ভবঘুরে পর্বঃ১৩

0
601

ভবঘুরে পর্বঃ১৩
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

আবিদ চারিপাশে একবার সজাগ দৃষ্টি রেখে চাপা উত্তেজিত গলায় বলল,
– আস্তে কথা বলুন। ওরা শুনে ফেললে সব ছুটে এসে সর্বনাশ হবে।… ওকি আবার ঢিল ছুঁড়ছেন কেন?
উরবি আরেকটা ঢিল ছুঁড়লে আবিদ সরে যেতে যেতে একথা বলে।
এদিকে উন্মত্ত জুয়া আর মদের আসরে একটা মৃদু গুঞ্জন ওঠে গেল আস্তানার পেছনে অপরিচিত মেয়েলী কণ্ঠস্বরের রূঢ় ব্যবহার শুনে। খেলায় অংশগ্রহণ না করে পড়ে থাকা দু’জন পাঁড় মাতালকে পাঠানো হল আস্তানার পেছনে। আদেশ মোতাবেক ঢলতে ঢলতে পেছনে হাজির হলো দু’জনে। দূর থেকে দেখতে পেয়ে লক্ষ্য করে কাছে এলো তারা। উরবি তখনো ক্রোধোন্মত্ত হয়ে এটা ওটা বলে যাচ্ছে আবিদকে। কিন্তু আবিদ নির্বিষের মতো চাপা-স্বরে নানান উপায়ে উরবির মন টলানোর চেষ্টা করছে। তথাপি উরবির কোপ দমে না! খানিক বাদে মাতাল দু’জন পেছন থেকে এসে একজন বেয়াড়া অথচ জড়িত গলায় বলল,
– ‘এই, কারা রে তোরা? এখানে কী চাই?’
বোধ করি এই মাতাল এই দেশীয় নয়। এই দেশের কথ্য-ভাষা এমন নয়।
উরবির মেজাজ তৎসময় দ্বিগুণ থেকে ত্রিগুণ খিঁচড়ে গেলেও তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ আর মদ্যপ কথার ধরণ দেখে কিছুটা দমে গেল সে। কিন্তু সেটা কণ্ঠে প্রকাশ পেল না। সে তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
– আমার যেখানে মন চায় সেখানে যাব। তোদের কী? তোদের বাপের কী? তোরা এখানে কী চাস?
লোক দু’জন অদ্ভুতভাবে হেসে খপ করে উরবির হাত আবদ্ধ করল। ক্ষীণবলা উরবির হাতেও যেন অশুরের ন্যায় শক্তি এসে গেল। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চটাস চটাস করে দু’জনকে একটা করে চড় উপহার দিল সে। একটু আগের খাওয়া চড়টার ঝাল যেন এদের ওপর মেটাল সে। উড়ু রোষে তার ঠোঁটযুগল কাঁপছে থরথর করে। চোখ দিয়ে যেন উপচে পড়তে লাগল আগুনের সরা। চড় খেয়ে মাতাল দু’জন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে মাটিতে লুটাল৷ আবিদ আর দাঁড়িয়ে থাকা সমীচীন মনে করল না। এখনই না পালালে সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিবে এই মেয়ে। ভাবতে ভাবতেই ক্ষিপ্র গতিতে কাজ করে আবিদ। খুব দ্রুত মাটি থেকে ক্যামেরাটা তুলে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে উরবির সরু উদর পেঁচিয়ে ধরে মাটি থেকে কিঞ্চিৎ আলগা করে নিল তাকে। তার বলিষ্ঠ সুঠাম বাহুতে অতি সহজেই সাপের ন্যায় বন্দী করে নিল উরবিকে।এরপর যে পথে এসেছিল পুনশ্চ ছুটল সে পথে। মাতাল দু’জনও টাল সামলে উঠে দাঁড়িয়ে হৈহল্লা করে ছুটল পিছুপিছু। আবিদের স্পর্শে যেন উরবির ক্রোধের পুরু প্রলেপ আগুনের সংস্পর্শে বরফের মতো গলে গেল। শুরুতে উরবি অদ্ভুত শিহরণে, চৈতন্য জাগরণে অন্তঃসারশূন্য স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুকাল। কিন্তু আস্তানা থেকে রেললাইনের দিকে অর্ধেক রাস্তা যখন পেরিয়ে এলো আবিদ, তখন উরবির মনে হলঃ নাহ নিজের স্বকীয়তা হারানো ঠিক হবে না,বজায় রাখা উচিত! কথাটা মনে করে সে কণ্ঠে রোষ এনে বলল,
– এই ছাড়েন আমাকে। বেহায়া ব্যাটা! আলুবাজ। ওমাগো পেট চিকনা হয়ে গেল আমার। এমনিতেই চিকনা।
আবিদ ছুটতে ছুটতেই বলল,
– আপনার পেট ধরার জন্য বসে নেই আমি৷ রাস্তায় উঠলেই নামিয়ে দিব। ঝামেলা করার জন্য আসছেন এখানে…
– আচ্ছা নামায়েন। কিন্তু পেট ছাড়েন। নাড়িভুঁড়ি সব বের হয়ে গেল আমার।
– পেট ছাড়লে ধরব কোথায়? চুপ করে থাকেন না। চলে এলাম তো।
আস্তানায় তখন হৈচৈ পড়ে গেছে। পিছন পিছন কয়েকজন লোকও ছুটে আসছে,পেছনে ফিরে দেখল আবিদ। কিন্তু আবিদ জানে তাদের দৌড় ঐ রেললাইন পর্যন্তই। এর বাইরে উশৃংখল তারা করবে না খুব সহজে। কাজেই সে প্রাণপণে রেললাইনের দিকে দৌড়াল। হতভাগী উরবিকে নিয়েই যত ঝঞ্ঝাট! নতুবা এভাবে কতক মাতালের কাছ থেকে পালিয়ে আসার মতোন কাপুরষ সে নয়; আবার বীরের মতোন একা লড়ার মতো সুপুরুষও সে নয়। তবু মাতালগুলো বশিভূত করা কোনো ব্যাপার ছিল না।
এদিকে উরবি শুরু করল আরেক কাণ্ড! আবিদের ঝাড়ি খেয়ে সে ঠোঁট সামাল দিল ঠিক,কিন্তু পেছনে আক্রমণাত্মক ধেয়ে আসা লোকগুলোকে সে অকারণ ভেংচি কাটতে লাগল আর খিলখিল করে হেসে মজা লুটতে লাগল। কুফলে লোকগুলো আরো উন্মাদের মতোন আস্ফালন করে ছুটে আসতে লাগল তাদের দিকে। আবিদ উরবির বাম করে ধরা পেটে চুপ করে থাকার ইঙ্গিতে মৃদুল চাপ দিল। এতেই উরবি ক্ষুব্ধা হয়ে তার ঢংয়ে একটা গালি পেড়ে বসল এবং বলল,
– ‘কুত্তা, খাটাস। আমার পেটটা কি আপনার বাপের সম্পত্তি যে মন চাইলেই চাপবেন…’ একটু পরেই আবার স্বর নামিয়ে বলল “এভাবে কষ্ট দিয়ে না নিয়ে সিনেমার মতো কোলে করে নিলে কত দারুণ হতো। ”
এই ঘোর বিপদে এমন কিম্ভূত অভিপ্রায়ে আবিদের রাগ উঠে গেল। সে চুপচাপ বনজঙ্গল মাড়িয়ে দৌড়ের গতি বাড়িয়ে রেললাইনে কাছে এসে ধপাস করে ছেড়ে দিল উরবিকে। ঠিক সেদিনকার মতো! রেললাইনের পাথর থেকে আত্মরক্ষা করতে দু’হাত বসিয়ে দিল উরবি। ওমনিই সে ব্যথায় কুঁকড়ে মুখ দিয়ে অনুচ্চ নাদে আর্ত শব্দ করল। সে চট করে দাঁড়িয়ে গিয়ে ধূলিমাখা দু-হাত ঝেড়ে নিয়ে বলল,
– এটা কী করলেন? সেদিনও গাছ থেকে নামায়ে ফেলে দিছিলেন আমাকে।
– বেশ করেছি। আপনার মতো ফাজিল মেয়ের এমন শাস্তিই পাওয়া উচিত। কেন এসেছেন এখানে? দুই পয়সার বল নেই শরীরে এতো নাচানাচি কীসের? সবকিছুতে এতো বাড়াবাড়ি কেন আপনার? আল্লার ওয়াস্তে আমার কাজগুলো একটু শান্তিতে করতে দিন। আপনাদের এলাকার ভালোর জন্যই পড়ে আছি এখানে। নয়তো দেখবেন মানুষ আঙুল তুলে বলবে ঐ যে সন্ত্রাসীর এলাকা। ভালো কাজ করতে করতে না পারলেও যারা ভালো কিছু করতে চায় তাদের সঙ্গে অকারণ ফাজলামো করার অধিকার আপনার নেই! ইডিয়ট!
বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ পদক্ষেপে সে জায়গা ত্যাগ করল আবিদ। পেছন থেকে উরবি কি যেন বলতে লাগল, স্পষ্ট শ্রবণীয় নয়। আবিদ সেসবে কর্ণপাত না করে নিজস্ব গতিতে বাড়ির পথে হাঁটতে লাগল। আরো অনেকগুলো ঘর চ্যাক করা হয়নি। কে জানে সেই ঘরগুলোতে কী অমূল্য রতন ঘাপটি মেরে আছে। একদিন যখন একটা ঝামেলা হয়েছে পরবর্তীতে তারা আরো বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করবে এতো সন্দেহ নেই। কাজেই,ভবিষ্যতের অভিযানগুলো আর সহজ-সরল নাও হতে পারে। ভাবতে ভাবতে পরবর্তী অভিযানের বিধেয় কোনো কূলকিনারা খুঁজি পেল না আবিদ। “ধ্যাৎ, প্ল্যানটাই মাটি!” নিজে নিজে জনান্তিক করল আবিদ।

শেষ দুপুরে নিরু এলো পড়তে। কিন্তু উরবির আজ পড়াতে ভালো লাগছে না বলে দু’জনে বসে আছে খাটের সাথে হেলান দিয়ে। আজ বহুদিন পর সইয়ে সঙ্গে অবসর পেয়ে নিরু উচ্ছ্বসিত হয়ে এটা-সেটা বলে যাচ্ছে আর উরবি মুখ চুন করে তা শুনে যাচ্ছে পরম ঔদাসিন্যে। উরবির ডাঁশা ফলের মতো গালে আবিদের চড়ের চার আঙুলের লালচে ছাপ বসে গেছে। মামি,বাবা এই নিয়ে জিজ্ঞেস করলে বলেছিল, নিজের ওপর রাগে নিজেই নিজেকে চড় মেরেছে সে। শুধুমাত্র নিরুকে আসল কথাটা মুখ ফুটে বলা হয়েছে। অনেক্ষণ পর ওর মুখের দিকে লক্ষ্য করে নিরু একটু চুপ করে গেল। বলল,
– আরে মুশকিল! আচ্ছা ওর কথায় এতো আপসেট হবার কী আছে? আসলেই তো তোর ওখানে যাওয়া ঠিক হয় নাই
উরবি ঘাড় ঘুরিয়ে স্বভাববিরুদ্ধ শান্ত চোখ চোখে তাকাল।বলল,
– আপসেট মানে বুঝস? আমি মোটেও আপসেট না। আমি ভাবছি।
– কী? কী ভাবিস?
নিরুর ঔৎসুক্যের কোনো উত্তর দিল না উরবি। দক্ষিণের জানালা হয়ে ফটকের ওপারে রৌদ্রময় রাস্তায় চোখ পড়তেই চকিতে উঠে দাঁড়াল। ছুটে গেল উন্মুক্ত বাতায়নের কোণায়। আম্রকাননের ঘিঞ্জি ডালপালার ফাঁকফোকর পেরিয়ে তার ধারালো দৃষ্টি পৌঁছে গেল দূর রাস্তায়। সে দেখল, খানিক পরপর ফটকের ভেতরে শিকারীর ন্যায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে জিসান আর পায়চারি করছে গেটের সামনে। আবার আবিদ মহাশয়ও তার কাছেপিঠে আছেন! ঘোর সন্দেহ হল উরবির। পুরো বিষয়টা আঙলে দেখার জন্য তর সইল না আর। তৎক্ষনাৎ নিরুকে নিয়ে নিচে ছুটে গেল সে। বাগান পেরিয়ে পার হল সদর দরজা। অকস্মাৎ উরবিকে সুমুখে ধরা পড়ায় কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়ল জিসান। কিন্তু আবিদ এরমধ্যেই কোথায় চম্পট দিয়েছে কে বলবে! উরবি কিছুকাল বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থেকে কাছে ডাকল জিসানকে৷ জিসান আহ্লাদে আটখানা হয়ে কাছে এল। উরবি বলল,
– কী রে? এখানে কী চাস?
জিসানের মুখের হাসি মুখেই গর্ত খুঁড়ে ঢুকে পড়ল। বলল,
– তুমি হেইদিন আমারে ক্যান্ মারছো আমি যানি না। পরে যহন জ্ঞান অইল তহন দ্যাখলাম বেবাক গায়ে ব্যথা। নড়িত পারি না। তয়…
– কেন মারসি জানস না? মদ খেয়ে কী করতে গেছিলি আমার সঙ্গে? আর কত মেয়ের সঙ্গে এগুলা করছস?
জিসান মাথা চুলকে বোকা হেসে বলল,
– হ ঠিক। হেইদিন ভদকা গিলছিলাম। মাতা ঠিক আছিল না।
পূর্ববর্তী ঘটনার জন্য জিসানের চোখেমুখে, কথাবার্তায়, আচার-আচরণে কোনো পরিতাপের চিহ্নমাত্র নেই দেখে উরবির ভেতরে রাগের সঞ্চার হতে লাগল ধীরে ধীরে। বলল,
– তুই আমার চোখের সামনে থেকে যা জিসান। নইলে লোক জড়ো করে মাইর খাওয়াব।
– লোক জড়ো করবা ক্যান? তুমি তো একাই মারতে পারো। যাউগ্গা, হুনছি আমার চাচাজানরে আবার খালে ফেলে দিছ তুমি?
উরবির রাগ টলেনি তখনো। সে জিজ্ঞাসু চোখে বলল,
– বুইড়া মনসুর তোর চাচা? সে কোন সাহসে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়?
জিসান জিভ কেটে ভুল শুধরে দিয়ে বলল,
– আরে না না। পুরা কথাটা হুনার আগেই নাকি তুমি তারে খালে মইদ্যে ফালাই দিছো। চাচাজান তো আমার আর তোমার বিয়ার লাইগ্গাই কথা কইতে গেছিল।
উরবি একপা পিছিয়ে একটা ইটের ক্লোজার কুড়িয়ে নিতেই জিসান দুইতিন লাফে দৌড়ে পালাল। উরবি ক্লোজারটা সেদিকে অলক্ষ্যে ছুঁড়ে মেরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
– শালা, লুইচ্চার আবার বিয়ে করার শখ!
জিসান তখন উরবির রোষানল থেকে বাঁচতে অনেকদূর পালিয়ে গেছে। এতক্ষণ এই বাগযুদ্ধ ক্ষান্ত হওয়ার পর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উরবি সেখানেই ধপ করে ধূলিকীর্ণ মাটিতে বসে পড়ল। দুই হাতের করতলে মাথা গুঁজে চুপ করে রইল অনেক্ষণ। মাথার ওপর শেষ গ্রীষ্মের খাঁখাঁ রোদ্দুর। চারিপাশটা তখন খরতাপে পুড়ে নিস্তব্ধ, নিরালা। অধুনা গাছের সবুজ-শ্যামলিমা রং রোদে নিরন্তর ঝলসে হয়েছে মলিন। পরম ব্যস্ত মানুষেরাও এই সময় একটু বিশ্রাম খুঁজছে ঘরের কোণে। শুধু এই দু’টি মূর্তি ঠায় ভানুর উষ্ণ ছায়াতলে দাঁড়িয়ে।
খানিক পর সেখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হল দুই সই। উরবির ভীষণ জানতে ইচ্ছে হচ্ছে আবিদের সঙ্গে জিসানের কী কথোপকথন হয়েছে সেসময়। কিন্তু লোকটা হঠাৎ কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল কে জানে!
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


সেদিন সন্ধ্যায় ত্যাঁদড় বুড়ো মনসুর ভাতিজা জিসানের বিয়ের কথা বয়ে আনল ইশতিয়াক সাহেবের কাছে। ইশতিয়াক সাহেব তাকে সসম্ভ্রমে আপ্যায়ন করল ঠিক কিন্তু বিয়ে সম্মন্ধে হ্যাঁ না কিছুই বলল না। ছেলে সম্পর্কে কোনোপ্রকার খোঁজ খবর না নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া হবে চরম বোকামি। তিনি ভেবেই পাচ্ছেন না উরবির হাতে বারবার অপমানিত হওয়ার পরও এই বুড়ো কীভাবে ভাতিজার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এল। কী দেখে এতো উন্মাদ হল সে? ইশতিয়াক সাহেবের ধন-দৌলত,ঐশ্বর্য বাংলার চিরাচরিত নিয়মে উদরসাৎ করার ফন্দি আঁটছে না তো! অসম্ভব কিছু নয় বটে। মনসুরের স্বভাব চরিত্র বোঝা মুশকিল। ইশতিয়াক সাহেব পড়ে গেলেন মহা চিন্তায়। এতোদিন পর কোনো সম্মন্ধ এসে তার চৈতন্য ফিরিয়ে দিয়ে গেল যে, মেয়ের বয়স হয়েছে। বি এ পাশ করেছে। অনূঢ়া কন্যা এখন এভাবে ঘুরে বেড়ানো তার সাজে না। স্বামী-সংসার নিয়ে স্থিত হওয়া দরকার। মনসুর চলে গেলে উরবি বাবার কাছে এসে বসল। কোনো মুখবন্ধ ছাড়াই শুরু করল,
– বাবা তুমি ঐ বুইড়াকে না করে দাও। আমি জিসানকে বিয়ে করব না। ছেলেটা ভালো না। মদ খায়। গাঁজা খায়। বিশ্বাস না হলে খোঁজ নিয়ে দেখো। আমার কপাল খারাপ যে প্রেম করছিলাম ওর সাথে।
ইশতিয়াক সাহেব কিছু বললেন না কয়েক মিনিট। মেয়েটা মায়ের মতো ঠোঁটকাটা স্বভাবের হলেও অন্য কোনো স্বভাব মায়ের পায়নি। নিজে প্রেম করেছে একজন গেঁজেলের সঙ্গে আবার সেটা নির্দ্বিধায় বাবাকে বলছে! এই নিয়ে জল ঘোলা করা লজ্জার ভেবে সেদিকে আর গেল না বাবা। বলল,
– ঠিক আছে। আমি না করে দিব। কিন্তু বিয়ে তো করতেই হবে তোকে। খেয়েদেয়ে একটু শরীরটা ফিট কর। এমন হাড্ডিসার থেকে গেলে বিয়ে হবে তোর?
উরবি মনে মনে বেজায় খুশি হল এককথায় বাবা সম্মতি দিয়েছে বলে। বাবার কথার শেষ বাক্যটি ধরে বলল,
– তোমার কী মনে হয়? আমার মতো খাবার এই বাড়ির আর কেউ খায়? আমি আজীবন গিলতে থাকলেও মোটা হব না। গরু মোটাতাজাকরণের ঔষধ খেলেও না।
– ঠিক আছে আমি কালকে মোটা হবার ঔষধ নিয়ে আসব।
– লাভ নাই। আমি এম. এ. করব। বিয়ে-টিয়ে করব না এতো তাড়াতাড়ি।
ইশতিয়াক সাহেব বিস্ময় নিয়ে বলল,
– তুই-না বললি আর পড়বি না। এখন এম.এ ভূত কে চাপাল। উফ বড় জ্বালা তোকে নিয়ে। একবছর লস দিলি ক্যান তাহলে?
শেষের কথার ইশতিয়াক সাহেবের মুখ চুইয়ে বিরক্তি ঝরে পড়ল। উরবি দারুণ ভঙ্গিতে দুইহাত জোড় করে স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে গদগদবচন করল ,
– ঘুরব বলে। একটা বছর আমি প্রচুর ঘুরব। বাংলাদেশের জেলায় জেলায় ঘুরব।
– ওসব হবে না। বিয়ের পাত্র দেখব আমি। যা নিজের ঘরে যা এখন।
উরবি উঠে দাঁড়াল। মুখের ভিতর শ্লেষোক্তিসূচক শব্দ করে খোলা চুলগুলো হাতের উল্টা পৃষ্ঠে ঝাপটা দিয়ে পিঠে এলিয়ে বলল,
– দেখা যাবে কে বিয়ে করে। এতো বিয়ে বিয়ে করলে কচি একটা ‘মা’ নিয়ে আসব দেইখো।
ইশতিয়াক সাহেবের মুখে আর বুলি রুচল না। কথায় কথায় বাপকেও খোঁচা দিতে ভুলো না এই মেয়ে! সে কথাগুলো যেন শরবিদ্ধ তির। উরবি খরগোশের বাচ্চার মতো লাফাতে লাফাতে বাবার ঘর ত্যাগ করল। ইশতিয়াক সাহেব মহা দুঃখে উরবির প্রয়াত মা’কে গভীরভাবে স্মরণ করল।…………

পরদিন সকালে আবিদের ঘুম ভাঙল উরবির মুখে একটা বিষম খারাপ সংবাদে। সকাল তখন আটটা সাতটা কি আটটা। আবিদের রুমের থাই জানালার বাইরে রৌদ্রজ্জ্বল দিন। উন্মুক্ত বাতায়ন গলে উষ্ণ হাওয়া ঢুকতে শুরু করেছিল সবে। মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটা নিরবচ্ছিন্ন ঘুরছে ফাঁফাঁ শব্দ করে। ফ্যানের বাতাসের উষ্মায় যেন মাথার ওপর একটা আগুনপাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে। গতরাতে বৈদ্যুতিক সংকটের ফলে সংযোগ না থাকায় অনেক রাত অবধি ঘুমানো হয়নি কারোরই। সেই রেশ ধরে অধিক বেলা অবধি ঘুমানোটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাতসকালে উরবির আকস্মিক পীড়াপীড়িতে ঘুম তার নিমেষে অন্তর্হিত হল। জড়িয়ে আসা দু-চোখ খুলে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে বলল,
– এতো সকালে ডাকছেন কেন?
– আরে ওঠেন। গ্রামে একটা মানুষ খুন হইছে?
আবিদ সজ্ঞানে ছিল না। ঘুমের চোটে দিকবিদিকশুন্য ছিল সে। সে আবার বালিশে মাথা রেখে বলল,
– তো আমি কী করব? পুলিশ ডাকেন৷
উরবি বলল,
– আমি তো ভাবলাম আপনার কোনো কাজে আসতে পারে। লোকটা সীমান্তের আস্তানার ওদিকে যাতায়াত করতো…
– হু যাতায়াত করতে দিন। আপনি মানুষকে বড়ো ডিস্টার্ব করেন।
উরবি সহসা চ্যাঁ করে চেঁচিয়ে উঠল,
– আরে মহা জ্বালা। উঠেন তাড়াতাড়ি। মানুষের ভালো করতে নাই৷ খচ্চর।
উরবির বাজখাঁই গলা শুনে আবিদের ঘুম যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও একপ্রকার বিনা অনুমতিতে নির্বাসিত হল। হাই তুলতে তুলতে আবিদ উঠে বসল। ডানে বাঁয়ে মুচড়ে আড়মোড়া ভেঙে বাম হাত বাড়িয়ে বলল,
– চলুন দেখে আসি আপনার কোন নাগর মরে পড়ে আছে।
এই কথায় রগচটা উরবির রাগ ধরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে নৈপুণ্যের সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে মনে মনে বলল, আমি আর আপনার কথায় রাগ করব না।

চলবে…