ভুল সত্য পর্ব-১২

0
110

ভুল সত্য

১২

প্রচন্ড মাথা ধরেছে। যদিও এটা নতুন কিছু না। তবু প্রতিবারই মনে হয় নিতে পারছি না। মাথার দুপাশ যেন কেউ ব্লেড দিয়ে চিড়ে দিচ্ছে। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছি তবু কমছে না। একটু আগে মুকুল মাথা ব্যথার ওষুধ দিয়েছে। খেতে ইচ্ছা করছিল না, তবু জোর করে খাওয়াল।

সকাল থেকে সবকিছু ঠিকই চলছিল। খাবার টেবিলে এতসব রান্নাবান্না দেখে মুকুল একটু বিরক্ত হলেও পোলাও আর ভুনা মাংস দেখে বেশ খুশি হয়েছিল। বিপত্তিটা বাঁধল খাওয়ার পর যখন আমার শাশুড়ি সারাদিনের রান্না বান্না করা সব খাবার বক্সে ভরে নাজু আপাকে দিয়ে দিল। নাজু আপা মহা খুশি। হবারই কথা। ব্যগ গুছাতে গুছাতে উনি বলতে লাগলেন
বুচ্ছস নাজু, বাসি খাওন আমি খাইতে পারি না। একদিনের খাওন আরেকদিন মাইনসে খায়? একদিনের খাওন পরের দিন খাইব কুত্তা বিলাই। আগে তো বেলায় বেলায় রান্দা হইতো। আমরা তো কোনদিন সকালের তরকারি দিয়া রাইতে ভাত খাই নাই।

খুবই স্পষ্ট ইঙ্গিত। বোঝাই যাচ্ছে পরের দিন আবার আমাকে বিস্তর রান্নাবান্না করতে হবে। আমি কিছু বললাম না পাশে তাকিয়ে দেখলাম মুকুলের খাওয়া থেমে গেছে। ও নাজু আপাকে উদ্দেশ্য করে বলল
কালকে কি রান্না করবে মার কাছ থেকে জেনে নিন। কাল তুলি থাকবেনা। ওর ক্লাস আছে।।
আমার শাশুড়ি ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল
অসুবিধা নাই কলেজ থেকে আইসা রানবো
সেটা সম্ভব না। ক্লাসের পর ও আমার অফিসে আসবে আমরা একটু শপিং করতে যাব।
উনার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। মুকুল খাওয়া শেষ করতে করতে বলল
তুলি, এত সব ঝামেলার আইটেম প্রতিদিন করবে না। ক্লাস থেকে ফিরে একটা দুটো আইটেম করতে পারো। দিনেরটা নাজু আপা আর মা মিলে সামনে নেবে।

আমি আর কিছু বলার সুযোগ পেলাম না। তবে তাকিয়ে দেখলাম আমার শাশুড়ি আর নাজু আপার মধ্যে এক ধরনের দৃষ্টি বিনিময় হল। বিষয়টা বেশ অর্থপূর্ণ তবু আমি এড়িয়ে গেলাম। এই মহিলা যদি ভেবে থাকেন রান্নাবান্না দিয়ে আমাকে নাজেহাল করবেন তাহলে ব্যাপারটা হাস্যকর। তবে মুকুল এসব মেয়েলি ব্যাপারের মধ্যে কেন ঢুকছে বুঝতে পারছি না। হয়তো ওর মায়ের চরিত্র খুব ভালো করে জানে বলেই, নাকি অন্য কোন ব্যাপার আছে?

এতসব রান্নাবান্না করেছি বলেই কিনা জানিনা বিকেল থেকেই প্রচন্ড মাথা ব্যথা শুরু হল। মুকুলের খুব ইচ্ছা ছিল আমাকে নিয়ে বাইরে বের হবে। একটা মাত্র ছুটির দিন ওর আমি সেটা নষ্ট করতে চাইনি। তাই একপ্রকার জোর করেই ওকে বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে পাঠিয়ে দিলাম। একটু ভালো সময় কাটিয়ে আসুক। যাওয়ার আগে ও অনেকবার করে বলে গেল কোন দরকার হলে ফোন করতে। আমি সায় দিয়ে দ্রুতই ওকে বিদায় করলাম। আমি চাইনা ও আমার আশেপাশে বেশি সময় ধরে থাকুক। কি জানি কেন, ওর প্রতি আমার মনে একপ্রকার গভীর মায়ার সৃষ্টি হয়েছে। শুধুমাত্র আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে বলে নয়। ওর জীবনের একটা গভীর সত্য আমি জেনে ফেলেছি বলে। প্রথম দিকে শুধু সন্দেহ ছিল কিন্তু কাল নিশ্চিত হয়েছি। এরপর থেকে আমার খুব ইচ্ছা করছে ঠিক যেরকমভাবে ও আমাকে আগলে রাখে আমিও ওকে সেই ভাবে আগলে রাখি।

আমি মনের মধ্যে কোন দুর্বলত কে পশ্রয়দিতে চাইনা। ছেলেদের ভালো মানুষের মুখোশ দেখার অভ্যাস আছে আমার। এই মুখোশ খসে পড়তে বেশি দিন লাগে না। কলেজ ভর্তি কোচিং করার সময় সায়মা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। মেয়েটা ভাল ছাত্রী হলেও একটু বোকা আর সহজ সরল। কোচিং এর পর আমরা মাঝে মাঝে সেন্টারে বসেই একটু এক্সট্রা পড়াশোনা করতাম। ওর সব কথাই আমাকে বলতো। আমাদের ক্লাস নিতেন যে তমাল ভাই উনি আমাদের সিনিয়র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। সায়মা পড়াশোনার চাইতে তমাল ভাইয়ের গল্পই বেশি করত। সপ্তাহ খানেক এর মধ্যেই জানতে পারলাম ওদের প্রেমটা হয়েই গেছে। আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল। সায়মা যেমন সহজ-সরল, তমাল ভাই সেই রকমই দুর্দান্ত স্মার্ট। আমি একটু অবাক হয়েছিলাম যখন দেখলাম সবার সামনে তারা দুজন দুজনকে না চেনার ভান করছে। সায়মাকে জিজ্ঞেস করায় ও বলেছিল তমাল ভাই চান না ব্যাপারটা সবার সামনে আসুক। বিষয়টা আমার ভালো লাগেনি। ভেবেছিলাম হয়তো এখানে ছাত্রী শিক্ষক বলে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলাম দু একদিন পর। একদিন সায়মা আসেনি আমি একাই একটা ফাঁকা রুমে বসে অংক করছিলাম। হঠাৎ করেই তমাল ভাই এসে আমার পাশের বেঞ্চে বসলেন। আমি ভাবলাম হয়তো সায়মার জন্য কোন মেসেজ দেবেন। প্রথমে কিছু সময় এদিক ওদিককার গল্প করার পর হঠাৎ করেই বললেন তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে তুলি। আমি জবাব দিলাম না। উনি আরেকটু এগিয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি চমকে উঠে বললাম
ভাইয়া, আপনি না সায়মাকে
উনি হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর মতন ভঙ্গি করে বললেন
আরে ধুর! ওর মতো একটা মেয়েকে আমি পছন্দ করব? কি করে সম্ভব ? ওই পাগল হয়ে গিয়েছিল আমার জন্য। আমার বরাবরই তোমাকেই ভালো লাগে।

আমি হতভঙ্গ হয়ে গেলাম তাহলে এতদিন ধরে তাদের মধ্যে কি চলছিল? টাইম পাস? একটা কথা ও না বলে সেদিন উঠে চলে গিয়েছিলাম। এরপর আর কোচিংয়ে যাইনি। পরে অন্যদের কাছে যেদিন শুনেছি যে সায়মা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে, আমার খুব তোমার ভাইকে বলতে ইচ্ছা করেছিল যে আপনার মত একটা থার্ড ক্লাস ছেলে সায়মার মত মেয়েকে ডিজার্ভ করে না।

এই জীবনে বিভিন্ন রূপেই আমি পুরুষদের মুখোশ উন্মোচিত হতে দেখেছি। তবে শেষেরটা সবচাইতে ভয়ংকর ছিল কিংবা কে জানে এর পরেরটা হয়তো আরো ভয়াবহ হবে। যখন মুকুলের আসল চেহারাটা দেখতে পাব। বিশ্বাস ভঙ্গের যন্ত্রণা আমি আর আমি নিতে চাইনা। এজন্য এই জীবনে আর কাউকে বিশ্বাস করব না বলে ঠিক করেছি।

কোথায় যেন একটানা একটা শব্দ হচ্ছে। ভুমিকম্প হচ্ছে নাকি বালিশটা ও মনে হয় কাঁপছে। এসব কি সত্যিই হচ্ছে নাকি আমার মাথার ভিতরে। অনেকটা সময় লাগলো বুঝতে যে বালিশের নিচে আমার মোবাইল্টা ভাইব্রেট করছে। এ সময় কে ফোন করল? মা নাকি? মা প্রতিদিনই একবার করে ফোন করে। কেমন আছি, কি খেয়েছি এসব অর্থহীন প্রশ্ন করে। আমার জবাব দিতে ইচ্ছা করে না। এতই যদি আমার জন্য চিন্তা তাহলে বিয়ের আগে আমার কথ একটু শুনলে কি হত? ফোনটা টেনে নিয়ে দেখলাম মা ফোন করেনি, মুকুল করেছিল লাইন কেটে গেছে। বাইরে গেছে এক ঘন্টাও হয়নি এর মধ্যে কি হয়ে গেল। আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তাই আর ফোন করলাম না। অবশ্য তার দরকার পড়ল না। ও নিজেই আবার ফোন করল। আমি জড়ানো কন্ঠে বললাম
কি হয়েছে?
মাথা ব্যথা কমেনি?
কমে যাবে
তার মানে এখনো কমেনি। এই অষুধে কাজ হচ্ছে না। দাড়াও আমি আসছি
না আসার দরকার নেই। এখন আর……
আমার কথা না শুনে ও ফোন রেখে দিল। ধ্যত! বললেই হত ব্যথা কমে গেছে। এখন আবার চলে আসবে। আমি চাইনা ও আমার আশেপাশে থাকুক।

মুকুল ফিরে এল দশ মিনিটের মাথায়। নিশ্চই বেশিদুর যায়নি। মেইন রোডেই কোথাও বন্ধুদের সঙ্গে চা খাচ্ছিল। ফিরে এসেই অত্যাচার শুরু করল। অন্য ওষুধ নিয়ে এসেছে, সেটা খেতে হল। শুধু তাই নয়। ঘর অন্ধকার করে মাথা মাসাজ করা শুরু করল। প্রথম দিকে বিরক্ত হলেও একটু পরেই আমার মনে হল মুকুল ক্যরিয়ার নির্বাচনে ভুল করেছে। ওর উচিত ছিল মাসাজ থেরাপিস্ট হওয়া। এত আরাম আমি জীবনে পাইনি। আমি অস্ফুটে বললাম
আহ! কি আরাম
ও বুঝতে না পেরে বলল
কি হয়েছে তুলি? কষ্ট হচ্ছে?
আমি চোখ মেলে তাকালাম। ওর দুচোখে কি গভীর উদ্বেগ, কি অসীম মায়া। আমার ভেতরে কি একটা হল। আমি দুই হাতে ওর মুখটা তুলে ধরে গভীর চুমু দিলাম। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। ইচ্ছা হল নিজের দুই গালে জুতার বাড়ি মারি। এখন কি করি? এটা তো আর ফিরিয়ে নেয়ার উপায় নেই। তাকিয়ে দেখলাম ও হতভম্ব মুখ করে তাকিয়ে আছে। কোনমতে বলল
আমি কিন্তু তোমাকে নেশার কোন ওসুধ দেইনি
ওর বলার ধরন দেখে আমি হেসে ফেললাম। এরপর যেটা হল তার জন্য আমার কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে