ভালোবাসার পরিনতি পর্ব-৬+৭

0
995

#ভালোবাসার_পরিনতি
#লেখা_ইভানা
#পার্ট_৬

ছয় বছর পরে তিহান ভাইয়ের সাথে দেখা। আগের থেকে বেশ পরিপাটি হয়েছে।আসলে সময়ের সাথে সবকিছু পরিবর্তন হয়। আমার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে তাই আমি বললাম,
-উহুম উহুম তিহান ভাই
-হ্যাঁ হ্যাঁ বল, কেমন আছিস?
-এইতো আছি ভালো, তুমি কেমন আছো?
-হুম ভালো।
-দেশে কবে এসেছো?
-একমাস হলো
-ভাবি কেমন আছে?
-আরে আমি তো বিয়ে করি নি
-সে কি এখনও বিয়ে না করলে আর কবে বিয়ে করবে?
-আমার কথা বাদ দে। তোর কথা বল, সংসারে কে কে আছে? কেমন দিন যাচ্ছে সে সব বল।
সংসারের কথা শুনে চোখে পানি চলে এলো তাও নিজেকে কিছুটা কন্ট্রোল করে বললাম
-ভালো, তুমি বসো মাকে ডেকে আনি।
-মামির সাথে দেখা হয়েছে, তুই বস।
-ওহ্
-তোর মেয়েটা দেখতে খুব মিষ্টি হয়েছে একদম তোর মতোই
-আমার মেয়ে তো আমার মতোই হবে।
রাফিসা আমরা ফোনটা হাতে করে নিয়ে এসে বললো,
-আব্বুকে একটু কল দেও আমি কথা বলবো।
-না সোনা এখন কথা বলা যাবে না
-কেনো যাবে না?
-ব্যস্ত আছে তো তাই, তুমি যাও গিয়ে খেলা করো
-না আমি আব্বুর সাথে কথা বললো
-মেয়েটা এতো জেদ করছে যখন তাহলে একটু কথা বলিয়ে দে। (তিহান)
-সেটা সম্ভব নয়, বলে আমি উঠে গেলাম। আড়ালে গিয়ে চোখে পানি মুছে রান্না ঘরে গিয়ে ছোট ভাবিকে
বললাম,
-ভাবি
-তোমাকে কি ডেকেছি নাকি?
-নাহ্, আমি নিজে থেকে এসেছি। ফল, সরবত আমি বানিয়ে দেই।
-তোমার কোনো কাজ করতে হবে না, আমার সব কাজ করা কম্পিলিট।
-একটু রান্না তো করতে পারি?
-না পারো না, আমার সাথে এসো।
-হুম।

তিহান ভাইয়া দেশের আসার পর আজ প্রথম আমাদের বাসায় এসেছে তাই আজকে না খেয়ে, থেকে যেতে পারবে না। বাসায় রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে কিন্তু আমাকে কোনো কাজ করতে দিচ্ছে না। আমার চার মাসে প্রেগন্যান্সি চলছে। এর মধ্যেও আমার স্বামী গায়ে হাত তুলতো আর পরিবারের কেউ আমাকে সামান্য কাজও করতে দেয় না। প্রতিটা পরিবার যদি মেয়েদের অসহায় সময়ে শক্তি দেয় তাহলে মেয়েরা সব কষ্ট ভুলতে সক্ষম হয়।
ওহ্ হ্যাঁ আপনাদের বলতে ভুলেই গেয়েছি, তিহান হচ্ছে ইভার মামাতো ভাই।

তিহান আসার কারণে সবার ভালো লাগছে। তিহান খুব মিশুকে যায় জন্য সবাইকে অতি সহজে আপন করে নেয়।

ওদিকে রোহান আজকে নিশিতাকে বিয়ে করেছে। নিশিতার বাবার অফিসে রোহান জব করে। রোহান দেখতে যেমন সুন্দর তেমন স্মার্ট। যে কেউ দেখলে ক্রাশ খাবে। নিশিতা মাঝে মাঝে অফিসে এসে রোহানের সাথে গল্প করতো। রোহানে নিয়ে বড় ক্লাবে পার্টিতে যেতো।নিশিতা সারাক্ষণ টাকার অহংকার নিয়ে থাকতো সাথে রোহানকে বুঝাতো টাকা ছাড়া কিছু হয় না। রোহানও আসতে আসতে নিশিতার বিলাসিতায় আসক্ত হলো। রোহান ভাড়া বাসা ছেড়ে নিশিতাদের বাসায় গিয়েছে।

দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ইভাদের বাসার সবাই তিহানের সাথে গল্প করতে আছে। সবাই ইভার মন ভালো করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে। ইভা সবার সাথে বসে থাকলেও তার মন পরে আছে রোহানের স্মৃতিতে। সব কথায় ইভা হুম, হ্যাঁ বলে যাচ্ছে। তিহান বললো,
-ইভা তোর বরের সাথে আমাকে মিট করিয়ে দিবি না? এক দিনের ছুটি নিয়ে আসতে বল।
তিহানের কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেলো। কে কি উত্তর দিবে তাই ইভা বললো,
-না ভাইয়া, আমাদের ডিভোর্স হয়েছে।

কথাটা বলে ইভা ওর রুমে চলে গেলো। রাফিসা রোহানের ছবি সামনে নিয়ে শত কথা বলে যাচ্ছে এই দৃশ্য দেখে ইভার চোখের পানি বাধ মানলো না। ইভার কান্না দেখে পিচ্চি মেয়েটাও চুপ করে আছে। সত্যি কারের ভালোবাসা বোধহয় ভুলে থাকা যায় না। বেশ কিছুক্ষণ পর তিহান ইভার রুমে আসে। ইভা শুয়ে আছে তিহানকে দেখে উঠে বসতে চাইলে তিহান বাঁধা দিয়ে বলে,
-সবার কাছ থেকে জানতে পেরেছি তোর জীবনে এখন একটা খারাপ সময় যাচ্ছে, তাই ওসব শুনে বলে তোকে আর কষ্ট দিতে চাই না
-কষ্টের পথ তো সবেমাত্র শুরু
-কিসের কষ্ট বল? যে তোর ভালোবাসার মূল্য দিলো না, সন্তানদের কথা ভাবলো না, স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারে নি তার জন্য কষ্ট পাওয়ার কোনো মানে হয় না। সে তো ঠিকই ভালো আছে
-আমি ভালো থাকতে পারছি না আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে।
-তোর সন্তানের কথা তো ভাবতে হবে?
-পারছি না, যে মানুষটা আমাকে ছাড়া অন্য কিছু বুঝতো না সেই চেনা মানুষ অচেনা হয়ে গেলো
– তুই নতুন করে সব শুরু কর দেখবি তোর থেকে ভালো কেউ নেই
-হয়তো কোনো এক দিন।
ইভার মা এক গ্লাস দুধ এনে বললো,
-এটা খেয়ে এখন ঘুমা
-মা দুধ খেতে ভালো লাগে না
-তোর কোনো কথা শুনতে চাই না এটা খেয়ে নে
-উফফ
-তিহান তুই ও গিয়ে একটু ঘুমা।
-না মামি আমি ঘুমাবো না। বিকেলে যেতে হবে তো(তিহান)
-কয়টা দিন থেকে যা বাবা, কতো বছর পরে দেশে এলি আবার কবে তোর দেখা পাবো?
-মামি তুমি এতো ইমোশনালি হয়ে কথা বলো যে কথা না রেখে উপায় নেই।
-আমি যতোদিন বেঁচে আছি ততোদিন বলবো
ইভা গ্লাসটা মায়ের দিকে ধরে বললো, খেয়েছি এবার শান্তি।
-হুম তোরে আল্লাহ সুখী করলে আমার শান্তি হবে তার আগে না।

ইভার বাবার সাথে ইভার শশুড়, শাশুড়ী ইভার রুমে আসে। ওনাদের দেখে ইভা অবাক হয়ে যায়! ওনারা এখানে কেনো এসেছে?

চলবে,,,,

#ভালোবাসার_পরিনতি
#লেখা_ইভানা
#পার্ট_৭

“আমার ছেলে যে অন্যায় করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য ,
আমার ছেলের হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো তাতে তো আমি কিছু করতে পারলাম না তাবে আমি তোমাকে দোয়া করি তুমি যেনো সুখী হও আর মাঝে মাঝে আমাদের সাথে কথা বলো আর নাতিদের দেখতে দিও এটা তোমার কাছে অনুরোধ ”

রোহানের বাবা আমাকে এই কথাগুলো বলে কান্না করে দিলো। তিনি অনেক অনুতপ্ত বোধ করছে। তার কান্না দেখে আমিও কান্না করে দিলাম।
রোহানের মা বললো,
“এই সময়ে একটুও কাঁদবে না। যে তোমাকে ঠকিয়ে ভালো আছে তার জন্য একটুও চোখের পানি ফেলবে না।তোমার কষ্ট হলে তো আমার নাতিনাতনিদেরও কষ্ট হবে। বুড়া বয়সে ওরা তো আমাদের শক্তি হবে। একটামাত্র ছেলে থাকতেও এখন নেই “।
আমার মা বললো,
” আপনাদের সাথে রোহান যোগাযোগ করতে চাইতে যোগাযোগ করবেন শত হলেও তো ও আপনাদের ছেলে।আমার মেয়ের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে তা ফিরিয়ে আনা যাবে না। সন্তানেরা ভুল করলেও তাদের অশিকার করা যায় না ”
” আপা আমরা অনেক ভাগ্য করে আপনাদের মতো পরিবার পেয়েছি, বৌ পেয়েছি কিন্তু আমার ছেলে বুঝলো না। আপনার এতোকিছুর পরেও আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করছেন তাতে আমরা কৃতজ্ঞ। “(রোহানের মা).
” না মা আপনারা নিজেদের দোষী ভাববেন না, যা হয়েছে সব আল্লাহর ইচ্ছেতে হয়েছে। আপনারা শুধু আমার জন্য দোয়া করবেন যেনো আমার সন্তানদের ভালো ভাবে মানুষ করতে পারি ” (ইভা)
“হ্যাঁ মা তোমাদের জন্য সব সময় দোয়া করি ” (রোহানের মা)
রাফিসা আমার কাছে ঘুমাচ্ছিলো সবার কথার আওয়াজ শুনে ঘুম থেকে উঠে গেলো। দাদা,দাদীকে দেখে খুব খুশী হয়েছে।
কিছুক্ষণ আমাদের সাথে সময় কাটিয়ে বিকেলে ওনারা চলে গেলো।
সারাদিন সবার সাথে থেকে ভালো লেগেছে। সন্ধ্যায় সবাই চা খেয়ে টিভি দেখতে বসেছে। আমার টিভি দেখতে একদম ভালো লাগছে না তাই নিজের রুমে শুয়ে সেই রোহানের স্মৃতিতে চলে গেলাম।
পাঁচ বছরের স্মৃতিতে কম কিছু নেই, এগুলো ভুলে থাকা সম্ভব নয়। রোহান অফিসে থাকাকালীন সময়ে মাঝে মাঝে ভয়েস মেসেজ দিতো
“লক্ষ্মী সোনা পাখিটা এখন খেয়ে নেও আমি খেয়েছি ”
“আজকে শাড়ী পরে রেডি থেকে, ঘুরতে নিয়ে যাবো”
“খুব মিস করছি আমার মিষ্টি বৌটাকে”
ভয়েস মেসেজগুলো শুনছি আর চোখের পানি পড়ছে।

তিহান ভাইয়া আমার রুমে এসে বললো,
“দেখ যে হারে আমাদের দেশে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে তাতে সবাই দুর্ভোগে পরেছে তুই আর চোখের পানি দিয়ে ঘরে বন্যা তৈরি করিস না ”
“ভাইয়া আমার ভালো লাগছে না, তুমি এখন মজা করো না তো”
“তোকে যে ভালো থাকতে হবে নয়তো আমি ভালো থাকতে পারবো ”
“আমাকে নিয়ে এতো ভেবো না, যাও সবার সাথে গিয়ে গল্প করো ”
“আমি তোর সাথে গল্প করবো ”
“আচ্ছা শুনি তো কি এমন গল্প করবে ”
“ছোটবেলায় আমি একবার গাছ থেকে পড়ে হাত ভেঙ্গে গিয়েছিল। আম্মু সারাক্ষণ খেয়াল রাখতো আমার কখন কি দরকার পরে। স্কুলে গেলেও আম্মু স্কুলে গিয়ে বসে থাকতো। আমি ব্যাথা পেয়ে কান্না করলে আমার কষ্ট দেখে আম্মু কাঁদতো, সন্তানেরা ভালো না থাকলে বাবা-মা ও ভালো থাকে না। দেখ রাফিসা অসুস্থ হলে তোর কতো কষ্ট হয় ঠিক তেমন মামা-মামিরও তোর জন্য কষ্ট হয়। তোর জীবন তো এখনও পরে আছে। আল্লাহ তোকে কম কিছু দেয় নি তো তোর পরিবার তোর সাথে আছে, একটা মিষ্টি মেয়ে আছে আবার একজন তোর কোল আলো করে আসবে। ছোট্ট হাতদিয়ে তোকে আদর করবো। দুটো বাচ্চা সারাক্ষণ তোকে মা মা বলে ডাকবে এর থেকে তোর আর কি চায়? তুই আল্লাহর কাছে তোর সকল অভিযোগ বলবি উনি তোকে ভালো রাখবে। ”
তিহানের কথা শুনে চোখে পানি চলে এলো সত্যি তো আমাকে আল্লাহ অনেক কিছু দিয়েছে।
“হ্যাঁ ভাইয়া তুমি একদম ঠিক বলেছো, আমি ভালো থাকবো আর কারো জন্য কষ্ট পাবো না”
বড় ভাবি আর ছোট ভাবি আমার রুমে এসে বললো,
“আমার একটা মাত্র ননদকে মন মরা দেখতে ইচ্ছে করছে না তাই চলে এলাম লুডু খেলতে (বড় ভাবি)”
“সাথে আমের আচার নিয়ে এসেছি ইভার জন্য ” (ছোট ভাবি)
“তোমার দেখি আমার কথা ভুলে গেছো ” (তিহান)
“এতো স্মার্ট দেবরের কথা কি ভুলে থাকা যায়, তোমার জন্য চানাচুর নিয়ে এসেছি ” (বড় ভাবি)
“না আমার আমের আচারের ভাগ চাই ” (তিহান)
“ছোটবেলার অবভ্যাস তোমার গেলো না আমার জিনিসে খালি ভাগ বসাও ” (ইভা)
“ঝগড়া তোলা থাক এখন লুডু খেলা শুরু করি ” (ছোট ভাবি)

চারজন মিলে লুডু খেলে কখন যে সময় পাড় করলাম সেটা বুঝতে পারি নি। রাতে খাওয়া শেষে করে ঘুমাতে গেলাম, রাফিসা আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমালো। আজকে মা ও আমার সাথে ঘুমাবে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম নিজেও বুঝতে পারি নি।

সকালে ফুপি এলো মানে তিহানের মা। সবার থেকে আমাকে একটু বেশি ভালোবাসে তা নিয়ে তিহান ভাইয়ার সাথে কতো ঝগড়া হতো। তিহান ভাইয়াকে ডাকতে গেলাম, গিয়ে দেখি সে ঘুমাচ্ছে তাই ডাক না দিয়ে চলে আসবো তখন চোখ গেলো একটা ডায়েরির ওপর। আমি ভাবলাম বাবার ডায়েরি ভুলে এখানে রেখে গিয়েছে তাই ডায়েরি হাতে নিলাম।ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা “”ইভার ডায়েরি””। লেখাটা দেখে চমকে উঠলাম কারন এটা বাবার ডায়েরি না এটা তিহান ভাইয়ার ডায়েরি হবে কিন্তু কেনো আমার নামে এসব লেখা? কৌতুহল হলো তাই ডায়েরি নিয়ে নিজের রুমে আসবো তখন শুনতে পেলাম ফুপি বাবাকে বলছে,
“ইভাকে আমার ছেলের বৌ করতে চাই, ভাইয়া আপনি আমার আবদারটা রাখেন ”

কথা শুনে খুব রাগ হলো কেনো সব সময় আমার সাথে এমন হচ্ছে? আমি আর কারো ভালোসায় জড়াতে চাই না।
রুমে এসে দরজা লক করে ডায়েরি নিয়ে বসে পড়লাম।

[[ তিহান ইভার ফুফাতো ভাই হয়। ভুলে মামাতো ভাই বলা হয়েছে। ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা করবেন।]]

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে