বে রঙিন পাতা পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0
730

#বে_রঙিন_পাতা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১২(প্রথম খন্ডের সমাপ্তি )

পরেরদিনই এলাকায় রটলো যে তারা দুইবোন পালিয়েছে।
নিহানের আজ ভিনদেশে যাওয়ার দিন। সে স্কলারশিপ পেয়েছে। কিন্তু যাওয়ার আগে ফুলকে একটি বার দেখার ইচ্ছে ছিল। তাই ফুলের বাড়ির দিকে রওনা দিল। ফুলের বাড়ি এলাকার একদম শেষপ্রান্তে হওয়ায় নিহান হেঁটেই গেল।

ফুলের বাড়ির সামনে যেতেই দেখলো তাদের বাড়ি থেকে পাড়া প্রতিবেশী বেরোচ্ছে। উঠোনে ফুলের বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে কয়েকজনের সাথে খেলছে। নিহান হাত দিয়ে ছেলেটাকে ডাকলো কিন্তু ছেলেটা আসলো না। নিহান ভেবে পেলো না, হুট্ করে এদের বাড়িতে এতো মানুষ কেন! নিহান গেটের পাশে দাঁড়িয়ে রইল।
উড়ো উড়ো ভাবে কানে আসলো ফুলরা পালিয়েছে। এসব কথা শুনে নিহান থমকে গেল। আসলেই কী তা সত্যি! ফুল কী আসলেই পালিয়ে গিয়েছে!

গেট দিয়ে কয়েকজন মহিলাকে বের হতে দেখে সে আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। এদের থেকে হলেও যদি কোনো খবর পাওয়া যায়!

গেট দিয়ে এক প্রতিবেশী বের হতেই উনারা বলাবলি করতে লাগলো,’আহারে, মেয়েগুলোর মুখ চেয়ে বাবা আরেকটা বিয়ে করে আনলো আর এরাই পালিয়ে গেল!’

আরেকজন প্রতিবাদের সুরে বলে উঠল,’ স্বাদে কী আর পালিয়ে গিয়েছে! ঐদিন দেখলে না কিভাবে মা’র’লো! নিজের মা কোনোদিন সন্তানকে এতো মা’রতে পারে না আর ইনি দুইদিনে না আসতেই সে কী মা’র! আর বাবাও বা কেমন! নিজের মেয়েকে তার দুইদিনের স্ত্রী এতো মা’র’ছে সে চুপচাপ তাকিয়ে ছিল অথচ ওদের মা বেঁচে থাকতে মেয়েগুলোর উপর কেউ ফুলের টোকা পর্যন্ত লাগতে দিতো না। বাবাও তেমন ছিল কিন্তু মা মারা যেতেই উনিও বদলে গেল। এখন মেয়েগুলোর বাবা আর এই মহিলাটার বেহুঁশ হয়ে মেয়েগুলোর জন্য কান্না করা এই সবকিছু এমনি উপরে নাটক করছে মনে হচ্ছে আমার।’

‘আসলেই, ঐদিন না দেখলে বুঝতেই পারতাম না যে ওই মহিলাটা এমন ব্যবহার করে মা ম’রা মেয়েগুলোর সাথে। আমি তো আরও খুশি হয়েছিলাম যে বেচারি মা ম”রা মেয়েগুলো হয়ত এখন একটা মা পাবে কিন্তু কে জানতো উনার এমন রূপ! কী মা’রা’টাই না মা’রলো!’

মহিলাটির কথায় অন্যরাও সাঁই জানালো।
নিহান তাচ্ছিল্য হাসলো। এই মানুষগুলোই খারাপ হলে সামনে থেকে চুপচাপ তাকিয়ে দেখবে আর পেছনে এসে উপরে থাকার জন্য প্রতিবাদের নাটক করবে। সমাজে এমন প্রতিবেশী কমবেশি সব জায়গায় থাকবেই। এদের কাজ হলো মানুষের বাড়িতে কী হলো না হলো সব বলাবলি করা। নিহান বুঝে পায় না এরা আসলে কোন দলের মানুষ!

‘কিন্তু বেচারি মেয়েগুলো কই গেল! ওদের তো যাওয়ার জায়গা নেই।’

‘সেটাই, আর হুট্ করে কেন চলে যাবে!’

ওদের কথার মাঝে গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে আরেকজন মহিলা এসে বলতে লাগলো,
‘এই এই শুনছো! রাসেল আর রাসেলের মা না-কি কোথায় চলে গিয়েছে!’

সবাই এঁকে অপরের দিকে তাকালো। তারা হয়ত কিছু একটা আন্ডাজ করে বলে উঠল,
‘কিছু একটা গোলমাল লাগছে না?’

‘হ্যাঁ, এক রাতের মধ্যে রাসেলরা আর এই মেয়েগুলো গায়েব!’

নিহানের আর কিছু শোনার ইচ্ছে হলো না। তার মনটা হুট্ করে ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ফুল পালিয়েছে! কিন্তু কিভাবে! আসলেই কী ইনারা যা বলছে সব সত্যি! ইনাদের কথার কতটুকু সত্যতা আছে তা নিহান ঘাটার চেষ্টা করলো না। ফুল এতটাও খারাপ না যে সে পালিয়ে যাবে। কিছু তো একটা গোলমাল আছেই কিন্তু নিহানের এতকিছুর মাঝে দেশের বাইরে যাওয়ার আগেই স্বপ্নটা ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। ফুলকে আর দেখা হলো না। খোঁজার সময়ও আর নেই সে যে আজ ভিন্ন একটা দেশে পাড়ি দিবে। এতদিনের স্বপ্ন তার পরিবারের স্বপ্ন সে তো তীরে এসেই শেষ করে দিতে পারবে না। চাইলেও পারবে না।

নিহান কিছুদূর এগিয়ে আসতেই দেখলো ফুলের ওই সৎ ভাইটি খেলা করছে। নিহান ইশারায় ডাকলো ছেলেটিকে কিন্তু ছেলেটি আসলো না। নিহান দোকান থেকে গিয়ে চকলেট নিয়ে এসে আবার ডাকতেই ছেলেটি দৌড়ে এগিয়ে এলো। এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর এই অভ্যাস, এমনি ডাকলে আসবে না কিন্তু কোনো কিছুর লো’ভ লাগালে ঠিকই চলে আসবে।
নিহান ছেলেটির উদ্দেশ্যে বলল,
‘তোমার ওই আপুরা কই?’

‘পা’লি’য়ে গিয়েছে।’ ছেলেটির কথা নিহানের বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। তার কেন জানি মনে হলো ছেলেটিকে এটা শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিহান তার আরেক হাতে থাকা বাকি চকলেটগুলো নড়াচড়া করে বলে উঠল,
‘সত্যিটা বললে এই চকলেট সবগুলো তোমার কিন্তু এখন দিবো না। আগে সত্যি কথা বলতে হবে।’

ছেলেটি নিহানের হাতে থাকা চকলেটগুলোর দিকে বারবার দৃষ্টি দিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে তার মন পুরোপুরি এখন চকলেটগুলোর দিকে।

‘লতা আপুকে ফুল আপু পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আর ফুল আপুকে ওর মামা এসে একেবারের জন্য নিয়ে গেছে। মা বলেছে,এখন বাড়িটা শুধুমাত্র আমার।’

নিহান বাকি চকলেটগুলো ছেলেটির হাতে দিতেই ছেলেটি দৌড়ে চলে গেল। তার যা জানার জেনে নিয়েছে কিন্তু ফুলের মামা-ই বা কোথ থেকে এলো!

যাওয়ার আগে আর দেখা হলো না ফুলের সাথে।
নিহান ভারাক্রান্ত মনে ফিরে এলো বাসায়। রাতেই বেরিয়ে যাবে। সব প্রস্তুতি আগেই নিয়ে রেখেছিল বিধায় তেমন আর গোছাতে হচ্ছে না। ভেবেছিল, আজকে ফুলের সাথে একটু হাটাহাটি করবে। মেয়েটা দীর্ঘ অনেকমাস ধরে পেছনে পড়েছিল, বুঝালেও বুঝতো না। সারাদিন অনুসরণ করতো, এসবে নিহান নিজেও অনেক বিরক্তি-বোধ হতো। এজন্যই শহরে চলে গিয়েছিল কিন্তু শহরে গিয়ে তারও একই রোগ ধরা দিল। ভেবেছিল, সবসময় ফুল অনুসরণ করে বিরক্ত করতো বলে খালি খালি লাগছে আর কিছুদিন পেরোতেই এসব ভুলে যাবে। কিন্তু দিন যতই গড়িয়ে যাচ্ছিলো তখনই বুঝতে পারলো তারও প্রথমবারের মতো কারো প্রতি তীব্র নেশা জেগেছে। যে নেশাটা কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয়।

নিহান জানালার বাইরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার মনে হচ্ছে মনের ভেতরে অনেক রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিন্তু উপরে কিছুই দেখাতে পারছে না। একদিকে আজ বাবা মাকে ছেড়ে এই আপন ঠিকানা ছেড়ে পুরোপুরি অচেনা একটা দেশে পাড়ি দিবে আরেকদিকে ফুলের জন্য মন খারাপ হচ্ছে। ফুলের কথা ভাবতে গেলেই বুকটা হুহু করে উঠছে! মেয়েটা ভালো আছে তো!
জানালার বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিহান খাটে এসে বসলো। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, ঠিক এমনই তার মনেও আস্তে আস্তে আঁধার নেমে আসছে। মা বাবাকে ছাড়া এতো দূরে সে কিভাবে টিকে থাকবে! কিন্তু নিজের দুর্বলতা দেখানো যাবে না কিছুতেই, এতে মা আরও ভেঙে পড়বে। ফুলের জন্য বারেবারে বুকটা খালি খালি লাগছে। এদিকে মা বাবা, পরিবার-পরিজন ছেড়ে কিভাবে থাকবে সেই চিন্তা আর অপরদিকে মেয়েটা কেমন আছে সেই চিন্তা। সবমিলিয়ে নিহানের আজ নিজেকেই চেনা বড্ড কষ্টদায়ক মনে হচ্ছে। নিহান একটা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত করে নিল।

আর কিছুসময় পেরোতেই রওনা দিতে হবে সম্পূর্ণ অচেনা একটা পরিবেশে।
নিহান জানালার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আপনমনেই বিড়বিড় করে বলে উঠল,’যেখানেই থাকো, ভালো থেকো রজনী।’

দুইজন দুইদিকের পথে পাড়ি দিল। তাদের আর দেখাটাও হলো না। আধো কী এদের আর দেখা হবে না-কি তাদের পথ শুরু হওয়ার আগেই একাভাবে শেষ বিদায়টা এভাবেই অদেখা ভাবে এখানেই সমাপ্তি! না-কি অন্য সবার মতো এদের ভালোবাসাও এখানেই শেষ হয়ে যাবে!

#সমাপ্তি
(আসসালামু আলাইকুম। বলতে গেলে প্রায় দুইমাস পরে গল্পটি নিয়ে লেখালেখিতে ফিরেছিলাম, ভেবেছিলাম এটা দিয়ে আবার লেখালেখি শুরু করবো কিন্তু পারিনি। একের পর একেকটা কারণে অনিয়মিত হয়ে পড়েছি। তার উপর এখন পড়েছি রাইটিং ব্লকে। আমার লেখার হাত এমনি কাঁচা, একদম ভালো না তার উপর রাইটিং ব্লকের কারণে আরও বাজে অবস্থা। কোনোমতেই সাজিয়ে লিখে উঠতে পারছি না। একনাগাড়ে গ্যাপও দিতে পারছি না তাই প্রথম খন্ড এনেছি। নাহলে গ্যাপ দিতে পারতাম না কিন্তু এছাড়া আমার উপায় নেই। এটা যেহেতু বাস্তবতাকে নিয়ে গল্পঃ তাই আমি ভেবেছিলাম গল্পটা ১৫-২০ পর্বে শেষ করে দিবো কিন্তু সেই পর্যন্ত যাওয়ার আগেই রাইটিং ব্লক আর মানসিকভাবে অবস্থা খারাপ। তাই ভাবলাম কয়েকদিন সময় নিই। রাইটিং ব্লকটা কাটুক আর মনও ভালো হোক তারপর আবারও লেখা শুরু করবো। আমি সত্যিই এমনভাবে লিখতাম না, গল্পটা এতো বড়ো না যে খন্ড খন্ড আনবো কিন্তু এছাড়া উপায় নেই। যদি এক সপ্তাহ সময় পেতাম তাহলে খন্ড আনতাম না কিন্তু এরকম কোনো সময় পাবো না তাই এভাবে শেষ করতে হয়েছে। বাকিটুকু দ্বিতীয় খন্ডে কয়েক পর্বে লিখে ফেলবো। আগে মাঝখানে সময় নিতে হবে কয়েকদিন। যে অল্পসংখ্যক গল্পটি পড়েছেন আপনাদেরও অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি অনেক অনেক দুঃখিত। আমাকে ক্ষমা করবেন প্লিজ। সর্বোপরি যারা এতদিন পাশে ছিলেন উনারা ভালোবাসা নিবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে