ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব-৫৫ এবং শেষ পর্ব

0
1087

#ভালোবাসার_ভিন্ন_রং
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫৫(প্রথম অংশ)
#সমাপ্ত_পর্ব

রাত তখন প্রায় ১০ টা। মিশি, মিশানকে খায়িয়ে ঘুম পাড়িয়েছে আজ আগেই। মিশানের কালকেই এক্সাম। আদ্র ও আপাতত ঘুম। রোদ ছেলের দিকে ঘুরে বসে আছে। নজর নিজের ছোট্ট জানটার দিকে হলেও অক্ষিপটে ভাসছে আদ্রিয়ানের সাথে বসে থাকা মাইশার দৃশ্য। হাত পা যেন হীম ধরে যাচ্ছে। মাথাটা চিরবিড়িয়ে উঠছে। তখন থেকে আদ্রিয়ানের সাথে কথাও হয় নি। রোজ কল দেয়। রোদ’কে দেখে। বাচ্চাদের দেখে। আজ বুঝি তার সময় হলো না? সে দেয় নি রোদ ও দেয় নি। রোদের মাথায় চিন্তা ঘুর ঘুর করছে। কি কাজ আদ্রিয়ানের ওনার সাথে? কেন মিথ্যা বললো?
দরজা খুলার শব্দ এলো। আদ্রিায়ন এসেছে। রোদ নড়ছে না। অতি রাগে, দুঃখে ওর কান্না পাচ্ছে। আদ্রিয়ান হাতের ব্যাগটা কাউচে রেখে এগিয়ে আসতে আসতে শার্টের বোতামে হাত রাখলো। দুটো বোতাম খুললো। একটু শান্তি লাগছে। সারাদিন অনেক খাটুনি গিয়েছে আজ। হাতটা কুনুই পর্যন্ত গুটাতে গুটাতে আদ্র’র ঘুমন্ত মুখটা দেখে নিলো কয়েকবার। শান্তি লাগে নিজের ছোট্ট এই অস্তিত্ব’টাকে দেখতে। রুমে আসার আগেই বাকি দুজনকে দেখে এসেছে। ঘুমন্ত সন্তানদের আদর দিয়ে এসেছে। মিশানের পড়ার টেবিলে তার চাওয়া নতুন ঘড়িটা রেখে এসেছে। নিশ্চিত সকালে পেয়ে লাফাতে লাফাতে বাবা’র বুকে আসবে। আদ্রিয়ান তখন বুক ভরে শান্তি পাবে।

আদ্রিয়ান আদ্র’কে দেখে রোদের দিকে না তাকিয়েই বললো,

— ক্ষুধা লেগেছে। রুমে নিয়ে এসো। নিচে যাব না।

রোদ নড়লো না। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকালো। কারণ তার কাপড় বের করা নেই। চাইলে ও নিজেই করতে পারে কিন্তু রোজ তো রোদ গুছিয়ে রাখে। আজ এসে এক গ্লাস পানি ও কপালে জুটে নি। না জুটেছে বউয়ের জড়িয়ে ধরা। রোজ তো এই ঘর্মাক্ত শরীর ই রোদ জড়িয়ে ধরে তাহলে আজ কেন নয়? একটা রা ও করলো না। কিছু কি হলো?
আদ্রিয়ান এগিয়ে এলো বউয়ের কাছে। ডাকলো,

— রোদ?

উত্তর নেই। আদ্রিয়ান এবার রোদের কাঁধে হাত দিয়ে ডাকতেই রোদ তাকালো শান্ত দৃষ্টি’তে। একটা প্রশ্নই করলো,

— মিটিং কেমন হলো?

— অনেক ভালো।

বেশ হাসিহাসি মুখে বললো আদ্রিয়ান। রোদের মাথা খারাপ হওয়ার জন্য সেই হাসি ই যথেষ্ট ছিলো। র*ক্ত যেন টগবগিয়ে উঠলো ওর। হারালো হিতাহিত জ্ঞান। আদ্রিয়ান নিজের হাতটা রোদের গালে রাখতে নিলেই রোদ ছিটকে সরিয়ে দিলো ওর হাত। আদ্রিয়ান কিছুটা অবাক। রোদকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই খলবলিয়ে উঠলো রোদ। দাঁড়িয়ে গেল সে নিজ শক্তিতে। ধাক্কা মারলো আদ্রিয়ানের বুকে। ধাক্কাতে ধাক্কাতে মুখে দারুণ রাগ ফুটিয়ে কিছুটা চিৎকার করে বলতে লাগলো,

— অনেক ভালো ছিলো তোর মিটিং? তাই না? ভালো তো হবেই। কেন হবে না। ঘরের বিরিয়ানি বাসি হলে বাইরের ডাল ভাত ও অমৃত লাগে। তাই না?

আদ্রিয়ান এবার বিষ্ময়ের উচ্চ প্রান্তে। কিছুই যেন বুঝতে পারছে না সে। রোদ ততক্ষণে ওকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে দেয়ালের সাথে আটকে ফেলেছে। রাগে লাল হয়ে খামচে ধরলো আদ্রিয়ানের বুকের দুই পাশের শার্ট। ভাগ্যিস নখ বড় রাখার অভ্যস্ত নয় রোদ। নাহলে আজ বুক ঝাঝরা করে দিত। আদ্রিয়ানের কিছু বলার আগেই রোদ কাঁপানো গলায় চিৎকার করে উঠলো,

— আমাকে এখন ভালো লাগেনা না? রোদ ভালো লাগে না? পঁচে গিয়েছে রোদ? তোর বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়েই তো এই অবস্থা আমার। নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে পারি না। মোটা হয়ে গিয়েছি। চেহারা’র সুন্দরর্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তোর সাথে ঠিক মতো ভালোবাসা হয় না। তাই বলেই তোর আগের বউয়ের কথা মনে পরেছে হ্যাঁ! আমাকে ভালোলাগে না তোর? রোদ ভালোলাগে না! মিথ্যা বলিস আমাকে? পাগল আমি হ্যাঁ? তোর ভালো মিটিং এই ছিলো? এত উতলা হয়ে, বোনের ডালা রেখে এই ছিলো জরুরি মিটিং? এই ছেড়ে দিবি আমাকে?

আদ্রিয়ানের মাথায় এবার কিছুটা ঢুকলো। বউ তার রেগেছে আজ। অনেক মাস পর এমন রাগ উঠেছে তার। আদ্রিয়ান মজা নিতে চাইলো। ও জানে যেগুলো রোদ বলছে এগুলো উপরে উপরে রাগ। তাই বললো,

— এতক্ষণ তো মুখের কথা বললা। এবার মনেরটা বলো।

কিন্তু তা হলো কই? আর কিছু বলার আগেই খেয়াল করলো রোদ শ্বাস নিতে পারছে না। এই সমস্যা আদ্র হওয়ার পর থেকেই। হাঁপাচ্ছে রোদ। হাত আলগা হচ্ছে আদ্রিয়ানের শার্ট থেকে। ততক্ষণে রোদের চিল্লানিতে ঘুম ভেঙেছে আদ্র’র। এবার থামায় কে ওকে? ঘুম ভাঙাতে সে কেঁদে যাচ্ছে। আদ্রিয়ান না পেরে রোদকে জড়িয়ে নিলো। পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করতে সময় নিলো। রোদ জোরেজোরে শ্বাস ফেললো। শান্ত হতেই আদ্রিয়ান থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কেঁদে ফেললো হাউমাউ করে। আদ্রিয়ানের নিজেকে ভাগ্যবান নাকি অভাগা কি মনে করা উচিত তাই বুঝতে পারলো না। রোদ কাঁদছে বাঁধ ভাঙা গলায়। আদ্র কাঁদছে স্বশব্দে। আদ্রিয়ান পরলো মহা ঝামেলায়। রোদ হঠাৎ মুখ চেপে ধরলো। আদ্রিয়ান ওকে নিয়ে বসাতেই রোদ কোনমতে বললো,

— ব…মি করব।

আদ্রিয়ান তারাতাড়ি ছুটলো বউ নিয়ে ওয়াসরুমে। গলগল করে বেসিন ভাসালো রোদ। আদ্রিয়ান ওর মুখে পানি দিয়ে কুলি করালো। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সাওয়ারের নিচে ওকে দাঁড় করিয়ে তা অন করতেই রোদ সরতে নিলো। আদ্রিয়ান ওকে চেপে ধরে দাঁড় করিয়ে ধমক দিলো একটা। ব্যাস সব ঠিক। পানির নিচে দাঁড়িয়ে রইলো রোদ। আদ্রিয়ান দৌড়ে বের হয়ে ছেলেকে বুকে তুললো। পাশেই ফিডার বানিয়ে রাখা। তা মুখে ধরে হাটলো কিছুক্ষণ। অর্ধেক খেতে খেতেই ঘুম। আর খাচ্ছে না। আদ্রিয়ান ওকে আস্তে করে দোলনায় শুয়িয়ে দিলো। এতটুকু করতেই প্রায় আধ ঘন্টা লাগলো ওর। মনে পরলো রোদের কথা। তড়িঘড়ি করে গিয়ে দেখলো যেমন দাঁড় করিয়েছিলো ঠিক তেমনই দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রিয়ান নিজেও পানিতে গেলো। জড়িয়ে ধরলো রোদকে। ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে রোদ। একদম শান্ত।
আদ্রিয়ান ছাড়লো না। জড়িয়ে রাখলো নিজের সাথে। কতটা ডেস্পারেট হলে রোদের মতো একটা মেয়ে এমন আচরণ করে? কতটা ভালোবাসা থাকলে অসহায়ের ন্যায় এমন করে কাঁদে? ঠিক কতটা? পরিমাপ করতে ব্যার্থ হলো আদ্রিয়ান। আধ ঘন্টা ভেজাতে রোদ কাঁপছে অল্প। বুকের মাঝে ছোট্ট বউ পাখিটার কম্পন টের পেল আদ্রিয়ান। আস্তে করে মুখটা তুললো। গোলাপি ঠোঁট জোড়া পানিতে ভিজে সাদা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। আদ্রিয়ানকে আজ এই র*ক্ত হীন ওষ্ঠাধর টানলো বেশ করে। রোদকে ঠেসে ধরলো নিজের ভেজা দেহে’র সাথে। আলিঙ্গন করলো গভীর ভাবে। রোদ যখন চোখ বুজে নিলো ঠিক তখনই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরলো অশ্রু কণা। রং হীন কণাগুলো পানির সাথে ধুয়ে গেলো। টু শব্দ করলো না ও। আদ্রিয়ান নিজেই রোদের ঠোঁট ছেড়ে দিলো। তাকাতেই দেখলো সাদা ঠোঁট জোরায় লাল লালা। আদ্রিয়ানের দন্তের আঘাতেই এই হাল। র*ক্ত বের হচ্ছে নিশ্চিত রোদ ও ব্যাথা পেয়েছে কিন্তু শব্দ করছে না ও। আদ্রিয়ানের একটু খারাপ লাগছে। কাঁমড় টা না দিলেও হতো। রোদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিয়ানের বুকে ঠেস দিয়ে। সাওয়ার অফ করে টাওয়াল দিয়ে জড়িয়ে আদ্রিয়ান আদেশের স্বরে বললো,

— যাও।

রোদ গেলো না। আদ্রিয়ান ধমকে উঠলো,

— দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও রুমে। তোমার ঠান্ডা লাগলে আদ্র’র ও লাগবে।

রোদ তাকালো। সেই চাহনি বুঝতে আদ্রিয়ানের বেগ পেতে হলো না। অসহায় চোখজোড়া ওর মায়াবতী’র। যেন আদ্রিয়ান তাকে ছেড়ে আজীবনের জন্য যেতে বলেছে। ভেতরের ভাব চেপে আদ্রিয়ান চোখ রাঙালো। রোদ বেরিয়ে এলো। কান্না পাচ্ছে ওর। আদ্রিয়ান এমন কেন করছে? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলো রোদ। আপাতত সারা চেহারার মধ্যে ফুলে ঢোল হয়ে আছে ঠোঁট। বজ্জাত আদ্রিয়ান কাঁমড়ে দিয়েছে। মনে মনে ছোট খাট গালি দিয়ে রোদ কাপড় পাল্টে নিলো। ঠোঁট জ্বলছে ভিষণ ভাবে। একবার ঘুমন্ত ছেলেকে দেখে পা বাড়ালো বাইরে। আদ্রিয়ানের জন্য খাবার আনতে।

আদ্রিয়ান একটা টাওয়াল পেচিয়ে রুমে এসেই দেখলো চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে পেচিয়ে রোদ খাবার নিয়ে বসে আছে। বিছানার উপর টাউজার রাখা। বাঁকা হাসলো আদ্রিয়ান। ডোজ কাজে লেগেছে। বউ সোজা করা জানা আছে ওর। টাউজার পরে গলায় টাওয়াল নিয়ে সেফাতে বসতেই রোদ চুপ করে উঠে ওর কাঁধ থেকে টাওয়াল নিয়ে চুল মুছে দিতে লাগলো। আদ্রিয়ান কিছুই বললো না। এগুলো রোদের কাজ। রোজ তে করেই আজ না করাতে বরং একটু উটকো লাগছিলো। চুল মুছে টাওয়ালটা বারান্দায় মেলে দিয়ে রোদ এসে আবারও একবার ছেলেকে দেখলো। ডায়পার চেক দিলো। না নষ্ট হয় নি। তখনই গম্ভীর কণ্ঠে আদ্রিয়ানের ডাক পরলো,

— এদিকে এসো।

রোদ গুটিগুটি পায়ে গেলো। চোখের ইশারায় আদ্রিয়ান বসতে বললেই রোদ বসে পরলো। একটু দূরত্ব রাখলো মাঝখানে। একটু আগে যেই সাহস দেখিয়েছে তার ছিটেফোঁটা ও এখন নেই এখন। বরং ভয় আছে অল্প সল্প। মনে মনে পৌঁচাসিক আনন্দ পেলো আদ্রিয়ান। এতটুকু ভয় বউয়ের থাকা দরকার। মন্দ না। ভাত মাখতে মাখতে আদ্রিয়ান ভাবছিলো এসব। এক লোকমা আঙুলের মাঝে তুলে রোদের মুখের সামনে ধরতেই রোদ মুখ খুললো। আদ্রিয়ান লেকমাটা মুখে ভরে দিয়ে নিজে একলোকমা মুখে তুললো। রোদ এক লোকমা খেয়েই আধ গ্লাস পানি গিলে ফেলেছে। আদ্রিয়ান দ্বিতীয় লোকমা দিতেই রোদ তাকালো। নিজের নারীর চোখের ভাষা জানে আদ্রিয়ান। তবুও জোর করতেই মিনমিন করে রোদ বললো,

— ঠোঁট জ্বলে।

— বড় করে হা করো।

রোদ তাই করলো৷ আদ্রিয়ান তুলনামূলক ছোট ছোট লোকমা তুলে খাওয়াচ্ছে বউকে। রোদ সব গুছিয়ে আসতেই দেখতে আদ্র মহাশয় কেঁদে ভাসাচ্ছে। ছেলেটা দূর্বল বলে কেমন কান্নাটা ও মাঝে মধ্যে দূর্বল শুনায় যদিও এখন অনেকটা গ্রো করছে। আদ্রিয়ান হাতে ফিটার তুলে দিলে সে খাবে না। এক বার মুখে দেয়া ফিডার দ্বিতীয় বার সে মুখে তুলে না। আদ্রিয়ান কোলে তুলে নিতে নিতে বললো,

— জমিদার পুত্র আমার।

আদ্র থামছে না। আদ্রিয়ান দুলিয়ে দুলিয়ে কত কথা বলছে। তবুও থামছে না সে।

— এই যে আমার বাবা। কেন কাঁদছে আমার জান। আব্বা তাকাও। সোনাপাখি আমার। মা আসছে এখনি।

আদ্র লালা দিয়ে হাত মুখ মাখিয়ে ফেলছে। রোদ ডুকতেই আদ্রিয়ান বলে উঠলো,

— ফিডার নিচ্ছে না মুখে। ফিড করাও।

রোদ কোলে তুললেই ওয়েট টস্যু দিয়ে আদ্রিয়ান ছেলের মুখ হাত মুছিয়ে দিলো। রোদ বেডে বসে একটা ওরণা দিয়ে নিজেকে সহ আদ্র’কে ঢেকে দিলো। আদ্র চুপ। রুম জুড়ে নীরবতা। মাঝে মধ্যে শুধু “উ আ” শব্দ করছে আদ্র। এই যা। আদ্রিয়ান বুঝলো ছেলে খাচ্ছে। কিন্তু নতুন ঢং ধরে আদ্রিয়ানের সামনে রোদ এভাবে ঢেকে আছে যা ভালোলাগলো না ওর। বিছানায় উঠে এক টানে ওরণা সরিয়ে দিলো। আদ্র টুকুর টুকুর করে একবার বাবা’কে দেখে আবার মনোযোগ দিলো খেতে। রোদ ও কিছু বললো না। আদ্র ঘুমাতেই রেদকে টেনে নিলো আদ্রিয়ান। একদম কোলে তুলে বসিয়ে নিলো। মাথাটা রাখলো বুকে। হাত দিলো চুলের ভাজে৷ আদ্রিয়ানের যত্নে যত্নে চুল আগের মতো হচ্ছে। এখনও হালকা ভেজা। জোরে শ্বাস টানলো আদ্রিয়ান। ঘ্রাণ নিলো নিজের প্রাণেস্বরীর চুলের। আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে নরম ভেজা গলায় বললো,

— মিটিং ছিলো ঐ ক্যাফেতেই। ছুটে যাওয়া দুজন বায়ার এসেছিলো। ঐ যে ছয়মাস আগের। বড় ডিল ছিলো। সেটাই হলো। চট্টগ্রামে প্রোজেক্ট। কথা হলো। সব ঠিক। সাইন হয়েছে আজ। আলহামদুলিল্লাহ।

একটু থেমে আবারও বললো,

— মাইশা গত দুই তিন মাস ধরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। মিশানকে দেখতে চায়। মিশানকে বললাম। সে রাজি না। দেখা করবে না। আমার দায়িত্ব আমি বলেছি।দেখা করা না করা মিশানের ইচ্ছে। আমি জোর করি না। মিশিকে দেখতে চেয়েছিলো সেটা আমি না করেছি। আমার মেয়ে’র মা আছে। এখন নতুন কিছু জানার বয়স ওর হয় নি। মাইশা অস্থির হয়ে আমার অফিসে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। আজ পিছু পিছু এখনেও এসেছিলো৷ মিটিং শেষে অনুনয় করে আধ ঘন্টা চাইলো৷ ভাবলাম ঝামেলা শেষ করি। দেখি কি বলে। তাই বসেছিলাম।
এবার বলো তুমি কিভাবে দেখলা?

— আদ্র কাঁদছিলো গাড়িতে তাই নেমেছিলাম।

— ওহ। শুনবে না মাইশা কি বলেছে?

রোদ চুপ। মানে শুনতে চায়। আদ্রিয়ান বললো,

— আদ্র হয়েছে তাই মাইশার চিন্তা হচ্ছে আমি মিশানকে অবহেলা করব। আজ এসেছিলো যাতে মিশানের নামে আমার সম্পত্তির কিছু লিখে দেই। এখন আমাকে ভরসা করতে পারছে না ও। যদি মিশানকে ঠকাই তাই।

— কিছু কেন লিখে দিবেন? ছেলে-মেয়েদের তো সমান ভাগ দিতে হয়। আপনার সব যেমন তিন ভাগ হবে তেমন আমার নামে যা আছে তা ও তো তিন ভাগ হবে। তাহলে যদি কিছু লিখে দেন তাহলে তো মিশানকে ঠকানো হলো। তাই না? বাবা-মায়ের সব কিছুর উপর সমান অধিকার সব বাচ্চাদের। যেমন আপনি আমি পেয়েছি। তেমন ওরা ও পাবে।

আদ্রিয়ান শুধু অবাক না বেশ অবাক হলো। রোদের মতো একটা মেয়ে এমন করে ভাবে? হাজার হলেও রোদ ততটাও ম্যাচুয়ুর না। বাচ্চামো রয়েছে ওর মধ্যে অনেকটাই। এতটুকু বয়সেই তার সন্তানদের হক নিয়ে চিন্তা চেতনা একদম পরিষ্কার। খাদহীন। আদ্রিয়ান আজ পর্যন্ত ভেবেছে ওর যা আছে তা ওর সন্তান আর রোদের। রোদ ও এমন ভাবে তা জানা ছিলো না। “মা” শব্দটা শুধু আবেগ বা ভালোবাসা’র না এটা দায়িত্বের যা একজন মায়ের মধ্যে আপনাআপনি এসে যায়। তাহলে কি মাইশা সন্তান জন্ম দেয়ার পরও মা হতে পারে নি? ওর চিন্তা মিশানকে নিয়ে মন্দ নয়। একদিক থেকে ভালোই হলো রোদের ভিতরের কিছু অজানা জিনিস জানতে পারলো আদ্রিয়ান।

আদ্রিয়ান রোদের ফুলে উঠা অধরে ছোট করে একটা চুমু খেলো। হাত দিয়ে গালে আদর দিতে দিতে বললো,

— এটার জন্য সরি। মেজাজা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।

— কোনটা?

না বুঝে প্রশ্ন করলো রোদ। আদ্রিয়ান মুখে উত্তর না দিয়ে আবারও ক্ষত হওয়া ঠোঁটে আলতো চুমু খেলো। রোদের চোখ ভর্তি তখন অপরাধবোধ। আদ্রিয়ান সেটা বুঝে। রোদকে নিয়ে মজা নিতে বলে উঠলো,

— আচ্ছা বউ বলতো তোমার কত বড়?

রোদ না বুঝতে পারলো না এই প্রশ্নের কারণ। অবুঝ গলায়ই বললো,

— দশ অথবা বারো।

— আচ্ছা আমি যতদূর জানি রাদ তোমার ছয় বছরের বড়।

— কেন জিজ্ঞেস করছেন?

— রাদ’কে তো কখনো তুই ডাকতে দেখি নি।

রোদ বুঝে গেলো আদ্রিয়ান ঠেস মারছে ওকে। কাটকে রাখা কান্নাটা এবার এসেই পরলো। আদ্রিয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়ে বললো,

— আমি আর বলব না। মাফ করে দিন। সত্যি বলছি। আর কখনো এমন হবে না।

আদ্রিয়ান জানে তখনকার গুলো রোদ মুখে মুখেই বলেছে। এখন আবার কাঁদছে। সহ্য হয় এসব? নিজের সাথে আরেকটু মিশিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

— কি করলে থামবে এই কান্না? আদর দেই?

উত্তর গলায় জ্বলুনি অনুভব করলো আদ্রিয়ান। দুষ্ট বউ ওর। এখন নিজেও দুষ্টামি করবে আদ্রিয়ান। মধু চন্দ্রিমা’র সাক্ষী হোক নাহয় আজ এই চন্দ্রহীন আকাশ।

_________________

একটা মাস যেন ঝরের বেগে গেলো। আজ রোদের রেজাল্ট। সেই দিকে খেয়াল নেই ওর। ননদ প্লাস একামাত্র বন্ধুর বিয়ে। আজ বরযাত্রী আসবে। বিয়ে পড়ানো হয়েছে গত কাল। এত ঝামেলা একসাথে করবে না বলেই কবুল ঘড়োয়া ভাবে একদিন আগেই বলানো হয়েছে। রোদের মনটা খারাপ হয়। ও চেয়েছিলো দুই দিক থেকেই বিয়ে খাবে। কিন্তু পাঁজি আদ্র তো মা ছাড়ে না। তাই রোদের সেই স্বপ্ন স্বপই রয়ে গেল।
আদ্রিয়ান আদ্র’কে কোলে নিয়ে দুই পাশে দুই বাচ্চা নিয়ে বসে আছে। মিশান মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। মিশি যদিও বুঝতে পারছে না যে সে কেন বসে আছে কিন্তু বসে আছে। ছোট্ট আদ্র ও সবাইকে ওদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজেও ” ট্যা টু” শব্দ করছে আর ওদিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করে ওয়েবসাইট অন হলো। আদ্রিয়ান কোনমতে রোদের রেজিষ্ট্রেশন নাম্বারটা টাইপ করার পরই দুই বার গোলগোল ঘুরে লোডিং হলো পরপরই রোদের মুখটা ভেসে উঠলো। “উত্তীর্ণ” দেখেই মিশান দুই লাভে উঠে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে “মা” “মা” ডাকতে লাগলো। আদ্রিয়ান “আলহামদুলিল্লাহ” বললো। পজিশন ভালো। ভালো সাবজেক্টের আশা করা যায়। এদিকে মিশিও ভাইকে লাফাতে দেখে নিজে লাফাচ্ছে। ছোট্ট আদ্র ও হয়তো খুশি হয়েছে। খুশিতে দিক হারা হয়ে একদম বাবা’র কোল ভিজিয়ে দিলো। গরম গরম ভেজা অনুভব হতেই আদ্রিয়ান বুঝলো কাম সেরেছে আদ্র। মাত্র আধ ঘন্টা আগেই ডায়াপার খুলে শুধু একটা ন্যাপি পরিয়েছিলো। বাচ্চাদের সারাক্ষণ ডায়পার পড়িয়ে রাখা উচিত না। আদ্র’কে শুধু রাতে আর বাইরে গেলেই ডায়পার পড়ানো হয় কারণ ডায়াপারে ব্যাবহার করা জেল গুলো গরমে গলতে শুধু করে। সেটা সারাক্ষণ বাচ্চাদের পড়িয়ে রাখলে ইন্টিমেট এরিয়াতে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভবণা আছে। এছাড়াও অনেক সময় তা মাত্রারিক্ত ক্ষতি করে থাকে। তাই আদ্র’কে এত বেশি ডায়পার পড়ানো হয় না। আদ্রিয়ান উঠে ছেলেকে চেঞ্জ করিয়ে নিজেও টাউজার পাল্টে নিলো। ওদের চিল্লাচিল্লিতে রোদও ততক্ষণে রুমে এসেছে। এসেই ধমকের সুরে বললো,

— কি হয়েছে? কাজ করছিলাম না? কখন থেকে চিল্লাচিল্লি করছো তোমরা? আর এটা রুম নাকি গোয়াল ঘর?

বলেই বিছানার চাদরে হাত দিলো রোদ। সব গোছালো ছিলো অথচ এখন কি অবস্থা। মেজাজা তুঙ্গে এখন ওর। মিশান মিনমিন স্বরে আবারও ডাকলো,

— মা।

— হু।

— রেজাল্ট দিয়েছে।

রোদ হাতের ঝাড়ু টা রেখে তড়িৎ গতিতে এসে বললো,

— কি? কখন?

— মাত্র।

ভয়ে ভয়ে রোদ আদ্রিয়ানের দিকে তাকালো। ঢোক গিলে বললো,

— আসে নি পজিশন?

আদ্রিয়ান গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

— একহাজারের মধ্যে আছে।

মিশান লাফিয়ে মায়ের হাত জড়িয়ে ধরলো। মিশি জড়িয়ে ধরলো কোমড়। আদ্র ও এখন কোলে আসবে। রোদ কোলে নিলো। এটাই একটা টেনশন ছিলো। এখন মুক্ত। আদ্রিয়ানের এই ইচ্ছেটা পূরণ করতে না পারলে নিজের কাছেই ছোট হয়ে যেত রোদ। চোখ চোখে কথা হলো আদ্রিয়ানের সাথে। আদ্রিয়ানের চোখে উপচে পড়া আনন্দ। রোদ তৃপ্ত হলো সেই নজরের দিকে তাকিয়ে। এত কষ্ট সফল হলো তাহলে।
.
অনুষ্ঠানে রাতে। সবাই সন্ধ্যা থেকেই পার্লারে। রোদ মুখ গোমড়া করে বসে আছে। এখন রাত আটটার উপরে। অথচ রোদ রেডি হতে পারছে না। আদ্র কারো কাছেই থাকছে না। আদ্রিয়ান ও নেই। বোনের বিয়ে দুই ভাই ই দৌড়াদৌড়িতে আছে। মিশান এসে বললো,

— মা পঞ্জাবীর বোতাম লাগিয়ে দাও।

রোদ উঠে লাগাতে লাগাতে বললো,

— বোন কোথায়?

— দিদার কাছে। ডেকে দিব?

— হ্যাঁ। দিয়ে যেও তো বাবা। ওকে রেডি করে দিব। ভাই’কে রেখে তো যেতে পারছি না।

— আচ্ছা। তুমি রেডি হবা কখন?

— ভাই ঘুমাক।

মিশান চলে গেল। রোদ আদ্রিয়ানের পাঞ্জাবি সহ যাবতীয় সব গুছিয়ে বেডে রাখলো। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আদ্র’কে দেখলো। হাত পা নাড়িয়ে খেলছে সে। অথচ এখন যদি রোদ একটু ওর চোখের আড়াল হয় তাহলেই কেঁদে ভাসাবে।
মিশিকেও তৈরি করয়ে শশুড়-শাশুড়ীর সাথে ভেন্যুতে পাঠিয়ে দিলো রোদ। বাসা পুরো খালি। রোদ’কে রেখে অবশ্য যেতে চায় নি। রোদ জানিয়েছে আদ্রিয়ানের সাথেই আসবে। এই লোক দিনদিন অলস হচ্ছে। রোদ’কে ছাড়া তৈরি হতে পারে না। রোদ এটা কই, ওটা কই করে করে মাথা খারাপ করে দেয়।
আরো আধ ঘন্টা পর এলো আদ্রিয়ান। রুমে ডুকেই রোদকে বাসার ড্রেস পড়ে থাকতে দেখে আদ্রিয়ান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— এখনও রেডি হও নি?

রোদ অসহায় চাহনি দিলো।

— একবারও ঘুমায় নি?

রোদ মাথা নাড়লো। আদ্রিয়ানের খারাপ লাগলো। কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো কেমন লাগছে বউটার। কত কত ইচ্ছে ছিলো রোদের বন্ধু সাথে ননদের বিয়ে তাই এটা ওটা করবে। কি পড়বে না পরবে সব এনেছে। সেখানে কি না এখনও তৈরি ই হতে পারে নি মেয়েটা। পার্লারেও যায় নি। বুকিং তো আদ্রিয়ান করে দিয়েছিলো। আদ্রিয়ান এগিয়ে এসে কিছু বলার আগেই রোদ বললো,

— আপনি যান তারাতাড়ি সাওয়ার নিয়ে আসুন। সব রাখা আছে। লেট হয়ে যাবে।

রোদ যে যেকোন সময় কেঁদে দিবে তা বেশ বুঝতে পারলো আদ্রিয়ান। ঝটপট বলে উঠলো,

— বাসায় ডাকাই পার্লার গার্লদের। ঝটপট রেডি করে দিবে।

— ওখান থেকে আসতে নাহলেও দুই ঘন্টা লাগবে। যান তো আপনি।

রোদের কন্ঠে কিছুটা অভিমান। আদ্রিয়ান কিছু বলতে যাবে তার আগেই রোদ বললো,

— আপনি কি চাইছেন?

— কই?

— যান তাহলে। নাহলে কিন্তু যাব না আমি।

রোদের হুমকি তে আদ্রিয়ান চলে গেল। দোষটা আদ্রিয়ানেরই। ওর উচিত ছিলো তারাতাড়ি ফিরে আসা। তাহলে তো বউটা এমন মনমরা হয়ে থাকত না। সবাই যেখানে গর্জিয়াস হয়ে থাকবে সেখানে রোদ কি যেই সেই ভাবে গেলে মানাবে? দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ঝটপট সাওয়ার নিয়ে বের হলো আদ্রিয়ান। পাঞ্জাবি পড়ে চুলগুলো মুছতে নিলেই রোদ সব এনে এনে দিচ্ছে। আদ্রিয়ান রোদের হাতটা ধরে বললো,

— চলো।

— কোথায়?

— লেট হোক। ব্যাপার না। পার্লারে চলো। আমি আছি তো।

— দেখুন লেট হচ্ছে আর এখন আমার মন ও চাইছে না। ওখানে পৌঁছাতে লেট হবে।

— কিছু হবে না।

— দয়া করুন এবার। একটু শুধু ওর কাছে বসুন। তাহলেই হবে। আমাকে কি বাচ্চা মনে হয় যে সাজতে না পেরে কাঁদব? আজব! আমার ছেলে থেকে কি ঐ সব বেশি?

বলেই ওয়াসরুমে ডুকে দরজা লাগিয়ে দিলো রোদ। মেজাজ এখন বেশি খারাপ লাগছে। আদ্রিয়ান কি না এখন দরদ দেখাচ্ছে? কেন রে ভাই রোদ কি বুঝে না কিছু? অবুঝ ও? মন খারাপ হয়েছে ঠিক তাই বলে তো আর ছেলে থেকে ঐসব বেশি না। হাত মুখ ধুয়ে রুমে এসে নরমাল একটা ড্রস পরে নিলো রোদ। আদ্রিয়ান তখন পুরো রেডি। আদ্রর ছোট ছোট কাপড় রাখা। সেগুলোই পড়াচ্ছে ছেলেকে। সাথে একটা ব্যাগও প্যাক করলো ছেলের যাবতীয় খাবার আর এক্সটা পোশাক নিয়ে। রোদ ততক্ষণে একটা বোরকা পড়ে হিজাব বেধে অল্প করে নিজেকে সাজালো। একদমই অল্প। রোদ ঘুরতেই আদ্রিয়ান তাকিয়ে রইলো। বোরকটা যথেষ্ট দামি এবং সুন্দর তাই বলে যে রোদকে এতটা মানাবে তা কখনো ভাবে নি। গত মাসেই এনেছিলো। রোদকে এতেই যথেষ্ট সুন্দর লাগছে। হয়তো লেহেঙ্গা’টা পড়ে সাজলেও সুন্দর লাগতো কিন্তু এরকম সুন্দর লাগত না। এতটা স্নিগ্ধ আর নরম সুন্দৌর্য আসত না তাতে। আদ্রিয়ান উঠে এগিয়ে গিয়ে ওর কাপলে চুমু খেয়ে বললো,

— মাশাআল্লাহ সোনা। অনেক সুন্দর লাগছে।

রোদ হাসলো একটু। পুচকু আদ্র হাত পা ছুড়ছে। রোদ এগিয়ে এসে ছেলেকে কোলে তুলে বললো,

— আপনার এই জন্য মা সব ত্যাগ করতে রাজি আব্বা। শুধু আপনি এভাবে হাসতে থাকুন।

#চলবে….

#ভালোবাসার_ভিন্ন_রং
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫৫(শেষাংশ)
#সমাপ্ত_পর্ব

বেশ সুন্দর ভাবেই বিয়েটা সম্পূর্ন হলো। জারবাকে বিদাই করা মোটেও সহজ হলো না কারো জন্য। এই মেয়ে তো এখানেই কেঁদে নিজেকে এলোমেলো করে ফেলেছে। দুই ভাইয়ের চোখেও পানি। ইয়াজ আরিয়ানের হাত ধরে বললো,

— ভাই আজ নাহয় থাকুক। কাল নাহয় নিয়ে যাব নে। ও ভয় পাচ্ছে।

আদ্রিয়ানের বাবা’র বুকের উপর পড়া পাথর যেন এতেই সরে গেলো। কোন বর বউয়ের কান্নায় এতটা গলে যায়। জারবার কান্নায় ইয়াজ নিজেই ঘেমে নেয়ে উঠেছে। কতটা টেনশনে আছে তা ওর চেহারায়ই বুঝা যাচ্ছে। আদ্রিয়ানের বাবা এবার বুক থেকে মেয়েকে সরিয়ে দুই গালে হাত রেখে বললেন,

— আম্মু। যেতে হবে তো। কালই আবার আমরা নিয়ে আসব তোমাকে। দেখো সবাই অপেক্ষা করছে। আব্বুর কথা শুনবে না আব্বু’র পরি?

জারবা কেঁদে কেঁদে মাথা নাড়লো। দুই ভাই মিলে বোনকে গাড়িতে তুলে দিলো। ইয়াজ শেষ মেষ কান্ড করেই বসলো। রোদ যখন ইয়াজকে কিছু বলছিলো যাতে জারবার সব ঠিক করে নিয়ে যায় তখনই ছেলেটা কেঁদে ফেললো। যদিও ওরা সাইডে ছিলো। রোদের কোলে আদ্র থাকাতে ও তেমন ভাবে সামলাতেও পারলো না। আদ্রিয়ান ওদের দেখতেই এগিয়ে এলো। ইয়াজ’কে জড়িয়ে ধরলো। সান্ত্বনা দিলো। ইয়াজ বোকার মতো করে রোদের হাত ধরে বললো,

— রোদ বোন আমার প্লিজ আজকে চল না আমার সাথে। আম্মু বাদে তো তেমন কোন বোন নেই আমার। তুই চল না। নাহলে জারবা ভয় পাবে।

রোদ চাইলেও যেতে পারবে না। কারণ আদ্র নিয়ে কোথাও ও থাকতে পারে না। তারমধ্য মিশি আছে। বুদ্ধি খাঁটিয়ে রোদ বললো,

— আচ্ছা আমি দেখছি। দাঁড়া।

রোদ তিশা আর অন্য একটা কাজিনকে বউয়ের সাথে পাঠিয়ে দিলো। কিছুটা সস্তি পেল ইয়াজ। বিদায় জানিয়ে বউ নিয়ে রওনা দিলো। পেছন থেকে জাইফ মুখ গোমড়া করে তাকিয়ে রইলো। ভেবেছিল আজ বোনের শশুর বাড়ী থাকবে। এখন ক্যান্সেল। যার জন্য থাকবে সে ই তো নেই। রোদ বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। এই দু’জনে যে কিছু চলছে তা ও আগেই বুঝেছিলো। ঠিক একবছর আগে।
.
ভেন্যু ছাড়বে এমন সময় চিৎকার শুনা গেলো। দিশা গলা ফাটিয়ে কেঁদে দিলো। পেইন উঠেছে বুঝতে কারো বাকি রইলো না। রাতুল তারাতাড়ি ওকে ধরলো। একপ্রকার হইচই লেগে গেল মুহূর্তেই। মেহমান সব আগেই চলে গিয়েছিলো যারা ছিলো তারা আত্মীয়। সবাই ছুটলো হসপিটালে। ছোট আদ্র’কে নিয়ে রোদ ও গেলো। হসপিটাল সামনেই। তাই আদ্রিয়ান ও না করে নি। শুধু ঘুমন্ত মিশি’কে মিশান সহ বাবা-মা আর সাবা’দের বাসায় পাঠিয়ে দিলো। আরিয়ানা আর আলিফ ও ছোট। ওদের যাওয়ার মানে হয় না।

দিশার হাত ধরে রাতুল ওকে সাহস দিচ্ছে। যখন লেবার পেইন এ দিশা ছটফট করছিলো তখন রাতুল ওর হাতটা শক্ত করে ধরে আল্লাহ’কে ডেকেছে। একসময় বাবা মায়ের প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাতুল দিশার মেয়ে ভূমিষ্ট হলো। নরমালেই এসেছে সে। একদম ছোট্ট একটা শিশু। বাচ্চাটাকে পরিষ্কার করেই দেয়া হলো তার বাবা’র কোলে। ভিন্ন রং এর আবির্ভাব ঘটলো রাতুলের জীবনে। বাবা হওয়ার মতো অতুলনীয় খুশিতে যেন পাগল প্রায় হলো রাতুল। দিশা’কেও দেখানো হলো। দূর্বল শরীরে ও দিশা হাসলো। ছোট্ট একটা রাতুল এসেছে দিশা আর রাতুলের ভালেবাসার চিহ্ন হিসেবে। কতশত কষ্ট। অবহেলা আর তিক্তটা পূর্ণ একটা সম্পর্ক এখন জোড়ালো হলো। মজবুত হলো। ভৃত্তি’টা যেন মজবুত হলো ছোট্ট এই প্রাণের স্পন্দনের মাধ্যমে।
.
জারবা এসেই নেতিয়ে গেলো। ইয়াজ কোলে তুলে সোজা ড্রয়িং রুমে এনে রাখলো ওকে। তিশা আর অন্য কাজিনটা থাকাতে কিছুটা সুবিধা হলো। ইয়াজের মা তারাতাড়ি হাত ধুয়ে বউয়ের জন্য খাবার নিলো। তখন মেয়ে’টা খেতে পারে নি। ইয়াজের বাবা পাশেই লেবুর পানিতে চিনি মিশাচ্ছেন। নিশ্চিত মেয়েটা টায়ার্ড এটা ভেবেই করা। এক ছেলে পেলে বড় করেছেন তারা। এখন তাদের মেয়ে এসেছে। মেয়েকে একদম এই রাজ্যের রাজকন্যা বানিয়ে রাখবেন তারা।

যেই ভাবা সেই কাজ। তারাতাড়ি করে ইয়াজের বাবা জারবাকে শরবত দিলেন। খেয়ে যেন দূর্বল জারবা একটু সস্তি পেলো। ইয়াজ ততক্ষণে সেরওয়ানী খুলে পাতলা টিশার্ট পড়ে এসেছে। এসেই দেখলো ওর মা জারবাকে খায়িয়ে দিচ্ছে। কেমন বোকাসোকা বউ ওর। মাথার ঘোমটা তো দূর থাক টিকলিটা ও সোজা নেই। ইয়াজ জানে ওর পরিবারে এমন একটা বোকা পাখি ই দরকার ছিলো। যাকে ওর বাবা-মা পুতুলের মতো রাখবে। টোনাটুনির সংসারে এই জারবার ই প্রয়োজন ছিলো। সারাদিন ইয়াজ বাসায় না থাকলে তারা একা একাই সময় পার করে এখন তাদের সঙ্গী হলো।

খাওয়া হতেই তিশা জারবা’কে রুমে নিয়ে গেলো। পিছন থেকে ইয়াজ বলে দিলো,

— তিশা ওকে এগুলো খুলিয়ে পাতলা ড্রেস পরিয়ে দিস।

তিশা “আচ্ছা” ভাই বলে ভেতরে গেলো। জারবাকে ঐ সব খুলাবে কি উল্টো নিজের ব্যাগ থেকে লিপস্টিক বের করে জারবার ঠোঁটে দিতে দিতে বললো,

— ইশ নতুন বউ সব লিপস্টিক খেয়ে ফেলেছে।

বলেই আবার জারবাকে বড়সড় ঘোমটা টেনে দিয়ে বললো,

— কখন এভাবে থাক। ইয়াজ ভাইকে পাঠাচ্ছি।

— তুমি আরেকটু থাক তিশা।

— উহু। রাত কত হলো। বেচারা ইয়াজ ভাইয়ের পকেট খালি করে এখনি ঘুমাতে যাব আমি।

বলেই জারবার কানে কানে কিছু বলে চলে গেল। টিপটিপ করা বুক নিয়ে বসে রইলো জারবা। এতটাও বোকা নয় ও যতটা তিশা ভাবলো। লজ্জায় লাল হয়ে ঠাই বসে রইলো ও।
তিশা সোজা ইয়াজের কাছে গিয়ে বললো,

— ইয়াজ ভাই, পাঁচ হাজারের এক টাকা ও কম চলবে না।

— কি করবি?

— তোমার বউকে তো ঠিকঠাক সদর ঘাট বানিয়ে দিয়ে এলাম। এবার টাকাটা দাও।

— কি করে?

— ঘুমাচ্ছে।

— ওহ।

বলে পকেট হাতড়ে হাজার টাকার কচকচে পাঁচটা নোট তিশার হাতে দিয়ে বললো,

— এটা পুরোটা তোদের দু’জনের। রোদের টা আলাদা রাখা আছে।

তিশা খুশিতে আত্মহারা হয়ে চলে গেল। ইয়াজ ড্রয়িং রুমের লাইট গুলো অফ করে রুমে গেলো। ওমা! পুরো রুম ঘুটঘুটে অন্ধকার। ইয়াজ লাইট জ্বালাতেই চমকালো। এই রাতের বেলায় চাঁদের আলোর ন্যায় আপসরী তার বিছানায়৷ এক হাত ঘোমটা টেনে সে বসে আছে। ইয়াজের অপেক্ষা বুঝি? ঠোঁট কামড়ে হাসলো ইয়াজ। এগিয়ে গেলো ধীর পায়ে। কাছে এসে ঘোমটা তুলতেই দেখা পেলো পরমা সুন্দরীর। ইয়াজের অর্ধাঙ্গিনীর। হ্যাঁ ইয়াজের বউ। কথাটা বারকয়েক আওড়ালো ইয়াজ। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো জারবা’র কোমল মুখ। কেঁপে উঠল জারবা। ইয়াজ ওর হাত ধরে বললো,

— জড়িয়ে ধরি। একবার শুধু। প্লিজ!

জারবা চুপ করে রইলো। ইয়াজ এগিয়ে এলো কিছুটা। আলতো হাতে জড়িয়ে নিলো। একসময় শক্ত হলো হাতের বাঁধন। আস্তে করে জারবার মাথায় চুমু খেয়ে বললো,

— আমার বউ।

— আমার জামাই।

ইয়াজ হেসে ফেললো। ওকে ছেড়ে উঠে বললো,

— শয়তান তিশাকে বললাম তেমাকে হেল্প করতে।

বলে নিজেই মেকাপ রিমুভার দিয়ে জারবার মেকআপ তুলতে লাগলো। একদম পরিষ্কার করে জারবার জন্য আনা একটা নাইট ড্রেস ওর হাতে দিয়ে বললো,

— রুমে চেঞ্জ করো। আমি বারান্দায় আছি। চেঞ্জ করে ডাকবে।

জারবা ঘাড় নাড়ালো। ইয়াজ যেতেই চেঞ্জ করে একেবারে নিজেও বারান্দায় এসে বললো,

— আমার শেষ।

ইয়াজ ওর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে বললো,

— ফ্রেশ হয়ে একেবারে ওযু করে এসো।

ভদ্র মেয়ের মতো তাই করলো জারবা। এসে একসাথে দুজন নফল নামাজ আদায় করলো একসাথে। শেষ করে জারবার মাথায় হাত রেখে দোয়া পড়ে ওকে ফুঁ দিলো ইয়াজ। ইয়াজের মুখের গরম বাতাস বেশ উপলব্ধি করলো জারবা। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো ইয়াজকে। ইয়াজ দাঁড়িয়ে ফট করে ওকে কোলে তুলে নিয়ে ধীমি গলায় বললো,

— নাও আই ওয়ান্ট ইউ মাই সুগার ক্যান্ডি।

জারবা লজ্জায় মুখ গুজলো ইয়াজের বুকে। ঘর কাঁপিয়ে হাসলো ইয়াজ। মনে মনে বললো, “পাগলের বুঝ ষোল আনা”।
.
দিশার বাচ্চা দেখে যেই না বাড়ি ফিরবে তখনই জানতে পারলো দিশা ব্রেস্ট ফিড করাতে পারছে না। হসপিটালের বিশেষ দুধ ও ডক্টর চাইছে না বারবার দিতে কারণ সেটা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া দেয়া হয় না। আপাতত অন্য কেউ ফিড করাতে পারলে ভালো হয়। কিন্তু এমন সময় কাকেই বা পাবে রাতুল। মেয়েটাও ক্ষুধায় কেঁদে যাচ্ছে। পৃথিবীর আলো দেখেছে তার চার ঘন্টা হয়ে এলো। হঠাৎ ওদের কথার মাঝে দিশার মা বলেই ফেললো,

— রোদ মা তুই একটু খাওয়া না। দিশার তো হচ্ছে না।

রোদ চমকালো। একটু বেশিই চমকালো। চমকালো রাতুল নিজেও। আদ্রিয়ান হয়তো একটু চমকেছে কিন্তু ততটাও না। রাতুলের মা রোদের হাত ধরে বললেন,

— মা একটু খাওয়াও না। দেখো কিভাবে কাঁদছে।

রোদ কিছু বুঝে উঠার আগেই আদ্রকে কোলে নিয়ে এসে বললো,

— অবশ্যই খাওয়াবে। কেন নয়?

রাতুল যেন ভিষণ চমকালো। তারাতাড়ি ওকে দিশার কেবিনে নিলো। রোদ মিনমিন করে বললো,

— অন্য কোথাও খাওয়াই।

ওর চাচি বললো,

— কি হয়েছে? আমরাই তো।

রোদ মুখটা নীচু করে রাখলো। আদ্রিয়ান জানে রোদ কারো সামনে ফিড করাতে পারে না আদ্রিয়ান ছাড়া। ও আদ্রিয়ানের সামনেই ঢেকে ঢেকে ফিড করায়। আদ্রিয়ান রোদকে নিয়ে পাশের কেবিনে গেলো। সেটা খালি আপাতত। সেখানেই রোদ প্রথম বারের মতো আদ্র বাদে কাউকে ফিড করালো। ছোট কয়েক ঘন্টার মেয়েটা কিভাবে খাচ্ছে। কি মনে করে কেঁদে ফেললো রোদ। আদ্রিয়ানের ও চোখ লাল হয়ে গেল। ছেলেকে আরেকটু চেপে ধরলো। ওদের মেয়েটা থাকলে তো এভাবেই খেত। ভাবতেই কেমন গলায় দলা পাকিয়ে কান্না আসে। রোদ খাওয়ানো হতেই বাচ্চাটাকে আদরে আদরে ভরিয়ে তুললো৷ চাইলেও থাকতে পারবে না এখানে। কেমন একটা টান অনুভব হচ্ছে এখনই। আদ্র ততক্ষণে জেগে উঠলো। জাগতেই তার খাবার চাই। রোদ ছেলেকে খায়য়ে একেবারে বের হলো। রোদের চাচি এসে বললো,

— জাইফা এসে আবার সকালে খাওয়াবে। এখন বাসায় যা মা।

রোদ যাওয়ার আগে ও বারবার তাকিয়ে দেখলো ঘুমন্ত মেয়েটাকে। মন চাইছে না যেতে। তবুও অপারগ রোদ আদ্রিয়ান।

____________________

বর্ষা কেটে শরৎ উঁকি দিচ্ছে। সাদা সাদা কাঁশ ফুলে চারদিক ঘেরা। আশে পাশে লেক আর নদীর পানি এখন টাইটুম্বুর। সবাই ঘুরতে যাচ্ছে প্রিয়জনকে নিয়ে। হারাচ্ছে সাদা মেঘের আড়ালে। প্রেম বিলাস করছে নব পুরাতন সকল জুটি৷ কেউ কেউ শরৎ উৎযাপন করতে সাদা শাড়ী পড়ে এসেছে। ষড়ঋতু’র দেশ হলেও আমরা তিনটা বাদে বাকিগুলো তেমন উপভোগ করতে পারি না। কিন্তু চারুকলা থাকাতে তা ভুলাও সম্ভব না। প্রতিটা ঋতু এখানে পালন করা হয়। বরণ করা হলো নিত্য নতুন সাজে।
এত সবের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো রোদ। গাড়িতে বসেই দেখছিলো ও। ভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়েছে আজ কয়েক মাস হলো। নিউট্রিশন এন্ড ফুড ইন্জিনিয়ারিংএ করছে রোদ। রোদ নিজের কোন ইচ্ছে প্রকাশ করে নি। আদ্রিয়ান ই এটাতে দিলো। রোদ ও না করে নি কারণ এটাও বায়োলজি বেস্ড। রোদের অনেকটা সুবিধা হবে। সরকারি ভার্সিটি হওয়াতে রোজ আসার ঝামেলা নেই। আজ পরিক্ষা বিধায় এসেছে। রোদের পরিক্ষার সময় আদ্র’কে আদ্রিয়ানই রাখে। মা ছাড়া থাকতে চায় না সে।
গাড়িটা বাসাতে ডুকতেই দৌড়ে মিশি এলো। বাড়ির সামনেই ছিলো আজ। রোদ নামতেই হাঁটু জড়িয়ে ধরে বললো,

— মাম্মা?

— জ্বি মা। আমার মা বাইরে কি করে?

বলেই কোলে তুলে নিলো। মিশি মায়ের গালে চুমু খেয়ে ব্যাগে হাত দিলো। রোদ তাতে আলতো চাপড় মে’রে বললো,

— কিছু আনি নি।

— আমি দেখব।

ব্যাগ হাতিয়ে ঠিকিই মিশি দুটো ক্যাটবেরি করলো। রোদ ওকে নিয়ে ভেতরে ডুকতে ডুকতে বললো,

— একটা বড় ভাইকে দিবে।

— আচ্ছা।

রোদ রুমে ডুকার আগেই আদ্রিয়ানের কথা শুনতে পেলো। ছেলের সাথে কি বলে এই লোক আল্লাহ মালুম। রুমে ডুকতেই দেখলো আদ্রর ছোট্ট পেটে আলগা করে মাথা রেখে আদ্রিয়ান আবদার করে বলছে,

— আব্বা চুলগুলো টেনে দিন।

রোদ ফিক করে হেসে উঠলো। আদ্রিয়ান ঐ দিকে তাকিয়ে বললো,

— কখন আসলা?

— যখন আপনি এক বছরের ছেলেকে চুল টেনে দিতে বলছিলেন।

বলেই ভেতরে ডুকতেই আদ্র’র কাছে এলো। ছোট্ট আদ্র মা’কে এতক্ষণ পর দেখেই হাত বাড়িয়ে ডাকতে লাগলো,

— আমমা। আম্মমা।

রোদ চোখ ভরে ছেলেকে দেখলো। হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিয়ে বসলো বিছানায়। আদ্রিয়ান ওর ফাইল আর ব্যাগ গুছিয়ে রাখছে। রোদ আদ্র’কে কোলে নিতেই বড় বড় চোখ দুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মা’কে দেখলো সে। মুখ খুলে আবারও ডাকলো,

— আআম্মা…

— জ্বি মা। এই যে আম্মা। আমার বাবা কি করছিলো? আম্মার বাবা কি খেয়েছে? আব্বা কি তাকে খায়িয়েছে?

আদ্রিয়ান মায়ের কাঁধে মুখ দিয়ে রাখলো। নাক মুখ ঘঁষলো মায়ের গালে। বুকে। মায়ের গালে লালা ভরিয়ে ছলছল চোখে তাকালো। রোদ বুঝে নিলো ছেলে তাকে মিস করেছে। আজই শেষ পরিক্ষা ছিলো। আর চিন্তা নেই। আদ্র’কে বুকে নিয়েই হিজাবটা খুলতে চাইলো। পেছন থেকে কারো হাত তা খুলতে সাহায্য করলো। খুলা হতেই রোদ আদ্র’কে বুকে নিয়ে কাঁত হয়ে শুয়ে পরলো। বাকিটা আদ্র এখন নিজেই পারে। মায়ের কাছে সে খাবে এখন। মায়ের ঘ্রাণ নিবে। একদম শান্ত ভদ্র ছেলে যাবে। চুকচুক শব্দ করে সে খাচ্ছে। রোদ আরেকটু জড়িয়ে বুকের উপর তুলে নিলো। মায়ের বুকের উপর শুয়েই আদ্র খাচ্ছে। অনেক ঘন্টা মা ছাড়া ছিলো আজ।

আদ্র কে শান্ত দেখেই আদ্রিয়ান এগিয়ে এসে রোদের মাথার কাছে বসলো। চুলে হাত বুলিয়ে বললো,

— পরিক্ষা কেমন হলো?

— আলহামদুলিল্লাহ। আজই শেষ।

— হুম।

— কেঁদেছিলো?

— সেটা আবার বলতে? পাগল বানিয়ে ফেলেছে আমাকে। ওর আম্মা চাই ব্যাস। আব্বা দিয়ে কি আর এত ঘন্টা চলে?

— খায়নি?

— অর্ধেক সেরেলাক্স খেল। জোর করেও খাওয়াতে পারি নি। পরে মিশানের কাছে ঘুমিয়েছিলো একটু।

— ওহ্। আজকে কি ব্যাস্ত?

— কেন?

— এমনিতেই।

আদ্রিয়ান রোদের মাথাটা নিজের কোলে রাখলো। দুই হাতে চুলের ভাজে বিলি কাটতে কাটতে বললো,

— তোমার জন্য আমি সবসময় ফ্রী? বলো।

— আরে তেমন কিছু না। এমনিই বললাম। আচ্ছা আপনি কি জানেন কাঁশ ফুল ফুটেছে।

— খেয়াল করি নি। উড়ে উড়ে আসে মাঝে মধ্যে।

— হু।

— ঘুমিয়েছে ও। রেখে উঠো। গোসল করে এসো। ওকে আমি করিয়েছি।

রোদ আস্তে করে আদ্র’কে বুক থেকে নামালো। দুই দিকে বালিশ দিয়ে কাপড় নিয়ে ডুকলো ওয়াশরুমে।
.
রাদ, জাইফা তাদের ছেলে রুহানকে নিয়ে এসেছে রাতুলদের বাসায়। রাতুল ই দাওয়াত করেছিলো। দিশা একা হাতে সব রান্না করেছে। হাজার চেয়েও শাশুড়ী থেকে হেল্প নেয় নি ও। রাতুল সামলেছে রুহানী’কে। তার পরীটাকে। একদম ঠান্ডা মেজাজের মেয়ে ওর। চুপচাপ থাকে। কাঁদে ও খুব কম। রাতুল মেয়েকে কোলে নিয়েই দরজা খুললো। প্রিয় বন্ধুকে দেখে একহাতে জড়িয়ে নিলো। জাইফা এসেই রুহানীকে কোলে নিলো। ওর সাথে বিশেষ এক সম্পর্ক আছে ওর। রুহানীর দ্বিতীয় দুধ মা ও। প্রথম দুধ মা রোদ। পালাক্রমে দীর্ঘ চল্লিশ দিন ওরা ফিড করিয়েছিলো এই ছোট্ট জানটাকে। এরপর থেকে দিশা ই ফিড করাতে পেরেছে। তাই আর প্রয়োজন পরে নি।
ওদের ভেতরে নিয়ে বসালো রাতুল। সম্পর্কের তিক্ততা গুলো এখন নেই। দিশা হাসি মুখে খাবার বেরে দিচ্ছে। রাদ যখন ওকেও বসতে বললো। দিশা মুচকি হেসে বললো,

— উনার সাথে খাব ভাইয়া। আপনি খেয়ে নিন।

রাদ প্রশান্তির হাসি হাসলো। দিশা নামক একটা অধ্যায় একটা সুখী। দুঃখ শেষ সে এখন কারো রাজ্যের রাণী। ভালেবাসার ভিন্ন রং এর দেখা পেয়েছে সে এখন। রঙিন হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

_______________

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আকাশে উড়ে যাচ্ছে সাদা সাদা ফুলা ফুলা পেজা তুলোর ন্যায় মেঘ। একসাথে কত গুলো সময় পার হলো। মাস পার হলো। জারবাকে পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরতেই জারবা মুখ গোমড়া করে বললো,

— ছাড়ুন। কথা নেই।

— কেন কেন?

— তখন কে ধমকালো।

— সেই কথা আবার বললে আবারও ধমক খাবা জারবা।

বলেই ওকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল ইয়াজ। বারান্দার রেলিং এ হেলান দিলো। জারবার দিকে তাকাতেই সেই রাগ ধরে রাখতে পারলো না। কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বললো,

— সময় হোক জারবা। আমরা ও বেবি নিব। এখন তুমি সামলাতে পারবে না ময়না পাখি।

— পারব। সত্যি।

— দেখা যাক। আল্লাহ দিলে হবে। এত অধৈর্য হলে হয়?

— হুম।

— আমার জান কি খেয়েছে?

— হুম।

জারবার হাতটা নিজের বুকে রাখলো ইয়াজ। জারবা তাকালো। এই লোকটার নেশালো চোখে ও ডুবে যায় বারবার। হাজার বার। ভিন্ন ভিন্ন ভালোবাসার রং দেখতে পায়। একদম কাছে থেকে। যতটা কাছে থেকে বুকের ধুকপুকানি শুনা যায়।
.
বিকেল হতেই আদ্রিয়ান ফিরে এলো। রোদ তখন কিচেনে ছিলো। হাত মুছতে মুছতে বের হয়ে আদ্রিয়ানকে দেখে আবারও কিচেনে ডুকে শরবত নিয়ে রুমে গেলো। এগিয়ে দিতেই আদ্রিয়ান এক ঢোকে খেয়ে নিলো। রোদ জিজ্ঞেস করলো,

— এত তারাতাড়ি?

— একটা মিটিং ছিলো।

— ওহ্।

— কি করছিলে?

— আদ্র’র খিচুড়ি রান্না করলাম৷

আদ্র তখন হামাগুড়ি দিয়ে মায়ের কাছে আসতেই রোদ কোলে তুলে নিয়ে মিশানকে বললো,

— আব্বু দেখো তো বোন কোথায়। বলো মা ডাকে। খাবে এখন।

আদ্রিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

— এখন বাইরে যাব। মিশান মিশিকে নিয়ে এসো। তুমি ই রেডি হও।

দুই লাফে মিশান বাবা’র কাছে এলো। আদ্রিয়ান জানে ছেলে কতটা খুশি হয়েছে। মিশান শুধু বাবা’কে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানিয়েই দৌড়ে।
মিশান যেতেই রোদের থেকে ছেলে’কে নিলো আদ্রিয়ান। আদ্র গালে টোল ফেলে হেসে উঠলো। মুখে ডাকতে লাগলো,

— আবব্বা। আব্বা।

— জ্বি আব্বা। আব্বা’র জান কি খেলছিলো।

আদ্রর বয়সে বাকি বাচ্চারা আরো কথা বলতে পারলেও আদ্র একটু কম পারে। তাতে অবশ্য রোদ আদ্রিয়ান কারোই আফসোস নেই। তাদের ছোট্ট সোনা মা-বাবা’কে ডাকতে পারে এই ঢের। আদ্রর আধো আধো গলায় এই “আব্বা আম্মা” ডাকটা দুই জনের কাছেই স্বর্গ সুখ এনে দেয়।

রোদ আদ্রিয়ানের ব্লাজার খুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,

— কোথায় যাবেন।

— দিয়া বাড়ি।

— আজব কেন?

— কাঁশ ফুল দেখতে।

রোদের ঠোঁটে আলতো হাসির রেখা ফুটলো। আদ্রিয়ানটা কিভাবে যেন সব বুঝে যায়।
.
আদ্রিয়ানের কোলে আদ্র। রোদের হাতে ধরা মিশি তার হাত ধরা মিশান। পাঁচজন একসাথে হেটে যাচ্ছে সামনের দিকে। সাদা সাদা কাঁশ ফুল বিলাস করছে তারা। এত এত জুটি এখানে অথচ এমন ভরা সংসার কয়জনের আছে? আদ্রিয়ান রোদের আছে। যাদের সংসার এখন পরিপূর্ণ। হয়তো মাঝে মধ্যে বুকের কোন এক জায়গায় চিনচিন ব্যাথা হয়। একটা প্রাণ নাহয় চলে গিয়েছে। তবুও আজ ওরা আছে। এত এত ভালোবাসাময় ঘিরা একটা রঙিন পৃথিবী আছে। যার সর্বোপরি জুড়ে আছে ভিন্ন রং এর বিচরণ। দূর থেকে যেন বাকিরা হিংসা করবে। এতটা সুন্দর গোছালো সংসার ও হয়? এতটা ভালোবাসা কি আদৌও হয়? উত্তরের থেকে উদাহরণটাই নাহয় হোক রোদ আদ্রিয়ানের এই ভিন্ন রং এর ভালোবাসা।

#সমাপ্ত

[ “রুদ্রিয়ান” মানে কোন নতুন গল্প লিখব না। যেখান থেকে “ভালোবাসার ভিন্ন রং” আজ শেষ হলো সেখান থেকেই শুধু করে কয়েকটা পর্ব লিখব আপনাদের অনুরোধে। সেটা পাবেন ২৫ তারিখ থেকে।]
( আমার এই গল্পে অনেক অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। আবার অনেক কটু বাক্য ও পেয়েছি। সর্বোপরি পেয়েছি একগাদা অনুপ্রেরণা। ভালোবাসা। অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে সাপোর্ট করার জন্য। শিঘ্রই ফিরে আসব আপনাদের রোদ-আদ্রিয়ান নিয়ে। ভালোবাসা রইলো অবিরাম)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে