ভবঘুরে পর্বঃ১৭

0
669

ভবঘুরে পর্বঃ১৭
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

– তারপর? তারপর আমি একপ্রকার ঘাড়ত্যাড়ামি করেই দেশের বাইরে চলে যাই পিএইচডি করতে। আদিবা আর না করল না আমার বেশি আগ্রহ দেখে। কিন্তু মনে মনে বেশ ক্ষুণ্ণ হয়েছিল সে। আমি কষ্ট পাব বলে কিছু বলেনি আমাকে। কিন্তু ভাগ্য সহায় হল না। লন্ডনে কিছুদিন থাকার পর সেখানে আমার পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে বেশ ঝামেলা হয়। যার কারণে আমাকে আবার ফিরে আসতে হয় খালি হাতে। আমি একাই না, আরো কয়েকজন বাঙালি ছেলেমেয়েরও সেইম অবস্থা হয়েছিল। আমার এই দুঃখের সময়েও আদিবা বেশ খুশি হয়েছিল আমি দেশে ফেরায়। আমাকে ঠেস মেরে বলেছিল,- দেখেছ আমি যেতে নিষেধ করেছি না যেতে!, ভালো হয়েছে তাড়িয়েছে।
আমি বললাম,” অন্য দেশে যাব। তখন দেখব তোমার খুশি কোথায় যায়।
ও বলল,” তোমার আর হবে না কোথাও যাওয়া। তুমি দেশকে ভালোবাসো না। দেশের মানুষ দেশেই থাকো না!”
বাস্তবেই আমি তখন দেশের প্রতি অতো টান ছিল না। কিন্তু ওর খাপছাড়া কথাটা ধরেই আজ আমি দেশকে ভালোবাসতে পেরেছি। আমার আর পিএইচডি করা হয়নি। মাঝখানে ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল। ঝগড়া বলতে তেমন না। ও কিছু করেনি আমিই ওর সঙ্গে রাগারাগি করেছিলাম। বেশ কষ্ট পেয়েছিল ও। ঝগড়ার কারণটা বলার মতো হলে বলতাম তোমাকে। জাস্ট মিসআন্ডারস্টান্ডিং আরকি! এদিকে আদিবার মায়ের মৃত্যু হয় হঠাৎ স্ট্রোক করে। ওনি এমনিতেই হার্টের প্রেসেন্ট ছিলেম। আমি দেশে ফেরার দু-তিন মাস পরের ঘটনা এটা। ও বেশ ভেঙে পড়ল মায়ের মৃত্যুর ঘটনায়। আমি কিন্তু অনেক ঘটনা স্কিপ করে যাচ্ছি। সময় কম তো তাই। যা মনে আসছে বলে যাচ্ছি। তো, তখনো কিন্তু আমি ওর সঙ্গে ভালো করে কথা বলি না সেই মনকষাকষির রেশ ধরেই। কিন্তু ওর মায়ের মৃত্যুতে তো আর এতোকিছু ধরে পারা যায় না। স্বামী হিসেবে যতটুকু পারা যায় ওকে সান্ত্বনা দিলাম। আগেই বলেছিলাম ও বেশ অভিমানী মেয়ে। আমার এতো সান্ত্বনাতেও তার মন গলল না। অভিমানের থলিটা বরং যেন আরো পরিপূর্ণ হয়ে গেল। বলে রাখি ওর একটা ছোট রোগ ছিল। রোগটা হলো মাথা ঘোরানো। একটু কায়িক শ্রম বেশি হয়ে গেলেই ও মাথা ঘুরে পড়ে যেতো। এতোসব মানসিক চাপে আদিবা অসুস্থ হয়ে পড়ল। শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল একেবারে। ট্রিটমেন্ট চলল অনেকদিন।…
আবিদের কথার মাঝখানে হঠাৎ বাঁধ সাধল উরবি। বলল,
– আচ্ছা, এটা বলুন না। কী নিয়ে মনোমালিন্য হয়ছিল আপনাদের? ওটা না জানা ছাড়া কেমন এলোমেলো লাগতেছে সব। আমাকেই তো বলবেন সমস্যা নাই তো!
আবিদ স্থবির চোখের পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবল কিছুক্ষণ। এরপর অকস্মাৎ ধ্যান ছুটার মতো করে বলল,
-‘ হুমম বলা যায়! শুনো, আমাদের বিয়ের আগে ওর সমবয়সী বা বয়সে একটু বড় একটা চাচাতো ভাই ওকে পছন্দ করতো। ও সেটা আমাকে বলেনি। অবশ্য বলার কোনো কারণও ছিল না। একটা মেয়েকে কত কেউ পছন্দ করতে পারে। কিন্তু তখন আমার অবচেতন মন সেকথা শুনেনি। ওর সেই চাচাতো ভাইটা ওকে একটা চিঠি দিয়েছিল যেটা ও পড়ার আগেই আমার হাতে পড়ে যায়। সেটা পড়ার পর আমার মেজাজ বিগড়ে যায় আর আমি ওকে বকাবকি করি৷ কিন্তু ও বারবার বলেছে সে নির্দোষ। এসবের কিছুই সে জানে না। পরে আমি আমার ভুল বুঝতে পারলেও আমি বরাবরই অভিমান ভাঙাতে অক্ষম ছিলাম। আমার দ্বারা হতো না ঐ জিনিসটা৷ তো, ও অসুস্থ হওয়ার পর ট্রিটমেন্ট চলল অনেকদিন। ডাক্তার বলল ওর এখন মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হওয়া দরকার। হাঃহাঃ তারপর অনেক রকম মনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমি ওর অভিমান ভাঙাতে যাই। খুব বেশি কসরত করতে হয়নি। এরপর ডাক্তারের কথামতো ওকে নিয়ে ঘুরতে যাই পুরো পরিবার নিয়ে। ওর পাহাড় দেখার শখ ছিল খুব। সেজন্যই বান্দরবানে যাই সপরিবারে। আমি, বাবা, মা,আদিবা আর আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড জামশেদ। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাঘুরির পর একদিন আদিবা বায়না ধরল পাহাড়ে উঠবে। বাইরে থেকে কত দেখা যায়। উপরে না উঠে মজা আছে? ওর কথায় আমার মাও সায় দেয়। ব্যস, ওনারা যখন রাজি তখন আমরা বাপ-ব্যাটা মিলে না করার মানে হয় না। আর অভিমানিনী আদিবার কথায় ‘না’ করলে যে পুরো ট্যুরটাই মাটি হয়ে যাবে তা আমি বেশ জানতাম। তো উঠলাম পাহাড়ে। বন্ধু জামশেদ আসেনি। ওর শ্বাসকষ্ট ছিল এজন্য ও রিসোর্টেই থেকে গেল। অনেক মজার সময় ছিল। পাহাড়ে ওঠার কষ্টের মধ্যেও বেশ মজা, হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়েই পাহাড়ে উঠলাম সবাই। ভাঙা দুর্বল শরীর নিয়েও আদিবা বেশ পাহাড়ে উঠল। কি এক অলৌকিক ক্ষমতা যেন ওকে পাহাড়ের চূড়ায় টানছিল। সেদিন সারাটাদিন ও এতো পরিমাণ খুশি ছিল যে তা সেই সময়ের জন্য অকল্পনীয়।’

চুপ করে গেল আবিদ। আবারো পুকুরের সবুজাভ পানির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল বেশ কিছু সময়। উরবি অস্থির হয়ে বলল,
– পাহাড়ে গেলেন,তারপর?
আবিদ সেভাবেই তাকিয়ে থেকে সম্মোহিত গলায় বলল,
– ‘সেই পাহাড়েই আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্বিষহ ঘটনাটা ঘটে আমার চোখের সামনে…। আমার মা আর আদিবা দাঁড়িয়ে পাহাড় দেখছিল পাহাড়ের একটা অংশে দাঁড়িয়ে। কিন্তু ওদিকটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ সাইট। রেড সিগনাল আর সাইনবোর্ডও ছিল। বাবা খাবারের আয়োজন করছিলেন। আমার তো ছবি তোলার শখ। আমি চারিদিক ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছিলাম। কোন সময় যে মা আর উরবি সেই বিপজ্জনক এরিয়াতে ঢুকে গিয়েছিল তা কেউ খেয়াল করিনি। মানুষকে যখন মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকে তখন আশেপাশের মানুষজন কিছুই লক্ষ্য করতে পারে না৷ হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মা আর আদিবার চিৎকার শুনি আমি। আমি ক্যামেরা থেকে চোখ ফেরাতেই তারা নাই হয়ে গেল তারা সেখান থেকে। বড় একটা পাথর খণ্ড সহ প্রায় হাজার ফুট নিচে বনজঙ্গলের মধ্যে পড়ে গেল । চোখের পলকে সবকিছু ঘটে গেল। আমি ঐ জায়গাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কতক্ষণ পর জানি না। বাবা এসে আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে চিৎকার করে কান্না শুরু করল। অন্যান্য পর্যটকেরা বাবাকে সামলালেন। আমার শক্ত-সামর্থ্য বাবাকে এর আগে এভাবে পাগলের মতো কাঁদতে দেখিনি আমি। কিন্তু আমি পাষাণের চোখে একফোঁটা পানি আসেনি সেদিন। এখনো দেখো না কত নির্বিকারভাবে বলে যাচ্ছি সব। খবর পেয়ে পুলিশ এলো। উদ্ধারকর্মীরা লাশ উদ্ধার করল। সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিল মা। চেহারাটা পর্যন্ত বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। চেনার উপায় ছিল না।আর আদিবা। যে বুকে আমার জন্য বুকভরা ভালোবাসা ছিল সেই বুকের ওপর বড় একটা পাথর চাপা পড়েছিল৷ একেবারে থ্যাতলে গিয়েছিল ভালোবাসা-ভরা হৃদপিণ্ডটা। আমার মায়ের যেই মাথাতে সারাক্ষণ আমার চিন্তায় ঘুরঘুর করতো সেই মাথাটা…। মায়ের যে চোখে আমার জন্য ঘুম আসতো না সেই চোখটা দেখার মতো ছিল না! শুধু আমিই তাকিয়ে ছিলাম লাশের পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা। কখনো বা ছুটেছি মায়ের পাশে কখনো বা ছুটেছি আদিবার কাছে। মানুষ বলেছিল, ছেলেটার মন পাষাণে গড়া। কারণ আমি কাঁদতে পারিনি। কে জানে কিসে শুষে নিয়েছে আমার সব চোখের পানি।… দেশের অনেক শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় ফলাও করে নিউজ ছাপা হয়েছিল। এমনকি আমাকে হাইলাইট করেও অনেক নিউজ হয়েছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত পাহাড় ধসে মা-স্ত্রী হারিয়ে নিঃস্ব ছেলে… এমন আরো কত! — বাবাটা আজো বেঁচে আছে মরার মতো। আমার দেখতে ইচ্ছে হয় না। বিধবা ফুফু দেখাশোনা করে। মেহেরপুরের ঐ বাড়িতে আমি থাকতে পারিনি আর। সেবাড়ির আনাচে-কানাচেতে আমার মায়ের আর আদিবার ছোঁয়া লেগে আছে। সাজানো গোছানো সংসারটা কীভাবে পাথরের চাপা পড়ল দেখলে তো? সে থেকে আমি ভবঘুরে,ছন্নছাড়া জীবন-যাপন করি। জীবনের আর কোনো মানে খুঁজে পাই না। বিতৃষ্ণা ধরে গেছে পৃথিবীটার প্রতি। এরপর ভাবলাম, দেশকে ভালোবাসি,সঁপে দিই নিজেকে। আড়াল থেকে আদিবা তা দেখে খুশি হোক। তাই করি। অপরাধ যেখানে দেখি রুখে দাঁড়াই। জীবনের পরোয়া করি না। এই জীবনটা গেলেই আমি খুশি। হাহ্!’
বলা শেষ করে ঈষৎ ঠোঁট প্রসারিত করে ম্লান হাসল আবিদ। দুইহাত আয়েশ করে গুঁজল বুকের দুপাশে। বহুক্ষণের চাপা দীর্ঘশ্বাসটা ছেড়ে দিল বাতাসে।
উরবি পাথরের মূর্তির ন্যায় ভূতলে তাকিয়ে রইল একনিমেখে। তার চোখের বারান্দায় চিকচিক করছে অরুদ্ধ অশ্রুজল। গড়িয়ে পড়ার আগেই সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে তা হাতের কনুইয়ে মুছে নিল৷ একটা মানুষ এতোটা কষ্টও বুকে ধারণ করতে পারে? মানুষটার বুক ভেঙে খানখান হয় না কেন কষ্টের খরস্রোতে? কষ্টের কল্লোলিত নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে লোকটা তো বেশ আছে,তবে উরবির কেন একটা বাঁধভাঙা কান্না দমকে আসছে সবকিছু চুরমার করে? কেন বুক উজার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে? আদিবা তো তার কেউ হয় না! কেউ না। নিজের মনকে প্রবোধ দিয়ে সান্ত্বনা করল উরবি৷ তবুও যেন শান্ত করা গেল না। আবিদের ওপর তার করা সমস্ত কুকীর্তির জন্য অনুশোচনার অনলে দগ্ধ হতে লাগল ভেতরটা। আরেকটু পুড়লেই যেন সমস্ত খাক হয়ে ধূধূ শ্মশান হয়ে যাবে। এবার একটু শীতলতা দরকার! লোকটাকে এতোটা কষ্ট না দিলেও পারতো সে! আবিদ উঠে দাঁড়াল।
– ‘চলুন। আর বসে থেকে কী হবে?’ তার কণ্ঠ অদ্ভুত শীতল।
উরবির মুহূর্তেকের জন্য মনে হল লোকটা আদতেই পাষণ্ড। এতোকিছুর পরও মানুষটা স্বাভাবিক থাকে কী করে?! সে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে উত্তর দিল,
– ‘আচ্ছা, আমার দ্বারা আপনি কখনো কষ্ট পাইছেন? কম তো জ্বালায় নাই আপনাকে!’
আবিদ মৃদু শব্দ করে নিটোল হাসল৷ এই হাসিতে বিন্দুমাত্র খেদ নেই। হাসিটা মুখে নিয়েই সে বলল,
– ‘এই জীবনে আমার আর কষ্ট পাওয়া হবে না। আপনার আচরণে কখনো কষ্ট পাইনি আমি। বরং উপভোগ করেছি আপনার ধূর্ততা। আমার মতো মানুষের ওসব মাথায় নিলে চলে নাকি?’

উরবি স্বাভাবিক হলো। নাক টেনে, ভালো করে দুচোখ মুছে, বার দুয়েক গলা পরিষ্কার করে নিল সে। পুকুর ঘাটে তখন তেজোময়ী রোদ্দুর এসে হানা দিয়েছে। বেলায় বেলায় কাঁঠালবাগানের মাথা হতে সূর্যটা বাড়ির ছাদের ওপর সরে এসে তেরছা হরিদ্রাভ আলো ছড়াচ্ছে সমগ্র পুকুরপাড়ে। এরিমধ্যেই শরীরের রোমকূপ চুইয়ে লবনাক্ত ঘাম জমতে শুরু করেছে । ভোরেই কর্মঠ পাখির দল উড়ে গিয়েছে দূর-দূরান্তে। আর অলস পাখিরা এগাছ- ওগাছের ডালে ডালে নৈদাঘের রোদে গা বাঁচিয়ে আড্ডা শুরু করেছে কিচিরমিচির কলরবে। পুকুরে ভাসমান তেলাপিয়া মাছগুলো ঘাটে আবিদের উপস্থিতিতে চকিতে অতলে ডুব দিল। দ্বিতীয়বারের মতো মুখহাত ধুয়ে আবিদ পা বাড়াল ঘরের পথে। উরবিও পুকুরপাড়ের ছাই দিয়ে দাঁত মেজে মুখহাত ধুয়ে নিল। হাঁটতে হাঁটতে উরবি অনুরোধের সুরে বলল,
– আমাকে আদিবার ছবি দেখাবেন?
আবিদ বলল,
– দেখাব,আসুন।
……………
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


আবিদ ইদানিং অস্ত্র-সমেত বাইরে বেরোয়। সে বুঝতে পেরেছে এই গ্রামে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ানোর দিন ফুরিয়েছে এবার। সময়ে-অসময়ে বাড়ির যথাতথা অপরিচিত সন্দেহভাজন লোক ঘুরাফেরা করতে দেখা যায়, লক্ষ্য করেছে আবিদ। কাজেই ঝুঁকি নেয়াটা সংগত নয় একেবারেই। বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে গ্রামের পশ্চিম কোণে একটু ঢুঁ দেওয়ার জন্য বেরিয়েছিল সে। ওদিকটা যাওয়া হয়নি এখনো। ছেলে-বুড়ো আর বাড়ন্ত তরুণদের হালচাল বোঝা দরকার। বিশেষত সদ্য অধিষ্ঠিত তরুণ প্রজন্মই পা দিচ্ছে মাদকের ভয়ংকর ফাঁদে। ক্যামেরা হাতে কিছুদূর পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে ছবি তুলল সে। আবিদের এই ফটোগ্রাফি এখন শুধুই ছদ্মবেশ; আগে যে আগ্রহ ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হয়েছিল জীবনের টানাপোড়েন আর কালান্তরে এখন তা বিলুপ্তপ্রায়। জীবনের আয়োজনগুলো যখন ভেস্তে যায় শখ নামের অনুভূতিগুলোও তখন অবলুপ্ত হয় ধীরে ধীরে।
হাঁটতে হাঁটতে জিসানের সঙ্গে দেখা হল আবিদের। দেখা ঠিক নয়। অকস্মাৎ দু-হাত প্রসারিত করে পথ রোধ করে দাঁড়ায় জিসান। আবিদ বুঝে নেয় জিসান কিছু বলতে চায়,তবুও সে ফিচ করে হেসে দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে টিপ্পনী কাটল,
– কী ব্যাপার ছবি তুলবে?
জিসানের দু-চোখ হরহামেশা অস্বাভাবিক রকমের লাল থাকে। আজও তাই। সে রক্তিম দুচোখ তুলে আবিদের দিকে তেতো কটাক্ষে চাইল একবার। ডানহাতের তর্জনী আর মধ্যমা আঙুল জোড় করে উঁচিয়ে ইশারায় কাছে ডেকে বলল,
– ছবি লাগবো না। এদিক আও। কতা আচে তোমার লগে।
আবিদ বাঁকা হেসে এগিয়ে এলো।
– বলো,কী কথা?
জিসান অকপটে জিজ্ঞেস করল,
– আপনে উরবির কে হন?
– ‘তা দিয়ে আপনার কী দরকার?’ কথাটা একটু ত্যাড়াভাবেই বলল আবিদ। এই সময় জিসানকে একটু বাজিয়ে দেখা অতিব জরুরি। রেগে গেলে সে বেফাঁস কিছু বলে দিতে পারে, এই আশা আবিদের। কিন্তু আশায় গুড়েবালি!জিসান রাগল না। বলল,
– এ্যামনিই জানবার চাইলাম।
আবিদ এবার সত্যিটা বলল,
– আমি উরবির কেউ নই।
– ‘মেহমানও না?’ জিসানের চোখে অগাধ বিস্ময়।
– ‘নাহ্। উড়ে এসে জুড়ে বসেছি৷ আমি ঐ বাড়ির কেউ না। তবে এখন আপন হয়ে গেছি অনেকটা। নিজের ঘরের মতো করে থাকি’ বলে ক্যামেরার ডিসপ্লেতে চোখ রাখার ভান করল আবিদ। কিন্তু আড়চোখে তাকাল জিসানের মুখের দিকে। জিসান একটু চুপ থেকে কি যেন ভেবে হঠাৎ চোখেমুখে সন্দেহ এনে বলল,
– ‘আপনে এহানে আসার উদ্দেশ্যটা কী?’ কথার মাঝে মাঝে আবিদের সঙ্গে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার চেষ্টাও চালায় জিসান।
উত্তরে আবিদ ফিচেল হেসে বলল,
– এসেছি একটা কাজে। আর কাজের কথা মানুষকে বলে বলে বেড়াব কেন? তবে, শেষ হলে জানতে পারবে ইন শা আল্লাহ।
জিসানের মুখটা বিমর্ষ হয়ে গেল। চোখের ওপর পড়ল একযোগে দুশ্চিন্তা আর ভীরুতার ছায়া। কথায় আছে চোরের মন পুলিশ পুলিশ। আসন্ন বিপদকে বোধহয় সে নিজের চোখের পর্দায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। বিপদ কাটাতে যবনিকাপাতনের চেষ্টা তো সে অবশ্যই করবে! তাতে কী? আবিদ মোকাবেলায় সদাপ্রস্তুত! জিসানের বিষন্নবদনে তাকিয়ে আবিদ যেন হাঁড়ির খবরটা জেনে গেল। মনে মনে ভারি কৌতুক বোধ করল সে।
– ‘তা,উরবির সঙ্গে প্রেম কেমন চলছে? বিয়ের দাওয়াত পাব তো?’ জলন্ত আগুনে ঘি ঢালল আবিদ। সচরাচর এমন অরুচিকর উপহাস সে করে না, তবে শত্রুপক্ষের লোকের গায়ে আঁচ দেওয়ার মজাই আলাদা।
জিসান আর একমুহূর্তও দাঁড়াল না। আবিদের কথার প্রতিউত্তরে কিছু না বলেই পাশ কাটিয়ে গটগট করে হাঁটা ধরল সে। আশুগতিতে হাঁটার দমকে তার শরীর দুলে ফেঁপে উঠে যেন উপচে পড়তে লাগল এতক্ষণের চেপে যাওয়া ক্রোধের নহর। আবিদ আবারো তার-ঢঙে বাঁকা হেসে পা বাড়াল। কিছুদূর এগিয়ে তার চোখে পড়ল খোলা মাঠের কিনারায় বটমূলে আড্ডা দিচ্ছে সদ্য কিশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেওয়া ছেলেরা। প্রত্যেকের হাতে জলন্ত সিগারেট। সফেদ ধূম্রজালে ভারী বাতাস। রাত্রিকালে এখানে বসে গাঁজার আসর। কখনো বা বড়লোক বন্ধুর কৃতিত্বে ইয়াবাও চলে! বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি আর মায়ের সঙ্গে ঝগড়া -গালাগালি করে টাকা দিয়ে গাঁজা ইয়াবা খাওয়ার গল্পও কম নেই এই তল্লাটে। এদের বাবা-মা’রা সন্তানের কাছে অসহায়! নাহ এই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এভাবে নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। অতি শিগগির আলোর পথে ফেরাতে হবে গাঢ় অন্ধকারের অতল গহ্বরে পতন-উন্মুখ তরুণসমাজকে। আজ প্রস্তুতি নেই। অন্যদিন এসে ওদের সঙ্গে কথা বলা যাবে। এই ভেবে ফেরার পথ ধরল আবিদ। মাথায় সেই একটাই চিন্তা আর উদ্দাম ভাবনা—

মেয়েরা পেটে কথা রাখতে পারে না। হাতের মুঠোয় কাদামাটি যেমন অনিরাপদ তেমনি মেয়েদের পেটেও যেকোনো গোপন কথা অনিরাপদ। বদহজম হয়। দুপুরে নিরু আসতেই উরবি আথালিপাথালি করে আবিদের সমস্ত অতীত পেট থেকে উগলে দিল। সব শুনে নিরু বিস্ময়াহত হয়ে বলল,
– এমন না হলেও পারতো!
উত্তরে উরবি ক্ষুণ্ণকন্ঠে বলল,
– হুমম, এজন্যই বলা হয়,জীবন কখনো কখনো নাটকের চাইতেও বেশি নাটকীয়। এসব শোনার পর থেকে না আমারো খারাপ লাগতেছে। মায়া হচ্ছে লোকটার জন্য। কেমন পোড়া কপাল দ্যাখ্!
নিরু কয়েক সেকেন্ড উরবির স্নিগ্ধ চোখেমুখে কিছু-একটা খোঁজার চেষ্টা করে ছোট করে বলল,
– মায়া? নাকি অন্যকিছু? কোথাও… ভালবাসা নয়তো!
উরবি নৈরাশ্যভরে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে পড়ে বলল,
– জানি না। এসব শোনার পর লোকটার ওপর আমার প্রথমে করুনা এবং পরে বিতৃষ্ণা জমার কথা। কিন্তু…
-‘কী কিন্তু?’ নিরুর কণ্ঠে উদভ্রম! সেও উরবির পাশে শুয়ে পড়ল।
– কিছু না। বাল, আমি নিজেকেই নিজে বুঝতে পারতেছি না নিরু। উফ্ হেল্প মি নিরু…
উন্মাদিনীর ন্যায় হাত পা ছুঁড়ে কুমড়োগড়াগড়ি খেতে লাগল উরবি।
ওর কাণ্ড দেখে নিরু মুখে হাত চেপে ফুলে ফুলে হেসে উঠে বলল,
– ওরে আল্লাহ্। তুই এমন বাচ্চাদের মতোন করতেছিস কেন উরবি। উঠে বয়।

চলবে….