মন উন্মনে আঁচড় পর্ব-০৮

0
510

#মন_উন্মনে_আঁচড়
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৮

.
ডাক্তারের আশ্বাসে খানিকটা স্বস্তি পেল রাতুল ও মাহতাব শেখ। মীতিকে সুস্থ দেখাটায় যেন তাদের এখন মূল উদ্দেশ্য। আরও কিছু কথা বলে ডাক্তার মীতির রিপোর্ট গুলো দেখায় ফের মনোযোগ দিলেন। রাতুল ও মাহতাব শেখ বেড়িয়ে এলেন কেবিন ছেড়ে। এখন শুধু মীতির জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী জ্ঞান ফেরার পর মেয়েটার ঠিক কি রিয়াক্ট হবে, তা ভাবতেই যেন ব্যস্ত রাতুল। মাহতাব শেখ দিকে তাকালো। বললো, “বাবা, এই ক’দিনে মীতির আচরণে কি কিছুই সন্দেহ হয় নি আপনার?

মাথা ঝাকালেন মাহতাব শেখ, না বোঝালেন। মাঝে মাঝে দু’একটা জিনিস ভুলে গেলেও তা মীতির দুঃচিন্তার কারণ ভেবে আর মাথা ঘামান নি। রাতুলের বিষয় নিয়ে এতটাই চিন্তিত ছিলেন যে, সেসব বিষয় এমনিতেই বেড়িয়ে গেছে মাথা থেকে। মীতির কথাগুলো বিশ্বাস করে রাতুলকেও ভুল বুঝেছেন, বলেছেন নানান কথা। রাতুলের কথাগুলো শোনার পর তাকে একাংশ বিশ্বাস করলেও মেয়ের কথাও ফেলে দিতে পারেন নি তিনি। কিন্তু এখন? এখন যেন নিজের কাছেই লজ্জিত মাহতাব শেখ।

রাতুলের দিকে তাকিয়েই আলতো করে তার হাতের উপর হাত রাখলেন মাহতাব শেখ। ধীর কণ্ঠে বললেন, “আমাকে ক্ষমা করে দিও বাবা, না জেনে তোমাকে নানান কথা বলে ফেলেছি।”

“আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন, বাবা? আপনি তো না জেনে মীতির কথায়…. মীতিও তো ইচ্ছে করে কিছু বলে নি। সবটাই তো ওর ভুল ধারণা ছিলো মাত্র।”

“তবুও রাতুল, তুমি আমাকে….”

“প্লিজ! বাবা। এসব আলোচনা আমরা পরে করি। আগে মীতির ব্যাপারটা…”

থামিয়ে দিলো মাহতাব শেখকে, রাতুল নিজেও চুপ করে গেল। মীতির ব্যাপারটা বড্ড ভাবাচ্ছে তাকে। মাহতাব শেখ করুন দৃষ্টিতে তাকালেন রাতুলের পানে। বললেন, “আমার মেয়েটা ঠিক হয়ে যাবে তো, রাতুল?”

“ভারসা রাখুন। মীতির কিছু হবে না, বাবা।”

মাহতাব শেখের কাছে রাতুল ভরসার স্থান, বিশ্বাসের স্থান। মীতির সাথে বিয়ের পর থেকেই রাতুলকে নিজ ছেলের মতো স্নেহ করেন তিনি, ভরসা করেন, ভালোবাসেন। সেই ছেলেটায় যদি এভাবে আশ্বাস দেয় তবে নির্ধিদায় ভরসা রাখা যায়। মাহতাব শেখ নিশ্চিন্ত হলেন। নিজ মনে ভাবলেন, ভুল করেন নি তিনি। মীতির জন্য বেস্ট’টাই পেয়েছেন। উঁহু! তিনি দিয়েছেন।

.
জ্ঞান ফিরে নিজেকে হসপিটালের বেডে দেখে বেশ অবাক হলো মীতি। ছটফটিয়ে উঠে বসলো। এখানে কি করছে সে? সে তো ফাহাদের সাথে ছিলো, বাবার সাথে ফাহাদকে পরিচয় করাতে নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু হসপিটালের বেডে কি করছে? আর ফাহাদ? কোথায় গেল ছেলেটা? নানান প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে উঠলো মেয়েটা। মুহুর্তেই উত্তেজিত হয়ে উঠলো যেন। এর মাঝেই একজন নার্স এসে মীতিকে এমতাবস্থায় দেখলো। মীতিকে, “আরে, কি করছেন? উঠেছেন কেন আপনি?”

বলেই এগিয়ে এলো মীতির কাছে। নার্সকে দেখে মীতি প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, “আমি এখানে কেন? ফাহাদ… ফাহাদ কোথায়?”

“ফাহাদ কে? দেখুন, আপনার অপারেশন হয়েছে, এভাবে উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয় আপনার জন্য। শান্ত হন।”

শান্ত হলো না মীতি, বরং নামতে লাগলো বেড থেকে। এগিয়ে এসে নার্স’টা ধরে ফেললো তাকে, নামতে বারণ করলো। কিন্তু কোন কথায় কানে নিলো না মেয়েটা। এবার যেন আর উপায় পেল না নার্সটা। মীতিকে রেখে ছুটে বেড়িয়ে গেল কেবিন ছেড়ে, ডাক্তারকে ডাকার উদ্দেশ্যে।

নার্স বেড়িয়ে যাবার দু’মিনিট পড়েই দু’জন ডাক্তার সহ সেই নার্সটা কেবিনে ঢুকলো। দরজার সম্মুখে আসতেই মীতিকেও ধরে ফেললো। টেনে নিয়ে বেডে বসাতে নিলেই মীতি উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বললো, “ছাড়ুন আমাকে, যেতে হবে আমার। ফাহাদ বাবার সাথে আছে, বাবা ওকে পছন্দ করে না, আমি না গেলে অপমান করে বের করে দিবে ওকে। ছাড়ুন।”

“আপনার বাবা হসপিটালেই আছে, আপনার হাসবেন্ড রাতুল ওনার সাথে আছে। আপনি প্লিজ শান্ত হন।”

“রাতুল? রাতুল কোথা থেকে আসবে? ও তো দেশের বাইরে আছে। ছাড়ুন আমাকে, যেতে হবে আমার…”

মীতির কথার মাঝেই থেমে গেল। ইতিমধ্যে ডাক্তারের ইশারায় মাহতাব শেখ ও রাতুলকে কেবিনে ডেকে এনেছে নার্স। মূলত মাহতাব শেখকে দেখেই চুপ করে গেছে মীতি, কিন্তু শান্ত হতে পারে নি। আবারও বলতে লাগলো, “বাবা… বাবা, ফাহাদ কোথায়? তুমি ওকে কিছু বলো না, প্লিজ! ও খুব ভালো ছেলে। প্লিজ বাবা, তুমি ওকে….”

ফের অসম্পূর্ণ কথার মাঝেই থেমে গেল মীতি। এবার মাহতাব শেখ বা ডাক্তারের জন্য নয়, রাতুলকে দেখেই সে থেমে গিয়েছে, কমে এসেছে তার উত্তেজিত হওয়ার মাত্রা। রাতুলকে দেখেই মেয়েটার মুখে হাসি ফুটে উঠলো, বিরবির করে বলে উঠলো, “ফাহাদ!”

এগিয়ে এলো রাতুল, মীতির খানিকটা কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। ডেকে উঠলো মীতিকে। বললো, “মীতি, শান্ত হও। এভাবে উত্তেজিতত হওয়া ঠিক নয় তোমার জন্য।”

“ফাহাদ, বাবাকে….”

“ফাহাদ?”

“হ্যাঁ! ফাহাদ, বাবার সাথে ছিলো তো। তুমিই তো….”

“এসব কি বলছিস মা? ফাদাহ আমার সাথে কেন থাকবে? ছেলেটাকে তো আমি কখনো দেখিই নি।”

ব্যাপক আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলেন মাহতাব শেখ। তার কথার প্রতিত্তোরে মীতি উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে নিলেই তাকে থামিয়ে দিলো ডাক্তার। রাতুলও কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে চুপ থাকতে বললেন মাহতাব শেখকে। মীতিকে উদ্দেশ্য করে ডাক্তার বললো, “দেখুন মিসেস মীতি, শান্ত হন। অপারেন হয়েছে আপনার, এভাবে উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয়।”

“কিন্তু ফাহাদ….”

ডাক্তার মীতিকে রাতুলের দিকে ইশারা করলো। বললো, “উনি আপনার হাসবেন্ড, রাতুল।”

রাতুলের দিকে তাকালো মীতি, মুহুর্তেই চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। এই ছেলেটাকে সে ঠিক কতদিন পর দেখলো, ঠিক মনে করতে পারলো না। এদিকে রাতুল কিছু বলতে গেলে অপর ডাক্তার তাকে থামিয়ে দেয়, বলে—তারা যেটা ভাবছেন তা হলো, রাতুলকেই মীতি ফাহাদ ভাবছেন। মীতির কাছে দু’জন ব্যাক্তি আলাদা হলেও তাদের সত্তা এক। শুধুমাত্র নামেই ভিন্নতা। ফাহাদ বলে আদোতে মীতির জীবনে কেউ নেই। একাকিত্বের সঙ্গী হিসেবে রাতুলকেই ফাহাদ নামে ইমেজিনেশন করে এসেছে মেয়েটা। মীতি এই ভুল ধরণাগুলো ভেঙে দিলেই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে আশা করা যায়। সবটা শুনে রাতুল বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না। নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু।

এদিকে রাতুলকে দেখে যেন স্বস্তি পেল মীতি, শান্ত হলো। পরমুহূর্তেই মস্তিষ্কে হানা দিলো ইশার কথা। রাতুলকে বললো, “তুমি? কেন এসেছো তুমি? বলেছিলাম তো, তোমার আর ইশার মাঝে আসবো না আমি।”

প্রতিত্তোরে রাতুল কিছু বলতে চেয়েও বললো না। ডাক্তার জবাব দিয়ে বলে উঠলো, “মীতি, আপনার হাসবেন্ড ও ইশা নামের মেয়েটির মাঝে আদোতে কোন সম্পর্ক নেই। সবটাই আপনার হ্যালুসিনেশন বা ইমাজিনেশন করা।”

নিশ্চুপে কথাটা শুনলো মীতি, কপাল কুঁচকে ফেললো। ডাক্তার আবারও বললো, “প্রায় মাস তিনেক আগে পড়ে গিয়ে যে মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন, সমস্যাটা ঠিক সেখান থেকেই। মাথায় আঘাত পাবার পর রক্ত জমাট বেধেছিল। ঠিকভাবে রক্ত সঞ্চালন না হবার ফলে আপনি ডিমেনশিয়া তে যান।”

একটু থামলো ডক্টর। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বললো, “এখন নিশ্চয়ই ভাবছেন ডিমেনশিয়া কি, তাই তো? ডিমেনশিয়া, এমন কিছু অনুভব করা—যেটা কখনো থাকেই না। হ্যালুসিনেশন বা ইমাজিনেশন করা। যা আপনি মি. রাতুলের ক্ষেত্রে করেছেন।”

“রাতুলের ক্ষেত্রে করেছি মানে?”

বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো মীতি। একবার চোখ বুলিয়ে নিলো রাতুল ও মাহতাব শেখ এর দিকে। ডাক্তার বললো, “হ্যাঁ! মি. রাতুলকে নিয়ে এমন কিছু ইমাজিনেশন করেছেন যেটা কখনো ঘটেই নি। অথবা আপনার হ্যালুসিনেশন বা ইমাজিনেশন। ডিমেনশিয়া মানে, এমন কিছু অনুভব করা—যেটা কখনো থাকেই না। হ্যালুসিনেশন বলতে পারেন। আবার যে ঘটনাটা আপনার সাথে ঘটছে তা কিছু সময়ের ব্যাবধানে ভুলে যাচ্ছেন। আই মিন, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে।”

মুখ ফুটে কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না, মীতি। কি-ই বা বলবে সে? রাতুলকে সে ভুল বুঝেছে তা ভেবেই যেন মনটা বিষিয়ে উঠলো। ডাক্তারটা আবারও বললো, “তবে ভয়ের কোন কারণ নেই, আমার চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি, অপারেশনও সাকসেসফুল হয়েছে। আজ পাঁচদিন পর জ্ঞান ফিরেছে আপনার। সপ্তাহ খানিক আপনার চিকিৎসা এভাবেই চললে আশা করি ভালো ফল আসবে।”

বলেই একটু থামলো। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বললো, “তবে উত্তেজিত হবেন না। আমরা আসছি এখন, আপনি রেস্ট করুন।”

বেড়িয়ে গেল ডাক্তার। যাবার আগে রাতুল ও মাহতাব শেখকেও ইশারা করলো মীতিকে রেস্টে থাকার জন্য। মাহতাব শেখও আর কেবিনে থাকতে চাইলেন না। মীতির মাথায় হাত নাড়িয়ে রেস্ট করতে বলে বেড়িয়ে যেতে লাগলেন। রাতুলও বেড়িয়ে যাবার উদ্যোগ নিলো কেবিন ছেড়ে, কিন্তু তার আগেই মীতি হাত ধরে ফেললো। মেয়েকে রাতুলের হাত ধরতে দেখেই মাহতাব শেখ হন্তদন্ত হয়ে কেবিন ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন। থাকুক না দু’জন একটু একসাথে, সময় কাটাক একান্তে।
পিছন ফিরে মীতির পানে চাইলো রাতুল। খানিকটা সময় নিয়ে বললো, “কি হয়েছে? রেস্ট করো এখন।”

“আই এম সরি, রাতুল!”

“সরি? কিন্তু কেন?”

ছলছল করে উঠলো মীতির চোখ দুটো। রাতুল কি তাকে অবহেলা করলো? ভেবেই যেন ভেতরটা পুড়ে গেল তার। ভাঙা গলায় বললো, “তোমাকে ভুল বুঝেছি, রাতুল। কিন্তু, কিভাবে তোমাকে ভুল বুঝলাম আমি?”

“মীতি, শান্ত হও। তোমার তো এতে হাত ছিলো না, তুমি তো ইচ্ছে করে ভুল বুঝো নি আমাকে।”

বলেই সামান্য এগিয়ে এলো রাতুল, ঘুচিয়ে দিলো তাদের দূরত্ব। আচমকাই রাতুলের কোমর জড়িয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো মীতি। বলতে লাগলো, “আমার সত্যিই কিছু মনে নেই, রাতুল। কিছুই মনে করতে পারছি না আমি।”

“রিলাক্স! এতটা হাইপার হচ্ছো কেন? ওসব নিয়ে আর ভাবতে হবে না তোমাকে।”

শান্ত হতে পারলো না মীতি। হঠাৎই যেন রাতুলকে হারানোর এক অজানা ভয় তাকে গ্রাস করে ফেললো। আগের চেয়েও অধিক দৃঢ় করলো তার হাতের বাঁধন। কান্নারত কণ্ঠে, “যদি তোমাকে ভুলে যাই, রাতুল? আমি কিভাবে থাকবো আমি তোমাকে ছাড়া?”

হাসলো রাতুল। মীতি তো তাকে ভুলেই বসেছিলো, তার মাঝেই ফাহাদ নামের এক না থাকা সত্তাকে ইমাজিনেশন করেছিলো। নাহ্, এই কথাটা মেয়েটাকে কিছুতেই বলা যাবে না আর। কিন্তু তাকে ভুলে গিয়েও যে প্রতিটি ক্ষণ তাকে মনে রেখেছিলো মীতি, তা ভেবেই যেন অদ্ভুত প্রশান্তি মিললো রাতুলের মনে। মীতিকে বললো, “আমাকে ভুলে গেলেও তোমার সেই ভুলে আমিই থাকবো, মীতি।”

.
.
চলবে….

[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে