বে রঙিন পাতা পর্ব-০৬

0
465

#বে_রঙিন_পাতা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৬

অসহায় মানুষদের মা কখনো ফিরিয়ে দিতেন না। অসহায় মানুষ দেখলেই মা আফসোস করতো। ঠিক সেইরকমই বাবার দূরসম্পর্কের বোনটাকে ভেবেছিল। আর এটাই ছিল মায়ের বড়ো ভুল।

মা মারা গিয়েছিল বি’ষ পানে কিন্তু আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কেউ বুঝতেও পারলো না যে মা কেন মারা গেল! এই সুযোগে বাবা বলে বলে বেরিয়েছিল যে মায়ের হয়ত কোথাও পরকীয়া ছিল আর ওখানে ধোঁকা খেয়ে স্বামী সন্তানদের এতদিন ঠকিয়ে আসছে ভেবে আ’ত্ম’হ’ত্যা করেছে। এক কান দুই কান করে করে পুরো এলাকায় হলো কথাটা তখনও আমরা কেউ আসল সত্যিটা বুঝে উঠতে পারিনি। এলাকার মানুষদের এতো এতো কথা শুনেও আমরা মাকে অবিশ্বাস করিনি
। আমরা জানি মা কেমন ছিল! আজ সব খোলাশা। মুহূর্তের মধ্যে বাবার প্রতি থাকা সব ভালোবাসাগুলো ঘৃণাতে জন্ম নিল। এতকিছুর পরেও বাবার প্রতি একটু হলেও বিশ্বাস ছিল কিন্তু সেই বিশ্বাস আর নেই।

——–

আরও দুইদিন কেটে গেল এভাবেই। মায়ের ডায়রি পড়ার পর থেকে বাবা নামক মানুষটাকে আমি ঘৃণা করি। বাড়িতে উনি থাকলে আমি রুম থেকে বেরোই না। উনার সামনে যেতেও ঘৃণা করে আমার। আপা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিল যে কী হয়েছে কিন্তু আপাকে বলতে চেয়েও পারিনি। আপাকে বললে হয়ত হিতে বিপরীত হবে। আপা রাগ সংযত করতে পারে না, হয়ত আপা এসব জেনে সহ্য করতে পারবে না। বাবা বিয়ে করার পর আপা এমনিও বাবাকে পছন্দ করে না, এর ভেতর এসব জানলে হয়ত আরও বড়ো কিছু ঘটে যাবে।
এই দুইদিন আমি বাবার সামনে যায়নি, খাবারও খেয়েছি সবার পরে। আমি আর আপা রুমেই খাই। বাবাও সামনে আসেনি, আগের মতো আর পছন্দও করে না আমাদের। আমরাও দুরুত্ব বজায় রেখে চলছি।

বিকালে আমি বাড়ির পেছনটাই বসে থাকি। মায়ের কবর দেখলে নিজেকে শান্ত আর হালকা লাগে। আজ মায়ের কবরের দুইপাশে দুইটা ফুলগাছ লাগিয়েছি। একটা বেলি, আরেকটা সাদা গোলাপ। দুইটারই অনেক সুগন্ধ। দুইটা গাছেই দুইটা করে করে ফুল আছে। গোলাপ গাছে আরেকটা কলি আছে। মায়ের ফুল অনেক পছন্দ। এজন্যই একেবারে আমার নামই দিয়ে দিল ফুল। মা আদর করে আমাকে মাঝে মাঝে একেক ফুলের নাম দিয়ে ডাকতো। আমি রাগ করলেও রাগ ভাঙাতো এভাবে,’আমার কৃষ্ণচূড়া, আমার বেলি।’ আরও অনেক অনেক নামে কিন্তু এখন আর কেউ ডাকে না। মায়ের মতো করে ঠিক আরেকজন ডাকতো, সে হলো নিহান ভাই।

মায়ের কবরের দিকে আরেকবার তাকালাম। এখন থেকে এদিকে যেই-ই আমার মায়ের কবরের পাশে আসবে সেই-ই একবার হলেও কবরের দিকে ফিরে তাকাবে। সাদা বেলি আর গোলাপ দুইটার স্নিগ্ধ ঘ্রান আর আকর্ষণের কারণে যে কেউ ফিরে চাইবে।

বাড়ি ঢুকতেই দেখি এক আধ-বয়স্ক লোক বসে আছে। মাও হাসাহাসি করে গল্প করছে। বাবার মুখেও হাসি। আমি সোজা রুমের ভেতর চলে যেতে নিলে বাবার ডাকে থেমে গেলাম।

‘এসব কী ধরণের বেয়াদবি ফুল! একটা মানুষ আসছে, সালাম তো দেওয়া যায়।’

আমি পেছন ফিরে লোকটার উদ্দেশ্যে সালাম দিলাম। আসলেই বেয়াদবি হয়েছে এটা, ওদের ঘৃণা করি ঠিক আছে কিন্তু বাইরের একজন মানুষ বাড়ি আসলে সালাম দেওয়া উচিত। তাই আর কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে আসলাম। রুমে আসতেই দেখি আপা ফোনে কথা বলছে। রাসেল ভাইয়ের সাথেই হয়ত। আপা ফোন রেখে জিজ্ঞেস করলো,’ফুল, কে আসছে রে?’

আমি জবাব দিতে যাবো তখন দেখি নতুন মা হাসি হাসি মুখে আমাদের রুমে। আমরা দুইজন দুইজনের দিকে তাকালাম। আজ সূর্য কোনদিকে উঠল। ইনি বিয়ে হওয়ার পর একদিনও আমাদের রুমে উঁকি পর্যন্ত দিয়ে দেখেনি আর আজ সোজা রুমে!

এসব ভাবতে ভাবতেই তিনি আপার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
‘লতা, ঝটপট একটা সুন্দর জামা পড়ে নাও তো।’

আপা হয়ত কিছু আন্ডাজ করতে পেরেছে তাই সে সোজা মুখের উপর পারবে না জবাব দিয়ে দিল। নতুন মা রাগতে গিয়েও মুখটাকে আবার হাসি হাসি বানিয়ে ফেলল।
বললো,’আচ্ছা, একটু সালাম হলেও দিয়ে আসো।’ আপা যাবে না মানে যাবে না। বাইরের কোনো লোকের সামনে সে যাবে না। নতুন মা রেগে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষন পর বাবা এসে সোজা আপার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। আপা হাত ছাড়াতে চাইলেও পারলো না।

আমার লোকটাকে সুবিধার মনে হলো না। ওদের মধ্যে কী কথা হয়েছে জানি না, নতুন মা আমাকে যেতে নিষেধ করেছে। কিছু সময় পর আপা মলিন মুখে ফিরল।

আপা বলে উঠল,’ফুল, লোকটা সুবিধার নয়।’

আমি আপাকে শান্ত করে বললাম,’আপা, হয়ত উনি ছেলের বাবা। আগে দেখতে এসেছে।’

আপা মলিন মুখে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রইল। আপাকে ভীষণ মনমরা দেখাচ্ছে।

————

এরপরেরদিন আপা আর কলেজ থেকে ফিরেনি। বারেবারে চিন্তা হচ্ছিলো আপার জন্য। আপার মোবাইলটাও বন্ধ। আপার কিছু হলো না তো!

বিকাল ঘনিয়ে আসতেই আশেপাশের সবাই উঁকি ঝুকি মারতে লাগলো। বাবাও কাজ থেকে ঘরে ফিরে আসলো। সবাই আড়চোখে আমার দিকেই তাকাচ্ছে। বাবা এসে বারান্দায় ধপ করে বসে পড়লো।
নতুন মায়ের কথা শুনে বুঝতে পারলাম রাসেল ভাই আর উনার মা কয়েকদিন আগে আপার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো কিন্তু রাসেল ভাইয়ের বাবা নেই, অনেক কষ্টে উনার মা উনাকে বড়ো করে তুলেছে, তেমন একটা টাকা পয়সা নেই তাই বাবা নতুন মায়ের কথায় রাসেল ভাইকে ফিরিয়ে দিয়েছে। নতুন মায়ের একটাই কথা তার টাকা লাগবে তাই তিনি তার দূরসম্পর্কের এক বয়স্ক পয়সাওয়ালার ভাইয়ের সাথে আপার বিয়ে ঠিক করে রেখেছে।
মায়ের কথা শুনে হুট্ করে মনে পরে গেল সেদিনের সেই আঙ্কেলটার কথা কিন্তু তিনি তো অনেক বয়স্ক। আমার বাবারই বয়সী, সেই মানুষটার সাথে আপার বিয়ে ঠিক করেছে! যিনি বিভিন্ন অজুহাতে আপাকে আর আমাকে ছুঁতে চেয়েছিল। এসব দেখে আপা আমাকে নিয়ে রুমের দরজা আটকে রেখেছিল।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, এত্তো বড়ো কথাটা উনারা লুকিয়ে গিয়েছে। নতুন মাকে অতটা খারাপ ভাবিনি কিন্তু এখন দেখি উনি খারাপের সাথে সাথে লোভীও বটে।
ইনারা শুধুমাত্র টাকা পাওয়ার জন্য আমার ফুলের মতো আপাটাকে এতো বুড়া একটা লোকের হাতে তুলে দিচ্ছিলো! বাবার হাতও কাঁপলো না! নতুন মা যে এতোটা নিম্নমানের হবে তা কোনোদিন কল্পনাও করিনি সাথে আমার বাবা নামক মানুষটাও যে এতটা নিম্ন তা কোনোদিন ভাবিওনি।

এখন সবকিছু পরিষ্কার আমার কাছে। এজন্যই আপা গত দুইদিন চুপচাপ ছিল। সেদিন নতুন মা আমার আড়ালে নিয়ে হয়ত আপাকে বিয়ের কথা বলেছিল।
এখন মনে হচ্ছে আপা হয়ত রাসেল ভাইয়ের সাথে বোধহয় চলে গিয়েছে। মনে মনে খুশিই হলাম, ভালোই হলো এখন আপা হয়ত সুখী হবে। রাসেল ভাইয়ের অতো টাকা না থাকলেও এতো কমও না। উনি বড্ড ভালো মানুষ। উনার মাও আমাদের প্রচন্ড ভালোবাসতো। থাক আমার আপা সুখে থাকবে।

এসব ভাবতে ভাবতেই মাথা তুলে তাকাতেই দেখলাম নতুন মা আমার দিকেই চিৎকার করে এগিয়ে আসছে। তিনি এগিয়ে এসেই আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই চুলের মু’ঠি ধরে টেনে আমাকে উঠোনে ছুঁ’ড়ে মারলো। আকস্মিক ব্যথায় আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মনে হচ্ছে মাথার ওখানে থেকে এক মুঠি চুল কেউ নিয়ে ফেলেছে। জ্বলছে খুব।
বাবার দিকে তাকাতেই দেখলাম বাবা নিশ্চুপ। ভেবেছিলাম, বাবা আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে কিন্তু না… শারীরিক ব্যথার চেয়ে মনের ব্যথা বেড়ে গেল।
নতুন মা আবারও এগিয়ে এসে থা’প্প’ড় দিয়ে বলে উঠল,
‘তুই সব জানতি। ইচ্ছে করে বলিসনি তাই না?আমার খেয়ে আমারই এত্তো বড়ো ক্ষতি করেছিস! শাক’চু’ন্নি।’
বলেই কিছু বুঝে উঠার আগেই তিনি আরও একটা থা’প্প’ড় দিয়ে তার রণ’চ’ন্ডি রূপ বের করে বলে উঠল,’তোরে তো আজ আমি মে’রে’ই ফেলবো। নিজের ক্ষতি নিজে ডেকে এনেছিস তুই।’

পরপর আরও কয়েকটা থা’প্প’ড় দিতেই আমি তাল সামলাতে না পেরে উঠোনে পরে গেলাম। চারদিকে সবাই তামাশা দেখছে। সবাই আজকে বুঝে ফেলেছে যে মায়ের এতদিনের দেখা রূপটা শুধুমাত্র বাইরের জন্যই। আমি নিশ্চুপে কান্না করতে লাগলাম। লজ্জায় মাথা তোলা যাচ্ছে না । ব্যথার চেয়ে বেশি অপমান লাগছে। আমি ঐভাবে ঠাঁই বসে রইলাম। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে।

মায়ের হয়ত এটাও সহ্য হলো না তাই তিনি আবারও থা’প্প’ড় তুলতে নিলে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আজ আর এই ব্যথাগুলোতে কষ্ট পাচ্ছি না।
কিন্তু থা’প্প’ড়টা আমার গায়ে পড়লো না। ভয়ে ভয়ে চোখ খুলতেই দেখি আমার পাশে কারো দুইটা পা এসে থেমেছে। উনিই হয়ত মায়ের হাত ধরে ফেলেছে। চোখ উপরে তাকাতেই অজান্তেই বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলাম,
‘নিহান ভাই!’

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে