বেলা শেষে পর্ব-২১

0
1060

#বেলা_শেষে। [২১]

প্রকৃতিকে জ্যোতির অলংকার পরিয়ে নিঃশব্দ পায়ে সন্ধানামে পৃথীবিতে। প্রবীন দিনকে পিছনে ফেলে অচেনা অনবদ্য রুপে সন্ধারানী এসে হাজির হয়, তবে সন্ধা বড়ই চঞ্চলা। এসেই বিদায় নেয়ার জন্যে প্রস্তুুত হয়ে পড়ে।বড়ই রহস্যময়। কুলায় ফেরা পাখির মতো সন্ধা মানুষকে ফিরিয়ে আনে ঘরে। প্রকৃতির রং বদলাতে থাকে। বিষাদিত গভীর মমতায় গাঢ় ছায়া সন্ধাসাবিদা পশ্চিম গগনে ডুবে যায়। হালকা আধার চারিদিকে ছড়িয়ে পরে দূরের দৃশ্যবলি ক্রমশ অস্পষ্ট হতে হতে এক সময় আধারের সাথে মিলে একাকার হয়ে যায়। বড়ই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।এমনি একটা দৃশ্য দেখেও মন ভালো হচ্ছে না নয়নার। এক ঝাকা গাঁদাফুল গাছের সামনে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে সে। ভূমিকা নিতু আর নয়নার ছোট বোন নীলা তাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। নয়না কারো কোন কথাই কানে তুলছে না। আর না ওর কান্নার কারনটা বলছে। আজ নয়নার গায়ে হলুদ । কাল ওর বিয়ে। নয়নার বিয়ের কারনেই নিতু ভূমিকাকে নিয়ে ওর গ্রামে আসে। নিতু অনেক আগেই ভূমিকার সম্পর্কে তার বাবা মা-কে বলেছে যার কারনে তারা তাকে খুব বেশী আপন করে নিয়েছে। কিছুক্ষণ পর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। আত্মীয়স্বজন বাড়ি ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। নয়নাকে রেডি করতে হবে অথচ সে এখান থেকে উঠছেই না। বিয়ের সময় মানুষ কাঁদে এটা স্বাভাকিক তবে, সেটা তো বিদায়বেলায় তাহলে নয়না এখনি এত কাঁদছে কেন?

কিছুক্ষণ পর নয়নার মা এসে নয়না কে ডাক দিলো। মায়ের কন্ঠশ্বর কানে আসতেই চোখের পানি মুছে অধরে হাসি ফুটিয়ে তুলে সে। এখন নয়নাকে দেখলে কেওই বলবে না এতক্ষণ এই মেয়েটার চোখে অঝরে বৃষ্টি ঝড়ছিল।বাধ্য মেয়ের মতো মায়ের কথা শুনেই নিজের রুমে চলে যায় নয়না। আর ওর পিছনে যায় ভূমিকা,নিতু আর নিলা। নয়নাকে রেডি করতে।

দিগন্ত আর মিমি দুজনে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে আজ। এক্কেবারে সামাজিক, ও ইসলামিক নিয়ম মেনে বিয়ে করেছে তারা। মিমিদের বাড়িতেই বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে। মাশহুদ ও তার গিন্নী কেও- ই আসেনি এই বিয়েতে। মিমির বাবা তার নিজ বাড়িতে ঘটা করে অনুষ্ঠান করে দুজনের বিয়ে সম্পন্ন করলেন। দিগন্ত আর মিমিকে নিয়ে মিমির বাড়ির সকলে অনেক খুশি। খুশি হবেই না কেন, এই দিগন্ত আজ বাদে কাল আণবিক সংস্থায় চাকরি করবে। হয়তো একদিন সে অনেক বড় সাইন্টিস হবে। এমন জামাই কে না চায়। বিয়ে শেষে দিগন্ত মিমিকে নিয়ে তার ফ্ল্যাটে ফিরে আসে। নিয়তির কি অদ্ভুত খেলা, একদিন এই ফ্ল্যাটেই সে ভূমিকাকে নিয়ে এসেছিল। তবে সেটা বউ করে নয়। কাগজে কলমে সই করে বউ নামক কাজের মেয়ে করে নিয়ে এসেছিলো সে। আর আজ সেই ফ্ল্যাটে বউ হয়ে এসেছে মিমি।

ফ্রেশ হয়ে একটা পাতলা সাদা শাড়ি পরে নেয় মিমি। হাতা কাটা ব্লাউজের সাথে সাদা শাড়িতে যে কাওকে অনেক মসৃণ লাগে। এই কোমলতা যে বড্ড বেশী ভয়ংকর। এই মসৃণতা বিবাহিতদের মনে এক নতুন ভালোবাসার আবাহন জানায় । তাদের আমন্ত্রণ জানায় এক অন্য দুনিয়ার। সেখানে ভালোলাগা আর ভালোবসায় একে অপরের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আর অবিবাহিতদের জন্যে এই ভয়ংকর মসৃণতা ডেকে আনে এক রাশ পাপের সম্রাজ্য।

ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে টাওয়ার দিয়ে চুল মুছছে মিমি। শাড়ির আঁচলটা তার হালকা করে পেটে গুজে দেওয়া। দিগন্ত এতক্ষণ বারান্দার ছিলো। রুমে আসতেই তার চোখ পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক স্নিগ্ধ রমনীর দিকে। যার কোমল হাতের স্পর্শে মাথার চুলগুলো বারবার কেপে উঠলো। কিছুক্ষণ সেই রমনীর দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্যে চোখ সামনের দিকে ফেরাবে তখন তার চোখ আটকিয়ে যায় মিমির আঁচল গুজে রাখা সেই নিষিদ্ধ স্থানে। মুহূর্তেই দিগন্তের চোখে এক প্রখর নেশা কাজ করে। ধীর পায়ে সে মিমির দিকে এগিয়ে যায়। মিমির কাছাকাছি এসেই সে মিমির উন্মুক্ত পেটে চেপে ধরে। সাথে সাথে মিমির হাত থেকে টাওয়াল নিচে পরে যায়। দিগন্ত আয়নায় থাকা মিমির প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে,

-কিছু দেখছে পাচ্ছো প্রিয়সি??

মিমির মুখে ঝেকে বসে একরাশ লজ্জা। সে লজ্জা নিবারণের জন্যে দিগন্তের বুকে মুখ গুজে দেয়। দু-হাতে দিগন্তের ট্রি-শার্ট খামছে ধরে বলে,

-প্রখর নেশা তোমার ওই দু-টি আঁখি জুড়ে।

-এই নেশা যে তোমাকে নেশাক্ত করতে চায় প্রিয়সী । দিগন্তের কথা শুনে মিমি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। হাত পা কাঁপছে তার। দিগন্ত মিমির উত্তরের অপেক্ষা করলো না। সে মিমিকে পাজা কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো।

লেপটপের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে রাকিব। কিছুক্ষণ আগে আরাভ তাকে কিছু কাজ দিয়েছে। ম্যানেজারের করা ভুলগুলি ঠিক করতে দিয়েছে তাকে। এতদিন আরাভ নিজেই করতো এসব কাজ। কিন্ত ভূমিকা আসার পর থেকে তো সেই করে যাচ্ছে এই কাজগুলা। আরাভের অভ্যাস চেঞ্জ হয়েগেছে। আরাভ তার চেয়ারে আরাম করে বসে তাকিয়ে আছে রাকিবের দিকে। রাকিবের চোখ তো লেপটপের দিকে কিন্ত ওর হাত আর মুখের রিয়্যাকশন বলছে রাকিব কোন কাজ করছে না। আরাভ কয়েকবার রাকিবকে ডাকলো কিন্ত রাকিব কোন রিসপন্স করলো না। আরাভ এবার সিউর হলো রাকিব কোন কাজ-ই করছে। কোন কিছু দুশ্চিন্তা করতে সে। ছোটবেলার বন্ধু রাকিব। একসাথে স্কুল কলেজ ভার্সিটিতে পড়েছে। ওরা একে অপরের মুখ দেখলেই সব বুঝতে পারে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। রাকিবের মন খারাপ দেখে আরাভ গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালো তারপর লেপটপ বন্ধকরে দিলো। তাতেও রাকিবের হুস ফিরলো না। আরাভ রাকিবের কাদে হাত রাখলো। তখনি চমকে উঠে রাকিব। আর বলে,

-কে – কে??

-রিল্যাক্স, ভয় কেন পাচ্ছিস।

-ওহ তুই??

-এভাবে মন খারাপ করে বসে আছিস কেন??এ্যনি প্রবলেম??

রাকিব তার অধরে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে বলল,
-নাহ, আই এম ফাইন।

-সেটা দেখতেই পাচ্ছি। বল কি হয়েছে। দেখ রাকিব এদম আমাকে মিথ্যে বলার চেষ্টা করবি ন। ডোন্ট টেল মি লাই। আরাভের কথা শুনে রাকিবের চোখ ছলছল করে উঠলো। রাকিব অস্ফুটভাবে বলে উঠলো,

-নয়না, আমার নয়নাকে ফিরিয়ে আনতে পারবি। বল পারবি।

রাকিবের কথা শুনে আরাভ মনে হয় আকাশ থেকে বলল। অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে রাকিবের মুখ পানে। রাকিব আবারও বলে উঠলো,

-আমি নয়নাকে ভালোবাসি, ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবি।

– মিছ নয়না জানে এসব।

-হুম। আমরা দুজন দুজনকেই ভালোবাসি।

-তাহলে মন খারাপ করছিস কেন? মিছ নয়না ফিরে আসবে। কয়েকদিনের জন্যেই তো গেছে।

-আজ নয়নার বিয়ে। ওর বাবা ওকে বিয়ের জন্যে ডেকেছে। রাকিবের কথা শুনে চোখ দুটি ছোটছোট হয়ে এল আরাভের।

-মিছ নয়নার বাড়ির ঠিকানা জানিস তুই??

-হ্যাঁ জানি। কেন??

-এখন চল। যেতে যেতে কথা বলা যাবে। বলেই অফিস থেকে বেড়িয়ে যায় আরাভ। আর আরাভের পিছন পিছন যায় রাকিব।

সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে নয়নার কান্নার তীব্রতা যেন বহু গুনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর পক্ষ চলে এসেছে সেই কখন। সবাই নয়নার বর দেখতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হইবে।

নয়না আর তার হবু বরকে পাশাপাশি বসিয়ে রাখা হয়েছে। কাজি সাহেব এখনি তাদের বিয়ের কালেমা পাঠ করবেন। নয়না শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার সামনে থাকা মানুষগুলির দিকে। কেন জানি নয়নার মনে হচ্ছে রাকিব আসবে। তাদের ভালোবাসাটা এভাবে শেষ হতে পারে না। রাকিবকে আসতেই হবে । ঠিক সেটাই হলো। কাজি সাহেব বিয়ে কালেমা পাঠ করার আগেই আরাভ আর রাকিব চলে আসলো। রাকিবকে দেখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো নয়নার অধরে। সে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে সকলের সামনে রাকিবকে জড়িয়ে ধরলো। রাকিবও তার প্রিয়সীকে শক্তকরে জড়িয়ে নিলো তার বুকে।

ওদের দু-জনকে এমন ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে উপস্থিত সকলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আসলে এখানে কি হচ্ছে সেটাই বুঝার চেষ্টা করছে সবাই। সকলে ধ্যান ভাঙিয়ে আরাভ বলে উঠলো,

-এই বিয়েটা বন্ধ করুন।
উপস্থিত সকলে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে আরাভের দিকে।আরাভ আবার বলে উঠে, এই বিয়ে হবে না। বন্ধকরুন। ভূমিকা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়ি সবটা দেখছিলো। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না কেন নয়না এত কাঁদছিল?? নয়না রাকিব ভাইয়াকে ভালোবাসে এটা সে আগে কেন বলেনি । ভরা বিয়ের অনুষ্টানে তার বাবা মা-কে এখন অপমানিত হতে হবে। নয়না আপি যথেষ্ট শিক্ষিত মেয়ে। বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন, তাহলে এই ভুলটা সে কি করে করতে পারলো।

বিয়ের আসরে পর পুরুষকে জড়িয়ে ধরা মেয়েকে সহজে কেও বাড়ির বউ করবে না। নয়নার হবু বরের বাড়ির লেকেরাও সেটাই করলো। তারা বিয়ে ভেঙে চলে গেলো । এই রকম নির্লজ্জ বেহায়া মেয়েকে তারা তাদের বাড়ির বউ কিছুতেই করবে না।

চলবে,,,,,,

#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে