ভবঘুরে পর্বঃ১৪

0
615

ভবঘুরে পর্বঃ১৪
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

সকালের ডাঁশা-ঘুমটা নষ্ট করায় আবিদ ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ ছিল উরবির ওপর। সে কারণে এতাবৎ উরবির কোনো কথার সুষ্ঠু প্রতি-উত্তর করেনি সে। মিনিট কয়েক উরবির পিছুপিছু পথ চলতে চলতে এবার চাপা রাগের হিমাদ্রি গলতে শুরু করেছে। কে খুন হয়েছে, কোথায় খুন হয়েছে,কে খুন হয়েছে তা বৃত্তান্ত জানা প্রয়োজন। ভেবে, এতক্ষণের আচরণের জন্য একটু অনুতাপ-ভরা গলায় বলল,
– আচ্ছা, কে খুন হয়েছে বলেছিলেন যেন? ঘুমের ঘোরে মাথা ঠিক ছিল না, স্যরি।
উরবি আবিদকে পথ দেখিয়ে দেখিয়ে সামনে হাঁটছিল। আবিদের মুখে কথা ফুটেছে দেখে অদ্ভুতভাবে তাকাল সে,যেন আজীবন বোবা কোনো মানুষ ভুল করে দু’আখর উচ্চারণ করে গোটা পৃথিবী চমকে দিয়েছে! অদ্ভুত ভঙ্গিটা মুখে টাঙিয়ে রেখেই মুখ ফিরিয়ে নিল সে। সামনে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
– শুনেছি, লোকটা ভালো না। মদ-টদ খেতো আর ঐ আস্তানায় আসা-যাওয়া করতো। ভাবলাম, হঠাৎ খুন হল, তার পেছনে নিশ্চয় আপনার হাত আছে।
শেষের কথাটা উরবি ইচ্ছে করেই বাড়িয়ে বলল যাতে আবিদের নিস্পৃহতাকে একটু আঙলে দেওয়া যায়। ঘটলও তাই। আবিদ একটু টলে গেল। তবুও কাটাকাটা গুরুগম্ভীর গলায় বলল,
– মানে? আমার হাত কীভাবে থাকবে? আমি ওদের ধরে নির্মূল করতে এসেছি। মারতে নয়।
– কীভাবে? আপনার ব্যাগে একটা পিস্তল আছে না? ওটা দিয়ে মারছেন।
– আপনি আমার ব্যাগ হাতেড়েছেন আমার অনুমতি ছাড়া? আপনার সাহসের প্রশংসা করতে হয়!
– ‘অনুমতি নেওয়ার সুযোগ ছিল না,আপনি তখন ইঞ্জুরি হইছিলেন। আপনার টিশার্ট নিতে গিয়ে দেখলাম ওটা। বাপরে কি ভারি! আচ্ছা গুলি বের হয় ওটা দিয়ে?’
কথা হচ্ছিল দু’জনের অলক্ষ্যে। কথাটা বলেই উৎসুক হয়ে উরবি হাঁটার গতি মন্থর করতেই আবিদ তার পাশাপাশি এসে গেল। উরবির আগের উৎসাহী দৃষ্টিটা আবিদের মুখের ওপর রাখল উত্তরের আশায়। আবিদ বিকারহীনভাবে বলল,
– গুলি তো বের হবেই। এটা গ্রাম শুদ্ধ বলে বেড়ালেও কিছু হবে না। ওটা লাইসেন্স করা আমার নামে। আমার গুলি থেকে যদি কেউ নিহত হয় তাহলে সেটা পুলিশ জানতে পারবে। আপনার গোয়েন্দাগিরি করার দরকার নেই।
উরবি বাঁ হাত মুখে টিপে খকখক করে হেসে বলল,
– রাগলেন কেন?…ঐ যে এসে গেছি।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


অদূরেই খালপাড়ের বেতগাছের ঝোপের তলায় একটা বড় জটলা দেখা গেল। দূর থেকে চোখ কাড়ে অগণিত মানুষের কালো-কেশী বাহারি রকমফের মস্তক। আরেকটু কাছে এগোতেই দৃশ্যমান হয় ছেলে থেকে বুড়ো পর্যন্ত মানুষের এলোমেলো সমাগম। বহুকষ্টে ভিড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল উরবি আর আবিদ। খালে তখন ভাটার টান পড়েছে পড়েছে। বেতঝোপের পাশে খালের পঙ্কিল মাটিতে আপাদমস্তক আধ-উদলা একটা লাশ পড়ে আছে। লোকটার দুই হাত আর দুই কান কর্তন করা হয়েছে পোড় খাওয়া কসাইয়ের মতো। সর্বাঙ্গে বিষধর সাপের ন্যায় ছোপছোপ কালসিটে আঘাতের চিহ্ন। উপুড় হয়ে আছে লাশটা। শুধু মাথাটা এমুখো হয়ে চোখদুটো পাকিয়ে চেয়ে আছে উচ্ছ্বসিত মানুষগুলোর দিকে। হত্যাকারী তার নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছে বেশ নিপুণভাবে। আবিদ খোঁজ নিয়ে জানল পুলিশে খবর দেয়া হয়েছে আধঘন্টা আগে। এই সংকীর্ণ অজপাড়াগাঁয়ে পুলিশ তখনো খবর পেয়ে পৌঁছুতে পারেনি। আবিদ চারপাশটা সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল অনেক্ষণ। কোনো আলামত মিলল না। মিনিট পনের পর পুলিশ এলে আবিদ সরে এলো অকুস্থল থেকে। উরবি একবার চুপিচুপি শুধাল,
– কিছু পেলেন?
আবিদ জবাবে কিছু না বলে শুধুমাত্র চিন্তামগ্ন হাত উঁচিয়ে থামাল উরবিকে। এরপর একদৃষ্টে ভূতলে তাকিয়ে থেকে কি যেন চিন্তায় অধীর হল সে।… নিহত লোকটাকে গ্রামের লোকজন অসৎ চরিত্রের লোক বলে জানে। যদ্দুর জানা যায় গ্রামে লোকটার শত্রু বিশেষ ছিল না। একলা সংসারী মানুষ সে। দিনে আনে দিনে খায়,রাত্তিরে মদ খেয়ে বউ পেটায়। এই তার নিত্যদিনের রুটিন। কিন্তু সীমান্তবর্তী আস্তানার সঙ্গে তার কী সংশ্রব সেটা আবিদের অবিদিত এই মুহূর্তে। এই বিষয়টা প্রতিমুহূর্তে ভাবতে বাধ্য করছে আবিদকে। তবে বেশিক্ষণ অজানা থাকবে না। অলীক আর রটানো কথাকুঞ্জের ফাঁদ খুব শীঘ্রই পঁচে-গলে নিঃশেষিত হবে। সময়টা খুব একটা দূরে নয়।

– ইয়ে… আপনাকে বোধহয় কোথাও দেখেছি।
অকস্মাৎ কারো দরাজ কণ্ঠে ভাবনার সুতো ছিন্ন হল আবিদের। একটু বিরক্তিভরে চোখ তুলল সে। ঝুলে-পড়া অবাধ্য চুলগুচ্ছতে আঙুল সঞ্চালন করে পেছনে চেপে ধরে ছেড়ে দিতেই কিছু ছন্নছাড়া চুল আবার কপাল দখল করে নিল নিমেষে। সামনে দাঁড়িয়ে স্থুলকায় পুলিশ অফিসার। আবিদ সন্দিগ্ধ গলায় নিজেকে দেখিয়ে দিয়ে বলল,
– আমাকে?
– ‘হ্যাঁ আপনাকে, কিন্তু কোথায় ঠিক মনে পড়ছে না।… ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে,হ্যাঁ টিভিতেই। সাংবাদিকের সাক্ষাৎকারে। মনে পড়ে? আপনি বন্দর এলাকায় জাহাজভর্তি মদ ধরিয়ে দিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গিয়েছিলেন। এরপর সরকার আপনার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিল…’ লোকটা মিনিট কয়েক অনর্গল আবিদের কৃতিত্ব বকে যাওয়ার পর জিজ্ঞেস করল,
– আপনি কি এখানেও কোনো কেস নিয়ে এসেছেন নাকি?
আবিদ পড়ল মুশকিলে। এই লোক যে ঐ মাতাল দলের সঙ্গে গলাগলি করবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে? কাজেই আসল উদ্দেশ্য নিহিত করে মিথ্যা বলতে হল তাকে,
– নাহ্ এখানে তো তেমন কিছু নেই। সবকিছুই ঠিকঠাক। আমি এসেছিলাম একটা খালার বাসায়। বেড়াতে। ঐ যে খালার মেয়ে…
দূর থেকে উরবিকে দেখিয়ে দিল আবিদ। উরবি হনহনিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে বাড়ির দিকে। অফিসার স্মিতহাস্যে সেদিকে তাকাল নিপাট কপালে। মেয়েটা কখন যে পাশ থেকে সরে গিয়েছে ঠাউর করে উঠতে পারেনি আবিদ। গেছে ভালোই হয়েছে,ছুতো দেখিয়ে অফিসার থেকে বিদায় নেয়া যাবে। ভেবে ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি সদ্য-সঞ্চিত মুক্তোর মতো চিলিক দিয়ে উঠল।
– ‘ইয়ে… স্যার, আমার যেতে হবে। আমি আবার বাসা চিনি না।, এতটুকু বলে উচ্চনাদে উরবিকে ডাকল আবিদ,
– উরবি,দাঁড়াও। আমিও যাব।
উরবি বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে থমকে দাঁড়াল। মাথা ঘুরিয়ে তাকাল মৃদু তালে দৌড়ে আসা আবিদের দিকে। জংলী লোকটার মুখে নিজের নাম আর ‘তুমি’ সম্মোধনটা যেন ডঙ্কার মতো এসে বাজল তার কানে। এই প্রথম লোকটা তাকে নাম ধরে ডাকল! উরবি তো ভেবেছিল লোকটা তার নামই জানার প্রয়োজন মনে করেনি অদ্যবধি। আরো একটু গভীর দৃষ্টিতে আবিদকে পরখ করল সে। ইশ্,কি অপূর্ব মুদ্রা উদ্ভাসিত করে দৌড়ে আসছে লোকটা! সঙ্গে তার ঝরঝরে দীঘল অবাধ্য চুলগুলোর কি নিদারুণ বৈচিত্র্য চড়াই-উৎরায় খেলা! উজ্জ্বল-শ্যামবর্ণা মুখমণ্ডলের নিচে আলুথালু দাড়িগুলো যেন আরো বিভিন্নতা প্রকাশ করে; আর নির্লিপ্ত দু-চোখে যেন তার পৃথিবীব্যাপি উদাসীনতা। খাড়া হৃষ্টপুষ্ট নাকের ডগায় টলটল করছে কয়েক বিন্দু ঘাম। উরবি মনে মনে একটা কথা ভেবে একচোট হেসে নিল। ভাবল,লোকটা নিশ্চয় বউ পাগলা হবে! আবিদ কাছে আসতেই চোখ নামিয়ে নিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করল উরবি। কেন কে বলবে! মানুষের নিশ্বাস প্রশ্বাসের বর্ণ সাধারণ হলেও দীর্ঘশ্বাসের রং ভারি দুর্বোধ্য।
কাছে এসে আবিদ বলল,
– কী ব্যাপার? এমন হনহনিয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন? আবার কার ওপর চটলেন?
লোকটা তার গতিক লক্ষ্য করছিল বলে প্রফুল্ল হল উরবি।! যদি বলি কেন? উরবির উত্তর জানা নেই। বলল,
– আর বলবেন না। শালার মনসুর বুইড়াকে নিয়ে মহা জ্বালায় আছি। চলুন বাজারের দোকানটার দিকে। হাঁটতে হাঁটতে বলা যাবে।
আবিদ তার কথায় সায় দিয়ে বলল,
– চলুন,আমারো বেশ খিদে পেয়েছে।

দু’জন মিলে মজিদের টং দোকানের দিকে পা চালাল। ঘটনাস্থল থেকে বাজার খুব একটা দূরে নয়৷ মিনিট পাঁচের পথ মাত্র। আর, বলা বাহুল্য এই অঞ্চলে মজিদের চায়ের দোকান বেশ প্রতিথযশা। মজিদের আগে তার বাবা ঐ দোকানটা চালিয়ে ঘরকন্না করতো। গ্রামের লোকজন বাজারের চা খাওয়া মানেই মজিদের দোকানই বোঝে,জানে, এবং চিনে। হাঁটতে হাঁটতে উরবিই শুরু করল,
– তো হয়েছে কি। বুইড়া লোকটা আছে,মনসুর। ব্যাটা আজকে আবার এই এতো লোকের ভিতর ভাজিতার বিয়ের কথা বলে। কেমন লাগে বলেন তো! এটা কি বিয়ের কথা বলার জায়গা?
আবিদ বলল,
– কাহিনিটা কী? আমিতো জানি না কিছু।
– ওয়েট বলছি। জিসান ছেলেটার সঙ্গে আমার একটা ঝুলন্ত রিলেশন ছিল এটা তো জানেন?
– হুম জানি। তো?
– তো, হয়েছে কি। আমি চেয়েছিলেন ওর সাথে মিউচুয়াল ব্রেকআপ করতে। কিন্তু যেদিন সেই কথা সব গুছিয়ে ওকে বলতে যাব সেদিন ও মাতাল অবস্থায় ছিল। তো,ও আনার সঙ্গে একটু অন্যরকম ব্যবহার করার কারণে আমি ওকে অপারগ হয়ে মেরে ধরে চলে আসছি। তারপর…
কথার মাঝখানে আবিদ থামাল উরবিকে। যাচাল,
– মাতাল ছিল? তাহলে তার সঙ্গে নিশ্চয় ঐ আস্তানার যোগসূত্র আছে।
-‘থাকতে পারে।’ প্রত্যাশা আর অপ্রত্যাশার মাঝামাঝি দোদুল্যমান থেকে বলল উরবি।
– ওকে। তারপর বলুন।
– তারপর, সে আর ছাড়ে না আমাকে। ওর চাচা মানে ঐ মনসুর আসল ভাতিজার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আমি তো রাজি না কোনোভাবেই। আবার এই এতো লোকের মাঝে আমাকে চুপিচুপি বিয়ের কথা বলে। কেমন লাগে দেখেন তো। আমি আড়ালে ডেকে নিয়ে গেলাম।… ওকি হাসেন ক্যান্। মধ্যিখানে কথা থামিয়ে আবিদের হাস্যোচ্ছটায় উছলে পড়া মুখের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল উরবি। আবিদের আত্মসংযম প্রচুর। তৎক্ষনাৎ সে সাধারণ হয়ে বলল,
– কিছু না বলুন,তারপর কী করলেন?
– তারপর আড়ালে ডেকে নিয়ে ঠাস করে তার টাকলা মাথায় একটা চড় বসায়া দিলাম। বুইড়া ব্যাটা চড় সহ্য করতে পারে নাই। ওমনি মাটিতে চ্যাপ্টা হয়ে হাত পা ছড়ায়া বসে গেল। তারপর আমি চলে আসলাম। এতটুকুই।
আবিদ আর কোনো মন্তব্য করল না এই বিষয়ে। অদ্ভুত রকমের হেসে চায়ের দোকানে প্রবেশ করল। উরবি বাইরের বেঞ্চিতে পা ঝুলিয়ে বসলে দোকানে অবস্থিত কয়েকজন মুরব্বি তাকে চোখা দৃষ্টিতে পরখ করলেও মুখে কিছু বলার সাহস জোগাল না। কারণ ইতোমধ্যেই উরবির ঔদ্ধত্যের কথা গ্রামময় রটে গেছে ভীষণভাবে। উরবির সেদিকে নজর দেবার সময় কোথায়? সে আছে তার মতো। নিজের বদনামের দুর্নমিত জলধারায় নিষ্ফল বাঁধ তৈরির কোনো ইচ্ছে তার নেই বললেই চলে। আবিদ কিছুক্ষণ কুশলাদি করল মজিদের সাথে। পরিবারের খবর জানতে চাইল। এবং শেষে দু’জনে নাশতা-পানি করে ফেরার পথ ধরল। বাড়ির কাছাকাছি এসে উরবি কৌতুহল উদ্দীপ্ত গলায় বলল,।
— আচ্ছা, আপনার বাড়ি মেহেরপুর তাই-না?
আবিদ সহসা ওর কৌতুহলের বিষয়বস্তু দেখে একটু অবাকই হল। একনিমেখে খানিক সময় তাকিয়ে থেকে বলল,
– হ্যাঁ। কেন?
– এমনেই। আচ্ছা, আপনার চলে কীভাবে?
– ‘মানে?’ আবিদ যেন বুঝেও কিছু বুঝে না।
উরবি খানিক্ষণ চুপ করে ভেবে কথাটা পুনরাবৃত্তি করল,
– মানে হল,আপনি যে এতো ঘুরে বেড়ান। আপনার টাকা-পয়সা কোত্থেকে আসে? যদিও শুনতে খারাপ শোনায়,তবু মনে একটা প্রশ্ন তো আসেই। না?
আবিদ ওর কথার ধরণ শুনে বিচলিত হল কিছুটা। এলোমেলো, উদ্ধত আর রগচটা মেয়েটা খ্যাঁচম্যাঁচ করা ভিন্ন সাবলীলভাবে কথা বলতে পারে তার জানা ছিল না। সে বলল,
– হুমম আসাটাই স্বাভাবিক। মূল কথা হল, আমার এযাবৎ উপার্জন দিয়ে আমার এই জীবন বেশ কেটে যাবে। উল্টো দানখয়রাত করে কিছু বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে জীবন শেষে।
উরবি আগের রূপ ধরে বাচ্চাদের মতো উৎফুল্ল হয়ে বলল,
– এত্ত টাকা আপনার? কী করতেন আপনি?
চোখ ফিরিয়ে আবিদ শক্ত গলায় বলল,
– বলা যাবে না ওসব। আপনাকে তো আগেই বলেছি আমার ব্যক্তিগত বিষয় কাউকে শেয়ার করি না।
সরাসরি না করে দেওয়ায় উরবির আঁতে ঘা লাগল একটু। হৃদকম্পনে একটা মরা রাগ ফেনিয়ে উঠতে চাইল। তথাপি পলকে নিজেকে বিচক্ষণ সামলে নিল সে। বলল,
– আচ্ছা। ওকে। আপনার ফ্যামেলিতে কে কে আছে? মা-বাবা, লাল টুকটুকে বউ, বিড়ালের মতো কচি বাচ্চা!
– প্লিজ থামুন। এই ব্যাপারে আপনার কৌতুহল আমার ভালো লাগছে না। আর এতো ফটফট কথা কীভাবে বলেন আপনি? মুখ ব্যাথা করে না?
প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে শেষের কথাটা বলে পায়ের গতি বাড়াল আবিদ। উরবিকে পেছনে ফেলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই দ্রুতলয়ে বাড়ির সদর দরজা পার হয়ে সে ঢুকে গেল অন্দরে। উরবির আশেপাশে মিনিট কয়েক একটা নিগূঢ় অপমানের কড়া ধূম ঘুরঘুর করল অনেক্ষণ যাবৎ। ধোঁয়াশা কেটে গেলে সে বিড়বিড় করে জনান্তিক করল আনমনে, ” আলুবাজ একটা,নিশ্চয় জায়গায় জায়গায় গিয়ে বিয়ে করা তোর পেশা,নেশা।বাঁদর কোথাকার।”
……………………….……………….…….…

সন্ধ্যাবেলায় মনসুরকে মারার অপরাধে উরবির বিরুদ্ধে সালিশ বসল গ্রামের পরিত্যক্ত ঈদগাহ ময়দানে। উরবির এতোদিনের বেয়াড়া সাজাগুলো মনসুর মানুষের কাছে এড়িয়ে গেলেও আজ গ্রামের লোকদের চোখের আড়াল সে হতে পারেনি কোনোভাবে। উরবির কঙ্কালের মতো হাতে আঘাত পেয়ে সে স্থানে বেচারাকে ওভাবে ধূলিবসনে বসে থাকতে দেখে গ্রামের লোকজন বেশ কৌতুহল নিয়েই পুরো ঘটনার ইতিবৃত্ত জেনে নিয়েছে। পাছে মনসুরের অপারগতায় গ্রামের লোকজন তাঁকে আর পূর্বের মতো ভীতি না করে তাই এই সালিশের আয়োজন করতে হল তাকে। সালিশে উপস্থিত রয়েছে গ্রামের পক্ষীয়-বিপক্ষীয় মাতব্বর, অপদস্ত মনসুর, তার ভাতিজা তথাকথিত উরবির অবল প্রেমিক জিসান। এই পর্যায়ে পাঠকগণ বিশিষ্ট তিনজন মাতব্বরের দেখা পাবেন৷ প্রথমজন হল, আবুল হোসেন। আর দ্বিতীয় জন হল, আবদুল লতিফ। এবং তৃতীয় জন হল গ্রামের বর্তমান মেম্বার রহিম শেখ। জনসমক্ষে এককোনায় নতমুখে বসে আছেন ইশতিয়াক সাহেব। তাঁর পাশেই উরবি বসে আছে ভাবলেশহীনভাবে। খানিক পরপর বিরক্তিসূচক শব্দ করে হাত দিয়ে নিজেকে বাতাস করছে সে। আবার কানে কানে বাবাকে বলছে,
– আর কতক্ষণ বাবা? শুরু করে না ক্যান?
মেয়ের এহেন প্রশ্নে বাবা মুখ কড়কে বলছে,
– চুপ থাকে বেহায়া মেয়ে, তোমার কারণে গ্রামে মানসম্মান থাকল না আমার!
– হ্যাঁ তোমার মানসম্মান খেয়ে ফেলতেছি আমি। আরো খাব। অপেক্ষা করো শুধু।
বলে চোখেমুখে বিতৃষ্ণা টেনে ঠোঁটদ্বয় গোল করে বাতাস ছাড়তে লাগল শূন্যে।একটু পর পুনরায় হাত দিয়ে বাতাস করতে করতে বলল,
– উফ্ কি গরম।… ও মেম্বার সাব,টেবিল ফ্যানটা আমার দিকে একটু দেন না। দেখেন না গরমে কেমন ঝোল হয়ে যাচ্ছি। আপনারা নিজে বাতাস খান আর জনগণকে শুকিয়ে মারেন। দেশের উন্নতি করবেন কী?
স্বয়ং অপরাধীর মুখে এমন অশিষ্ট কথা শুনে মজলিসটা গমগম করে উঠল। উপস্থিত নর-নারীরা কানাকানি শুরু করল যারযার পাশের জনের সঙ্গে। ইশতিয়াক সাহেবের মুখটা চাপা রাগ আর অপমানে কালিমা-নত হয়ে গেল। উরবি লোকজনের হল্লা শুনে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল ইশতিয়াক সাহেব মেয়ের হাত চেপে ধরে ক্ষীণ স্বরে বলল,
– চুপ কর।চুপ কর।
পৌঢ় মেম্বার সাহেব এতক্ষণে থতমত খাওয়া গলায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোকরাটাকে ধমকালেন,
– দাঁড়িয়ে দেহস কী? যা গিয়ে আরেকটা ফ্যানের ব্যবস্থা কর।
উরবি একগাল হেসে বলল,
– এইতো এক কথায় আমাদের মেম্বার ভালো হয়ো গেছে। গুড।
মেম্বার সাহেব নিজের ক্ষমতা দম বজায় রাখতে বললেন,
– হয়েছে। সালিশ শুরু যাক এবার।

চলবে….