বে রঙিন পাতা পর্ব-০৯

0
471

#বে_রঙিন_পাতা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৯

একদিন কেটে গেল। সন্ধ্যায় আমি ঘর ঝাড়ু দিয়ে ভেতরে ঢুকব সেই সময়েই দেখি ঐদিনের ওই মানুষটা যার সাথে ছোট মা আপার বিয়ে ঠিক করার কথা শুনেছিলাম। মানুষটার মুখে হাসি হাসি ভাব। তার দুইহাতেই বড়ো সরো বাজারের ব্যাগ। আমি কিছুসময় উঠোনের দিকেই তাকিয়ে রইলাম। লোকটি বাজারের ব্যাগ নিয়ে উঠোন পেরিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসতেই আমি দ্রুত ঝাড়ু ফেলে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলাম। মাকে বলতে হবে, ইনি আমাদের ঘরে কেন আসলো!

ছোট মা বিভিন্ন পদের রান্না করছে। মাকে আজ বেশ হাসিখুশি লাগছে। আজ এতো এতো পদের খাবার কেন রান্না করেছে সেটার উদ্দেশ্য পেয়ে গেলাম। তার মানে ছোট মা এই লোকটার জন্যই এগুলো রান্না করেছে! আপা ছোট মাকে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। আপাকে ইদানিং দেখতে বেশ হাসিখুশি লাগে আর আপা ছোট মাকে মা বলে ডাকে। সবমিলিয়ে পরিবারটা এখন সুন্দরই। যদিওবা আমাদের মায়ের অভাব কোনোদিনও পূর্ণ হবে না, মায়ের আসনটা খালিই থেকে যাবে কিন্তু ইনিও ভালোভাবে দেখাশোনা করছে আমাদের।

আমি ছোট মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠলাম,
‘ ছোট মা, ঐদিনের ওই লোকটা এসেছে!’

আপা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,’কোনদিনের কোন লোক!’

আমি কিছু বলার আগেই ছোট মা দেখি উঠে দাঁড়ালো। বললো,
‘আগে বাসায় ঢুকতে দেয়। লতা নাস্তাগুলো তৈরী করে নেয়।’

আমি ছোট মায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। ছোট মা খুব স্বাভাবিক। যেন এই মানুষটা আসবে সেটা তিনি আগে থেকেই জানতো।

আপা এখনো কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বোকা বোকা চাহনিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আমি আপাকে সেই মানুষটার কথা বলতেই আপা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ততক্ষনে ছোট মা লোকটিকে গিয়ে সাদরে গ্রহণ করে বাড়িতে ঢুকিয়েছে। ছোট মা ভেতর থেকে আপার উদ্দেশ্যে ডাক দিল কিন্তু আপা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। ছোট মা দ্রুত পায়ে ওই লোকটির হাত থেকে বাজারের ব্যাগ গুলো নিয়ে রান্নাঘরে আসলো। ব্যাগের ভেতর একটু আধটু উঁকি দিয়ে উনার চোখ চকচক করে উঠল। এসবের কিছুই আর বুঝার বাকি রইল না। ছোট মা আপার দিকে এগিয়ে এসে নাস্তার প্লেট নিয়ে আপার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
‘নিয়ে আয়।’

আপা সংকোচ নিয়ে বলে উঠল,
‘আমি যাবো?’

‘হ, তুই না তো কে! ও তোরেই দেখতে এসেছে।’

আপা থমকে যাওয়া দৃষ্টিতে ছোট মায়ের দিকে তাকালো। আপার সাথে সাথে আমিও ভীষণ অবাক হলাম। আপাকে দেখতে এসেছে মানে কী! আপার তো রাসেল ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গিয়েছে।

আপা হাত থেকে নাস্তার প্লেট রেখে বলে উঠল,
‘এখন আমি অন্যের বউ। যার তার সামনে নাস্তা নিয়ে কেন যাবো!’

আপার কথায় ছোট মা হাসলো।
‘কিন্তু আমরা তো সেই বিয়ে মানি না।’

ছোট মায়ের সেই চিরচেনা গা জ্বা’লা’নো হাসি। তা দেখে আমাদের আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না যে এরা কেউই ভালো হয়নি। আপা রেগে দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকে যেতেই ছোট মা আপার পেছনে পেছনে গিয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকে দিল। আপা দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলে উঠল,
‘ ভালো হবে না। আমি বাবাকে বলে দিবো। দরজা খুলুন আপনি।’

ছোট মা উচ্চস্বরে হাসলো। যেই হাসিতে কোনো মায়া নেই।
‘কী করতে পারবা! আর তোমার বাবা আর আমি মিলেই এসব করেছি। তোমার বাবা আমার কথা শুনেই তোমার সাথে এই একটা দিন ভালো ব্যবহার করেছে। তোমার এখন না চাইতেও আমাদের কথা মেনে নিতে হবে।’

আপা জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। সে রেগে বলে উঠল,
‘আপনাদের এই ভালোর মুখোশ পড়া আমি আগে বুঝতে কেন যে পারলাম না! আমাকে আটকে রাখতে পারবেন না। রাসেল ঠিকই এসে নিয়ে যাবে।’

‘ওহ আচ্ছা তাই না-কি! ডাকো ওকে।’

ছোট মায়ের কথায় আপার দরজা ধাক্কানো থেমে গেল। হয়ত আপা মোবাইল নিতে গিয়েছে।

কিছু সময় পেরোতেই আপা চিৎকার করে উঠল,
‘ আমার মোবাইল কই!’

আপার কথা শুনে উনি এদিকে সেই চিরচেনা গা জ্বা’লা’নো হাসিটা আবারও দিল।
‘তোমার কী মনে হয়! তোমাকে আমি এতো তাড়াতাড়ি হাত ছাড়া করে দিবো! আর কোনো পথ খোলা রাখবো! তোমার সাথে এই লোকটার সাথেই কাল বিয়ে দিবো। দেখি কে কিভাবে বাঁচায়।’ বলেই তিনি রুম থেকে তালা এনে আপার দরজার বাইরে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে আমার দিকে র’ক্ত’চক্ষু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘যদি ভুলেও তোমাকে এই দরজার আশেপাশে দেখি তো আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। ‘

বলেই তিনি চলে গেলেন। এইবার সবকিছু খোলাশা আমার কাছে। তার মানে ইনারা ভালো হয়নি! শুধুই নাটক! খুব কী ক্ষতি হয়ে যেত যদি এই একদিন উনারা যা নাটক করেছে তা সত্যি হতো!

—–
রাত গড়াতেই তড়িঘড়ি করে বাবা ঘরে আসলো। আমাকে মা চোখে চোখে রেখেছে, ভুলেও আপার রুমের দিকে যেতে দিচ্ছে না আর বাড়ির বাইরেও পা রাখতে দিচ্ছে না। উনার ধারণা আমি যেকোনো ভাবে আপাকে রক্ষা করবো, বাড়ির বাইরে গিয়ে রাসেল ভাইয়ের বাসায় চলে যাবো এটাই ভেবে তিনি আমাকে বাড়ির বাইরে যেতে দিচ্ছিলো না।

আমি বারান্দায় বসে ছিলাম। আমার বিপরীত পাশে ওই লোকটা বসে আছে। মা আমাকে জোর করে ওই লোকটার পাশে বসিয়ে দিল। লোকটার দৃষ্টি দেখেই আমার ঘৃ’না’য় গা গুলিয়ে উঠল। লোকটির দৃষ্টিতে কোনো মায়া নেই। আমার আরেকপাশে সাকিব বসে আছে। মানে বাবার ছেলে। ছেলেটা আমাকে রেখে কোথাও যাচ্ছেও না। কোনোদিকেই কোনো ফাঁক-ফোকর পাচ্ছি না যে আমি বের হবো। আপার মোবাইলটা অনেক খুঁজেছি কিন্তু পেলাম না, হয়ত দ্বিতীয় মা আলমারিতে তালা বদ্ধ করে রেখেছে মোবাইলটা।

রাতে আর আপাকে কিছু খেতে দেওয়া হলো না। আমার ভারী খারাপ লাগলো কিন্তু কোনো উপায় ছিল না। আপার সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না, হয়ত বেচারি কাঁদতে কাঁদতে শান্ত হয়ে পড়েছে। বিকেল থেকেই ওই রুম থেকে ক্ষ’নে ক্ষ’নে কান্নার আওয়াজ এসেছিলো আপার কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। আমাকে ওই রুমের আশেপাশেও যেতে দিচ্ছিলো না।

এরপরেরদিনও একই ভাবে দিন কাটলো। ছোট মা আর বাবা অনেক তাড়াহুড়োই আছে। বুঝতে পারলাম আজকে রাতেই বোধহয় ওই লোকটার সাথে আপার বিয়ে দেওয়া হবে। পাড়া প্রতিবেশী কেউ জানতেও পারলো না। কারণ রাসেল ভাইয়ের বাড়ি বেশি একটা দূরে নয়। একজন জানতে পারলে আস্তে আস্তে রাসেল ভাইয়ের কানে চলে যাবে। ওই লোকটা রাতটা এখানেই কাটিয়ে ফেলল। দিনে বের হলো না।
সন্ধ্যা হতেই ওই লোকটার পরিবার থেকে বোধহয় কয়েকজন মানুষ এসেছে। এদিক ওদিক থেকে শুনলাম বাবা কাজী ডেকে আনতে গিয়েছে। দ্বিতীয় মা অনেক হুলুস্তুল আছে।
আপার রুমের দরজা একবারের জন্যও খোলা হলো না। কিন্তু আমি হাল ছাড়বো না। আমি এই ফাঁকে মায়ের শাড়ির আঁচলে আপার রুমের চাবিটা দেখে ফেলেছি। বারবার নজরে রাখছি সেটা। হাল ছাড়া চলবে না। আমি কিছুতেই ওই অ’স’ভ্য লোকটার সাথে আপার বিয়ে হতে দিবো না। দরকার হলে আপাকে রাসেল ভাইয়ের সাথে সারাজীবনের জন্য এখান থেকে চলে যেতে বলবো। সেটা ভাবতেই একটু খারাপ লাগলো যে আপাকে হারিয়ে ফেলবো কিন্তু আপার সুখের জন্য আমার এটা করা লাগবেই। আমার বিশ্বাস রাসেল ভাইও এটা জানলে আপাকে নিয়ে চলে যাবে। যেভাবেই হোক ওদের এক হতেই হবে। আমার আপা অনেক সুখে থাকবে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে