দিয়েছি
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। তবে যে তাদের দুজনের মধ্যে খুব আঁতাত চলছে এখন। তার কি?
উনি মনে হয় আমার মন পড়ে ফেললেন। বললেন
আমি বলেছি বেশি ঝগড়া ঝামেলা না করে একটু বন্ধুত্ব করে নিতে।
বন্ধুত্ব? মানে এখন ওদের দুজনের মধ্যে যেটা চলছে তুমি সেটাও জানো?
জানব না কেন? ওই যে তোর শাশুড়ির বস্তা ভরে ওকে খাবার দিয়ে দিচ্ছে ওইটা তো?
আমি আবারো অবাক।
তোর শাশুড়ি নিজেকে খুব বুদ্ধিমতী মনে করে। সে বুদ্ধিমতী এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে বাকিদের বোকা ভাবে এটা ঠিক না
একটা ব্যাপার অবশ্য আমিও লক্ষ্য করেছি; আমার শাশুড়ি অন্যদের সঙ্গে যতই ঝামেলা করুক না কেন রেহানা আন্টিকে কেমন একটু সমীহ করে। আন্টির ব্যাপারটাও অদ্ভুত ওনাকে ভাবি না ডেকে কেমন কোন সম্বোধন এড়িয়ে যায়। এমনকি আপনি তুমিও বলে না। কথাবার্তা হয় ভাববাচ্যে। ওনার আচরণটা আবার সম্পূর্ণই বিপরীত। উনি রেহানা আপা আর আপনি আপনি বলে নিজেকে ছোট প্রমাণ করার একটা চেষ্টা সবসময় চালিয়ে যান। আন্টি অবশ্য এতে বিরক্ত না হয়ে বরং খুশি হন।
তুই গোসল করেছিস?
করেছি সকালে একবার এখন আবার করব। কথাটা বলেই মনে মনে জিভ কাটলাম। এত ডিটেলে না বললেও চলবে।
চল তো, তোর ঘরে গিয়ে দেখি ঘর কেমন সাজিয়েছিস।
আমি আন্টিকে নিয়ে উপরে যাওয়ার সময় দেখলাম আমার শাশুড়ির ঘরের দরজা বন্ধ। আন্টির কাছ থেকেই জানতে পারলাম তিথি একজনের সঙ্গে দেখা করতে কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে গেছে। আমাদের বাড়ির কাছেই ধানমন্ডি সাতাইশে। ছেলেপক্ষ ওদের বাড়িতে এসে আনুষ্ঠানিক দেখাদেখি করে গেছে।। আজ ছেলের সঙ্গে আলাদা কথা বলবে তাই একটা রেস্টুরেন্টে বসেছে। আমাকে বলেছিল আগে। ইস! একদম ভুলে গেছি। কি যে হয়েছে আমার, নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে আছি। তাকিয়ে দেখলাম আন্টি কেমন জহুরীর মত চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর বলল
মুকুলের সঙ্গে তোর সব ঠিকঠাক চলছে?
আমি একটু লজ্জা পেয়ে বললাম, হু
উনি আর কথা বাড়ালেন না। বললেন
যা তাড়াতাড়ি গোসল করে আয়। তিথি চলে আসবে, টেক্সট করেছে।
আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম। অন্তত মায়ের মতন করেনি। গত মাসে মায়ের ওখানে গিয়েছিলাম এক শুক্রবারে। সেদিন মুকুল আমাকে নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়েছিল। আমরা বাইরে সকালের নাস্তা করে একটু রিক্সা করে ঘুরলাম। ফুলার রোড শহীদ মিনার ওই দিকটাতে। তারপর মুকুল বলল
তুলি তোমাকে একটু তোমাদের বাসায় নামিয়ে দেই? অনেক দিন তো যাও না
আমি বুঝলাম নিশ্চয়ই তার অন্য কোথাও যাবার আছে। তার তো আবার বন্ধুর অভাব নেই। আমি বললাম
আজ কোন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন? নার্সারিতে যাদের সঙ্গে পড়েছেন?
ও একটু লজ্জা পেয়ে বলল
না মানে অনেকদিন ধরে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় না তো; তাই ওরা খুব করে ধরেছে। বেশি সময় লাগবে না আমি লাঞ্চের পর তোমাকে ওখান থেকে পিক করে নেব, তারপর সারা বিকেল ঘুরবো। কেমন?
ওর কৈফিয়ৎ দেয়া দেখে আমি হেসে ফেললাম। বেচারার জন্য একটু খারাপই লাগলো। আমার জন্য ওর স্বাধীন জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল অথচ আমার সঙ্গেও সুবিধা করতে পারছে না।

অসময়ে আমাকে দেখে মা ভীষণ খুশি হয়ে গিয়েছিল। কি খেতে দেবে, কি রান্না করবে এই নিয়ে কতক্ষণ ছুটাছুটি করলে। আমি বিরক্ত হয়ে একসময় বললাম
কি শুরু করলে
ঠিক আছে চুপচাপ বসতো একটু কথা বলি
কি কথা?
দেখি এদিকে তাকা।, তুই কি মোটা হয়েছিস? চোখের নিচে কালি পড়েছে
কি সব অদ্ভুত কথা বলছো।
মুকুল কি তোকে খুব বিরক্ত করে?
না তো। বিরক্ত করবে কেন?
এরপর আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলল
খবরদার পিল খাবি না।
আমি এতক্ষণে মায়ের কথা সারমর্ম বুঝতে পারলাম। লজ্জায় আমার সারা শরীর লাল হয়ে গেল। কোনমতে বললাম
এসব কি বলছো মা?
কি আবার বলছি? বিয়ের পর এত লজ্জা পেতে হয় না। বিয়ে হয়ে গেলে মায়েরা বন্ধুর মতন হয়ে যায়, তাদের সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করা যায়। তুই আমাকে সব বল।
আরে আজীব তো। কি বলবো?
সব খুলে বল। দেখ পুরুষ মানুষ ঘরেরটা না পেলে কিন্তু তখন বাইরেরটা খুঁজবে। মা হঠাৎ করেই পুন পুন করে কান্না শুরু করল, তারপর বলল
আমি চাই না তোর জীবনটা আমার মতন হোক।

মায়ের উপর রাগ হলেও সেদিন আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। কতবার যে মাকে বলেছি এসব ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যেতে। কিন্তু ওই। লোকে কি বলবে, তার কলিগদের কাছে কি করে মুখ দেখাবে। এসব বলেই আমার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।
বিয়ের আগেও আমি মাকে এই কথাটা বলেছিলাম যে আমার জীবনটাও তো তার মতোই হতে পারে। কিন্তু মা মানেনি। রেহানা আন্টির উপর তার অগাধ বিশ্বাস। উনি যখন বলেছেন ছেলে ভালো তার মানে অবশ্যই ভালো। রেহানা আন্টিকে অবশ্য আমিও ভীষণ বিশ্বাস করি। আমার ভীষণ কঠিন একটা সময় উনি আমার পাশে ছিলেন।

এখনো মনে আছে আশরাফ চাচার ঘটনাটার পর আমি ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিলাম। কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারছিলাম না। শুধু তিথিকে বলেছিলাম।প্রমিস করিয়েছিলাম যেন কাউকে না বলে। তিথি অবশ্য সে প্রমিস রাখেনি। ওর সাথে এজন্য আমার ঝগড়া ও হয়েছিল অনেক। তবে এখন বুঝতে পারি ভাগ্যিস ও প্রমিসটা রাখেনি। । ও যেদিন আমাকে বলেছিল ও মাকে সব বলে দিয়েছে আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম কোনদিন আর ওর সঙ্গে কথা বলবো না। সবাই আমার বিশ্বাস ভেঙেছে । এই পৃথিবীতে সবাই।

এর কদিন পর এক দুপুর বেলা রেহানা আন্টি বাড়িতে এসেছিলেন। সে সময় একা বাসায় থাকতে আমার ভীষণ ভয় করত কিন্তু উপায় ছিল না। মার ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমার স্কুলেও যেতে ইচ্ছা করত না। আমি দরজা বন্ধ করে বসে থাকতাম। কেউ এলে দরজা খুলতাম না। আন্টিকে দেখে অবাক হয়েছিলাম খুব। কথা বলতে না চাইলেও উনি কি করে যেন আমার ভেতর থেকে কথাগুলো টেনে বের করে নিয়ে আসলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো ওনার সঙ্গে কথা বলে খুব হালকা মনে হয়েছিল নিজেকে। একমাত্র উনিই মনে হয় আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিলেন আমাকে বলেছিলেন
তুই যা করেছিস একদম ঠিক করেছিস। মেয়েদের নিজের সেফটি নিজেকেই দেখতে হয়। কোন রাজপুত্র এসে উদ্ধার করবে কিংবা তোর হয়ে অন্য কেউ কিছু করবে এই আশায় থাকবি না। সবসময় চোখ কান খোলা রাখবি। বুঝেছিস? আর এখন থেকে স্কুলের পর আর বাড়িতে একা থাকার দরকার নেই। তিথির সঙ্গে আমাদের ওখানে চলে আসিস। ঢাকা মেডিকেল তো আমাদের বাসার কাছেই ফেরার সময় তোর বাবা তোকে নিয়ে যাবে।

সেই রেহানা আন্টি আমার ব্যাপারে সবকিছু জানা সত্ত্বেও যখন আমার বিয়ের কথা তুললেন আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। রাগ হয়েছিল খুব তার উপর। কিন্তু উনি অনেক বুঝিয়েছিলেন। আমাকে ডেকে নিয়ে আলাদাভাবে অনেক কথা বলেছিলেন
বিয়ে তো একদিন তোকে করতেই হবে, আজেবাজে কোন ছেলের হাতে পড়ার থেকে মুকুলকে বিয়ে কর। ও খুব ভালো ছেলে। আমি ওকে ভালো করে চিনি।
আমার বিশ্বাস হয়নি। আমি বলেছিলাম
সবাই এমন বাইরে থেকে ভালোই হয়। তুমি কি আর তার ভেতরের রূপটা জানো? ও তোমার ভাইয়ের ছেলে তাই হয়তো তোমার তাকে ভালো মনে হচ্ছে। পৃথিবীর সব ছেলেরাই এমন। সবাই তো কারো না কারো ভাই, বাবা, বোনের ছেলে।
আন্টি হেসে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, একদিন বুঝবি।

মুকুল ফিরল অনেক রাতে। আজকাল প্রায়ই রাত করে ফেরে। অফিসে নাকি কাজের অনেক চাপ। সামনের সপ্তাহে ওর কনফারেন্স। কনফারেন্সের জন্য চিটাগাং যাচ্ছে তিনদিনের জন্য। আমাকে বলেছিল মায়ের ওখানে গিয়ে থাকতে আমার ইচ্ছা করেনি। আমি বলেছি এখানেই থাকবো। তাছাড়া কনফারেন্সের পর ও দশ দিনের ছুটি নিয়েছে। আমরা মালয়েশিয়া যাচ্ছি। বিয়ের পর কোথাও যাওয়া হয়নি তাই একবারে ছুটি জমিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি আগে কখনো মালয়েশিয়া যাইনি।

দুপুরে তিথিদের সঙ্গে অনেক খাওয়া-দাওয়া করেছি বলে আমি আর রাতে কিছু খাইনি।। মুকুল ও বলল দেরি হয়েছে বলে অফিস থেকে খাবার দিয়েছে। ওর খিদে নেই। ঘরে ঢুকে একবারে গোসল করতে চলে গেল। । আমি সব গুছিয়ে ঘরে এসে দেখলাম ওর ফোন বাজছে। দেখার আগেই বন্ধ হয়ে গেল। মুকুল নতুন ফোন কিনেছে। একদিন আমি দেখছিলাম তখন লক্ষ্য করলাম ফোন লক করা। আমার একটু রাগ হয়েছিল। ফোন লক করে রাখার কি মানে? আমি কি ওর ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করব। আমি এই কথা ওকে বলেছিলাম ও। তখন বলেছিল
তোমার জন্য করিনি। তুমি চাইলে তোমাকে কম্বিনেশন বলে দেব। আমার কলিগরা গ্যালারি থেকে ছবি দেখে। আমার ভালো লাগে না সেটা।
এটা অবশ্য ঠিকই বলেছে। মুকুল আমার অনেক ছবি তুলে দেয়। সেসব ছবি অন্য কেউ দেখছে ভাবতে আমার ও ভালো লাগে না।
ফোনটা আবারো বাজছে। আমি কাছে গিয়ে দেখলাম শাওন নাম উঠে আছে। এই শাওন টা আবার কে? ভাবতে ভাবতেই ফোনের স্ক্রিনে একটা মেসেজ ভেসে উঠলো। মেসেজটার দিকে তাকিয়ে আমার সারা শরীর জমে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। এমনটাই যদি হবে তাহলে কেন আরো আগে হলো না। এভাবে আমার বিশ্বাস ভাঙার কি অর্থ ?

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে