ভালোবাসিবো খুব যতনে পর্ব-০৬

0
495

#ভালোবাসিবো_খুব_যতনে
#Ayrah_Rahman
#part_06

” কিরে পূর্ণ ! এভাবে মাটিতে বসে আছিস কেন ? ”

ইলমির কন্ঠ শুনতে পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ইলমির দিকে তাকালাম ,
চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে ফট করে উঠে দাড়িয়ে সাড়ি থেকে ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে সাড়ি টা ঠিক করে দাড়ালাম,

” রাস্তা ঘাটে যখন কিছু অসভ্য মানুষজন গরু ছাগলের মতো দৌড়াদৌড়ি করে তখন আমার মতো মাসুম কিউট বাচ্চাদের তো চলতে ফিরতে সমস্যা হবে ই , ধাক্কা খেয়ে পড়তেই হবে , ইট ইজ স্বাভাবিক ”

বলেই আড় চোখে মাস্ক পড়া লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখি , উনি কি সুন্দর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে ফোন ঘাটছে যেন কিছু ই হয় নি ,

” আপু আসলে দোষ টা আমার ই , আমি ই খেয়াল করি নি , আমি আসলেই দুঃখীত , প্লিজ রাগ করবেন না আপু ”

আমি সাড়ির কুচি ঠিক করে সেই ছেলেটার দিকে তাকালাম ,
মুচকি হেসে বললাম ,

” ইট’স ওকে ভাইয়া , আমি কিছু মনে করি নি , তুমি তো আমার ছোট ভাইয়ের মতোই , আর ভাইয়ের সাথে কি বোন রাগ করতে পারে ? আমি একটুও রাগ করি নি ”

মাঝখান থেকে সেই মাস্ক পড়া লোকটা মোবাইলে র দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বলে উঠলো ,

” তানজিম তুই কি আজ বাসায় যাবি? গেলে বল তা না হলে আমি গেলাম , বাই ”

বলেই লোকটা মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে হাটতে লাগলো ,

” তোমার ভাই উনি ? ”

আমার কথা শুনে তামজিদ শব্দ করে হেসে বলল,

” খুব অদ্ভুত তাই না ? আসলে ভাইয়া এমন ই , কথা কম বলে আর সারাক্ষণ আলাদা মুড নিয়ে থাকে , খাটাস ”

” হ্যা সেটাই ”

” ধন্যবাদ আপু , আজ তাহলে আসি ”

আমি প্রতুত্তরে হাসলাম ,

ছেলেটা চলে গেলো , খারাপ লাগে নি ছেলেটাকে , বয়স আর কত হবে ! হয়তো বাইশ কি তেইশ , অনার্স থার্ড কিংবা ফোর্থ ইয়ারে পড়ে হবে হয়তো ”

” কিরে আজকে কি সারাদিন এখানে ই দাঁড়িয়ে থাকবি ? চল ভেতরে চল ”

” হুম ”

বলেই চুলে হাত দিয়ে দেখি বকুল ফুলের মালা টা নেই , চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকালাম , নাহ কোথাও নেই , নিচে পড়লে তো এখানেই থাকতো ,

” কিছু খুজছিস ? ”

আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে বললাম ,

” হ্যা বকুলের মালা টা ”

” থাক মালা লাগবে না , চুল গুলো এমনি ই ছেড়ে দে , একটা দিন ই তো ”

ওর অনুরোধের ভঙ্গিতে বলা কথার পরিপ্রক্ষিতে আমি ও কথা বাড়ালাম না ,

বসন্তের আমেজ শুরু হয়ে গিয়েছে , হালকা শীতল বাতাস আর চারিদিকে রঙ বেরঙের পাখি গাছে গাছে নতুন পাতা গজানোর মৌসুমে অনুষ্ঠানটা বেশ আনন্দময় হয়ে উঠলো , দিনের ক্লান্তি ভাব টা অনেকাংশে ই কমে গেছে , বাসন্তী রঙের সাড়ি তে আর খোলা চুলে বসন্ত বাতাস আজ বেশ উপভোগ করছি ,

আমি যে ততটা ফর্সা তা কিন্তু না , আমি শ্যামবর্না , গায়ের রং টা তামাটে , আর ইলু হলুদ ফর্সা , কোথাও একটা শুনেছিলাম , একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে আরেকটা সুন্দরী মেয়ের বন্ধুত্ব টা খুব বেশি দিন টেকে না , তাই হয়তো আমার আর ইলুর বন্ধুত্ব টা এতো টা গাঢ় ,

দু’জনে মিলে বেশ অনেক ঘুরাঘুরি করলাম , বিভিন্ন খাবার দাবার শেষ করে ফিরতে প্রায় রাত আটটার মতো বেজে গেছে ,

এই মূহুর্তে আমি আর ইলু দাঁড়িয়ে আছি রিক্সার জন্য কিন্তু আমাদের ভাগ্য তো এত সুপ্রসন্ন নয় যে দাঁড়ানোর সাথে সাথে রিকশা পেয়ে যাবো ,

দুর থেকে একটা রিকসা দেখা যাচ্ছে এদিকটায় আসছে ,

” চাচা যাবেন ? ”

চাচা গলায় থাকা গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল ,

” হহহ আম্মা যামু , কই যাবা ”

” দুই নাম্বার রোড ”

” আইচ্ছা উঠো ”

মাঝ রাস্তায় হঠাৎ সামনে ভিষন ভীড় দেখে রিকসা থেমে যায় ,

আমি ভ্রু কুচকে সামনে তাকায় , ইলুর দিকে তাকিয়ে দেখি ওই ঘুমে ঢুলছে ,

আমি রিকসা থেকে নেমে কিছু টা সামনে এগিয়ে গেলাম , লোকজন বলাবলি করছে সামনে এক্সিডেন্ট হয়েছে ,

আমি ভীড় ঠেলে সামনে গেলাম , চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা ছেলে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে কিন্তু চারপাশে এত লোক থাকতে ও কেউ গিয়ে ধরছে ও না আর না হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে ,

আমি ছেলে টার কাছে যেতেই একজন লোক পিছনে থেকে ডেকে বলে উঠলো ,

” আপা ওনার কাছে যাইয়েন না , যেই এক্সিডেন্ট করছে মনে হয় না যে বাঁচব আজাইরা নিজে ঝামেলা ই জরাইয়েন না , পুলিশের প্যাচে পড়বেন,

লোকটা আরো ও কিছু বলতে নিবে আমি রেগে তার দিকে তাকতেই লোকটা চুপ হয়ে যায় ,

মানুষ কতটা নিম্ন মস্তিষ্কের অধিকারী হলে এই মূহুর্তে এমন একটা কথা বলতে পারে , আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম ,

আমি ধীর পায়ে ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলাম ,
ওর সামনে হাটু গেড়ে বসে তর্জনী আঙুল ওর নাকের কাছে নিতেই শ্বাস প্রস্বাস টের পেলাম তার মানে এখনো বেঁচে আছে , তবে অবস্থা আশঙ্কা জনক সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে , মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে এখনো

এতক্ষণে ভীড় ঢেলে ইলু ও এসেছে , আমি ওকে কিছু একটা ইশারা করতেই ও দৌড়ে সেখানে থেকে চলে যায় ,

আমি ছেলেটার মাথা নিজের কোলের উপরে রেখে সাড়ির আচলের কিছু অংশ ছিড়ে মাথাটা ভালো ভাবে বেধে দেই যেন রক্ত পড়া টা কিছু টা হলেও কমে যায় , ততক্ষণে ইলু রিক্সা ওয়ালা চাচাকে নিয়ে হাজির , ছেলেটাকে রিকসা য় উঠিয়ে আমি আর রিকসা ওয়ালা চাচা হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম , ইলু সেই রিকসার পিছনে পিছনে ই আরেকটা রিকসা নিয়ে, কাছে ই একটা হসপিটালে ছেলেটাকে নিয়ে এলাম , আমার সারা শরীর ছেলেটার রক্তে রঞ্জিত , হসপিটালে ভর্তি করে সেখানেই বসে রইলাম,

” চাচা আপনার ভাড়া টা কত দিবো ? ”

আমার কথা শুনে চাচা চোখ ভর্তি পানি নিয়ে আমার মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন,

” ভাড়া লাগবো না রে মা , দোয়া করি তোর মতো মেয়ে যেন সবার ঘরে ঘরে জন্মে ”

এমন সময় ডাক্তার বের হয়ে আসে , ডাক্তার কে দেখা মাত্র ই আমি দৌড়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে ,

” ডাক্তার কি অবস্থা রোগীর ? ”

আমার কথা শুনে ডাক্তার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল ,

” অবস্থা এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না তবে খুব একটা ভালো না , মাথার পিছনে দিকে আঘাত টা বেশি লাগছে , গলায় ও বেশ খানিকটা জখম হয়েছে ,মাথায় বিভিন্ন জায়গায় কাচ ঢুকে আছে , ইমিডিয়েটলি অপারেশন করাতে হবে , রোগীর বাসার লোক কেউ আছে ? bond paper এ সাইন করতে হবে , অপারেশন করালেও যে রোগী বাচবে এমন কোন সিউরিটি দিতে পারছি না , আঘাত টা খুব বেশি ই পেয়েছে

আমি কিছু চিন্তা না করে ই বলে উঠলাম ,

” আমি রোগীর বোন হই কোথায় সাইন করতে হবে বলেন আমি এক্ষুনি সাইন করে দিচ্ছি , আপনি এক্ষুনি অপারেশন এর ব্যবস্থা করেন ”

” জি অবশ্য ই ”

ডাক্তার তার পাশে থাকা নার্স কে বলল ,

” উনার সব পেপার রেডি করে সাইন করাও আর অ’টি রেডি করো ,, তাড়াতাড়ি কর ”

নার্স আমার দিকে তাকিয়ে বলল ,

” আপনি চলুন আমার সাথে ”

আমি নার্সের সাথে যেতে যেতে পিছনে তাকিয়ে ইলুর দিকে তাকিয়ে বললাম ,

” তুই এখানে একটু বস আমি আসছি ”

আমার কথার পরিপ্রেক্ষিতে ইলু মাথা নাড়িয়ে সিটে বসে পড়লো ,

নার্স আমা সাথে যেতে যেতে বলল ,

” রোগী কি আপনার কিছু হয় ? ”

” হুম , আমার ভাই ”

” ওহ , ওনার আঘাত গুলো খুব গুরুতর , কিভাবে হয়েছে একটু বলতে পারবেন ? ”

” লড়ির সাথে প্রাইভেট কারের এক্সিডেন্ট ”

” ওহ ”

ফর্মালিটি শেষে ডাক্তার অ’টি তে ঢুকেছে প্রায় এক ঘন্টা , আমি আর ইলু অ’টির সামনে , টেনশনে হাত পা বরফ হয়ে আসছে , চোখ ফেটে কান্না আসছে , টুপ করে চোখ থেকে জল মাটিতে গড়িয়ে পড়লো , একটা অচেনা অজানা ছেলের জন্য এতো চিন্তা ! আমি খুব করে চাইছি আল্লাহ র কাছে যেন ছেলেটা সুস্থ হয়ে যায়, কোন মায়ের বুক যেন খালি না হয় ,

প্রচন্ড অস্থিরতায় ভুগছি , অবশেষে অ’টির লাল লাইট নিভে গেলো

ডাক্তার বাইরে বেরিয়ে এলেন৷

” কি অবস্থা ডাক্তার আমার ভাইয়ের ? ”

” আল্লাহ র অশেষ রহমতে এবারে র মতো বেচে গেছে , সময় মতো না পৌছালে হয়তো বাচানো সম্ভব হতো না , তুমি মেয়ে অনেক সাহসী , খুব ভালোবাসো ভাইকে তাই না , ব্রেভ গার্ল, ডোন্ট ওয়ারি ভাই ঠিক হয়ে যাবে , কিছু দিন রেস্ট করুক , আর গলায় যেহেতু আঘাত পেয়েছে কথা বলতে কয়েক দিন সমস্যা হবে তবে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে ”

ডাক্তারের কথায় আনমনেই আমার ঠোঁটে হাসির রেখা ভেসে উঠলো ,

” ভেতরে যেতে পারি ডাক্তার ? ”

” আবাদত ঘুমাচ্ছে , কাল সকালে র আগে ঘুম ভাঙবে না , তবে দেখে আসতে পারো ”

” ধন্যবাদ ডাক্তার ”

” মাই প্লেজার ”

বলেই ডাক্তার চলে গেলো , আমি ইলমির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম , ও আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বোঝালাো সব ঠিক হয়ে যাবে ,

_______________

সকাল প্রায় ৭ টা বাজতে চলল ,

তালুকদার ভিলায় কারো চোখে ঘুম নেই , ড্রয়িং রুম জুড়ে সবার আনাগোনা , তাপস তালুকদার সোফায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে , মেহেরিন শিকদারের চেহারায় ও ছেলের জন্য অস্থিরতা , তাহরিম তালুকদার মোবাইল হাতে নিয়ে পায়চারি করছে পুরো রুম জুড়ে কাল রাত থেকে তানজিমের ফোন বন্ধ , রাতেও বাসায় আসে নি , যে ছেলে এক ঘন্টা বাসায় না থাকলে মায়ের কাছে সত্তর বার ফোন করে সে ছেলের ফোন কাল রাত থেকে অফ!

পুরো শহর জুড়ে পুলিশ ফোর্স লাগানো হয়েছে , কিছু ক্ষন আগেই একজন পুলিশ কর্মকর্তা ফোন করে জানিয়েছে , তাদের গাড়ি টা মহাসরকের পাশে খুব ই বাজে ভাবে ভেঙে যাওয়া অবস্থায় পাওয়া গেছে কিন্তু সেখানে তানজিম ছিলো না ,

এলাকার লোক জন থেকে শোনা গেছে গত কাল রাতে প্রায় আটটার দিকেই এদিকে গাড়ি ট এক্সিডেন্ট করে আর পরে থাকা ছেলে টাকে একটা মেয়ে রিকসায় করে হসপিটালে নিয়ে যায় , কিন্তু কোন হসপিটালে নিয়ে গেছে কেউ জানে ,,

চলবে ….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে