মন উন্মনে আঁচড় পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
810

#মন_উন্মনে_আঁচড়
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ১০

.
মীতির দেওয়া খোঁচা বেশ বুঝতে পারলো রাতুল। তবে কিছু বলতে পারলো না। দরজা লাগিয়ে মীতির সামনে এসে দাঁড়িয়ে, “এ্যাই, তুমি কেন এসেছো? কার সাথে এসেছো? আসবে আমাকে জানাও নি কেন?”

“কেন এসেছি মানে কি? আমার বাসায় আমি কেন এসেছি, তা তোমাকে কেন বলবো?”

“আচ্ছা বেশ, এসেছো ভালো। কিন্তু আমাকে জানাও নি কেন? কার সাথে এসেছো?”

“একা এসেছি, কোন সমস্যা?”

এবার যেন রেগে গেল রাতুল। রাগী কণ্ঠে, “একা এসেছো মানে? কোন সাহসে একা বেড়িয়েছো বাসা থেকে? বাবা মা জানেন, বলে এসেছো তাদের?”

মুচকি হেঁসে না বললো মীতি, রাতুলের রাগের মাত্রা বৃদ্ধি পেল। ফোন বের করে তৎক্ষনাৎ কল দিলো মাহতাব শেখ কে। বিস্তারিত সবটা বলতেই ফোনের অপর পাশে হেঁসে উঠলেন মাহতাব শেখ। বললেন, “চিন্তা করো না বাবা, মেয়েটা মজা করছে তোমার সাথে।”

“মানে?”

“আমিই নামিয়ে দিলাম ওকে বাসার সামনে। তুমি না আসায় কাল থেকে মুখ ভার করে, মন খারাপ করে বসে ছিলো। সকাল থেকে আসার জন্য বায়না করে যাচ্ছিলো। মেয়ের এক কথা—বাপের বাড়িতে এভাবে এতদিন থাকা ঠিক নয়, আশেপাশের কেউ ভালো নজরে দেখে না।”

বলেই আবারও হেসে উঠলেন মাহতাব শেখ। রাতুল মীতির পানে তাকালো। মেয়েটার মুখে দুষ্ট হাসি। তা দেখে এতক্ষণের রাগটা নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল। মাহতাব শেখ বললেন, “মেয়েটার কথা ফেলতে পারলাম না বাবা, দিয়ে গেলাম।”

“কিন্তু বাবা, উপরে এলেন না।”

“অন্যদিন যাবো। জানি, বলতে হবে না। তবুও বলছি, মীতির খেয়াল রেখো রাতুল।”

“আপনি চিন্তা করবেন না, বাবা।”

হাসেন মাহতাব শেখ, আস্বস্ত হন। রাখছি বলে কল কেটে দিতে নেয়। তবে রাখেন না। বলে উঠেন, “রাতুল, মেয়েটার খেয়াল রাখতে গিয়ে নিজেকে ভুলে যেও না। নিজেরও খেয়াল রেখো।”

“আপনার মেয়ে আশেপাশে থাকলে নিজের খেয়াল রাখতে হয় না, বাবা। এভাবেই ভালো থাকি।”

.
“রাতুল, এগুলো কি?”

কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো মীতি। মেয়েটার কথায় সেদিকে তাকালো রাতুল। মীতির হাতে কিছু একটার প্যাকেট দেখলো, নিজেও বুঝতে পারলো না।
রাতে ঘুমানোর জন্য বিছানা ঝাড়ছিলো মীতি। হঠাৎ মনে হলো চাদরটা অপরিষ্কার লাগছে। ভেবেই আলমারি থেকে নতুন চাদর বের করতে গিয়ে দেখে প্যাকেট’টা। হাতে নিতেই ঝনঝন শব্দ হয়। কৌতুহল বাড়ে মীতির, জিজ্ঞেস করে রাতুলকে। বুঝতে না পেরে তাকে দিতে বলে রাতুল। প্যাকেটটা তার হাতে দিতেই মনে পড়ে—এটা তো মীতির জন্যই নিয়ে এসেছিলো, তাকে সারপ্রাইজ দিতে। কিন্তু হঠাৎ সেদিন ঝামেলাটা লাগায়….
সেসব কথা আর মনে করতে চাইলো না রাতুল। মীতির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললো, “এটা তোমার জন্য।”

“কি আছে এতে?”

“খুলেই দেখো, কি আছে।”

রাতুলের দিকে তাকিয়ে বেশ কৌতুহল নিয়েই খুলতে লাগলো। প্যাকেট’টা যতই খুলতে লাগলো, ততই ঝনঝন শব্দে সুর তুলতে লাগলো। খানিকটা সময় নিয়েই প্যাকেটটা খুলতে সক্ষম হলো মীতি, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। তা দেখে রাতুলের ঠোঁটের হাসিটা প্রসস্থ হলো। ভুরু নাচিয়ে বললো, “কেমন?”

“এটা আমার জন্য?”

“হ্যাঁ! তোমার জন্য। সারপ্রাইজ! পছন্দ হয়েছে?”

অবাকের মাত্রা বাড়লো মীতির। রাতুল কিভাবে জানলো? প্রশ্নটা মাথায় এলো মেয়েটার। পছন্দ না হবার অবকাশ নেই। ভালোবাসার জিনিসগুলো এক সময় পছন্দ হয়েই যায়, পছন্দের জিনিসও একসময় ভালোবাসার হয়ে যায়। ঠিক তেমনি রাতুলের দেওয়া এই ঘুঙুর গুলো মীতির ভীষণ পছন্দের ও ভালোবাসার। সে সত্যিই সারপ্রাইজ হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত এই জিনিসটা পেয়ে।

ছোট বেলা থেকেই ক্লাসিকাল নাচের প্রতি মীতির প্রবল আগ্রহ ছিলো। স্কুলের প্রতিটি অনুষ্ঠানে সে বড় আপুদের থেকে নাচ শিখে পারফরমেন্স করতো। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি পর্যন্ত তা অভ্যাহৃত ছিলো। আলাদাভাবে নাচও শিখতো মেয়েটা। কিন্তু ধীরে ধীরে পড়াশোনার চাপে একসময় চাপা পড়ে যায় মীতির শখের নাচ। তারপর বিয়ে, ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা, অতঃপর সংসারের ঘরনী হয়ে ওঠা। সব মিলিয়ে তার শখের নাচের কথা সে ভুলেই বসেছিলো। রাতুলের দেওয়া ঘুঙুর দেখে হঠাৎই জাগ্রত হয়ে উঠলো সেসব স্মৃতি। কিন্তু রাতুল কিভাবে জানলো তার নাচের কথা? কখনো বলেছিলো কি? ঠিক মনে করতে পারলো না। মনের প্রশ্নটা করেই ফেললো, “রাতুল, তুমি কিভাবে জানলে আমি নাচ করতাম?”

“আশ্চর্য! আমার বউয়ের শখ আহ্লাদের কথা আমি জানবো না?”

“বলো না কিভাবে জানলে? বলেছিলাম আমি? মনে পড়ছে না কেন আমার?”

“হ্যাঁ! তুমিই বলেছিলে। থাক, এসব নিয়ে এতটা ভাবতে হবে না তোমার।”

বারণ করলেও রাতুল জানে এই বিষয়টা নিয়ে ভাববে মীতি, ঠিক কবে তাকে বলেছিলো তা মনে করার চেষ্টা করবে। অনেক ছোট ছোট বিষয়গুলো মীতির মেমোরীতে নেই, ভুলে গেছে, কিছু কিছু কথা মনেও করতে পারে না। তা নিয়ে মাথা ঘামায় না রাতুল, যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে, প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে অন্য কথা বলে। রাতুল জানে, এসব বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত ভাবলেই মীতির ব্লাড ক্লট হবার সম্ভাবনা আছে।

বরাবরের মতো এবারও প্রসঙ্গ পালটাতে চাইলো রাতুল। মীতি কথা বাড়ানোর আগেই বলে উঠলো, “এ্যাই! মেয়ে, শোন। নাচার পারমিশন দিয়েছি বলে নাচতে নাচতে যার-তার সামনে যাবে না, বলে দিলাম।”

রাতুলের এহেন সতর্কবাণী তে হাসি পেল মীতির, সহসায় ভুলে গেল আগের কথা। কিছু বলতে নিলেই হাত ধরে তাকে কাছে টেনে নিলো রাতুল। আবারও বলে উঠলো, “তুমি শুধু আমার ব্যাক্তিগত ডান্সার। ওই তো, আগেকার জমিদার বাড়িতে ব্যাক্তিগত ডান্সার থাকতো না? ঘুঙুর পড়ে শুধু জমিদারের সামনেই নাচ করতো। জমিদার নেশাদ্রব্যে বুদ হয়ে সুন্দরীর নাচ দেখতো। ঠিক তেমনি তুমি শুধু আমার ব্যাক্তিগত ডান্সার। মনে থাকবে?”

“আর ওই সব নেশাদ্রব্য? সেটা থাকবে না?”

কাঠকাঠ গলায় বললো মীতি। তাতে হাসলো রাতুল। মীতিকে আরও কাছে টেনে দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলো। ফিসফিসিয়ে রাতুল বললো, “তোমার মতো একটা জ্বলজ্যান্ত নেশাদ্রব্য থাকতে ওসব নেশাদ্রব্যের প্রয়োজন পারবেনা মিসেস মায়মুনা শেখ মীতি।”

“কেন পড়বে না?”
রাতুলের মতোই ফিসফিসিয়ে বললো মীতি। রাতুল, “কারণ, আপনার নেশা এতটাই মারাত্মক যে, নির্ধিদায় আমি ঘায়েল হতে বাধ্য।”

বলেই যেন মীতির সাথে দুষ্টুমিতে মেতে উঠলো ছেলেটা, অবাধ্য ভাবে হাত দু’টো চলাফেরা করতে লাগলো। ঠিক যেন সেই আগের মতো। খিলখিল করে হেসে উঠলো মীতি, ভুলে গেল তার অসুস্থতা, এতোদিনের বিষন্নতা।
ছাড়ানোর চেষ্টা করলো রাতুলকে, বাধা দিতে লাগলো। কিন্তু অবাধ্য রাতুল ও তার হাত দু’টো কোন বাঁধায় শুনলো না। আরও নিজের সাথে আটকে নিতে লাগলো মীতিকে। হাসতে হাসতে মীতি বললো, “উফ্! রাতুল, ছাড়ো তো। এভাবে মা’রার প্ল্যান করছো আমাকে?”

“তুমি ম’রতে চাইলে আমি মা’রতে রাজি আছি, মিসেস!”

শান্ত হলো মীতি, ধক করে উঠলো তার হৃদপিণ্ড। এই বাক্যটা সে আগেও শুনেছে, কিন্তু কোথায়? ঠিক মনে করতে পারলো না। নিশ্চুপ হয়ে মনে করার চেষ্টা চালাতে লাগলো। আসলেই কি শুনেছিলো? না কি নিজের কল্পনায় এনেছিলো?
মীতি শান্ত হওয়ায় রাতুলও থেমে গেল। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো—কি হয়ছে? ধ্যান ভাঙলো মীতির, সেই কথাটা নিয়ে আর ভাবতে চাইলো না। মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু না বোঝালো। রাতুল বললো, “তাহলে? এমন থম মেরে গেলে কেন? আদরের ডোজ’টা কি বেশি হয়ে গেছে?”

“উহুঁ! কম হয়ে গেছে।”

বলেই রাতুলের গ্রীবাদেশে মুখ গুঁজে দিলো মীতি, দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বললো, “আপনার আদরের ডোজটা আরও বাড়াতে হবে মিস্টার রাতুল মাহমুদ। আর সেটাও এক্ষুনি।”

“হ্যাঁ! বুঝেছি। এবার ছাড়ো, ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি বিছানায় চাদর বিছিয়ে দিচ্ছি।”

বলেই মীতিকে ছাড়ানোর চেষ্টা। খানিকটা রেগে গেল মেয়েটা। বললো, “ছাড়বো মানে? কেন ছাড়াছাড়ি নাই। যা বললাম সেটা করো।”

“মীতি, তুমি অসুস্থ।”

“হ্যাঁ! অসুস্থই তো। এই যে, এতদিন তোমাকে কাছে না পেয়ে কেমন শুকিয়ে গিয়েছি, খাবারে অরুচি এসেছে, চোখে ঝাপসা দেখছি, তুমি ছাড়া বাকিসব ভুলে যাচ্ছি। এটা তো বিরাট অসুস্থতা, আর এই অসুস্থতার ওষুধ শুধু তোমার কাছেই আছে।”

“তুমি যে ব্যাপক ফাজিল হয়ে যাচ্ছো, তা কি জানো মেয়ে?”

শুনলো না মীতি, গাঁইগুঁই করতেই থাকলো। আহ্লাদীপনা যেন বৃদ্ধি পেল। অবশেষে হার মানতে হলো রাতুলকে। মীতিকে বুঝিয়ে বললো—আগে ফ্রেশ হয়ে আসতে। রাজি হলো মেয়েটা, রাতুলকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। চকিতেই ফের এসে বসলো তার সামনে। ছেলেটা ইশারায় জানতে চাইলো—কি হয়েছে? মীতিও ঠিক তার মতোই ইশারা করলো, মাথা নিচু করতে বললো রাতুলকে। কপাল কুঁচকে মাথা এগিয়ে আনলো। মীতি মুখ এগিয়ে নিলো রাতুলের কানের কাছে, আস্তে করে বললো, “আই লাভ ইউ! মিস্টার মাহমুদ সাহেব।”

কিঞ্চিৎ কম্পন সৃষ্টি হলো বোধহয় রাতুলের শরীরে। বুঝতে পারলো সে, কিন্তু বুঝতে দিলো না মীতিকে। প্রথমবার অর্ধাঙ্গিনীর মুখে ভালোবাসার কথা শুনে ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়েছে যেন তাকে। এই মুহুর্তটা হাতছাড়া করতে চাইলো বা রাতুল। দু’হাতে মীতির মুখটা আঁজলা করে ধরলো। ঠিক মীতির মতো করেই বললো, “ভালোবাসি মিসেস মায়মুনা শেখ!”

.
লিফট থেকে বেড়িয়ে নিজের ফ্লাটের সামনে আসতেই কেঁপে উঠলো রাতুলের হৃদপিণ্ড, চলতে লাগলো দ্রুত গতিতে। হঠাৎই যেন হাত হাত পা অসার হয়ে আসলো, মৃদু কম্পন সৃষ্টি হলো শরীরের। দরজায় তালা ঝুলানো দেখে সবটা এলোমেলো হয়ে গেল রাতুলের। মস্তিষ্কে হানা দিলো—তবে কি মীতি সত্যিই চলে গেল?
মুহুর্তেই কেমন জানি ছন্নছাড়া ভাব ফুটে উঠলো ছেলেটার মাঝে। মীতিকে নিয়ে আজকাল বড্ড ভয় রাতুলের মনে। মেয়েটার ভুলে যাওয়ার সমস্যাটা মারাত্মক ভয় তুলে রাতুলের মনে। ছোট খাটো বিষয়গুলো খুব সুক্ষ ভাবেই ভুলে বসে মীতি, কোথায় কি কারণে যায় সেটা ভুলে যায়, রাস্তা ভুলে যায়। মেয়েটার ভুল ভেঙে না দিলে কিছুতেই তা থেকে মন সরাতে পারে না, মনে করতে পারে না কথাটা। আর রাতুলের ভয়টা ঠিক এখানেই।

গতকাল রাতে সামান্য বিষয় নিয়ে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিলো তাদের। মীতি ভুলে যায় বলে, নিজেকে নানান ভাবে দোষারোপ করছিলো, রাতুল রেগে গিয়ে এসব না বলতে বাধা দেওয়াতেই কথা কাটাকাটির সূত্রপাত। একসময় মীতি বলে সুযোগ পেলেই চলে যাবে সে, থাকবে না আর। ভয়টা ঠিক সেজন্যই জেঁকে ধরলো রাতুলের। মেয়েটাকে সময় দিতে অফিস থেকেও আজ জলদি চলে এসেছে, কিন্তু….

পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল দিলো মীতির নাম্বারে, দাঁড়িয়ে না থেকে লিফটের কাছে আসলো। কিন্তু লিফট তখন চার তালা থেকে নয় তালার দিকে ছুটছে। অপেক্ষা করলো না ছেলেটা, মোবাইল কানে রেখেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। এর মাঝে বার কয়েক কল দিলো মীতির নাম্বারে, রিং হলেও রিসিভ হলো না। হন্তদন্ত হয়ে নিচে নেমে এলো রাতুল, বাসা থেকে বেড়িয়ে এপার্টমেন্টের গেইট পেরিয়ে রাস্তার নেমে এলো, ফের কল দিলো মীতির নাম্বারে। এবার শেষ দিকে এসে রিসিভ হলো, অপর পাশে মীতির কণ্ঠে ‘হ্যালো’ শুনতেই উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো, “হ্যালো! মীতি, কোথায় তুমি? কল করছি, ধরছো না কেন? কোথায় আছো তুমি?”

“আমি তো…”

“হ্যাঁ! কোথায় তুমি? দেখো, পাগলামি করো না। আমাকে বলো, এখনি আসছি আমি।”

“রাতুল, আমি তো… আসলে বুঝতে পারছি না এখানে কেন…”

যথা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো রাতুল। এতক্ষণে রাস্তার পাশ বেয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে হাটতে শুরু করেছে। মীতিকে বললো, “আচ্ছা, রিলাক্স! ঠান্ডা মাথায় বলো আমাকে। ঠিক কোথায় আছো…”

থেমে গেল রাতুল। রাস্তার পাশে একটা ফার্মেসির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো মীতিকে। ফোনে কোনরকমে—আমি আসছি, বলেই ছুটে গেল রাতুল। মীতির সামনে দাঁড়িয়ে যেন জোরে জোরে নিশ্বাস টেনে ছাড়লো। তাদের এপার্টমেন্টের সামনেই ফার্মেসিটা। অফিস থেকে ফেরার সময় গাড়িতে থাকায় মীতিকে নজরে আসে নি তার।

এদিকে রাতুলের এমতাবস্থায় খানিকটা ভরকে গেল মীতি। যাওয়াটাই স্বাভাবিক। ইন করা সাদা শার্ট এলোমেলো হয়ে ঘামে গায়ের সাথে লেপ্টে রয়েছে, চুলগুলোও এলোমেলো হয়ে পড়ে রয়েছে কপালে পড়ে আছে, চোখে মুখে চিন্তা ও আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। চিন্তিত স্বরেই মীতি বললো, “কি হয়েছে?”

মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু না বোঝালো রাতুল, ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে এলো মীতির কাছে। কোন কথা না বলে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটার মাথা বুকে রেখে চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো রাতুল। শান্ত হলো এবার, শীতল হলো তার হৃদপিণ্ড।

রাতুলকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো মীতি। কি করছে ছেলেটা? আশেপাশের সবাই যে তাদের দেখেছে, সেটা ভুলে গেছে কি? আস্তে করে বললো, “আরে, কি করছো রাতুল? ছাড়ো, সবাই দেখছে তো।”

“হু!”

‘হু’ বললেও ছাড়লো না। ফের রাতুলকে সরানোর চেষ্টা করলো মীতি, ছেড়ে দিতে বললো। এবার ছাড়লো রাতুল। খানিকটা রাগ কণ্ঠে বললো, “এখানে কি করছো তুমি? তোমাকে না বলেছিলাম, বাইরে না আসতে। আমাকে না বলে কেন এসেছো?”

“রেগে যাচ্ছো কেন? আমি তো….”

“রাগবো না? কতটা ভয় পেয়েছিলাম জানো? তোমার কিছু হলে…”

কথাটা শেষ না করেই থেমে গেল রাতুল। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিলো। মীতি নিপলক তাকিয়ে রইলো রাতুলের পানে। বললো, “ঠিক আছি তো রে বাবা।”

“আমাকে টেনশনে ফেলে ঠিক তো থাকবেই। এখন বলো কি নিতে এসেছিলে? আমাকে বললে কি আনতে পারতাম না?”

“আমি তো ওই….”

চুপ করে গেল মেয়েটা, মনে করতে পারলো না ঠিক কি নিতে এসেছে। আমতাআমতা করতে লাগলো, রাতুল হয়তো বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। বললো, “আচ্চা, বাদ দাও। মনে করতে হবে না।”

হঠাৎ সামনের ফার্মেসির দিকে নজর পড়লো রাতুলের। তারপর মীতির দিকে তাকিয়ে বললো, “ফার্মেসিতে এসেছিলো? কোন মেডিসিন লাগতো?”

বলেই একটু থামলো রাতুল। কিছু একটা ভেবে আবারও বললো, “পিরিয়ড শুরু হয়েছে? প্যাড লাগতো?”

মাথা ঝাঁকিয়ে না বোঝালো মীতি। পরক্ষণেই তার কিছু একটা মনে পড়লো। হ্যাঁ! পিরিয়ড। তার তো পিরিয়ড মিস গেছে, আর সেজন্যই সন্দেহের বসে প্রেগ্ন্যাসির কিট নিতে এসেছিলো। তা ভেবেই মুখ ফুটে উচ্চারণ করলো, “ওও শিট!”

“কি হলো?”

“আসলে রাতুল, আমি তো… পিরিয়ড মিস গিয়েছে। ভুলে যাই বলে ক্যালেন্ডারে দাগ কেটে রেখেছিলাম। আজকে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতে গিয়ে মনে পড়লো গত তিন মাসে পিরিয়ড মিস গেছে। তাই সন্দেহের বসে প্রেগ্ন্যাসির কিট….”

রাতুল যেন কথা বলতেও ভুলে গেল। কি বলছে মেয়েটা? গত তিম মাস পিরিয়ড মিস গিয়েছে? আর প্রেগ্ন্যাসি কিট? তার মানে মীতি…. কথা ভাবতেই যেন অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হলো রাতুলের। নিজেকে সামলে বলে উঠলো, “আমাকে বলো নি কেন, স্টুপিট!”

“ভুলে গিয়েছিলাম তো।”

শ্বাস টেনে নিলো রাতুলো। মীতিকে উদ্দেশ্য করে বললো, “তুমি এখানেই থাকো, আমি আনছি প্রেগ্ন্যাসি কিট।”

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো মীতি, রাতুল এগোতে লাগলো ফার্মেসির দিকে। কিছু একটা ভেবে ফিরে আসলো। বলে উঠলো, “তোমার ধারাণা যদি সত্যি হয়, মীতি?”

হাসলো মীতি। মুখে হাসি ফুটিয়েই বললো, “আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, উই আর গোয়িং টু বি প্যারেন্স!”

কিঞ্চিৎ কম্পন সৃষ্টি হলো রাতুলের শরীরে। কিন্তু বরাবরের মতোই তা নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলো। প্রতিত্তোরে কিছু না বলে ফার্মেসিতে গেল, খুব কম সময়ে হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে ফিরেও এলো। মীতির হাত ধরে বাসার দিকে এগোতে লাগলো।
লিফটে উঠে রাতুলকে ভালোভাবে দেখলো মীতি। কপাল কুঁচকে ওড়নার কোণা নিয়ে রাতুলের মুখ মুছে দিতে দিতে বললো, “ইস্! কি অবস্থা করেছো চোখ মুখের, এমন কেউ করে?”

হাসলো রাতুল, খানিকটা কাছে টেনে নিলো মীতিকে। আলতো স্বরে ডেকে উঠলো। রাতুলের মুখ ও গলার ঘাম নিজের ওড়না দ্বারা মুছে দিতে দিতে কপাল কুঁচকে মীতি বললো, “কি হয়েছে, ঘাম বসে যাবে না? মুছতে দাও।”

“পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে সময়, মন কাটিয়ে মন। তোমার মনের উন্মনে কেটেছি প্রেমের আঁচড়।”

থেমে গেল মীতির হাত, তাকালো রাতুলের পানে। মুখ ফুটে কিছু বললো না। এই ছেলেটার যে হুটহাট কি হয়, নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। রাতুল আলতো করে এক হাতে মীতির পেট স্পর্শ করলো। বললো, “এভাবে আমার মনের উন্মনে প্রেমের আঁচড় না কাটলেই পারতে, মিসেস মায়মুনা শেখ।”

.
.
সমাপ্ত…..!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে