ভবঘুরে পর্বঃ ১৬

0
608

ভবঘুরে পর্বঃ ১৬
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

আশেপাশে কোথাও উরবি চিহ্নমাত্র নেই। চারিদিকে শুধু জ্যোৎস্নার গুড়িগুড়ি বৃষ্টি! আবিদ কম্পিত গলায় ডাকল,
-‘কোথায় গেলেন আপনি?’
তথাপি কোনো সাড়া নেই। আবিদ ইতস্তত হেঁটে আবারো অলক্ষ্যে ডাক পাড়ল,
– মিছিমিছি লুকোচুরি করে লাভ নেই। বেরিয়ে আসুন কোথায় আছেন।
এবারো কোনো উচ্চবাচ্য না পেয়ে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করল আবিদ। একঝলক আলোকরশ্মি উদগীরণ করে জ্বলল ফ্লাশ। ঠিক তখনি অনতিদূরের শিমুলগাছের আড়াল হতে একটা বিড়ালছানা হাতে বেড়িয়ে এল উরবি। তার চোখেমুখে বাঁধভাঙা খুশি। সে এগিয়ে আসতে আসতে তুলতুলে বিড়ালছানার লোমশ মাথায় হাত বোলাচ্ছে আর বলছে,” আমাদের অনেক আম আছে,তোকে আম খেতে দিব।” বিড়ালছানাটা নড়চড়ে ‘মিউমিউ’ করে উঠে। গোপন দুঃখ প্রকাশ করে নাকি বদ উরবির কথায় সায় দেয় বোঝা ভার। উরবি বেশ বুঝবানের মতো বলে,” আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে”
আবিদ কিছু না বলে কটিতে দু’হাত ঠেকিয়ে বিরক্তি নিয়ে ওর কাণ্ড দেখতে লাগল। উরবি সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে আকর্ণ বিস্তৃত হেসে বলল,
– ভয় পেয়েছেন? না? আসলে হইছে কি। এই বিড়ালটার মা’কে মেরে ফেলছে গ্রামের শয়তান ছেলেগুলা। তো তারপর অনেক খুঁজছি ছানা দুইটারে। একটা পাই নাই। আরেকটা এখানে পেলাম।
আবিদ এই প্রসঙ্গে আর কিছু বলল না। চোখ-মুখ শক্ত করে জবাব দিল,
– ঠিক আছে চলুন। সময় কম। ফিরতে দেরি হবে আবার!
বলে দ্রুতপদে হাঁটা শুরু করে আবিদ। মেয়েটাকে তার বিরক্ত লাগছে এই মুহূর্তে। বলা নাই কওয়া নাই হুট করে উধাও! ফাজিল!
উরবি পেছন থেকে দু-এক লম্ফ দিয়ে ছুটে এসে আবিদের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। উরবির হাঁটার ধরণটা ভারি মিষ্টি। ছোট ছোট পদে হাঁটে কিন্তু খুব দ্রুত পা ফেলে। তারওপর জাঁহাবাজ কিশোরীর মতোন টিনটিনে শরীরের পুতুলের মতোন গোলগাল মুখটা! সবমিলিয়ে অদ্ভুতরকমের সুন্দর! সে হাঁটতে হাঁটতে কটাক্ষ করে বলল,
– হুঁ, রাগ দেখিয়ে লাভ কী? আপনার রাগের থোড়াই কেয়ার করি না আমি।… এই দে তো লোকটারে একটা কামড়,ওঃ দাঁত উঠেনি! আচ্ছা বড় হলে দিস।
আবিদ এই কথায় অবিকার মুখে একবার তাকাল কেবল।
উরবি বুঝল লোকটার কথা বলার ইচ্ছে নেই এই মুহূর্তে। থাক সেও চুপ করে। অচেনা অজানা একটা লোককে এতো খানি পাত্তা দিলে চলবে কেন? সে কি এতোই সস্তা? ‘সস্তা’ কথাটা উরবির মাথা ভিমরুলের মতোন ভোঁভোঁ করে ঘুরতে লাগল হরদম। ঠিকই তো! জীবনে বোঝ হবার সূচনালগ্ন হতে যত মানুষের সঙ্গে সে গলাগলি করেছে, ভালোবেসেছে, বচসা করেছে, বিবাদ করেছে, বাগবিতণ্ডা করেছে সব জায়গাতেই কি সস্তার একটা কঠিন প্রলেপে আবৃত ছিল? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে উরবিঃ মাত্রাতিরিক্ত চঞ্চলতা, সদাশিব থাকা,অল্পতেই মানুষকে বিশ্বাস করা, কেউ একহাত বাড়ালে নিজে দু’হাতে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেওয়া এসবের এককথায় প্রকাশ করলে কোনো কুলক্ষণে কি ‘সস্তা’ শব্দটা এসে দাঁড়ায়? উরবি জানে না। ভাবুক-গম্ভীর সে নয়। সে সদ্য পরিস্ফুট নবীন কিশলয়ের মতোন মতো ধাবমান, একমূর্তিতে দাঁড়িয়ে থেকে গম্ভীরবেদী ভাবাভাবি তার পক্ষে সাজে না। ভাবনার সায়রে ডুব দিতে-না-দিতেই নানান অনাসৃষ্টি কাণ্ড তাকে তাড়া করে বেড়ায়। সবশেষে একটা বিকট দীর্ঘশ্বাসে সব ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে আগের মতো হয় হতে হয় তাকে। এবারো তাই হল।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


অর্ধেক পথ হেঁটে বড় রাস্তায় এসে গাড়িতে চড়ল দু’জনে। পিচঢালা সমান্তরাল পথে মফস্বলে পৌঁছুতে খুব একটা দেরি হল না। ঘন্টা আধেক পর পৌঁছুল তারা। উরবি থানায় যাবে না। থানা আর হসপিটাল এই দুই জায়গা তার জন্য বড় অস্বস্তিকর। একজায়গায় রোগীদের ছড়াছড়িতে মন বিষিয়ে উঠে,অন্য জায়গায় অপরাধী আর চাটুকারি পেটমোটা পুলিশদের আনাগোনায় ভেতরের অন্তঃকরণ বিদ্রোহ করে উঠে। কাজেই আবিদকে থানায় পাঠিয়ে সে নিজে শপিং কমপ্লেক্সে ঢুকে পড়ল। বিড়ালটার জন্য কাপড় কিনতে হবে! অগত্যা আবিদ একাই থানা প্রবেশ করল। অফিসার আবিদকে দেখামাত্রই গদগদকণ্ঠে বলে উঠলেন,
– ‘আরে আপনি যে… হঠাৎ আমার থানায়?’
দু’জনে করমর্দন করে নিজ নিজ আসনে বসে পড়ল। আবিদ চেয়ারে হেলান দিয়ে শান্ত হয়ে বসল কয়েক মুহূর্ত। এরপর পিঠ তুলে ঈষৎ ঝুঁকে দু-হাত স্বচ্ছ কাচের টেবিলে ঠেকিয়ে কোনো ভূমিকা ছাড়াই শুরু করল,
– ‘আসলে আমি আপনাকে মিথ্যা বলেছিলাম। আমি এখানে এসেছি একটা কাজে। কী কাজ সেটা আপাতত বলা যাবে না। আপনার আগে যে অফিসারটা ছিল তিনি একটু বদ টাইপের ছিলেন। তাই আসা হয়নি এখানে। এখন যেহেতু আপনি আছেনই…মানে আমাকে চিনেন,সো আসতে পারলাম। মূল কথাটা হল, আজকের খুনের কাহিনিটা কী ছিল? বলা যাবে?’
অফিসার জানে আবিদের সঙ্গে সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে হাত আছে। তারাই অগ্রিম কোনো হেল্প এর প্রয়োজন হলে আবিদকে ডেকে পাঠান দেশের অভ্যন্তরে নানা জায়গায়। কারণেই এঁকে সবকিছু না বলে উপায় নেই। অফিসার ফিক করে একটু হেসে বলল,
– ‘ঘটনা তো পানির মতো পরিষ্কার এখন। আপনি যেহেতু জানতে চেয়েছেন অবশ্যই বলব।’ এটুকু বলে অফিসার একটু নড়েচড়ে বসে পুরো ঘটনাটা মস্তিষ্কে একবার খেলিয়ে নিয়ে বললেন,
-‘যে লোকটা নিহত হয়েছে সে লোকটা মাদক ব্যাবসার সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত ছিল। তো, কোনো কারণে সে মাদক ব্যাবসা ছেড়ে দেবার চিন্তাভাবনা করেছিল। তার ব্যাবসার পার্টনারদের সে বলেছিল যে সে আর মাদক ব্যাবসা করবে না। তার ভাগের টাকাটা যেন ফেরত দেয়! তারা রাজি হয় না। এবং ভয় পায় যে সে বাইরে সব কিছু ফাঁস করে দেয় কি না! তখন তো সব ভেস্তে যাবে! যার জন্য এই খুনটা করেছে তারা।’
আবিদ চিন্তিত ভঙ্গিতে আলগোছে দাড়ি টানতে টানতে বলল,
-‘আচ্ছা, অপরাধী ধরা পড়েছে?’
– ‘হ্যাঁ দুইজন।… আঙুল দিয়ে দুই সংখ্যা দেখিয়ে দিলেন অফিসার,” কিন্তু আবিদ সাহেব! দুইদিন পর তারা আবার ছাড়া পেয়ে যাবে!”
আবিদ ভুরু কুঁচকে বলল,
– মানে? কেন?
অফিসার আশেপাশে একবার সতর্ক দৃশ্য নিক্ষেপ করে চাপা গলায় বললেন,
– আরে… এদের সঙ্গে তো বড় বড় নেতাদের ভালো সম্পর্ক আছে। নেতাদের নির্দেশেই তো কাজ করে এরা!
আবিদ তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়াল। ফিরতে উদ্যত হয়ে বলল,
– আমার বোঝা হয়ে গেছে। কিন্তু আপনিও আবার ওদের সঙ্গে গিয়ে মিলবেন না যেন! সাবধান!… মনে কিছু নিবেন না অফিসার। আমি যা বলি সোজাসাপটা বলি। আজ আসি। আবার আসতে পারি।
অফিসার স্মিত হেসে সায় দিলে আবিদ দীর্ঘ পদক্ষেপে বেরিয়ে এলো।

দু’জনে যখন বাসায় ফিরল ঘড়ির কাটায় সময় তখন রাত ন’টা। শহর কিংবা মফস্বলের কোলাহল ইতোমধ্যে স্তিমিত না হলেও গ্রামের জন্য এই সময়টা অনেক রাত। কেউ কেউ এরিমধ্যে হাঁস-মুরগির সঙ্গে দিয়েছে গভীর সুষুপ্তি। ফিরে এসে আবিদ চলে গেল নিজের ঘরে। কিন্তু উরবিকে ধরে পড়ল সালমা।
– এই উরবি, শোনে যাও।
সারাদিনের ঝক্কি-ঝামেলায় অবসাদগ্রস্ত হলেও উরবির মন ভাল ছিল,বিধায় অন্যদিনের মতো জ্বলে না ওঠে শান্ত স্বরে বলল,
– বল মামণি।
সালমা বুঝলেন মেয়ের মনমেজাজ মোটামুটি ভালোই আছে। এই সুযোগে কিছু কথা জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাক। অনেকটা ভয়ে ভয়ে শুধোলেন,
– এতো রাত পর্যন্ত ছেলেটার সঙ্গে কোথায় ছিলে? কোনো ভালো ঘরের মেয়ে এভাবে বাইরে থাকে?
উরবি আড়চোখে একবার মামিকে পরখ করে হেদিয়ে পড়া গলায় বলল,
– মামণি! আমি টায়ার্ড বুঝছ? না-হয় অন্যদিনের মতো ঝগড়া করতাম। এখন শক্তি পাচ্ছি না। আমাকে কিছু খাইয়ে তরতাজা করো তারপর তোমার সঙ্গে দেখো কী করি!
সালমা প্রশ্রয়ের হাসি দিয়ে বললেন,
– হ্যাঁ খাওয়াব। তার আগে বলো,আবিদের সঙ্গে তোমার কী? শুরুতে তো একদম দেখতে পারতে না ওকে।
উরবি হঠাৎ পাগলটা ষাঁড়ের মতোন ফোঁস করে উঠল,
– আমার মাথা ওর সঙ্গে। বারবার বলি রাগাবে না আমাকে। কেন? তোমার কী মনে হয় আমি ওর গলায় ঝুলে পালিয়ে যাচ্ছি এবাড়ি থেকে। যতসব উদ্ভট কথাবার্তা জিজ্ঞেস করে। বাল! যাও খাব না কিছু। দূর হও আমার সামনে থেকে। যাও বলছি।
উরবির রুদ্রমূর্তি দেখে সালমা আর কোনো দ্বিরুক্তি না করে পড়িমরি করে জায়গাটা থেকে পালিয়ে এলো। এই অবস্থায় মেয়েটার সামনে থাকলে মানসম্মান নিয়ে ফেরা মুশকিল।
…………………………………………..

দিন দুয়েক পরের কথা। জৈষ্ঠ্যের কাকডাকা ভোর। ব্রাশ হাতে আমবাগান হয়ে পুকুর ঘাটের দিকে যাচ্ছিল আবিদ। তার পরনে রাতের কালো টি- শার্ট আর ট্রাউজার। সদ্য ঘুম-চ্যুত দু’চোখের পাতায় স্ফীত ভাব। প্রতিদিনকার মতোন আজও গায়ে প্রভাতের হাওয়া লাগিয়ে ঢিমেতেতালে এগোচ্ছিল সে। আচানক মাথার ওপর একটা আমের আঁটি এসে পড়ল তার। খুব জোরেসোরেই পড়ল। একেবারে মাথার করোটিতে লেগে ‘টক্’ করে একটা শব্দ উৎপন্ন হয়েছে। আবিদ সচকিত হয়ে ওপরের দিকে এবং আশেপাশে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে ফিরল। কিন্তু কোনো মানুষ তো দূর একটা কাঠবিড়ালিরও দেখা মিলল না! পুনরায় হাঁটতে উন্মুখ হতেই উপর থেকে চিটচিটে আমের রস পড়ে মাথা ভরে গেল। মুখে অস্ফুটে বিরক্তিসূচক শব্দ করে আবার হাঁটার উদ্যোগ নিল সে। তখনি গায়েবি আওয়াজের মতো যেন বাতাসে ভেসে এলো,
-‘এইযে জংলি মানুষ। এদিক এদিকে!
বলা শেষেই তীক্ষ্ণ হাসি তরঙ্গায়িত হতে লাগল ভোরের ঐন্দ্রজালিক ভুবন কাঁপিয়ে।
আবিদ বিরক্ত নিয়ে বলল,
– আমি জানতাম সাঝ-সকালে আপনি ছাড়া এই বেয়াদবি কেউ করবে না৷ কোথায় আপনি?
শেষের বাক্যটি একটু ঝাঁজ নিয়ে শুধাল আবিদ।
গায়েবি আওয়াজটা শব্দ করল,
– একমিনিট! নেমে আসতেছি…
বলা মাত্রই আবিদের সামনে যেন আকাশ থেকে ধপ করে নেমে এল উরবি। ঝুরঝুর করে তার কোল থেকে গলে পড়ল গোটাকতক ডাঁশা আম। সে দ্রুত সেগুলো কুড়িয়ে নিল। আবিদ ওপরে তাকিয়ে দেখল, অপেক্ষাকৃত নিচু একটা ডাল থেকে লাফিয়ে নেমেছে মেয়েটা। হাত-পা মচকেনি এই ঢের! উরবি দু-হাত ঝেড়ে নিতে নিতে ত্যাড়া গলায় বলল,
– আমাকে বেয়াদব বললেন কেন? আমের আঁটি মাথায় মারার উদ্দেশ্য ছিল আপনার এ্যাটেনশন সিক করা। আর আমের রস চিবে ফেলছি আপনি উপরে তাকালে আপনার মুখের ওপর পড়বে আর আপনি সেগুলো খাবেন,সেই উদ্দেশ্যে। কিন্তু আপনি উপরে না তাকালে আমার কী দোষ? আপনি বেয়াদব আপনার চৌদ্দ গুষ্টি বেয়াদব। মানুষের ভালা করতে নাই। ধুরর!
বলতে বলতে কঠোর হয়ে এলো উরবির মুখ। আবিদ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ফস করে হেসে দিয়ে বলল,
-‘আকাশ থেকে পরি নামে জানতাম। কিন্তু কাঠবিড়ালি নামতে আজ প্রথম দেখলাম’
উরবি ডানহাতের তর্জনি উঁচিয়ে ঠোঁট কুণ্ঠিত করে বলল,
– আমাকে রাগাবেন না বলে দিচ্ছি। আপনার চুল সব ছিঁড়ে ফেলব।
বলেই একপা এগিয়ে আমের রসমিশ্রিত আঠালো হাতে আবিদের সুসজ্জিত চুলগুলো মুহূর্তেই এলোমেলো করে দিল সে।
আবিদ চোখেমুখে সিকিপরিমাণও বিরক্তি নেই। সে আগের হাসিটা বজায় রেখে বাঁ হাতে এলোমেলো চুলগুলো পেছনে সরিয়ে বলল,
– আপনার কারণে গোসল করতে হবে আমার। কি বিশ্রীভাবে রস ঢেলেছেন মাথায়!
উরবি ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলল,
– প্রয়োজনে আরো ঢালব। এই দুইদিন তো খুব শান্তিতে ছিলেন, আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করি নাই। বিড়ালের ছা টা নিয়ে বিজি ছিলাম!
উরবির কথার ধরণে আবিদের নিভে যাওয়া হাসিটা আবারো জ্বলে উঠল। হাসিটা মুখে টেনে বলল,
– আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। আসলেই শান্তিতে ছিলাম।
– কিন্তু আর থাকতে দিচ্ছি না। আপনি না বলেছিলেন,আমাকে সব বলবেন? চলেন বলবেন।
– এই অসময়ে? আজও এড়িয়ে যেতে চাইল আবিদ।
উরবি জোর দিয়ে বলল,
– এটাই পারফেক্ট সময়। পুকুরঘাটের দিকে চলুন। ওখানে বসে বসে শুনব।
আবিদ কিছু বলল না অনেক্ষণ। নিরুদ্যমে উরবির পিছুপিছু পুকুরঘাটে গেল। অন্যমনস্ক চলনে ব্রাশ করল, আমের তীব্র রসে ভরপুর চটচটে মাথাটা ধুয়ে নিল পুকুরের পানিতে। সবশেষে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি মেলে উরবির পাশে পাকা ঘাটে বসল। উরবির সমস্ত আননে চলকে পড়া ঔৎসুক্য। সে থুতনিতে বাঁহাত ঠেকিয়ে মনোযোগী ঢংয়ে বলল,
– বলুন এবার।
তবুও আবিদ আরো কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে থেকে বিস্মৃত-অবিস্মৃত স্মৃতিগুলো হৃদয়ের তলানি হাতড়ে আন্দোলিত করে ঠোঁটের ডগায় আনতে লাগল। বহুক্ষণ পর তার ঠোঁটযুগল কাঁপল,
-‘ আমার জীবনের ঘটনা খুব করুন উরবি! এজন্য আমি বলতে চাই না কাউকে। আসলে আমি ম্যারিড।’ এতটুকু বলে একটু থামল সে।
উরবি চোখদুটো মুহূর্তেকের জন্য বিস্ফারিত হল এবং পরক্ষণেই তার সমস্ত উদ্যম যেন কর্পূরের মতো উবে গেল। আগের মূ্র্তিতেই সে স্থির,তবে তার সৌম্য দৃষ্টি ছায়াছন্ন হয়ে এলো ধীরে ধীরে। অজানা কারণে এক বিধ্বংসী আবর্ত তার বুকের ভেতরের জগৎটাকে যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগল। এর কারণ তার অজানা! আবিদ আবার বলতে শুরু করল,
– আমি যখন অনার্স করছি তখন বাবা মা ধরে বেঁধে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয় যাতে ভার্সিটিতে পড়ে বখে না যাই। মায়ের ধারণা ছিল ছেলে বেশি পড়ালেখা করলে ছেলে আর পরে মা বাবার কথা আর শুনে না। নিজের ইচ্ছেমতো বিয়েসাদী করে। তখন একপ্রকার আমার অনিচ্ছাতেই বিয়েটা হয়ে যায়। বাচ্চা একটা মেয়ে ছিল। তার বয়স ছিল তখন সতেরো। বাবা মা’রা কীভাবে কীভাবে যেন জন্মনিবন্ধন কার্ডে বয়স বাড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়। কীসের এতো তাড়া ছিল কেজানে। গ্রামগঞ্জে এমনি হয়। মেয়ে একটু ডাগর হয়ে ওঠার আগেই বাবা মায়েরা বিয়ে দিবার চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ে। তবে গ্রামের মেয়েরা বেশ স্বামীভক্ত হয়। আদিবাও ছিল। ওর নাম ছিল কামরুন্নাহার আদিবা। যাইহোক,জীবন তো আর নাটক সিনেমা নয় যে বিয়েতে আমার মত ছিল না বলে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিব না! মেনে নিয়েছিলাম ওকে। খুব লক্ষ্মী একটা মেয়ে ছিল। গায়ের রংটা তোমার মতো ফর্সা না হলেও মন্দা ছিল না। হুমম? অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল বলে বন্ধুরা আমাকে জামাই বলে ক্ষ্যাপাতো। আমি কিছু বলতাম না। হেসে উড়িয়ে দিতাম। ভাবতাম,মজা করার টপিক একটা পেয়েছে, করুক না মজা। তাদের বঞ্চিত করব কেন? কয়েকটা বছর ভালোই চলল সব। আমার অনার্স শেষ হল। মাস্টার্সও কমপ্লিট হল। বাবার ব্যাবসা ছিল মেহেরপুরে। সেটা দেখভাল করলাম কিছুদিন। পরে ভাবলাম পিএইচডি করতে যাব বাইরে। কিন্তু আদিবা এর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। ও আরেকটা কথা, আদিবাও কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল আমার কথায়। ওর যখন বিয়ে হয় আমার সাথে তখন সবেমাত্র এসএসসি পাস করেছিল ও। শুনলেই কেমন হাসি পায় না? হাঃ হাঃ হাসি আসারই কথা। আমাকে ছাড়া ওর একটা দিনও চলতো না। ভালোবাসাবাসি হয়তো একটু বেশিই ছিল আমাদের! আমি রাত জেগে পড়লেও আমার পাশে এসে বসে থাকতো। হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে। একসময় আমার অভ্যাসটা এমন হয়ে গিয়েছিল যে ও পাশে বসে আমার দিকে তাকিয়ে না থাকলে আমার পড়াই আগাতো না। বাবার বাড়িতে গেলো তিনদিনের বেশি মন টিকতো না তার। নানান ছুতো ধরে ফিরে আসতো শ্বশুরালয়ে। আর কি জানো, ও খুব অভিমানী ছিল। কিন্তু রাগ করতে জানতো না কখনো। বলা যায় তোমার উল্টো স্বভাবের। হ্যাঁ ঠিক তাই। কিন্তু আমি কখনোই ওর অভিমান ভাঙাতে পারতাম না। কেন জানি না। এদিক দিয়ে ও হয়তো একটু অসুখীই ছিল। কিন্তু ভালোবাসা কোনো অংশ কম ছিল না।’
আবিদ থামল এটুকু বলে। উরবির দিকে তাকিয়ে বলল,
– কী? একটু বেশিই রোমান্টিক আর নাটকীয় লাগছে না?
উরবি এতক্ষণ নিবিষ্টচিত্তে মুখে হাত দিয়ে আবিদের কথা শুনছিল, এবার টানটান হয়ে বসে বলল,
– মোটেই না। আমার শুনতে ভালো লাগতেছে। তারপর কী হল বলুন না! ইশ, হিংসা হচ্ছে, আমার যদি এমন একটা স্বামী থাকতো!
আবিদ ওষ্ঠাধর প্রসারিত করে হাসল। বলল,
– হয়ে যাবে।
– দেখা যাক, তারপর?
– তারপর?

চলবে…

ইচ্ছে ছিল আবিদের কথাগুলো শেষ করা। কিন্তু শরীর সায় দিচ্ছে না।

এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share