ভুল সত্য পর্ব-১৩

0
104

ভুল সত্য
১৩

মুকুল আজকাল কেমন সিনেমার নায়কদের মতন আচরণ করছে। হুটহাট জড়িয়ে ধরছে। আলটপকা চুমু খাচ্ছে। কাজে বেরুনোর আগে তো যা করছে সেটা বলার মতো না। ওর এইসব আচরনে আমার বিরক্ত হওয়া উচিত, রাগ হবার কথা কিন্তু অদ্ভুত ব্যপার হল আমার রাগ হচ্ছে না বরং ভালো লাগছে। আশ্চর্যের কথা হল ও এমন না করলেই অস্বাভাবিক লাগছে। এটা খুবই খারাপ লক্ষণ। এতে একধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়, যেটা পূরণ না হলে হতাশা জন্মায়।

আমি এসব থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে চাই। নিজেকে প্রতিদিন বোঝাচ্ছি এসব আর কিছু নয়, অভ্যাস মাত্র; কিংবা বলা যায় এক ধরনের চাহিদা। মুকুল যখন আমাকে বাইরে খেতে নিয়ে যায়, আমি কি খাচ্ছি না? খাবারটা যেমন একটা চাহিদা সেই রকম শরীরেরও নিজস্ব কিছু চাহিদা আছে। এর বেশি তো কিছু নয়। এর বেশি কিছু হলেও আমি সেটা ভাবতে চাই না। চাইনা মনের মধ্যে কোন দুর্বলতাকে স্থান দিতে। চাইনা আবার নতুন করে কারো প্রতি বিশ্বাস তৈরি করতে। সত্যি কথা বলতে আরেকবার ঠকতে চাই না।

অনেক রাত হয়েছে। আজ খুব শখ করে পুরনো কতগুলো সুতি শাড়ি হাতে ধুয়ে দিয়েছিলাম। আমি আর তিথি এই শাড়িগুলো বঙ্গবাজার থেকে কিনেছিলাম। বঙ্গবাজার মার্কেটটা তিথিদের বাড়ির একেবারেই কাছে।। ক্লাসের শেষে আমরা দুজন প্রায়ই ওদের বাসায় চলে যেতাম। পথেই মার্কেটে ঢু মারতাম। এত কম দামে এত সুন্দর সুন্দর শাড়ি; মোটামুটি আমাদের পকেটে মানির টাকা দিয়েই হয়ে যেত। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে পহেলা ফাল্গু্‌ন একুশে ফেব্রুয়ারি সব উপলক্ষেই শাড়ি কিনতাম। বিয়ের পর এখানে আসার সময় এগুলো নিয়ে আসতে পারিনি। মা কাল বস্তা ভরে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমার একটু সুচিবাই এর মত আছে। সব শাড়ি গুলো আজ ধুয়ে দিয়েছি। ছাদে মেলতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম ওদের ছাদটা বেশ সুন্দর। আমি বিকেলে কিছুক্ষণের জন্য যাই। শাড়ি গুলো বিকেলে ছাদ থেকে নিয়ে এসেছি। গুছিয়ে রাখা হয়নি। আলমারিতে
শাড়ি গুলো রাখতে গিয়ে মনে পড়ল বিয়ের পর মুকুল আমাকে কয়েকটা শাড়ি কিনে দিয়েছিল। সে সময় খুলে ও দেখিনি। আজ বের করে নিয়ে বসলাম। দুটো গোলাপি আর একটা সবুজ রঙের। গোলাপি রং আমার দু চক্ষের বিষ। ছোট বেলায় মা আমকে সারাক্ষণ গোলাপি জামা পরিয়ে রাখত।

আমি সবুজ শাড়িটা খুলে দেখলাম। ঘন সবুজ রঙ্গে কালো পাড়। নরম বাটিকের সুতি শাড়ি। আমি খুব যত্ন করে পরলাম। ঘন করে কাজল দিলাম চোখে। আয়নার সামনে দাড়িয়ে কয়েকবার নিজেকে বললাম
ওকে খুশি করার জন্য পরিনি। পড়তে ইচ্ছা হয়েছে তাই পরেছি।
মনে হচ্ছে কিছু একটার অভাব। ছোট করে একটা কালো টিপ দিলাম। হ্য, এবার ঠিক আছে। সব শেষে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম। সাড়ে নয়টা বাজে। ও তো সাতটার মধ্যেই চলে আসে। দেরী হলে ফোন করে। আজ কি হল?

আমি নিচে নেমে গেলাম। পুরো বাড়িটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। আমার শাশুড়ি নতুন ডায়েট শুরু করেছে। আটটার সময় গ্রিন জুস আর ডিম খায়। রাতে খাবারের সময় আমাদের সঙ্গে দুধ আর ওটস নিয়ে বসে। আজ আটটার সময়ই খেয়ে শুতে চলে গেল আমাকে বলে। আমি কয়েকবার ফোন দিলাম, মুকুল ফোন ধরল না। আমার কেমন কান্না পাচ্ছে। বাইরে শো শো শব্দে ঝোড়ো বাতাস দিচ্ছে। এত দেরী হচ্ছে কেন? কোন বিপদ হয়নি তো?

মুকুল ফিরল সাড়ে দশটার দিকে। আমাকে দেখে ভুরু নাচিয়ে বলল
কি? রাত বিরাতে এত সাজগোজ করেছ কি আমার জন্য?
রাগে আমর ইচ্ছা করছিল ওর উপর ঝাপিয়ে পড়তে। আমি ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম
ফোন ধরছিলেন না কেন?
ফোন ভেঙে গেছে
আমি ভুরু কুচকে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকালাম
সত্যি। এই দেখো
তাকিয়ে দেখলাম ফোন আসলেই ভাঙ্গা
ভাঙল কেমন করে?
মুকুল টাই খুলতে খুলতে চেয়ারে বসে বলল
সে অনেক কথা। পরে বলব। আগে এদিকে এস তো। তোমাকে একটু দেখি
আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। একে তো দেরী করে এসেছে আবার বলছে ও না কিছু ঠিকমত উল্টো ঢং দেখাচ্ছে।
আমাকে দেখার কি আছে?
বাহ! নিজের বউকে দেখব নাতো কি পাশের বাসার মেয়েকে দেখব
আমার ভেতরটা হঠাত জ্বলে উঠল। আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম
অন্য কোন মেয়ের দিকে যদি তাকান তাহলে কাটা চামচ দিয়ে চোখ তুলে নেব।
মুকুল কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর হো হো করে হাসতে শুরু করল। আমার হঠাতই কেমন লজ্জা করতে লাগল। আচ্ছা ও কি ভাবল। অন্য মেয়ের কথা শুনে আমি জেলাস। ব্যপারটা তো তা নয়। একজন বিবাহিত পুরুষ অন্য মেয়ের দিকে চোখ দিচ্ছে বিষয়টাই তো অশ্লীল। কিন্তু এখন ওকে এটা কে বোঝাবে। ধুর! কি বলতে যে কি বলে ফেলি।
আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম
খাবার গরম করছি
ও আমার একটা হাত ধরে বলল
আচ্ছা শোনো। একটু পরে খাই। চল ছাদে যাই
আমি অবাক হয়ে বললাম
কেন? এখন তো বৃষ্টি পরছে।
এজন্যই তো
চল বৃষ্টিতে ভিজি
বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলে আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে।
একদিন ভিজলে কিছু হবে না
না।
আচ্ছা ঠিক আছে আমি রেইন কোট পরে নিচ্ছি
সেটা খুবই হাস্যকর হবে
কিচ্ছু হবে না। চলো তো
না এখন না
মুকুল আমার কথা শুনল না। জোর করে ছাদে নিয়ে গেল।আজকের বৃষ্টিটা একেবারেই অন্যরকম। কতদিন পর বৃষ্টিতে ভিজলাম। আমি ইচ্ছা করেই ওকে আমার সঙ্গে ভিজতে দিলাম না। চিলেকোঠার ঘরের সামনের সেডটার নিচে দাড়িয়ে থাকতে বললাম। অনেক অনেকদিন পর এমন নিশ্চিন্তে মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজলাম। চোখ বুজে আকাশের দিকে মুখ করে অনেকক্ষণ ভিজলাম। হঠাৎই গালে কারো হাতের স্পর্শ টের পেলাম। আমার ভয় করলো না। যেন এ স্পর্শ আমার অনেক দিনের চেনা। চোখ মেলে দেখলাম ও কেমন ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

উত্তপ্ত দীর্ঘ চুমু। অনেকটা সময় পর মুকুল খুব আস্তে আস্তে বলল, চলো ভেতরে যাই, আর ভিজতে হবে না। আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো আমাকে নিচে নিয়ে যাবে কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ও আমাকে চিলেকোঠার ঘরটাতে নিয়ে গেল। পুরনো দিনের রঙ চটা একটা বেতের সোফা রাখা ওখানে। আমি ওটাতেই বসলাম। ও আমার হাতে চায়ের মগ দিয়ে পাশে বসতে বসতে বলল
তোমাকে এরকমই বৃষ্টির দিনে প্রথম দেখেছিলাম
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম
হ্য, মনে আছে
ও খুব অবাক হয়ে বলল
তোমার সত্যিই মনে আছে?
থাকবে না কেন? এইতো সেদিনের কথা

মুকুল হাসছে। কেন হাসছে বুঝতে না পেরে আমি বললাম
হাসছেন কেন?
ও হাসি থামিয়ে বলল
তোমাকে আমি প্রথম তিথিদের ছাদে দেখিনি। দেখেছিলাম আরো প্রায় বছরখানেক আগে। তুমি শহীদ মিনারের সামনে একটা ছোট কুকুর ছানা কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছিলে।
আমার শরীর কেমন শিরশির করে উঠলো। সেদিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমি ঢাকা মেডিকেলে বাবার কাছে গিয়েছিলাম। মেডিকেলের গেটেই ছোট কুকুরছানাটাকে দেখে এত কষ্ট হলো যে তুলে নিলাম। বাবাকে এত করে অনুরোধ করার পরও বাবা রাজি হলো না ওকে আমাদের সঙ্গে রাখতে। আমি তখন ওকে নিয়ে কি করি? বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে, ভাবলাম ওকে তিথিদের বাসায় দিয়ে আসি। ওদের বাসায় তো আরো কিছু কুকুর আছে। বেরিয়ে কোন রিক্সা ও পাচ্ছিলাম না। শহীদ মিনার পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম। এত কান্না পাচ্ছিল। কেন ওকে আমাদের সঙ্গে রাখতে পারব না? হঠাৎ করেই কোত্থেকে একটা ছেলে এসে আমাকে বলল
কি হয়েছে খুকি? কোন সমস্যা? তোমার কোন সাহায্য লাগবে?
আমার এত রাগ হয়েছিল। মনে হয়েছিল ছেলেটা গায়ে পড়ে কথা বলতে এসেছে। নিশ্চয়ই কোন বদ মতলব আছে। খুব খারাপ ব্যবহার করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা রিক্সায় উঠে গিয়েছিলাম। কি অদ্ভুত! ওটা মুকুল ছিল? আমি কোনমতে বললাম

ওটা আপনি ছিলেন?
হ্যাঁ এরপর আমি কতবার যে ওখানে তোমাকে খুঁজেছি। অথচ তুমি আমার এত কাছেই ছিলে। সেদিন তিথিদের ছাদে তোমাকে দেখে এত অবাক হয়েছিলাম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
মুকুল আরো কি সব বলছে। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বারবার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে; তার মানে ও সেদিন আমার বৃষ্টি ভেজা শরীর দেখে আমাকে বিয়ে করতে চায়নি। আমি শুধু শুধু এতদিন ওকে ভুল বুঝেছি। আমার ভেতরে কিছু একটা হল। সেদিনের মতো আমি আবারো ওকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরলাম। বোধহয় একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছিলাম। ও আমাকে দুই হাতে তুলে নিয়ে নিচে আমাদের ঘরে নিয়ে গেল।
উত্তাল রাত্রির শেষ প্রহরে মুকুল আমাকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে বিষন্ন কন্ঠে বলল
আমার সাথে যাবে তুলি?
যাব
কোথায় যাবে জানতে চাইলে না?
যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানেই যাব
সত্যি?
হু
আমি অস্ট্রেলিয়ায় ইমিগ্রেশনের জন্য এপ্লাই করেছি। অনেকটা প্রসেস এগিয়ে গেছে। হয়ে গেলে আমরা দুজন চলে যাব। কেমন?
শুধু আমরা দুজন যাব?
হ্যাঁ, শুধু তুমি আর আমি। যাবে তো?
যাব
একটা বড় উঠানসহ বাড়ি নেব। সেখানে তুমি যত ইচ্ছা হাস, মুরগি, বিড়াল, কুকুর হরিণ রাখতে পারবে।
হরিণ ও রাখতে পারব?
পারবে না কেন? নাকি তুমি ক্যাঙ্গারু রাখতে চাও?
আমি হেসে ফেললাম। পুরোটা আমার কাছে কেমন স্বপ্নের মতন লাগছে। হঠাত কেমন ভয় করতে লাগল। স্বপ্ন তো হয়ই ভেঙে যাবার জন্য।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে