ভবঘুরে পর্বঃ১১

0
626

ভবঘুরে পর্বঃ১১
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

কণ্ঠ শুনে আবিদ চমকে ওঠে উরবির হাত জোরে ছুঁড়ে মারল নিজের বুক থেকে। অদ্ভুত উদ্ভ্রান্তের মতো দুচোখ মেলে ধরে উঠে বসার বৃথা চেষ্টা করে বলল,
– আপনি?…কেন এসেছেন?
উরবি আবিদকে জোর করে শুইয়ে দিতে দিতে বলল,
– আরে আরে, উঠবেন না। আপনার তো ভীষণ জ্বর!
চাষার হাতে সদ্য কাটা পড়া তরুলতা যেভাবে ভূতলে নিজের শরীর এলিয়ে দেয় ঠিক সেভাবেই ধপাস করে নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দিল আবিদ। সর্বাঙ্গে অপরিমিত উত্তাপের যাতনায় একবার চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিল সে। এরপর বলল,
– আমি ঠিক আছি। আপনি চলে যান।
উরবি হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে উঠল,
– চুপ করুন তো!অতি দর্পে হাত লঙ্কা, জানেন তো! জ্বরে মরে যাচ্ছেন সেখানেও ইগো দেখাচ্ছেন।… একটু সবুর করেন। আসতেছি।
বলে সেখান থেকে ক্রোধভরে উঠে গেল উরবি। ধমক খেয়ে আবিদ নিশ্চল শুয়ে রইল। এই মুহূর্তে ঝগড়াটে উরবির সঙ্গে অনর্থক বাগবিতণ্ডা করার মতো ইচ্ছে কিংবা সামর্থ্য কোনোটিই তার নেই। নয়তো আবিদ কোনোমতেই ছেড়ে দেবার পাত্র নয়!

মিনিট দুই পর উরবি ফিরে এলো জ্বরিত আবিদকে জলপট্টি দেওয়ার সরঞ্জাম হাতে। বিছানার পাশে টিপয়ের ওপর জলের বাটিটা রেখে তাতে শুকনো কাপড় ভিজিয়ে নিল সে। এরপর আবিদের উন্নত-প্রশস্ত ললাটের এলোথেলো চুলগুলো বাঁ হাতে আলতো করে সরিয়ে জলপট্টিটা বসিয়ে চেপে ধরল। অকস্মাৎ ঠাণ্ডা জলের অনাবিল স্পর্শ পেয়ে দু-চোখ আধো খুলল সে। সোজা পতিত করল রোগী সেবায় ব্যস্ত ঈষৎ ঝুঁকে থাকা উরবির চোখের ওপর। উরবি সেদিকে তাকিয়ে মুখ শক্ত করে ভুরু নাচিয়ে বোঝাতে চাইল “এভাবে তাকানোর কারণ?”
আবিদ ভাঙা স্বরে অকপটে বলল,
– আপনাকে না এই মুহূর্তে বিরক্ত লাগছে আমার।
উরবি হর্ষোৎফুল্ল মুখে বলল,
– তাই?… এখন কী করতে হবে তাহলে?
আবিদের দু-চোখ অনড় হয়ে নিবদ্ধ উরবির ঘুম- বিজড়িতন ফোলা চোখের দিকে। কণ্ঠে বিরক্ত ঠালতে গিয়েও ব্যর্থ হল সে। আগের মতো করে বলল,
– আমাকে একটু ঘুমাতে দিতে হবে।
উরবি আবিদের কপাল থেকে ভেজা কাপড়টা নামিয়ে আস্তে-ধীরে নেড়েচেড়ে ভিজিয়ে নিল সেটা। পুনরায় সেটি আবিদের কপালে চড়িয়ে দিয়ে উদাসভাব নিয়ে বলল,
– সেটা হচ্ছে না। আপনি ঘুমান। নিষেধ নাই। কিন্তু,জ্বর না কমা পর্যন্ত আমি এখানেই আছি।
– ‘ঠিক আছে, থাকুন।’ একপর্যায়ে অসন্তুষ্ট হয়ে কথাটি বলে একটু নড়চড়ে শুয়ে চোখ বুজল সে এবং অল্পকিছু সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল৷
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


আবিদের ঘুম যখন টুটে গেল তখন অদূরবর্তী কোনো মসজিদে ফরজের আজানে মুয়াজ্জিন ডাকছে সুমধুর স্বরে। বাগানের পাখিগুলো আজ গতদিনের কালান্তক ঝড়ের তাণ্ডবে নীরব নিস্তব্ধ শোক পালন করছে। প্রতিদিনকার মতো কিচিরমিচির শব্দে জাগাচ্ছে না মানুষগুলোকে। পাশের তরু-ঘেরা জঙ্গলে রাহুগ্রস্ত ঝিল্লিপোকার দল ডেকে চলেছে তারস্বরে। তমিস্রা তখনো ভীষণভাবে পরিবৃতি করে আছে পৃথিবীকে। দক্ষিণের খোলা জানালা ধরে মুক্ত প্রফুল্ল পবন ঘরে ঢুকছে অবাধে। আবিদ চোখ খুলতেই দেখল উরবি কপাল থেকে জলপট্টিটা সরিয়ে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। একাধারে বিনিদ্র রাত কাটানোর দরুন তার দু-চোখের ভেতরের উপশিরাগুলো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। আবিদ তাকাতেই ভারী মিষ্টি করে হাসল সে। আলস্যভরে আবিদ দুচোখ ডলে সন্দিহান গলায় বলল,
– আপনি এখানে ছিলেন সারারাত?
উরবি ক্লান্ত গলায় বলল,
– হ্যাঁ, আপনার কেমন লাগছে এখন? জ্বর তো ছেড়ে গেছে মনে হচ্ছে।
আবিদ একটু চুপ করল। এরপর উঠে বসতে বসতে বলল।
– ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে ভালো হয়ে গেছি। শুধু হাতটা নাড়লে চিনচিন করে ব্যথা করে, এই যা!
উরবি প্রফুল্ল হয়ে হাততালি দিতে গিয়েও পরক্ষণে দুই করতলে মুখ ঢেকে চুপ করে গেল। আবিদ বলল,
– আপনি খামোখা এতে কষ্ট করতে গেলেন কেন? এখন তো না ঘুমিয়ে আপনার শরীর খারাপ হবে। তখন তো আমাকে দোষ দিবেন!
উরবি কপট রাগ দেখিয়ে মুহূর্তেই ফিক করে হেসে বলল,
– জ্বি নাহ্। বলব বা।…
আবিদও কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে দক্ষিণের জানালার দিকে সোজা বাইরে তাকাল। উরবি আবিদের দৃষ্টি লক্ষ্য করে সেদিকে তাকাল। এরপর মুখ ফিরিয়ে আবিদকে বলল,
– আচ্ছা বাইরে যাবেন?
আবিদ জানালা থেকে চোখ তুলে উরবির দিকে তাকাল,
-এখন? বাইরে তো আলো ফুটেনি ভালো করে।
– হ্যাঁ এখনি। আপনার গায়ে জ্বর আছে?
বলে সামনে এগিয়ে আবিদের কপালে হাতের উল্টো পিঠ স্পর্শ করালো উরবি। আবিদ সংকোচে আঁটুবাঁটু হয়ে গেল একেবারে। দেখে উরবি কড়কে বলল,
– ওকি! ওমন বাচ্চাদের মতোন করতেছেন কেন্?…নাহ জ্বর নাই। চলেন ঘুরে আসি। ভোরের হাওয়া খেয়ে ভাল্লাগবে।
আবিদ ভেবে দেখল একবার। মেয়েটা একদিনেই কেমন সাহসিকতার সাথে অধিকার খাটানো শুরু করেছে। বিষয়টা ভালো লাগল না তার। কে জানে মতলবটা কী! নাকি নিজের দোষে অসুস্থ হয়েছে বলে এসব করছে কে জানে! তবে, এখন সকাল সকাল একবার সীমান্ত এলাকার ওদিকটা ঘুরে আসলে মন্দ হবে না। বরং ওদিকটা এখন জনশূন্য থাকার কারণে ভালো করে দেখে নেওয়া যাবে কোথায় কি আছে। আবিদ রাজি হয়ে মাথা নেড়ে বলল,
– আচ্ছা,চলুন। আলনা থেকে টিশার্টটা দিন কষ্ট করে।
উরবি উঠে গিয়ে টিশার্টটা দিলে রোগক্লিষ্ট আবিদ অনেক কষ্টে সেটাকে গায়ে গলাল। এরপর চুপিসারে হাওয়া খেতে বেরিয়ে পড়ল দু’জনে।

বাইরে বেরুতেই একদল পালছুট মাতাল হাওয়া জোরো ঝাপটা দিল দু’জনকে। তল্লাটে তখন আঁধারের গাঢ়তা হালকা হয়ে আসছে আস্তে আস্তে। পুবাকাশ ছেঁদে মৃদু অংশু ছড়িয়ে পড়ে অন্ধকারকে বিদায়ের তাড়া দিয়ে যাচ্ছে আলোরা। গতদিনের ঝড়ের তাণ্ডবের রেশটা এখনো রয়ে গেছে প্রকৃতির গায়ে গায়ে। কারণেই আজ ভোরের বাতাসে শীতল ভাবটা আজ একটু বেশিই! কোমল পায়ে হেঁটে বাগানের সেই রক্তমিশ্রিত দুমড়ানো ভূলুণ্ঠিত গাছটা পেরিয়ে রাস্তায় উটে এলো তারা। উরবি একনাগাড়ে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারে না। এ তার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু আজ মনের ঘুলঘুলি গলে কোনো কথা বেরুচ্ছে না তার। অনেক্ষণ কথার অভাবে চুপচাপ হাঁটার পর হঠাৎ সে বলে উঠল,
– আচ্ছা, আপনি কখনো প্রেম করছেন?
কথাটা বলে ফেলে নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন রাখল উরবি, “কথাটা সে কেন বলল?”
আবিদ সপ্রতিভ হেসে বলল,
– অপ্রাসঙ্গিক কথা কেন?
উরবি বলল,
– কোনো প্রসঙ্গেই ছিলাম না আমরা। তাহলে অপ্রাসঙ্গিক হয় কী করে?… যাইহোক আমি একজনের সাথে প্রেম করি বুঝলেন? কিন্তু তাকে আমার পছন্দ না।
আবিদ ভারি অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে তাকাল,
– এটা কেমনতরো কথা? পছন্দ না হলে প্রেম করার কী দরকার?
– আরে আগে ব্যাপারটা বুঝেন। সে আমাকে জ্বালাতন করতো সবসময়… এরপর উরবি হাঁটতে হাঁটতে জিসানের ইতিবৃত্ত কথা খুলে বলল আবিদকে এবং শেষে আবিদের নিকট কোনো সুবুদ্ধি চাইল সে।
সবশুনে আবিদ বলল,
– তাই তো বলি,আপনার সঙ্গে প্রেম করে আবার কে! ওসব হ্যাংলা ছেলে ছাড়া আর কে! এখন একটাই সমাধান। ছেলেটাকে আপনার আসল রূপ দেখিয়ে দিন।এমনিতেই লেজ তুলে পালাবে।
উরবির ঠোঁটের অগ্রভাগে একটা কঠিন গালি এসে হাজির হল। বহুকষ্টে সেই খিস্তিটা ‘বিনাচর্বণে’ গিলে নিয়ে খটখটে গলায় বলল,
– আপনি ঠিক কী বলতে চান বলুন তো! আসল রূপ মানে কী?
– এই যে এখন যে ভাব ধরে বসে আছেন… সবসময় যে ভাব ধরে থাকেন… আশা করি মারমুখী প্রেমিকা ভালো মস্তিস্কের কেউ চাইবে না।
– আপনি তো ভীষণ অকৃতজ্ঞ!
– না না,আপনার গতকালের উপকারের কথা অস্বীকার আমি করব না। কিন্তু আমি সত্য কথাটাই বললাম।
– হু,গুল্লি মারি আপনার সত্যি কথার। আপনার মুখ ফাটানোর উচিত ছিল,যাতে কথা বলতে না পারেন।
আবিদ শুষ্ক হাসল। উরবি আর কিছুমাত্র না বলে নীরবে দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ সংবরণ করার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হল। ক্ষণকাল পরে আবার আবিদ জহুরি গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
– আমার মনে হয় আপনার লোকটাকে সরাসরি বলে দেওয়া উচিত যে আপনি তাকে পছন্দ করেন না। সেটা শুধু মিস্টেক ছিল। রাগ করবেন না। আপনার দেমাগ আছে। ঠিকি সামলে নিতে পারবেন। আর যদি মনে হয় যে,নাহ আপনি তাকে একটু বাজিয়ে দেখবেন। তাহলে সে আপনার ইচ্ছে। তবে বাজাতে গিয়ে যাতেই নিজে বেজে না উঠেন সেটা খেয়াল রাখলেই হবে। যদিও আপনার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। কমবয়সী আবেগের অতল সমুদ্র থেকে উঠে এসেছেন অনেক আগে। এই বয়সে আবেগ নয় বিবেক দিয়ে চিন্তা করতে হয়। স্যরি, মিছেমিছি জ্ঞান দিয়ে ফেললাম!
উরবির মুখমণ্ডল থেকে ক্রোধের আঁচটা কমে গিয়ে একটা অভূতপূর্ব নির্ভরতার ফল্গুধারা বয়ে গেল।
এতক্ষণ আবিদের দেখিয়ে দেওয়া পথে সীমান্তের দিকে হাঁটছিল তারা। দিন কতক আগে এখানে একবার এসেছিল আবিদ। তখনো বেশ সুবিধে করতে পারেনি। আজও বোধহয় পারা যাবে না। এই ভোরের বেলাতেও সন্দিগ্ধ সেই জায়গাটাকে কিছু লোকসমাগম দেখা গেল দূর থেকে। ইশরায় উরবিকে আর না আগানোর নির্দেশ দিল আবিদ। উরবি কিছুক্ষণ লোকগুলোর চলাফেরা পরখ করল তীক্ষ্ণ চোখে ভ্রুকুটি করে। এরপর আবিদের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– ওরা কারা? এই ভোরেও দলবেঁধে জেগে আছে!
আবিদ নির্বিকার গলায় বলল
– আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন না! এখানে কেন এসেছি? ওদের জেলে পুরে নিয়ে যাবার জন্য এসেছি।
উরবির দৃষ্টি আরো গভীর হল। কপালে গুনে গুনে তিনটি ভাঁজ পড়ল, বলল,
– মানে? আপনি কে?—— না মানে ওদের জেলে নিয়ে যাবার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক —— ওয়েট ওয়েট,আপনি ডিটেকটিভ নন তো?
আবিদ আশু বলল,
– না না। ওসব না। তবে একপ্রকার বলাই চলে। কিন্তু বেতন পাই না এসব করে। পুরস্কার পাই। কখনো কখনো পুরস্কার ঘোষণা হলেও আমাকে পাওয়া যায় না। আমি তার আগেই চম্পট!
বলে নিজের কথাই নিজেই কান পর্যন্ত বিস্তৃত নিঃশব্দ হাসি দিল আবিদ।
উরবি বুঝতে পারল না আবিদের হেঁয়ালিপূর্ণ কথাবার্তা। বোঝার চেষ্টাও করল না আর। তবে এতটুকু তার মাথায় গ্রহণ করে নিল যে, একটা ভালো কাজে সে এসেছে। তবে সে হুট করেই অন্য ভাবনায় বিভোর হয়ে গেল। সে ভাবছে আজকে জিসানের সঙ্গে একবার দেখা করার প্রয়োজন৷ পুরো বিষয়টা আজ খোলাসা করে নিবে সে। পৃথিবীতে মিথ্যে আশাই মানুষকে বেশি পোড়ায়!
সূর্য যখন পুুবের আকাশ দাপিয়ে পুরোপুরি আত্মপ্রকাশ করল তখন আবিদ আর উরবি সীমান্তবর্তী একটা টং দোকানে প্রাতঃভ্রমণ এবং প্রাতঃ ভোজন উভয়ই সেরে আবিদের সুবিধার্থে একটা ভ্যানে করে বাসায় ফিরে এলো তারা। অবশ্য সুবিধা কতটুকু হয়েছে বলা ভার; কিন্তু এবড়োখেবড়ো মেটে রাস্তায় বারংবার ঝাঁকুনিতে অসুবিধা আর কাটা হাতের যাতনা যথেষ্ট হয়েছে আবিদের। তার একবার মনে হলো দূর্ঘটনার পরদিন এভাবে না বেরোলেও হতো! কিন্তু উরবির অভীক চঞ্চলতার কাছে জেতার মতো ডাঁট কার আছে এই অঞ্চলে?

দুপুরের মধ্যে আরেকটা বিষম কাণ্ড ঘটে গেল। গ্রামের ভবিষ্যত মেম্বার মনসুরের চাকর এসে উরবির নামে মানহানির অভিযোগ দিয়ে গেল ইশতিয়াক সাহেবকে। সংক্ষেপে অভিযোগটি হল এইঃ
আজ দুপুরে যখন মনসুর ফিরছিল বাজার থেকে, উরবি তখন অকারণে মনসুরকে গালাগাল করেছে এবং টেনে হিঁচড়ে খালের জোয়ারের পানিতে ফেলেছে। মনসুর জোয়ারের স্রোতে বহুদূর চলে যাওয়ার পর বাড়ির চাকরটি তাকে দেখতে পেয়ে খাল থেকে কূলে ফিরিয়ে এনেছে। এযাত্রায় বেঁচে গেছে মনসুর।
যাওয়ার বেলায় চাকরটি এই বলে শাসিয়ে গেল যে, মনসুর সাহেব বলেছে এই ঘটনা যাতে জানাজানি না হয়। যদি হয় তার মেয়ের নামে সালিশ বসবে গ্রামে এবং কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে মেয়েকে।
সব শুনে ইশতিয়াক সাহেবের আকর্ণ লাল হয়ে গেল দুর্বার ক্রোধে। মেয়েটার দুর্বিনীত আচরণ দিনকে দিন সমুদ্রের জোয়ারের মতো ক্রমে ফুলে ফেঁপে উঠছে। এখনি একটা শক্তপোক্ত বাঁধ নির্মাণ না করলে মানসম্মান সব অকূলে ভেসে যাবে এতে সন্দেহ নেই! মেয়ের এই বাঁধভাঙা ধৃষ্টতার উপযুক্ত শাস্তি দিবেন ঠিক করে কাজের মেয়েটির দ্বারা উরবিকে ডেকে পাঠাল মাঝদুপুরে। উরবি তখন খাতার ওপর মগ্ন হয়ে নিরুকে জটিল কোনো অংক করাচ্ছিল। ঠিক তখনি কাজের মেয়েটি দরজার কোণে দাঁড়িয়ে যান্ত্রিক স্বরে বলে গেল,
– আপা,আপনারে চাচা ডাকে।
উরবি না তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,
– যাও,আসতেছি।

নিরুকে একটা ম্যাথ করতে দিয়ে বাবার ঘরে গেল সে। এতক্ষণে বাবার ডেকে পাঠানোর কোনো কারণ খুঁজে না পেলেও, বাবার ক্রোধোন্মত্ত চেহেরাটা দেখে উরবি একটু যেন আন্দাজ করতে পারল বিষয়টা। তবুও সে নির্ভার গলায় বলল,
– ডাকছো বাবা?
চোখ তুলে তাকালেন ইশতিয়াক সাহেব। গম্ভীর স্বরে বললেন,
– হুমম, আজকে দুপুরে বারোটার দিকে কোথায় ছিলে তুমি?
– ঐযে আমার আইডি কার্ডে মায়ের নামটা ভুল আসছিল ওটা সংশোধন করতে বারবার যেতে হচ্ছে উপজেলা অফিসে।
ইশতিয়াক সাহেব আর ভূমিকা দীর্ঘ না করে প্রশ্ন করলেন,
– আসার সময় মনসুরকে কী করেছ তুমি? তার চাকর এসে অভিযোগ দিয়ে গেল আমাকে।
উরবি আসল ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে পেরে মুখ ফিরিয়ে নিশ্বাস ফেলল একটা। এরপর আবার বাবার দিকে তাকিয়ে নিঃসংকোচে বলল,
– খালে ফেলে দিছি, আর একচোট গালাগালি করছি।
মেয়ের অস্বাভাবিক নিস্পন্দতায় ইশতিয়াক সাহেব রাগ প্রশমন করে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
– কেন?
উরবি হঠাৎ উদ্দীপ্ত গলায় বলল,
– কেন সেটা বলে নাই? সেই বুইড়া ব্যাটা নাকি আমাকে পছন্দ করছে তার ছোটবউ করার জন্য। কেমন বেহায়া দেখো। নিজের বিয়াত্তা একটা ছেলে আছে তারপরেও নাকি সে বিয়ে করবে।
– আচ্ছা, তোকে আজকে কী বলেছিল?
– ‘জানি না। তোমার ওসব শুনতে ইচ্ছে করতেছে ক্যান? নাকি তোমারও বিয়ে করতে মন চাচ্ছে বুড়া বয়সে।’ শ্লেষাত্মক কথাটি বলে ভুরু কুঁচকে তীক্ষ্ণ কটাক্ষে তাকাল উরবি।
ইশতিয়াক সাহেবের সমস্ত রাগ যেন বাষ্পীভূত হয়ে মহাশূন্যে মিলিয়ে গেল। এখন অপ্রতিভ গলায় আগে নিজের সম্মান বাঁচাল,
– আরে না না কী বলিস এসব।
উরবি সুর করে টেনে বলল,
– ওমা!… এখন লজ্জা পাচ্ছ মেয়েকে নিজের বিয়ের কথা বলতে। আগেই তো বলছিলাম, একটা বিয়া করে নাও। আমারো একটা মা হোক। এখন তো কোনো কচি মেয়েকে আমি ‘মা’ বলে ডাকতে পারব না। আমার কথা ঠিক সময়ে শুনলে বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরত না।..
উরবির অসংলগ্ন, বেয়াড়া কথার তির বোধহয় তখনো নিঃশেষ হয়নি,তার আগেই বাবার পাণ্ডুর মুখ দেখে দমে গেল সে। এরপর ঠাণ্ডা গলায় বলল,
– হইছে মুখটা ওমন করে রাখা লাগবে না আর। এই ভরদুপুরে না ঘুমিয়ে জেগে কেন? যাও ঘুমিয়ে নাও একটু। ঔষধ খাইছ তো?
বাবা এবার যেন একটু স্বস্তির দম ফেলল মনে মনে। এতক্ষণ পর পরিবেশ অনুকূলে পেয়ে বলল,
– হ্যাঁ আমার সব হয়েছে। তুই ঐ লোকটাকে এড়িয়ে চলিস প্রয়োজনে। এতো ঝামেলায় যাওয়ার দরকার নাই।
উরবি উগ্র ঢংয়ে ঘুরে দরজার দিকে পা বাড়াল। গনগনে গলায় বলে গেল,
– আমার সাথে বেয়াদবি করলে আমি কাউকেই ছাড় দেব না। বুড়া লোক হলে তো না-ই!

…………………………………………..

বিকালে জিসানকে ফোন করে সেই খালপাড়ের জারুলতলায় ডেকে নিয়ে গেল উরবি। উদ্দেশ্য, এযাবৎ ঘটে যাওয়া সমস্ত জিসানকে ঠাণ্ডামাথায় বুঝিয়ে বলা। জিসানের প্রতি তার রত্তি পরিমাণ অনাসক্তির কথা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। সবকিছু যে ভুলপথে এগুচ্ছে এবং একসময় যে সেই পথ বড়ো কণ্টকাকীর্ণ হয়ে দাঁড়াবে, মৃগতৃষ্ণায় পথ হারাবে সবাই— সব গুছিয়ে বলা।
ওরা জড়ের মতো ঠায় বসে আছে নির্জন-বিজন খালপাড়ের জারুলতলায়। জিসানের নিরবচ্ছিন্ন দৌরাত্ম্যে মাঝে মাত্র আধহাত দূরত্ব তাদের। উরবিও আজ আর শেষদিন হিশেবে বিশেষ আপত্তি রাখেনি। জিসানের কথাই রটিয়েছে। অন্যদিন হলে জিসান একেবারে কথার স্রোত বইয়ে দেয়। কিন্তু আজ তার বাক্যস্ফূর্তির টলটলে নদী যেন শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে গেল— এমন অবস্থা! কিন্তু উরবি আর চুপ করে থাকতে পারল না।
খালপাড়ের ঝাপটা বাতাসে এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে উরবি বলল,
– জিসান তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে আমার।
জিসান অদ্ভুত ঢংয়ে ঘুরে তাকিয়ে ঔৎসুক্য নিয়ে বলল,
– হাচা নি? কী কতা? কও হুনতাছি।
বলে সে ওভাবেই তেরছা চোখে তাকিয়ে রইল। উরবির কুলক্ষণেও খেয়াল করল না যে জিসানের দু-চোখ টকটকে লাল আজ। কেন জানি আজ কনীয়ান একটি ভীতি কাজ করছে তার ভেতরে। তবু সেটা চাপিয়ে সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে প্রবোধ দিল নিজেকে। ঘুরে তাকাল জিসানের দিকে। চোখে চোখ পড়তেই একটু একটু চমকে উঠল সে। জিসান মদির কটা চোখে আপাদমস্তক দেখছে লোলুপ দৃষ্টিতে অবলোকন করছে উরবিকে। উরবি বিরক্তি নিয়ে আরেকটু দূরে সরে বসে জড়িত গলায় বলল,
– তোমার কী হয়েছে আজকে?এমন মাতালের মতো দেখাচ্ছে কেন?
এতক্ষণে জিসানের অস্বাভাবিকতা চোখ কাড়ল উরবির। কিন্তু জিসানের কোনো ভাবান্তর ঘটল না উরবির কথায়। সে একই দৃষ্টি বজায় রেখে পুনরায় দূরত্ব কমিয়ে এনে বসল উরবিকে ঘেঁষে। চকিতে হাত রাখল উরবির ক্ষীণ কটিদেশে। সর্বাঙ্গ শিরশির করে একটা শীতল প্রবাহ বইয়ে গেল স্থবির উরবির। পরক্ষণেই হাতটা কোমর থেকে এক ঝটকায় আলাদা করে নিয়ে কম্পিত গলায় চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল সে,
– কী সমস্যা তোমার?
রক্ত লাল চোখদুটোতে অপরাধী ভাব জড়িয়ে জিসানও দাঁড়িয়ে গেল। যদিও ভয় জিনিসটা উরবির জন্য নয় তবুও আজ তার বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। আসার সময় নিরু আসতে চেয়েছিল যেচে;কিন্তু উরবি রাজি হয়নি। সে আসলে সাহস যুগিয়ে দুটো কথা বলা যেতো।
– এমুন করো ক্যা? আমি তোমার কাছে না আইলে কে আইব কও?
মুখে অস্পষ্ট জড়িমা নিয়ে কথাগুলো বলে আরো এগিয়ে গেল জিসান। দুইপা পিছনে হটতেই জারুল গাছের সঙ্গে পিঠ ঠেকে গেল তার। জিসান এগিয়ে এসে ধীরে ধীরে কাম-উন্মত্ত কম্পমান দুইহাত রাখল উরবির গালে। উরবির সারা শরীর প্রবলভাবে দুলে উঠল বারকয়েক। জিসান যতোই এগোয় ততই ভুরভুর মদের বিশ্রী গন্ধ ছুটে আসে ওর মুখ থেকে। উরবি বুঝতে পারে এই মাতালের হাতে পড়লে স্ব সতীত্ব নিয়ে ফেরা দুষ্কর হয়ে পড়বে। কাজেই সে মস্তিষ্কে উচ্ছিষ্ট ভাগাড় থেকে সাহস কুড়ায় ধীরে ধীরে। দু’হাতের পাঁচআঙুল শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে। এরপরের ঘটনাটা করুন বলে আখ্যায়িত করা যায়। যখন জিসান উৎকট উন্মাদনায় উরবির মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়ে ঠিক তখনি উরবি বজ্রকঠিন দুই মুষ্টি দিয়ে কঠিন আঘাত করে জিসানের কানের ওপর। মাদকতা টুটে যায় জিসানের। দুই কান চেপে ধরে ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠে সে। উরবি শুরুতে একটু হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই চপলা চোখে আশেপাশে খুঁজে একটা কাঁচা ডাল কুড়িয়ে নিয়ে আসে সে। এরপর জিসানের হাত-পায়ের তালুতে চোর পেটানোর মতো করে আচ্ছামত ঠ্যাঙিয়ে,মাদকতা ছুটিয়ে সেখান থেকে হতোদ্যমে প্রস্থান করল সে। আজ তার দিনটা বড় ভালো। মজার মজার সব ঘটনা ঘটছে। উরবির কাছে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে,এই বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডে প্রেমিক পেঁদানোর মতো মজার কাণ্ড আর দ্বিতীয়টি নেই। প্রফুল্ল মনে চাচাদের ঘরের দিকে এগোল সে। আজ নিরুকে সব না বলে শান্তি হবে না তার।

চলবে…