ভুল সত্য পর্ব-১১

0
120

ভুল সত্য

১১

সারা জীবনে আমি এত লজ্জা কোনদিন পাইনি, ঘুম ভেঙে যে পরিমান লজ্জা পেলাম। চোখ মেলে দেখলাম আমি মুকুলকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছি। সাধারণত ভয় পেলে আমার টেডি বেয়ারটাকে এইভাবে ধরি। ও বেচারা তো আর কিছু বলতে পারেনা। কিন্তু মুকুল যে এখনো দম বন্ধ হয়ে মরে যায়নি সেই ঢেড়। উঠতে গিয়ে টের পেলাম ও নিজেও আমাকে একইভাবেই জড়িয়ে ধরে আছে। হাত ছাড়িয়ে উঠতে যেতেই মুকুল , ধরমর করে উঠে বসে বললো
তুমি ঠিক আছো তুলি?
আমি কোনমতে বললাম
আমি কি আপনাকে অনেক বিরক্ত করছি?
না একেবারে না। এ

    কটু ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে
    কি হয়েছিল আমার? আমি এখানে কি করে এলাম?
    তুমি ছাদ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে। এখন কেমন লাগছে?

    আমি জবাব না দিয়ে ঘাড় কাত করলাম। ভীষণ অসস্তি হচ্ছে। ও নিশ্চয়ই অনেক প্রশ্ন করবে। এর আগেও আমি ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিক আচরন করেছি বেশ কয়েকবার, আবার কাল রাতেও ওর কথা শুনে ছাদের মধ্যে কিসব করলাম; এমনকি ওকে চিনতে ও পারলাম না। কিন্তু অদ্ভুত ব্যপার হল। মুকুল কিছুই জানতে চাইল না। শুধু বলল
    ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে কিছু খেয়ে নিতে। রাতেও খাওয়া হয়নি। আমি বাধ্য মেয়ের মতো ওর কথামতো নিচে গেলাম। তবে সেখানে যে আমার জন্য এত বড় চমক অপেক্ষা করছিল সেটা ভাবতেও পারিনি।

    ড্রইং রুমের সোফায় আমার শাশুড়িকে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। তার পায়ের কাছে কেউ একজন বসে ঝামা দিয়ে পা ঘষে দিচ্ছে। সামনে গামলা ভর্তি পানি ও দেখা যাচ্ছে। বোধহয় সকাল সকাল পেডিকিউর চলছে। এই দৃশ্য দেখে তেমন অবাক হলাম না কিন্তু পায়ের কাছে বসে থাকা মানুষটিকে দেখে রীতিমতো ধাক্কা খেলাম। সে আর কেউ নয় আমাদের অতি প্রিয় নাজু আপা, যাকে গতকাল এক প্রকার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছিল। আমাকে দেখে উনি বললেন
    – এইত তর ভাবী আইসা গেছে। কি কি কইরা কাখসস বুঝায়া ক
    – হ ভাবী, আলু ভাজি কইরা রাখসি, হালুয়া ও করসি। আটা মাকসি। আপ্নে রুটি বানায়া দিয়েন। আমার রুটি তো খালাম্মার পসন্দ হয় না।
    তর ওই ল্যপের মত রুটি খাওন যায় নাকি? দে ভালো কইরা ঘষা দে পায়ে
    উনার কন্ঠে স্নেহের ছোঁয়া। বুঝলাম এদের মধ্যে পাঁচমিশালি খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের আভাষ। আমি রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। পেছন থেকে উনি ডেকে দুপুরের রান্নার মেনু দিলেন। সেই মেনুর বহর শুনে আমার মত রান্না প্রিয় মানুষ ও আঁতকে উঠল

    ১ লতি দিয়ে শুঁটকি
    ২ খাসির মাথা
    ৩ মুরগির গিলা কলিজা দিয়ে লটপটি
    ৪ মুগডাল দিয়ে রুই মাছের মাথার মুড়িঘন্ট
    ৫ বাসমতী চালের ভাত
    ৬ কচুর মুখি দিয়ে আলু বেগুনের ঝোল

    মেনু শুনে মাজাজ খারাপ হল। এত সব রান্না করতে হবে বলে নয়। যে সব আইটেম বলা হয়েছে এর একটাও মুকুল খায় না। এই মহিলা আমাকে যন্ত্রনা দিতে যতটা উৎসাহী এর দশ ভাগের এক ভাগ ও যদি ছেলের স্বাস্থ্য নিয়ে হত তাহলে ছেলের এই হাল হত না। যাক তার মায়েরই যদি কোন চিন্তা না থাকে তো আমার কি? আমি রুটি সেকে টেবিলে দিলাম। উনি বললেন
    বেগুন একটু বাচলে ভর্তা বানায়ো তো
    আমার আবারো মেজেজ খারাপ হল। বেগুনে মুকুলের অ্যালার্জি। এসব কি উনি ইচ্ছা করে করছেন? আমি নাজুকে বললাম
    নাজু আপা গরুর মাংস বের করেন তো আর পোলায়ের চাল ধুয়ে রাখেন।
    তারা দুজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল।

    নামার আগে মুকুল বলেছিল
    ভেবেছিলাম আজ সারাদিন ঘুরব। কিন্তু কাল যে অবস্থা হল বিকেলের আগে বেরোনো সম্ভব না
    আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম
    না না আমি আজকে সারাদিন রান্না করব। ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ ডিনার সব বাসায় করব।
    শোন তুলি
    জি
    বেশি স্ট্রেস নেয়ার দরকার নেই। কিছু লাগলে আমাকে বলো
    ওর বলার ধরন দেখে আমি হেসে ফেললাম। মনে হচ্ছে যেন আমার খুব কঠিন কোন অসুখ করেছিল কেবলই সেরে উঠেছি। অথচ এগুলো আমার সঙ্গে প্রায়ই হয়। বিশেষ করে সেই দিনের পর থেকে। সেদিনের সেই অন্ধকারে ভয়াবহ আতঙ্ক, এর পরে ও আমার জীবনে বারবার ফিরে এসেছে। আমি ভেবেছিলাম মা ভিষণ রেগে যাবে। হয়ত বাবার সাথে ঝাগড়া করবে। কারন বাড়িতে আশরাফ চাচার এই অবাধ বিচরন মা কখনোই স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি। প্রায়ই খুব বিরক্ত হত। কিন্তু দেখা গেল মা কেমন যেন মুষড়ে পরল বরং বাবাই খুব হম্বিতম্বি শুরু করল। বারবার বলতে লাগল
    দুধকলা দিয়ে মানুষ সাপ পোষে আর আমি পুষেছি শেয়াল। যে থালিতে খায় সেখানেই হাগে। হারা/মজাদার হাগা আমি বের করছি। এমন ওষুধ দেব যে হাগা মাথায় উঠে যাবে।
    যখন এত হম্বিতম্বি করছিল তখনি আমার সন্দেহ হয়েছিল, কিছু একটা ঝামেলা আছে। মাকে বলেছিলাম সে কথা, মা তখন গুরুত্ব দেয়নি বলেছিল
    না, এবার তোর বাবা সত্যি রেগে গেছে। ওই বদমাইশটা আর বাড়িতে আসবে না। আমার তবু কেন যেন ভরসা হলো না। মেয়েদের সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল হয় কথাটা বোধ হয় আসলেই সত্যি। এর ঠিক দুই দিনের মাথায় বাবা আশরাফ চাচাকে নিয়ে আবার বাড়ি এলেন। বাবার মুখ কাচুমুচু, আশরাফ চাচার কাঁদো কাঁদো। বাবা হাত কচলাতে কচলাতে বললেন
    একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে এই জন্য এত দিনের সম্পর্ক নষ্ট করা কি ঠিক?
    আমি হতভম্ব মুখ করে তাকিয়ে রইলাম, কোন জবাব দিতে পারলাম না। এবার বাবা বেশ কড়া গলায় বললেন
    উনি তো তোর বাবার মতোই বরং তুই যেটা করেছিস সেটাই অন্যয়। তোর উচিত আশরাফের কাছে ক্ষমা চাওয়া
    আশরাফ চাচা দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বসে ছিলেন, এই কথা শুনে ব্যস্ত হয়ে বললেন
    না না কায়সার ও কথা বলিস না। ও ছোট মানুষ, বুঝতে পারেনি। আমাকে মাফ করে দাও প্রিন্সেস, প্লিজ।
    বলতে বলতে আসরাফ চাচা হু হু করে কেঁদে উঠলেন। আমি আর নিতে পারছিলাম না। এক ছুটে নিজের ঘরে দৌড়ে পালিয়েছিলাম। সেখান থেকেই শুনলাম আশরাফ চাচা বাবাকে বলছে
    তোর মেয়ে যেন আর বেশি বাড়াবাড়ি না করে। তা না হলে তোর জন্য ভালো হবে না। মনে রাখিস তোর ব্যাপারে আমি ও অনেক কিছুই জানি।

    এই কথা শুনে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু সেটা হয়নি। ওই মুহূর্তে শুধু একটা কথাই মনে হয়েছিল আল্লাহ আমাকে একটু কম বুদ্ধি দিলেও চলত, তাহলে জীবনটা এর চেয়ে একটু সহজ হতো। এর পরের অংশটা আমার জন্য সহজ হল না। আমি চোখ মুছে আবার ড্রয়িং রুমে ফিরে গেলাম

    চাচা আমাকে দেখে কান্নার মত একটা ভঙ্গি করলেন। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম
    চাচা আমাকে মাফ করে দিন। আমি আসলে বুঝতে পারিনি। আপনি আমার সঙ্গে যা করেছেন নিশ্চয়ই মৌরিন আপুর সঙ্গেও তাই করেন। আমারই বোঝার ভুল হয়েছে। আই এম সরি।
    আমি তাকে দেখলাম, তার চোখের মনি মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠেছে প্রচন্ড ক্রোধে। উনি এক মুহূর্ত সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলবেন
    প্রিন্সেস তুমি আর মৌরিন আমার কাছে একই
    তা তো নিশ্চয়ই। বাবা আমি আর মৌরিন আপু যেন তোমার কাছেও এখন থেকে একই হই।
    মৌরিন আশরাফ চাচার মেয়ে। বয়সে আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় হবে। তাকিয়ে দেখলাম রাগে চাচার ফর্সা গাল লাল হয়ে গেছে। উনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন
    প্রিন্সেস দেখি বড় হয়ে গেছে।

    আমি আর কথা বাড়ালাম না, নিজের ঘরে ফিরে গেলাম। সেদিন থেকেই আমার অভিনয় জীবনের শুরু। সেদিন আমরা তিনজনই জানতাম আসল সত্যটা কি অথচ তিনজনই অভিনয় করে যাচ্ছিলাম। এরপর দশ বছর চলে গেছে। জীবনের প্রতিটি দিনই আমার অভিনয় করে কেটেছে। এখন তো এমন অবস্থা হয়েছে যে কোনটা অভিনয় কোনটা সত্যি নিজেই বুঝতে পারি না। এই যেমন কদিন ধরে মুকুলের সঙ্গে বেশ প্রেম প্রেম অভিনয় করছি। এটা তো অভিনয়ই তাই না? আমি নিশ্চই সত্যি সত্যি ওর প্রেমে পড়িনি? আপনাদের কি মনে হয়?

    চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে